লকডাউনের পর…

লকডাউনের পর… -- অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

 

ল্যাপটপের ব্যাগ থেকে প্লাস্টিকের ফাইলটা আরও একবার বের করে দেখলাম। দুটো প্রিন্ট আউট আছে। বাংলায় লিখেছি।

জুতোয় নিজের মুখ দেখুন।
বিটেক এমবিএ দ্বারা জুতো পালিশ করা হয়।
পনেরো টাকা।

আমার পাশে যারা বসে আছে তাদের রেট দশ। আমার পনেরো। আমার বিটেক এমবিএ আছে। ওরা কেউ স্কুলের গন্ডি টপকায়নি। ওরা জুতো পালিশ করতে করতে পিচিক করে পিক ফেলে। আমি ফেলি না। ওরা ভগলবা কহলবা করে। আমি প্রয়োজনে ইংরিজি বলি। মানে, বলতে পারি আর কি। ওদের লুঙ্গি আর ময়লা গেঞ্জি। আমার ফর্মাল জামাকাপড়। প্রিন্টআউটগুলো লাগানোর জন্য একটা স্ট্যান্ড যোগাড় করতে হবে। কেউ তাগাদা দেওয়ার নেই তো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ল্যাপটপটা নিয়ে নিয়েছে। ডেটা কার্ড, চার্জারের সঙ্গে আমি ব্যাগটাও জমা দিতে গিয়েছিলাম। এ সব জমা নেওয়ার জন্যই সেদিন অফিস খুলেছিল। এইচআর ব্যাগটার কন্ডিশন দেখে বলল, ‘নট রিকোয়ার্ড’। স্ট্র্যাপটার কাঁধের জায়গাটায় স্পঞ্জের মতো যে একটা জিনিস থাকে, ওটা সাদা হয়ে গিয়েছিল। খড়খড়ে। ফাঙ্গাস টাঙ্গাস পড়েছিল মনে হয়। ঘেমেছে, শুকিয়েছে কত বার। আমি তো দিয়ে দিতেই চেয়েছিলাম। নিল না। ল্যাপটপটা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল। বাঁদিকে স্ক্রিনের কোনায় একটু স্ক্র্যাচ পড়ে গিয়েছিল। নোট নিল, টু বি অ্যাডজাস্টেড ইন দ্য এফএনএফ। এই তিনটে অক্ষরের মানে হল ফুল অ্যান্ড ফাইনাল সেটলমেন্ট। তার পরে বলল, ‘আমরা সরি, বাট থ্যাঙ্ক ইউ এনিওয়ে।’ আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিলাম। চোখ ফেটে কিছু একটা বেরোতে চাইছিল। কাচের দরজাটা টেনে খুলতে যাচ্ছি, তখন ওই লোকটা বলল, ‘একটা কার্টেসি ভিডিও কল করে নিও তোমার বসকে। আমার সামনেই করো।’ আমি আগরওয়ালের নম্বর ডায়াল করলাম। দুটো রিং হওয়ার আগেই উনি ফোন তুললেন। মুখোশ লেপ্টে থাকা একটা মুখের উপর আরও একটা মুখোশ। মাস্ক। লাল। টিকলো মুখে ওনাকে একটা কাঠঠোকরা পাখির মতো লাগছিল। একটা প্রোগ্রাম করা বডি ল্যাঙ্গোয়েজ। ফোনটা তুলেই প্রথমে হাত জোড় করে একটা নমস্কার করলেন। তার পরে থাম্বস আপ দেখিয়ে বললেন, ‘অল দ্য বেস্ট।’ তার পরে হাত দিয়ে টাটা দেখালেন। এর পরে নিজেই ফোনটা কেটে দিলেন। এইচআর বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’ আমি দরজা খুলে বেরোলাম। পরের জন ল্যাপটপ নিয়ে রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

