নয়া কৃষি-সংস্কার বিল: দেশ কি আবার এক কৃষক আন্দোলন দেখতে চলেছে?

সুশোভন ধর

 


লেখক রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষক

 

 

 

আমাদের অনেকের মনে আছে যে ২০১৮ সালের শুরু থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক আন্দোলন নিয়ে চারিদিকে বেশ হৈচৈ পড়ে। প্রায় ৪০,০০০ কৃষক নাসিক থেকে ১৮০ কিলোমিটার মিছিল করে মুম্বাইয়ের রাজপথ কাঁপিয়ে তোলে। কৃষকদের প্রবল আন্দোলনের মুখে মহারাষ্ট্র সরকার কৃষকদের সমস্ত দাবি মৌখিকভাবে মেনেও নেয় যদি শেষ পর্যন্ত কোনও কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। ওই পদযাত্রায় অংশ নেওয়া ৬৫ বছর বয়সি শেকুবাই ওয়াগলের ক্ষতবিক্ষত পায়ের ছবি দেখেই শিউরে উঠেছিল গোটা দেশ। ফোসকা পড়ে তাঁর দু পায়ের তলার পুরো চামড়াটাই প্রায় উঠে এসেছিল। শেকুবাইয়ের ক্ষতবিক্ষত পা হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের প্রতীকী ছবি। একই বছরের শেষে ঋণ মকুব ও ফসলের ন্যায্য দামের দাবিতে ফের দিল্লিতে জমায়েত হন হাজার হাজার কৃষক। একাধিক সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ ডাকে এই কৃষকেরা দিল্লির রামলীলা ময়দানে অবস্থান শুরু করেন। ২০১৪ সাল থেকে চলতে থাকা নরেন্দ্র মোদির একতরফা শাসন অল্প হলেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ভারতের কৃষক আন্দোলন সহ আরও বিভিন্ন আন্দোলন ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বিক্ষোভের ফলে। কিন্তু ২০১৯ সালের পুলওয়ামা কাণ্ডের পরে ঘটনার খাত অন্যদিকে বইতে থাকে। একদিকে প্রবল উগ্র-জাতীয়তাবাদী প্রচার ও ম্যানুফ্যাকচার্ড দেশপ্রেমের বন্যায় খানিকটা হলেও দমে যায় কৃষক আন্দোলন সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলমান বিভিন্ন গণ-আন্দোলনগুলি। এরই সুযোগ নিয়ে মোদি আরেকবার ভারতের মসনদে আসীন হন। এবং ২০১৪ সালের থেকে আরও বেশি আসন সংখ্যা লাভ করে।

দিল্লির রাজপথে কৃষকরা, ২০১৮

এই মুহূর্তে আবার দেখা যাচ্ছে যে ভারতের কৃষকরা আবার নতুন করে রাস্তায় নামতে শুরু করছেন। ঘটনার সূত্রপাত তিন মাস আগে কেন্দ্রীয় সরকারের জারি করা তিনটি অর্ডিন্যান্সকে কেন্দ্র করে, যেগুলি হল:

  1. The Essential Commodities (Amendment) Ordinance, 2020 (অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের সংযোজনী ২০২০);
  2. The Farmers (Empowerment And Protection) Agreement On Price Assurance And Farm Services Ordinance, 2020 (দাম নিশ্চিন্তি ও কৃষি পরিষেবার চাষি (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) চুক্তি অর্ডিন্যান্স ২০২০); এবং,
  3. The Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Ordinance, 2020 (চাষির ফসলের ব্যবসা ও বাণিজ্য (অগ্রগতি ও সুবিধা) অর্ডিন্যান্স ২০২০)

কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি এই তিনটি বিলই কৃষকদের স্বার্থে কৃষিক্ষেত্রের আমূল সংস্কার ঘটাবে। একটি অর্ডিন্যান্স ইতিমধ্যেই লোকসভায় পাশ হয়ে গেছে ও অন্য দুটি কেন্দ্রীয় কৃষি ও কৃষক কল‍্যাণ উন্নয়ন মন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর রাজ‍্যসভায় পেশ‌ করেছেন। সরকার দাবী করছে এই নয়া আইন ও আইনের সংশোধনী কৃষকদের শৃঙ্খলমুক্ত করবে। স্বাভাবিকভাবে আমরা ধরে নিতেই পারি যে আরও বেশি স্বাধীনতা দেয় এমন সমস্ত আইনকানুন তো কৃষকদের করজোড়ে স্বাগত জানানোর কথা। কিন্তু তা না করে তারা এভাবে দলে দলে রাস্তায় নামছেন কেন?

