প্রশান্ত ভট্টাচার্য
লেখক কবি, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক।
নরেন্দ্র মোদির যতই বিরোধিতা করা যাক না কেন, মানতেই হবে, তাঁর তুল্য নেতা সমকালীন ভারতে একজনও নেই। মোদির সঙ্গে কেউ হয়তো খুচরো পাঙ্গা নিতে পারেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত মোদির নেতা ইমেজকে চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন না। নেতা হওয়ার একটা যোগ্যতা লাগে। ইংরেজিতে ‘লিডার’ শব্দের অর্থ নিরূপণ করতে গিয়ে অভিধান বলছে, ‘a person in control of a group a country or situation’, কিংবা ‘one having authority to direct’।
এই আক্ষরিক অর্থ অনুযায়ী, মানতেই হয়, নরেন্দ্র মোদি একজন যথার্থ লিডার বা নেতা। জওহরলাল নেহরুকে চরম গালি দিলেও, আদতে মোদির কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে, তিনি বিশ্বায়নের যুগে নেহরুর খ্যাতিতে ভাগ বসাতে চান। নেহরু-মার্কা জহর কোট গায়ে তুলেছেন, অথচ ভক্তদের কল্যাণে নাম হয়েছে ‘নমো কোট’। এই ছ বছরের রাজত্বকালে নেহরুর চেয়েও বেশি বিশ্বভ্রমণ করেছেন। মোদির মনে নেহরুর মতো বিশ্বনেতা হওয়ার প্রবল ইচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টরা যে তাঁর কত কাছের, তা বোঝাতে বারাক ওবামা যে তাঁকে তুইতোকারি করেন সে তথ্যও তিনি নিজেই প্রকাশ্যে জানিয়েছেন। সারা বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে বলেন, বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর বন্ধু।
কিন্তু,নিয়তির এমনই পরিহাস, সেই বন্ধুই তাঁর প্রেস্টিজের বেলুনটা ফুটো করে দিলেন! একেবারে সরাসরি ধমক দিয়ে!
নরেন্দ্র মোদি বেইজ্জত হলে আমার কোনও হেলদোল হয় কি না, তা ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু, বলতে বাধ্য হচ্ছি, মার্কিন প্রেসিডেন্টের হুমকিটা একজন ভারতবাসী হিসেবে ‘জাস্ট’ নিতে পারছি না। লিখিতভাবেই বলছি, ‘কে তুমি বট হে, যে ভারতের নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে হুমকি দাও।’ এটা তো ঘটনা, ভারতের আর কোনও প্রধানমন্ত্রীকে কোনওদিন এমন ধমকির মুখে পড়তে হয়নি। জানি, করোনা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন নাকানিচোবানি খাচ্ছে, তাই বলে ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে সমস্যায় পড়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ‘থ্রেট’ করবে। তোমার দরকার, তুমি প্রার্থীর মতো আবেদন করো, তা না, একেবারে সরাসরি চোখরাঙানি! এই যে কদিন আগে ভারত সফরে এসে মোদির সঙ্গে এত গা-ঘেঁষাঘেষি করে ফোটো-অপ করলে… সেসব ভুলে গেলে!
