আমার ভাঙা পথের রাঙা ধূলায় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

 



লেখক চলচ্চিত্রবেত্তা, শিক্ষক, গদ্যকার, সাংস্কৃতিক ভাষ্যকার।

 

 

 

করোনার দিনগুলিতে যা আমাদের বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে তা হচ্ছে আমাদের অর্থাৎ এই মধ্যবিত্ত সমাজের অনুভূতির অসারতা। কথাটা এইজন্য বলছি যে, এইসময় আমাদের যাবতীয় কথাবার্তা, আসমুদ্রহিমাচলে ভেসে আসা বুলেটিন দেখে-শুনে আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না যে আমি ভারতবর্ষের মতো কোনও দেশে থাকি। যেসব কথা বলা হচ্ছে তা হয়তো সবই খুব প্রয়োজনীয়, কিন্তু আদ্যন্ত কর্পোরেট ভাষায় যখন ‘আইসোলেশন’ ‘সোশাল ডিসট্যান্সিং’ ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে, ঠিক সেইসময় আমার মনে প্রশ্ন জাগছে, আমাদের দেশের কত শতাংশ মানুষের নিজের ঘর আছে! এই মানুষেরা তো জানেনই না কোথায় খাদ্য তেল পরিচ্ছন্ন সিন্ধুতীর পাওয়া যাবে! আমার গরিব দেশের হাড়হাভাতে মানুষজন সব, এরা জানেন না অসুস্থ হলে এনআরএস, মেডিকেল বা ক্যাম্পবেলে কটা বেড তাদের জন্য বরাদ্দ আছে! অথচ তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বা না করেই যেসব ভাষায় কথা বলা হচ্ছে, তা দেখে আমার মনে হয়, কর্পোরেট প্রশ্রয়ে জেগে ওঠা মধ্যবিত্ত ভাবতে শুরু করেছে ভারতবর্ষ শুধুমাত্র তাদের নিজেদের দেশ। এ দেশের ভাষা, ট্রাস্টেড অ্যাকসেন্টেড ইংরেজি, এ দেশের সমস্ত উদ্যোগ যেন নেওয়া হয়েছে কিছুসংখ্যক আত্মগর্বে স্ফীত মধ্যবিত্তের জন্য। আমরা সোশাল মিডিয়ায় নিরন্তর দেখতে পাচ্ছি নানা জোকস, নিত্যনতুন রন্ধনের রেসিপি অথবা সুরক্ষার আবহের মধ্যে থেকে একধরনের কল্পিত আতঙ্কের বিলাসিতা৷ এই বিলাসীরা কখনওই বিবেচনা করছে না যারা অন্নহীন, গৃহহীন, ভাষাহীন, তারা, যাদের নাম লিখতে চন্দ্রবিন্দু লাগে না, তারা কী করে বাঁচবে!

আমার মনে পড়ছে, বছর দশেক আগে মুম্বইতে একজন রূপোপজীবিনী একটি বিদেশি কাগজকে বলেছিলেন, “I am not afraid of dying from AIDS tomorrow, I am scared of dying from hunger today.” তিনি নিশ্চয়ই এই ভাষায় কথাটা বলেননি, মারাঠিতেই বলেছিলেন, নিউইয়র্ক টাইমস সেটা অনুবাদ করে ছেপেছিল। ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের দেশের অবস্থা অনেকটা সেরকমই। করোনায় ভারতবর্ষে কতজন মারা যাবে সেটা আমাদের একমাত্র সমস্যা নয়। নিশ্চয়ই এটা একটা বিশাল সঙ্কট ও সামাজিকভাবে এর প্রতিরোধ করা দরকার, কিন্তু তার চেয়েও বড় ঘটনা যে মানুষ তার আত্মজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। এই একশো তিরিশ কোটি লোকের মধ্যে একশো দশ কোটি মানুষই খাদ্য পাবে কিনা, ওষুধ পাবে কিনা জানা নেই, এসব তারা সাধারণ সময়েও নিয়মিত পায় না। তারা তাদের এই নিয়তিকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু দেখা যাবে, ভারতবর্ষের টিভি, মিডিয়া, খবরের কাগজ আর তাদের নিয়ে কথা বলছে না। তারা সত্যিই ‘ডিসপোসেবল ওয়েস্ট’। আমাদের ভাষার ব্যবহার পালটে গেছে। সেই ভাষার মধ্যে কোথাও জীবাণু হিসেবেও গরিব প্রবেশ করে না। এই যে অসারতা, এই যে হিম ঘুম নেমে আসা, এই যে চর্মকুষ্ঠ, এই অভিশাপ আমাদের ঘিরে ধরেছে। আজকাল ডাক্তাররা যে ভাষায় কথা বলেন, তা কজন লোক বুঝতে পারে। মানুষ আজ ঈশ্বরকে ভুলে গেছে, মার্ক্সকেও ভুলে গেছে৷ মানুষ মনে করেছে তার বহুতল অট্টালিকা, স্ফীত বিত্তরাশি, তার প্যান নাম্বার তাকে বাঁচাবে। সে শুধু রসদ জমা করছে। লকডাউনের দিনে ভুরিভোজনের সরঞ্জাম বেশি করে কিনে ঘর বোঝাই করছে। মদ্যপানের যথেষ্ট উপকরণ ঘরে আছে কিনা তা নিয়ে সে প্রবলভাবে চিন্তিত। সে ভাবছে এইভাবে ‘ওয়র্ক ফ্রম হোম’ করেই সে সঙ্কটটাকে পার করে দেবে। তার মনেও আসছে না, ভারতবর্ষের কটা লোকের কম্পিউটার আছে? কটা লোকের স্মার্ট ফোন আছে? স্কুল-কলেজগুলোতে হঠাৎ অনলাইন এডুকেশনের কথা বলা হচ্ছে। আমি অবাক হয়ে দেখছি, পশ্চিমবাংলার একজন মাত্র উপাচার্য বলেছেন, এটা সামাজিক বৈষম্য তৈরি করার নতুন প্রয়াস। আর কেউ এই কথাটা বলা তো দূরস্থান, ধারণাতেই আনছেন না। কী করে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত প্রদেশে অথবা তিস্তা পারে কম্পিউটারের জানালা খুলবে, সেটা যারা নিশ্চিন্ত রিভলভিং চেয়ারে বসা রোবট, তারা কীভাবে অনুমান করবেন? আমার তাদের প্রতি আর করুণাও হয় না। ভারতবর্ষের যেসব আমলা, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, বড় বড় ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ এখন নানা সমাধানের কথা বলছেন, তাদের কথা শুনে আমার অবাক লাগছে, এরা কি নিজেদের মাতৃভাষা জানেন নাকি বহুদিন আগে ভুলে গেছেন? আমরা আগে থেকেই কয়েকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করতাম। করোনার দিনগুলিতে আমরা যেন পরস্পরের থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। ভারতের জনসাধারণ এদের থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন, এক্সট্রিম লং শটেও তাদের আর দেখা যাচ্ছে না।

