আন্তোনিওনি, আপনাকে

আন্তোনিওনি, আপনাকে

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

প্রিয় আন্তোনিওনি,

কোনও কোনও দিন একা রাস্তায় আপনার কথা মনে পড়ে। কোনও কোনও দিন ভিড়ের মধ্যে। সন্ধে হয়, সন্ধে নামে, নির্মিত হয়। একটা আধো-অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে মনিকা ভিত্তির মতো দেখতে একটা মেয়ে। অল্প হেলে আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ে। আমি জানি, ওই হাতেই শেষ বাকিটা অংশ। মেয়েটার সঙ্গে আমার সেই রাত্রে, পরের রাত্রে দেখা নাও হতে পারে। খুব সম্ভবত, দেখা হবে না। একটা স্টকব্রোকারের মতো জীবনে পিছতে পিছতে আমি একটা সময় এগিয়ে যাওয়া বন্ধুদের চেয়েও বেশি এগিয়ে থাকব। কারণ পৃথিবীটা গোল। অথবা একটা টাওয়ারের ওপর উঠে কাউকে কিছু না বলেই ওপর থেকে একটা আলতো ঝাঁপ। লং শটে আমার শরীরে চলবে একটা ক্যামেরার বার্ডস আই ভিউ, মেয়েটি দৌড়ে আমাকে ধরতে পারবে না। প্রিয় আন্তোনিওনি, এত শব্দহীন কান্না, কান্নাহীন শব্দ, কিভাবে তৈরি করলেন আপনি?

‘রেড ডেসার্ট’ (১৯৬৪)

একটা রং করা কারখানার পাশ দিয়ে যেতে যেতে হাত ছেড়ে দৌড়ে যাবে ছেলে। ও তখন অনেকটা বড়। একটা হলদে ধোঁয়া। বিষ। বাবা, পাখিগুলো ওখানে গেলে বাঁচবে? না। আমি সংক্ষিপ্ত হই। তাহলে? ওরা যদি মরে যায়? ছেলেটা ভয় পাবে না। ও জানে আমার পরবর্তী উত্তর। পাখিগুলো জানে ধোঁয়ায় গেলে ওরা বাঁচবে না। তাই, ওরা আর যায় না ওখানে। আমাদের মুখস্থ সংলাপ। রিহার্সাল। সকাল দুপুর। একটা লাল রঙের মরুভূমির ভেতর দিয়ে আমার হাঁটা। পাশের মানুষ, ঘরের মানুষ আমাকে চেনে না। আমি চিনি না। কেন হাঁটি? কেন পালাই? মাঝে মাঝে মনে হয়, যেখানে আছি এখন, অ্যাট প্রেজেন্ট, সেখানে থাকার অধিকার নিয়ে আসিনি আমি, তাই পালাই। তুমি দেখো। শরীর, বন্ধুত্বের কাঁধ, চোখের জলের দুই নদী। তুমি দেখো, ভাবো কোথায় আশ্রয় নেবে, থাকবে। আমি ভাবি কিভাবে বাঁচব।

‘লা নোত্তে’ (১৯৬১)

শুধু বাঁচাটুকু হলে চলত। মরা, মরে দিব্যি বেঁচে থাকা? এসব ঝক্কি থেকে যায়। ব্যর্থ কিছু বছরের ওজন, প্রিয় আন্তোনিওনি কোনওদিন বুকের ওপর জমতে দেখেছেন? মরে যাওয়া আর বাঁচার সূক্ষ্মতর এক তফাৎ আছে। মেহের আলি দিনের পর দিন সেখান থেকে সরে আসতে বলছে। আমি সেই বৃদ্ধকে নিওরিয়েলিজম বোঝাই। ওপর থেকে ঘণ্টাধ্বনি। অশুভ বার্তা। চলে যাব? অথচ, চট করে মরে যেতে গেলেই একটা হাসপাতাল ঘর ভেসে ওঠে। খ্যাতি, অসুখ আর লোনলিনেসের মাঝে এক একটা শব্দ। অকাল মৃত্যুর একটাই সুবিধে আছে জানি, টু এসকেপ সাক্সেস, সাফল্যকে পাশ কাটানো। আঃ। অদ্ভুৎ এক শান্তি।