মানছি, জীবনের চেয়ে কোনও কিছুই ঢ্যাঙা নয়। আর এই জীবনরক্ষার ওপরই নির্ভর করছে তাঁর ‘আসছে বছর আবার হবে’… মানে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউজে ফেরা। তাই বন্ধুত্বকে এক লহমায় ছুড়ে ফেলে হুঁশিয়ারি দিতে শোনা গেল মার্কিন প্রেসিডেন্ট তথা নরেন্দ্র মোদির বিশেষ বন্ধু ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। কী বললেন ট্রাম্প? “If he (Modi) doesn’t allow it (Hydroxychloroquine) to come out, that would be okay, but of course there may be retaliation. Why wouldn’t there be?” অর্থাৎ মোদি যদি এই বিশেষ অ্যান্টি-ম্যালেরিয়াল ওষুধটি মার্কিন মুলুকে রফতানির অনুরোধ নাকচ করে, তাহলে তার ফল ভুগতে হবে ভারতকে।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করে ট্রাম্প নাকি অনুরোধ করেছিলেন, যাতে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের রফতানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। হোয়াইট হাউজে প্রেস ব্রিফিংয়ে ট্রাম্প ওই হুমকির আগে জানান, “আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুব ভাল। আমি বলেছি, আপনি যদি নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন, তাহলে খুবই ভাল হবে। যদি তিনি একান্তই এ-দেশে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে) ওই ওষুধ আসতে না-দেন, তাহলেও আমি অবাক হব। আমার কিছু বলার থাকবে না। তবে, তার ফল ভুগতে হতে পারে ভারতকে।”
প্রশ্ন হল, এটাকে কি বন্ধুত্বপূর্ণ কড়কানি বলা চলে না? কেননা, ‘রিট্যালিয়েশন’ শব্দটির ইংরেজি আভিধানিক অর্থ ‘action that a person takes against somebody who has harmed them in some way’; কিংবা ‘Violent or otherwise punitive response to an act of harm or perceived injustice’; ‘a hitting back’; ‘revenge’। এগুলোর কোনওটাই কোনও ইতিবাচক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না। এটাকে সোজা বাংলায় বলতে হয়, মহাশক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দেশকে হুমকি দিল। এমন হুমকি হজম করার অভ্যাস আমাদের নেই বলে অনেকেই এই প্রসঙ্গে ইন্দিরা গান্ধির প্রসঙ্গ টেনে আনলেন। আমাদের এক অধ্যাপক বন্ধু বললেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মলগ্নে ভারতকে ভয় দেখাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সপ্তম নৌবহর (সেভেন্থ ফ্লিট) পাঠিয়েছিল, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধি পাত্তাই দেননি’। ইন্দিরা বেপরোয়া ছিলেন মানছি, কিন্তু আমি ওই বন্ধুকে মনে করিয়ে দিলাম, সেই সময় ভারতের পিছনে ছিল ব্রেজনেভের সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর সেটা ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের কাল। এখন একমেরু বিশ্ব। দাপটের সঙ্গে মার্কিন হুমকির মুখোমুখি হওয়া সোজা কথা নয়।
হল-ও তাই। ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির ফোনালাপের আগের দিনই, ২৫ মার্চ ওই ওষুধের উপাদান রফতানির ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা চাপায় ভারত। উদ্দেশ্য, দেশে যাতে করোনা-আক্রান্তদের চিকিৎসায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন-এর জোগান কম না-পড়ে। তাই ট্রাম্পের সঙ্গে কথার সময়, তাঁর আর্জি মেনে মার্কিন মুলুকে ওই ওষুধ পাঠানোর বিষয়ে কোনও স্পষ্ট কথা বলতে পারেননি মোদি। শুধু একটু ধোঁয়াশা রেখে বলেন, “আমরা যা করতে পারি, তা করব।”