আমি অবশ্য খেটেখাওয়া ভারতীয় জনসাধারণের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত নই। বরং আমরা, সুখী মধ্যবিত্তরা নিরালম্ব বায়ুভূতের মতো একদিন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাব, এরা টিঁকে থাকবে। আমরা জানি, সিন্ধু নদ যখন তার গতিপথ পরিবর্তন করেছিল, সেদিনও এরা বেঁচে গিয়েছিল। অথবা রাজস্থানে যেসব মহিলারা প্রতিদিন পনেরো কিলোমিটার পথ হেঁটে জল ভরতে যান, এই ভয়ঙ্কর সময়ের সঙ্গে লড়াই করে তারা আজও বেঁচে থাকবেন। এই যে শ্রমিক-দম্পতিকে আমরা দেখছি, তারা ভাটিন্ডা থেকে হাঁটা শুরু করেছে ভুবনেশ্বরের দিকে, তারা জানে না অত কিলোমিটার তারা কীভাবে হাঁটবে! তাদের মাথার ওপর রুদ্রের কটাক্ষ, তাও তারা হাঁটছে। এরাই একদা পুণ্যশ্লোক বুদ্ধদেব এবং নগরনটী আম্রপালীকে দেখেছে। এরা সম্রাট অশোক ও বাদশা আলমগীরকেও দেখেছে৷ আমাদের দেশের দরিদ্র মানুষেরা তখন থেকে হাঁটছে। এরা ভারতবর্ষের ইতিহাসকে দশ হাজার বছরের আয়ু দিয়েছে৷ আরও দেবে। আর যারা নির্জীব শ্যামাপোকার মতো ফেসবুক পতঙ্গ, তারা ক্রমশই ঝরে পড়বে।

আমি হঠাৎ দেখতে পাচ্ছি রামকিঙ্করের সেই সাঁওতাল দম্পতিটিকে। তাদের দেখতে পাচ্ছি মেঠো রাস্তায়, রাজপথে। নাসিক থেকে পুনায়। জলপাইগুড়ি থেকে বালুরঘাটের পথে। তারা তাদের সন্তানকে কোলে-কাঁখে নিয়ে হাঁটছে৷ সূর্য তাদের ঝলসে দিচ্ছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসের বুকের ওপর দিয়ে তারা হাঁটছে। এই দম্পতি শেষ পর্যন্ত আমাদের এই সচ্ছল ভারতকে, আমাদের  আধা ইংরেজি আধা বাংলার ‘অ্যাফ্লুয়েঞ্জা’-বর্বর ভাষামঞ্জরীকে ধ্বংসস্তূপের দিকে ঠেলে দেবে। ভারতবর্ষ বেঁচে থাকবেই। ভারতবর্ষ বেঁচে থাকবে তার এই উন্মাদ মধ্যবিত্ত জনপ্রবাহ ছাড়াই। হয়তো করোনা আমাদের এই নির্লজ্জ মাঝারিয়ানার হাত থেকে উদ্ধার করবে। এটাই এই মুহূর্তে করোনার একমাত্র ইতিবাচক দিক, একমাত্র আশীর্বাদ৷

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

4 Comments

  1. অত্যন্ত সময়োপযোগী লেখা। রূঢ় সত্য! অস্বীকার করা যাবেনা।

  2. অবশ্যই খুব মর্মস্পর্শী কাব্য রচনাটি। কিন্তু এতেওবা এগোবে? লেখকের অস্মিতায় বেশ খানিকটা সুড়সুড়ি দেওয়া ছাড়া আর কিছু হবে বলে বিশ্বাস হয় না।
    হৃদয়ে অনুভূতি আছে, লেখনীতে শক্তি আছে– এটুকুই ব্যাস্।….?

Leave a Reply to Monoranjan Das Cancel reply