‘লা অ্যাভেনচুরা’ (১৯৬০)

প্রেরণা, প্রেম, আশ্রয় এসব কিছুই নেই, ছিল না, কোনওদিন হবেই না ভেবে এগোনো। আর তাছাড়া, আমাদের প্রেরণা নেই, শুধু স্মৃতি আছে। হাজারটা দোষ আছে, বিষ আছে, কিন্তু আমি সেগুলো ঢালি না। আই হার্ডলি প্র্যাকটিস দেম। সেসব বিষ, এমনিই জমে থাকে। জমে জমে দীর্ঘসূত্রতা বাড়ে। আমি ভালো ছেলে হয়ে যাই। বাঁচি…

‘ব্লো-আপ’ (১৯৬৬)

একটা সময়ে ফাঁকা একটা গলফ কোর্সের মাঝে তার সঙ্গে দেখা হয়। প্রিয় আন্তোনিওনি, আপনার ছবির শেষটুকুর মতো একটা তীব্র, পরিণতিহীন আদরে দোষ ঢাকি আমি। তাকাই, তাকিয়েই থাকি। নারী। নারীর প্রিয়তম পোশাক তার চামড়া। সে সঙ্কোচে বলে, কী দেখছ। আমি বলি, আঁকছি, আঁকছি তোমায়, দেখতে পাচ্ছ না। সে বলে, ঠিক কী ভাবছ বলো তো, আঁকতে আঁকতে। আমি বলি, কিছু না, স্রেফ কাঁপুনি। একটা শাডার। সেও অমনি একটা কাঁপুনি দিয়েই সরে আসে। হাসে। আমি তার মনের কথা শুনতে পাই। সলিলোকি। একটা পেরেক, একটা বই, একটা সুতো, একটা মানুষ— ধরার জন্য প্রত্যেকেই এক। পার্থক্য নেই। ইন দ্য লং রান।

‘ইল গ্রিডো’ (১৯৫৭)

আমার নিজস্ব এক অপরাধবোধে প্রিয় আন্তোনিওনি, আপনার ছবির অভিঘাত। আমাকে রাস্তা পার করে দিয়ে আবার একটা বড় রাস্তার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া এক একটা মুহূর্ত। ফ্রেম। ওপাশ থেকে একটু একটু করে হেঁটে যান পিতা। পঞ্চাশ, ষাট, এখন সত্তরের দিকে। কী ভাবছ বাবা? হাসেন বৃদ্ধ। আসলে দুজনেই জানি, পঞ্চাশ পেরলে শীতলতা ছাড়া আর কিছু ভাবার থাকে না। ইউ অনলি ফিল দ্য কোল্ড। রিয়েলিটি। ক্রুড রিয়েলিটি। বাস্তবতা। ছোটবেলার জনি সোকোর বাস্তবতা না। আরেকটু বড় হয়ে কান্ট্রি বয়ের রুপোলি বাস্তবতা না। তিরিশ পেরনোর বাস্তবতা। সময়। কিছু একটা ভয়ঙ্কর বীভৎস ব্যাপার লুকিয়ে থাকে রিয়েলিটির ভেতর, প্রিয় আন্তোনিওনি আপনি জানেন। একটা পার্কের বেঞ্চে বসে এক্সট্রিম লং শটে বিশ্বাস ফিরে আসে? নাকি হারিয়ে যায়? দুই মানুষ মানুষীর? আসলে বিশ্বাস বলে ছিল কি কোনওদিন? একটা ছুটন্ত ট্রেনকে পাশ কাটিয়ে অসম্ভব আদরে বলে ওঠে নারী— ইউ আর মাইন, মাইন, মাইন…। আমার শরীরে কিছুই আর বেঁধে না যে। ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়। আমি একা হই। আর একা হলেই সামনের অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে ওঠে দেখবেন। আপনার ছবির মতো, একা থাকা মানুষগুলোর মতো, সব কিছু ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। ভিড়ের মাঝেও একা। জাস্ট একা। আর কিছু না। ভাললাগবে না। অথচ বেরনোর রাস্তা নেই। একজন মানুষ চলে যাবে জেনেও পিছু নেয়। কিছুটা এগিয়ে দিই তোমায়, সেই দিন, সেই ঘর, কলোনি, গরিব নোংরা বাচ্চা, আমাদের সেই আদরের জায়গাগুলো, মাঠের ওপর রকেট ওড়ানো ছেলেগুলো, এসবের ভেতর কিছুটা এগিয়ে দিই এসো। তারপর যেও। আর জ্বালাতে আসব না।