আমার বিবেচনায় মোদির এই উত্তর ছিল যথেষ্ট স্মার্ট। কিন্তু বন্ধুতা রাখতে পারলেন না ট্রাম্প। ওষুধ না-পেয়েই দুনিয়ার সংবাদমাধ্যমের সামনে ‘থ্রেট’ করলেন মোদিকে। অথচ পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন। আমরা লক্ষ করলাম, পরের দিনই সাউথ ব্লক ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল। নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে রাতারাতি সরে এসে আতলান্তিকের ওপারে আকাশপথে পাঠিয়ে দিল হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। এটা হেরে যাওয়া না কি বিপদের সময় বন্ধুর পাশে দাঁড়ানো, তা নিয়ে বিতর্ক চলবেই। কিন্তু যেভাবে ঘটনাটা ঘটল তাতে মনে হতেই পারে, এ হল হুমকির কাছে কুঁকড়ে যাওয়া। আমি মনে করি না, এই বিপদের দিনে মার্কিন দেশ ভারতকে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া বা নিকারাগুয়ার মতো ভেবে সামরিক শিক্ষা দিতে তৎপর হয়ে উঠত।
একেবারে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নিজেদের সিদ্ধান্ত বদল করার দরকার ছিল না। মোদি যেমন বহু ব্যাপারে লেজে খেলাতে ভালবাসেন, অনেক দেরিতে ‘রিঅ্যাক্ট’ করেন, এখানেও তেমন করতে পারতেন। সারা বিশ্ব দেখত, একটি অসভ্য রাষ্ট্রপ্রধানের অশ্লীল আস্ফালন। তা না-করে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন-সমীকরণটা হালকা করে দিয়ে তুরন্ত ২ কোটি ৯০ লক্ষ ওষুধ পাঠিয়ে দিলেন। আর সেই বার্তা পেয়েই হোয়াইট হাউসের অস্থায়ী অধিবাসী সংবাদমাধ্যমকে ডেকে জানিয়ে দিলেন, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। ভারত থেকে ওষুধ আসছে। মোদি মহান। উনি খুব ভাল মানুষ।” আর সেই প্রশংসায় গদগদ হয়ে মোদিও জানিয়ে দিলেন, এমন অম্লমধুর সম্পর্ক না হলে বন্ধুতা দৃঢ় হয় না।
আসলে রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে বন্ধুতা হল এই নরমে-গরমে চলার কৌশল, যেটাকে কেউ-কেউ একধাপ এগিয়ে বলেন ‘ড্রামাবাজি’। ঠান্ডা যুদ্ধের কালে যেহেতু পৃথিবী খাড়াখাড়ি দুটো শিবিরে বিভক্ত ছিল, তখন শিবির রক্ষা করতেই দুই প্রধান শক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর মান-সম্মান বজায় রাখত। সেইসব রাষ্ট্রপ্রধানদের সামাজিক সম্মান যাতে সবসময় অটুট থাকে, তার দিকে নজর ছিল মস্কো ও ওয়াশিংটনের। সেই বিশ্বব্যবস্থা বিলোপ হতেই দাদাগিরির একছত্র অধিকার চলে গিয়েছে পেন্টাগনের দখলে। বেজিং মার্জিনের বাইরে থেকে স্রেফ নজরদারি চালিয়ে যায়। আর পুটিন কার্যত ‘সর্বঘটের কাঁটালি কলা’– নৈবেদ্যে জায়গা পেলেই হল। এই অবস্থায় ট্রাম্পের হুমকি উড়িয়ে দেওয়ার মতো দম ৫৬ ইঞ্চির ছাতিতেও নেই। তার ওপর নিকটতম প্রতিবেশী পাকিস্তান। যে রাষ্ট্রটি সম্পর্কে ওয়াশিংটন কখনওই ঝেড়ে কাশে না। অতএব বেচারি নরেন্দ্র মোদি আর কীই বা করেন!
যদিও একদল ভক্ত মনে করছেন, দ্যাখো এত বড়লোক দেশ, সেও কীরকম ভিখারির মতো হাত পাতছে, আমাদের সাহায্য ছাড়া উপায় নেই! এই আত্মবিমোচন হয়তো শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা, থালা বাজানো, মোমবাতি-আস্ফালন করা ভারতবাসীর জন্য বিজেপির একটা মুখরক্ষার দাওয়াই, কিন্তু, বাস্তবিক এটা ভারতের অপমান। আরও অপমানজনক হল হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন পেয়ে যাওয়ার পরের নাটকটা। মোদিও পাল্টা অভিভূত না-হলে, একটা বীরোচিত জবাব প্রত্যাশা করা যেত। কিন্তু মোদি ভারতবাসী হিসেবে আমাকে সেই ‘কলার তোলার’ সুযোগটা দিলেন না। জানি না, মোদি থেকে ট্রাম্প এবং ট্রাম্প থেকে মোদি— সবটাই নাটক কিনা! প্রথমে করোনাকে গুরুত্ব না-দিয়ে, যথাযথ পদক্ষেপ না-করে, তারপর সেই ব্যর্থতা ঢাকা দিতে দুই দেশের রাষ্ট্রনায়কই বোধহয় ‘হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন’-কে সামনে রেখে একটি সস্তার নাটক করে গেলেন। আর, আমরা ফের দাবার বোড়ে হলাম।