টানা চল্লিশ দিন অফিস যাইনি। ইচ্ছে করে নয়, যেতে বারণ করেছিল। মার্চের শেষ সপ্তাহে, লকডাউনের আবহে করোনা আপডেট দেখতে দেখতে মাসের টার্গেটটা কীভাবে টানা যায় ভাবছিলাম যখন, তখনই এইচআর থেকে ঝপ করে একটা মেল ঢুকল। বলল, কাল থেকে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। তার পরে লাল অক্ষরে, বোল্ডে লেখা ছিল, এর মানে কিন্তু ছুটি নয়। যেহেতু বাড়িতে বাড়তি সময় পাওয়া যাচ্ছে অনেকটা বেশি, তাই সেলস টার্গেট-ও পনেরো পার্সেন্ট বাড়িয়ে দেওয়া হল। আরও লিখল, আমরা চাই, পুরো দিনটাই, কোজি পজিশনে অফিসের জন্য ডিভোট করো। এই ইমেলটা আমার কাছে গুমোট গরমে তাজা, ঠান্ডা হাওয়ার মতো ছিল। কত দিন বাড়ির লোকেদের সঙ্গে সময় কাটাইনি সেভাবে। বিয়ের তিন বছর পার হতে চলল, এখনও একটা ঠিকঠাক হানিমুন হল না। অন্তত সময়টা তো দিতে পারা যাবে এবার। শুন্ডির রাজার মতো ছুটি ছুটি বলতে বলতে কেউ ওয়াগন ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। পরের দিন দেরি করে উঠব ভেবেছিলাম। সাতটার জায়গায় সাড়ে সাতটা, পৌনে আটটা। কী যায় আসে। চা নিয়ে টিভিতে দেখানো বিজ্ঞাপনের মতো মারি বিস্কুট খাব। ঠিক সাড়ে নটায়, অফিস টাইমে কাজে বসে গেলেই তো হল। পৌনে সাতটায় আগরওয়াল ফোন করেছিলেন। ঘুম চোখে ‘হ্যালো’ বলার পরেই শুনেছিলাম, ‘আজকের সেলস প্ল্যানটা দশ মিনিটের মধ্যে আমায় ইমেল করো।’ ঘুম চটকে গিয়েছিল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়েছিলাম। পরের ফোনটা এল সোয়া সাতটায়। আগরওয়াল উত্তেজিত। ‘তুমি ভেবেছটা কী? লকডাউন ইজ নট মেন্ট টু এনজয় অ্যান্ড গিভ বার্থ টু বেবিজ। এখনও প্ল্যানটা আসেনি কেন?’ চাবুকের মতো লেগেছিল কথাটা। সৌমিও শুনতে পেয়েছিল হয়তো। না হলে ও এই কথাটার পরেই ঘর থেকে ছুট্টে বেরিয়ে গেল কেন। আমি বলতে চাইছিলাম, এখনও তো অফিস আওয়ার্সই শুরু হয়নি স্যার। মেলটা পাঠালাম আটটায়। কী পাঠাব? এই বাজারে কাকে বেচব গাড়ির ইনসিওরেন্স? এমনিতেই আমাদের কোম্পানির প্রিমিয়ামটা বাজারের থেকে একটু বেশি। একটার পর একটা নম্বর ডায়াল করে বলে যেতে হয়, এই বাড়তি বেনিফিটগুলো পাচ্ছেন স্যার। আর পনেরো দিন পরেই প্রিমিয়ামটা বেড়ে যাবে ম্যাডাম। আপনার জন্য, আজকের জন্য স্পেশাল রেট। সব ফালতু কথা। জয়েন করার পরে পাখিপড়ার মতো এই কথাগুলো শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বেশ কিছু দিন ধরে দেখছি, এমন ফোন করলে কেউ কেউ তেড়ে খিস্তি মারে। একজন বলল, শালা খেতে পাব কিনা আর সাত দিন পর ঠিক নেই, গাড়ির বিমা করাবে! রাসকেল কোথাকার। বলে ফোন কেটে দিল। আরেকজন বলল, নিজের পেছনে গোঁজ্ প্রিমিয়াম। করোনায় মরছি, এখন গাড়ির প্রিমিয়াম। যত্তসব। আগে দশটা ফোন করলে বড় জোর দুটোয় গালাগালি খেতে হত। এখন আটটায় খাই। জানি ভুল সময়। জানি এই নোংরা আর টালমাটাল জলে ছিপ ফেলে লাভ নেই কোনও। এটাও জানি, পলিসি বেচতে না পারলে মাসের শেষে মাইনেটা পাব না।