‘লা এক্লিস’ (১৯৬২)

এসবের ভেতর, প্রিয় আন্তোনিওনি, আপনার ক্যামেরা আমাকে অন্ধকার দেয়। আলো না। একটা টেনিস বল। ছিল না কোথাও। একটা মিম। খেলা। এধার থেকে ওধার। ওধার থেকে ওধার। শাফল। তোমার কাছে বল। আসলে তো র‍্যাকেটগুলো নেই। বলটাও। অথচ তোমাকে ফেরত দিতে হবে। তোমার দিকে তাকিয়ে আছে দর্শক। প্লেয়ার। কী করবে? বাঁচবে? সেই জীবন, আন্তোনিওনি, একটা মিম। জাস্ট প্রিটেন্ড টু প্লে। অর, বিইং প্লেইড। শেষ দৃশ্যের একটা অদ্ভুত লং টেকে তোমাকে গুলিবিদ্ধ করে চলে যায় যারা, তারা জেনে যায় না, তুমি আসলে নেই সে তুমি। জানলা দিয়ে অনেক দূরে যে মেয়েটি, তাকে চিলেকোঠার ঘর, বৃষ্টি আর ব্যক্তিগত কথা বলতে বলতে একদিন তুমি হেজে যাবে। তোমার পাশ দিয়ে একটা প্রচন্ড জোরে ট্রাক চলে গেলে তোমার চুলে হাওয়া এসে লাগবে অল্পই। ছুঁয়ে দেখবে, গরম, মৃত্যুবৎ। ট্রাকের ওপর দিয়ে শুয়ে চলে গেল কে? পাশে শিশু ছিল কি? কান্না। তোমার গলা বুজে আসবে। শিশুটির পিতৃহারা হওয়ার সময় এসে গেল। একটা একলা দ্বীপে ঝড়ের মধ্যে তোমাকে বসিয়ে দিয়ে যায় ওরা। তুমি, বন্ধুমৃত্যু না সেরেন্ডিপিটি, এই দুইয়ের তফাৎ বুঝতে বুঝতে দেখবে ভোর হয়ে আসছে আর খুব দূরে এক যৌনদৃশ্য অভিনীত হচ্ছে। মরুভূমির ভেতর। শহরের ভেতর। তোমার পুরনো আত্মীয়া, বান্ধবী, সহোদরা, স্ত্রী, প্রেমিকা – আর তোমার পৌরুষ শরীর পাল্টে পাল্টে ছুঁয়ে দেখছে ব্যক্তিগত আকাশ। নমনীয়তা। শিল্প। অসুস্থ হয়ে আসবে তুমি। ক্রমে, আরও অসুস্থ। তোমার সলিলোকি। একাই…

আই হ্যাভ বিন সিক, বাট আই মাস্ট নট থিঙ্ক অফ ইট। দ্যাট ইজ, আই হ্যাভ টু থিঙ্ক অল দ্যাট হ্যাপেন্স টু মি ইজ মাই লাইফ। দ্যাটস ইট …

‘দ্য প্যাসেঞ্জার’ (১৯৭৫)

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...