গুচ্ছ কবিতা

মুজাহিদ আহমদ

 

মৃত্যুদূতবাহী ট্রেন

বলছিলাম—হাজার মাইল দূরের পরিযায়ী শ্রমিকের কথা—
যার লাগি সবচেয়ে ভারি কাজটি তুলে রাখো, জমা করে রাখো কঠোর খাটুনির কর্ম।—সেতো রেলের চাকায় মিশে গেছে—গেলো ভোররাতে।—তার লাগি এতোটুকু মায়া জমেছে কি—হৃদয় কোণে?—যদি ভুল করে জমেই যায়! এককাজ করো—তাঁর দেহখানা মর্গের পাশেই বেওয়ারিশ লাশঘরে এখনো।
—মায়া মিশ্রিত জলে তার গোসলের আয়োজন করো।
তাঁর বাবা লকডাউনের বেড়াজালে আটকানো।—গজার মাছের মতো উচাটনে রাত-দিন করছে একাকার। সেতো হাজার মাইলের পথ দূরে। পুত্রধনের শীতল শরীর ছুঁতে পারেনি সে।
বন্ধ করে দিতে পারেনি নিস্তেজ খোলা চোখ, হা করা মুখ।
তাঁর থেঁতলে যাওয়া ঠোঁট দু’খানায় চুমু খায়নি শোকে উন্মাদ মা, মাথার চুল টেনে টেনে ছিঁড়ছে বোবা বোন।

—ছিন্ন দেহখানা ডুমের জিম্মায়, পলিথিনের মমতাহীন প্যাঁচে; অনন্ত ঘুমে।—এই ঘুম শেষ হবে না।

রাজ্যপ্রধান অথবা কেন্দ্রীয় কেউ—কেটা নও। ভাবো— ভুসাবলের পথে হাঁটা কুড়ি মানুষের দলে তুমিও ছিলে। আজ প্রাণ নিয়ে ফেরা মহারাষ্ট্র এক। মিলাও—ঐ ভোররাতের মৃত্যুদূতবাহী ট্রেন ছুটে আসছে তোমার দিকে; হুইসেল বাজিয়ে। ভাত আর ঘুমের কাছে হেরে গেলে তুমি।—বিছানো পাথরগুলো হয়ে উঠলো মসৃণ মখমল। তুমি ঘুমে—তারপর?

চার লাখেরও বেশি হাতুড়ি-শাবলের যে মিছিল ঘরমুখি তাঁদের পিঠ থেকে সঙ্কট সরাও। তাঁরা ক্ষুধা দিয়ে বানায় যে রুটি—তা তোমাদের রোদ্রদিনের সে এক মেঘছায়া আর তুমুল আম্পানের বিপরীতে বিশাল পরিধির—সুন্দরবন এক।

 

ছেঁড়া চটি

তোর দায়িত্ব নিতে পারিনি
ফিরতে চেয়েছিলে মায়ের কাছে অথবা জন্মগ্রাম
আমরা বন্ধ করেছি মায়ের কোলমুখো সকল পথ
এখন লকডাউন।

পথটা কতোটুকু দীর্ঘ—বুঝিনি; মুর্খ যে
তোর প্রয়োজনটা মাথায় ঢুকেনি তখন
তোরও ঘুম পাচ্ছিলো বেশ; ঘুমিয়ে পড়েছিস
ব্যস এতটুকুই—

তুই অনন্ত ঘুমে—আমার তো ঘুম আসছে না ভাই
তোর ছেঁড়া চটি আর আমার বিবেক
এই দেখ—পাশাপাশি মিলাই

চকচক করছে কেমন ছেঁড়া চটিখানা তোর
বিবেকটা মলিন। জানুক দুনিয়া, দুনিয়ার মানুষ
আমরা কতোটা মুখচোর।

 

তাঁরা ঘরে ফিরেনি

পথ হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত তাঁরা—
হাঁটু থেকে সব বল খুলে পড়েছে পথে
পথের দৈর্ঘ্যতা বেশুমার
পথ চলতে চলতে ক্লান্তির কাছে কাবু।

চোখে ঘুম বেশি
মনেও ঘুম বেশি
শরীরজুড়ে ঘুম অপরিসীম।—পথেই দিলো ঘুম।
ঘুমিয়েছে তাঁরা পথে
রাষ্ট্র—তোমার সব পথরুদ্ধ
ট্রেনটা বাকি; তাই তাঁদের উপরদি গেলো ধুম।
তাঁদের চোখে বেজায় ঘুম।
বড্ড বেশি ঘুম, মৃত্যুঘুম।
ঔরঙ্গাবাদের বদনাপুর ও করমাড স্টেশনের মাঝামাঝি
কোথাও রেলপথের পাথুরে বিছানায় জীবনের ঘুম
—তাঁরা ঘরে ফিরেনি।

 

পরিযায়ী শ্রমিক

পেটে এতো আগুন। কই—বাড়ি, কই—ঘর
বাপ—মা—বউ—পোলপান, নিজের গ্রাম
ভিনরাজ্য, ভিনমানুষ। ভিন সম্বোধন

খাবার— ডাল—ভাত—নুন; বছরের পর বছর
কখনো জুটে, কখনো বা না—

কোথায়— নয়ডা থেকে বীজপুর
আহমেদাবাদ থেকে রায়বেরিলি
কোথায়— আঁধোপোড়া রুটি, পানির বোতল

বিতাড়িত তাঁরা,—রাস্তায়। রাজ্য পুলিশেরও লাঠির মায়া
হায়, পেটে বয়ে বেড়ায় আগুন।‘ওরা’ পরিযায়ী শ্রমিক
‘ওরা’ মানুষ নয় মানুষের ছায়া

 

2 Comments

Leave a Reply to মানিক বৈরাগী Cancel reply