টার্গেটের তিরাশি পার্সেন্ট অ্যাচিভ করেছিলাম মার্চ মাসে। কী করে যে করেছিলাম জানি না। মাসের শেষ দিন যাদেরকে ফোন করেছিলাম, তাদের দুজন বলেছিল, ‘স্পষ্ট করে কথা বলুন মশাই। গোঙাচ্ছেন কেন? খেতে পান না?’ আমি কী করে বোঝাই গলা থেকে তখন আওয়াজ বেরোচ্ছিল না আর। মাসের একতিরিশ তারিখে একটা ইমেল এল। তাতে লেখা স্যালারি উইল বি ডিলেড। কোম্পানির কাছে পয়সা নেই। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে মার্চ মাসের মাইনে দিল। চল্লিশ শতাংশ। সারা গায়ে চিরে যাচ্ছিল যখন, তার মধ্যে এপ্রিলের নতুন সেলস টার্গেট এল। রিভাইজড। আগেরটার থেকে কুড়ি পার্সেন্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। পুরো মেলটাই লাল ফন্টে, আবার। বোল্ড অক্ষরে। প্রসেনজিৎ হতে ইচ্ছে করছিল খুব। একটা বাইক নিয়ে একশ কুড়ি স্পিড তুলে প্রবল ধাক্কায় উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড করা রাস্তা। খাবার ছিনিয়ে নেওয়া, আমার মাইনে কেড়ে নেওয়া রেড জোন। না করে দেওয়া, ফোনে খিস্তি দেওয়া স্যারদের সামনে গড় করে শুয়ে বলতাম, প্লিজ স্যার, প্লিজ। যেমন করে আমাকে সেদিন ফোনে বলল ওই মেয়েটা। কোনও একটা ব্যাঙ্ক যেন। ভুলে গিয়েছি। একটা কার্ড নিন না, প্লিজ স্যার। মাসে পঞ্চাশটা না করতে পারলে এক টাকাও মাইনে দেবে না স্যার। পাঁচটাও হয়নি এ মাসে। আজ আঠাশ তারিখ। ফোনে আমার পা ধরতে চাইছিল। ও জানত না আমিও পা ধরে আছি অন্যের।

এপ্রিল মাসের টার্গেটের কুড়ি পার্সেন্টও অ্যাচিভ করতে পারিনি। পয়লা মে, মানে মে ডে-র দিন সকালে ফোনটা অন করার সঙ্গে দুটো এসএমএস ঢুকল। ব্যাঙ্কের ইএমআই রিমাইন্ডার আর বসের ‘কল মি আর্জেন্টলি।’ আগরওয়াল বলল, ‘ক্রিস্পলি বলছি। ইউ আর ফায়ার্ড। এক ঘণ্টায় রেজিগনেশন দাও। এলস বিকেলে টার্মিনেশন লেটার চলে আসবে। বাই।’ ফোনটা কেটে দিল। আমি উল্টে ফোন করলাম। বললাম, ‘প্লিজ স্যার, প্লিজ।’ আগরওয়াল বলল, ‘লট অফ কলস টু মেক। গেট লস্ট।’ শেষ দুটো শব্দ বলল চেঁচিয়ে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম। এই আগরওয়ালই গত বছর মন্দারমণিতে অ্যানুয়াল মিটিংয়ের শেষে আমাকে মাঝখানে বসিয়ে সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভদের একটা গ্রুপ ফটো তুলেছিল। নিজেই তুলেছিল। আমার হাতে জ্বলজ্বল করছিল টপ পারফর্মার অ্যাওয়ার্ড। ছবিটার কোলাজ করে দিয়েছিল বত্রিশ জনের টিমের সবাইকে।

এক বছরেই গেট লস্ট। মাথার উপরে মশার ভনভনানি। মশা না অন্য কোনও পোকা? ওগুলোর চোখ নাক মুখ। গলায় ঝোলানো, অর্ধেক খুলে যাওয়া, নেতিয়ে পড়া টাই। হুল ফুটিয়ে ফুটিয়ে ওরা আমায় ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে লাগল। যেন বলছে, দলে আয়। দলে আয়। যেন বলছে, লক্ষ্য ছিল লক্ষ হওয়ার, কোটি হব ঠিক। ওদেরকে মারতে যাই। কটাকে মারব?

খবরের কাগজের পাতাগুলোতে রক্ত লেগে থাকে। জব সাইটেও সেই কবে পোস্ট হওয়া কোনও চাকরির বিজ্ঞাপন। নেই, নেই, কিচ্ছু নেই। বিমলকাকুকে ফোন করলাম। বলেছিল, চাকরিবাকরি নিয়ে কখনও কোনও সমস্যা হলে বলিস। বিমলকাকু একটা বিশাল বড় কোম্পানির জিএম। ফোন করে বললাম, ‘বাঁচাও’। বিমলকাকু বলল, ‘উরিশ্শালা। এ তো পুরো দাদা আমি বাঁচতে চাইয়ের মেল ভার্সান রে। ফিরসে বোলো।’ বললাম, ‘চাকরিটা গেছে গো।’ বলল, ‘কারও থাকে কারও যায়, কেউ মরে কেউ খায়। জাস্ট বানালাম। কেমন হয়েছে রে?’ ফোনটা রেখে দিয়েছিলাম। স্কুলের চার পাঁচটা বন্ধুকে ফোন করলাম। একজন বলল, ‘গুরু আমারও যাবে আর দিন কয়েকের মধ্যে। চিল মার্। আগে সেভিংসটার দশ পার্সেন্ট শেষ করি। তার পরে আবার খুঁজব। ইউ ডু দ্য সেম বাডি। একটাই লাইফ।’ ওর হাইল্যান্ড গ্রিনস, আমার ক্ষয়াটে সাড়ে চারশো স্কোয়ার ফিটের উপরে ন্যাড়া ছাদ। সৌরভ বলল, ‘কিছু করতে পারলে ভাল হত। কিন্তু কী করি?’ দেবদত্ত বলল, ‘ইসস্। একটু পরে ফোন করছি রে।’

শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনগুলোতেও এখন শুধু হাহাকার ছাপে। আট পাতার কর্মখালি এখন দু পাতাও ভরে না। চোখে মাইক্রোস্কোপ লাগিয়ে একটা কাজ খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম। পিএইচডি-ও তো দরখাস্ত দেয় পিওনের শূন্য পদে। চারদিকে করোনার থাবা না বসলেও দেয়। এটিএম গার্ড হওয়ার জন্য ফোন করেছিলাম ‘নিজ জেলায় পোস্টিং’ লেখা একটা বিজ্ঞাপন দেখে। পড়াশোনা কদ্দুর-এর উত্তর পাওয়ার পরেই চার অক্ষরের একটা খিস্তি মেরে ফোন রেখে দিল। কাগজের থালাবাটি বানানো যেত। জায়গা কই? মেশিন কেনার পয়সা কে দেবে আমায়? ছোট্ট একটা মুদির দোকান করব ভেবেছিলাম। বাইশ হাজার টাকা ভাড়া চাইল মাসে। মাল কিনতে হবে অন্তত লাখ তিনেক টাকার। কই? বিশ্বাস করুন, আর কিচ্ছু ছিল না করার মতো। আয়না বলত, এ মা, তুই বেকার। বলত, নিজের গায়ে থুতু দে। যত দিন যাচ্ছিল, সৌমির ভুরু কোঁচকাচ্ছিল আরও। বাবার কপালের বলিরেখার মধ্যে ঝড়ে উপড়ে পড়ে যাওয়া ডালপালা।

কাউকে বলিনি। বলতে পারিনি। চার দফা লকডাউনের পর আনলক ওয়ান ঘোষণার আগেই জুতো পালিশের কাঠটা বানিয়ে নিয়েছিলাম একটা মিস্ত্রিকে দিয়ে, চুপিচুপি। কালি, ব্রাশ, ক্রিম, কাপড় সব কেনা হয়ে গিয়েছিল। নিজের জুতো তো নিজেই পালিশ করেছি এত দিন। প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম কি না জানি না, ভেবেছিলাম বসলে নিজের ডালহৌসির অফিসের সামনেই বসব। হোক প্রতিরোধ। অফিসের লোকেরা দেখুক আমায়। অন্য অফিসের লোকগুলোও রগড় দেখুক। মুখে মুখে কথা রটে যাবে। ভেবেছিলাম খবর হবে আমায় নিয়ে। হয়তো হেডলাইন হত, বিটেক এমবিএ-র হাতে আজ জুতো পালিশের ব্রাশ। মনে হয়েছিল, এই খবর পড়ে হয়তো আমায় আবার ডেকে নেবে আমার পুরনো কোম্পানি। লজ্জায়। যেদিন প্রথম বসলাম, বসকে একটা এসএমএস পাঠিয়েছিলাম, ডেস্টিনি টুক মি এগেইন ইন ফ্রন্ট অফ দ্য অফিস। আর কিছু লিখিনি। কোনও উত্তর পাইনি।

তিন স্কোয়ার ফিটের একটা জায়গা করে ফুটপাথে বসে পড়লাম যেদিন, সামনের লোকগুলো অবাক হয়ে তাকাচ্ছিল। অফিসের শিবব্রত, মনীশ, দেবাঞ্জনের সঙ্গে আধঘণ্টার মধ্যেই দেখা। আমাদের টিম, সেলস টিম। মনীশ বলল, ‘সেকি!’ দেবাঞ্জন মিনমিন করতে লাগল, ‘টু ব্যাড, টু ব্যাড’। শিবব্রত বলল, ‘কেমন রোজগার হয় জানাস তো।’ অফিসে ঢোকার পরে তিনজনই চুপি চুপি আমার কাছে এল। কিন্তু আলাদা আলাদা। তিনজনই বলল, ‘একটা ভালো বিজনেস আইডিয়া দে না রে। যে কোনও দিন, যে কোনও মুহূর্তে চাকরি চলে যাবে।’ শুনলাম, ওই বত্রিশজনের সেলস টিম আজ মাত্র ঊনিশ। অফিসের আড়াইশো কর্মচারীর মধ্যে এখন টিকে আছে দেড়শোজন। আমার সঙ্গেই তো সতেরোজনের চাকরি চলে গিয়েছিল। একই দিনে। সেলস-এর আমি একাই ছিলাম সেদিন। শুনলাম, আগরওয়াল আজও আমার নাম শুনলেই বলে, ব্লাডি নন পারফর্মার। মেরা এপ্রিল ডুবা দিয়া শালা। আরও বলে, লাথি মেরে বের করব সব কটাকে। লাথ মারেঙ্গে।

ফুটপাথে এক দর্শনীয় বস্তুর মতো হয়ে যাচ্ছিলাম ক্রমশ। লোকেরা জটলা পাকিয়ে আমায় দূর থেকে দেখে। ‘ভাই পালিশ হবে’ বলে পা-টা বাড়িয়েও ঝটকা খাওয়ার মতো ফিরিয়ে নেয় আবার। যেন স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাবিলদারের ছেঁড়া হাফ প্যান্টই এই পেশার ড্রেস কোড। সারা দিন বসে থাকি। পা আসে না। পাশের লোকগুলো, মানে আমার কম্পিটিটররা পরম যত্নে লোকের পা জড়িয়ে ধরে একটার পর একটা জুতোর ভোল বদলে দেয়। আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন। সন্ধেবেলা ফুটপাথেরই একটা খাবারের দোকানদারের কাছে পালিশের কাঠটা জমা রেখে বাড়ি ফিরে যাই। বাড়ির লোকেরা জানে, অনেক কষ্টে একটা কাজ জুটিয়ে নিয়েছি ফের। অফিস জব।

 

বেকারত্বের হার তেইশ শতাংশ ছাড়াল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউনের পর আনলক যত হবে এবারে, খেলাটাও ক্রমশ জমবে। না চাকরির হারও বাড়বে লাফিয়ে লাফিয়ে। ব্যবসার পাতার অর্ধেকটা জুড়েই তো শুধু ছাঁটাইয়ের খবর। শু কেয়ার কিটটা সামনে রেখে মন দিয়ে ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পড়ছিলাম, এমন সময় একটা জুতোর ঠকঠক। মুখ তুলে দেখি আগরওয়াল। মনে হয়েছিল, আমার প্রার্থনা শুনে দেবতা মন্দির থেকে নেমে এসেছেন হয়তো, আমার জন্য চাকরি নিয়ে। কম মাইনে দিলেও জয়েন করে যাব স্যার। ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। উনি তাকিয়ে থাকেন আমার পিছনে দাঁড় করিয়ে রাখা স্ট্যান্ডটার দিকে। বিটেক এমবিএ দ্বারা জুতো পালিশ করা হয়। পাগলা হাওয়া দিচ্ছে। বিটেক এমবিএ দুলছে। উনি বললেন, ‘ক্যায়া লিখা হ্যায় উধার?’ আমি হিন্দিতে তর্জমা করে দিলাম পুরো তিন লাইন। উনি বললেন, ‘ব্রিলিয়ান্ট’। তার পর নিজের ডান পা-টা ঠকাস করে বসিয়ে দিলেন পালিশের কাঠটার উপরে। বললেন, ‘বিশ দেঙ্গে। আচ্ছাসে করো।’ স্যারের থেকে অনেকটা দূরে, পিছনে দাঁড়িয়ে আমার কয়েকজন প্রাক্তন কলিগ। রগড় দেখছে।

ডান পায়ের পরে বাঁ পা। আমি জুতোয় ভাল করে ক্রিম ঘষি। পালিশ লাগাই। কাপড় দিয়ে রগড়াই। নামী বিদেশি ব্র্যান্ডের জুতো জোড়া ঝলমল। বলি, ‘ডান স্যার’। আগরওয়াল বললেন, ‘টেকিং ইওর পাঞ্চলাইন। নিজের মুখটা নিজে দেখতে পাচ্ছ, অ্যাট লিস্ট?’

আমি স্যারকে কী করে বোঝাই ওই চকচকে কালো চামড়ায় একটা ছবি ফুটে উঠছে ক্রমশ। তাকিয়ে থাকি। নিজের মুখটা তো আছেই। মন্দারমণির ওই গ্রুপ ফটোটা জ্বলজ্বল করছে সেখানে।

এ বারে ফ্রেম ছেড়ে মাথাগুলো বাড়তে থাকে। বেড়েই চলে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...