অবস্থা যা তাতে দেখা যাচ্ছে যে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা ইতিমধ্যেই রাজপথে নেমেছে। এই আন্দোলনটি রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ এবং উত্তর প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। বিরোধী দলগুলি যে এই অর্ডিন্যান্সের সমালোচনা ও বিরোধিতা করবেন তা তো জানা কথা। কিন্তু মোদি সরকারের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পমন্ত্রী শ্রীমতী হরসিমরত কউর বাদল মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন এই দাবি তুলে যে এই নতুন আইন কৃষকবিরোধী এবং তিনি এর প্রতিবাদে পদত্যাগ করছেন। হরসিমরত কউর বাদল বিজেপির জোট-শরিক আকালি দলের সদস্য।

প্রশ্ন হল, দেশের কৃষকরা এতটা বিচলিত কেন? বর্তমান আইনটি দাবি করছে যে তা সমস্ত ফড়ে বা দালালদের ক্ষমতা হ্রাস করবে। তার ফলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য যাকে ইচ্ছা এবং উচিত মূল্যে বিক্রি করতে পারবেন। তাদের তো তাহলে আনন্দে ভেসে যাওয়া উচিত।

দেখা যাচ্ছে এই আইনের লক্ষ্য বিভিন্ন কৃষি মাণ্ডি অর্থাৎ কৃষি পণ্য বাজার কমিটিগুলির (এপিএমসি) ক্ষমতা খর্ব করা। এবং কৃষকদের ভয়টা ঠিক এইখানেই।

তারা ভয় পাচ্ছেন যে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) ধীরে ধীরে তুলে দেওয়া হবে। প্রতিবছর এমএসপিতে প্রচুর পরিমাণে গম এবং চাল এবং অন্যান্য ফসল কেনার জন্য সরকারের বিশাল ক্রয় কর্মসূচি চালায়। এটি কেবল মান্ডির মাধ্যমেই করা হয়। গত রবি মরসুমে, যা এপ্রিল মাসে শেষ হয়েছে, সরকার মাত্র একটি রাজ্যে, পাঞ্জাবে, পঞ্চাশ লক্ষ টন গম সংগ্রহ করেছে। কৃষকরা প্রতি কুইন্টালে ১৮৪০ টাকা দাম পাওয়ার ফলে পরিশ্রমের টাকা ঘরে তুলতে পেরেছিল। রাজ্য সরকারও মোট মূল্যের ৮.৫ শতাংশ মান্ডি কর হিসাবে আদায় করেছে। প্রকৃতপক্ষে পাঞ্জাব রাজ্যটি ম্যান্ডি ট্যাক্সের আয়ের উপর নির্ভর করে, যা জিএসটির বাইরে। যদি ম্যান্ডি এবং এপিএমসি সিস্টেম খর্ব করা হয় বা তা ভেঙে দেওয়া হয় তবে কৃষক যে ন্যূনতম দাম পাবে তার কোনও গ্যারান্টি নেই। কেবলমাত্র সরকার শুধুমাত্র ম্যান্ডির মধ্য দিয়ে ফসল কিনলে কৃষক ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পেয়ে থাকে।

যদিও প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সরকার আশ্বাস দিয়েছেন যে এমএসপি পদ্ধতি অব্যাহত থাকবে, তবে বাস্তবে কী হবে তা স্পষ্ট নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিহারে গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার এক শতাংশও ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে হয়নি। আসলে বিহারে ২০০৬ সালে এপিএমসি ভেঙে দেওয়া একদমই কৃষকদের পক্ষে যায়নি। এর ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে কৃষক ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের অনেক কমে বেসরকারি ক্রেতাদের ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কৃষকদের আশঙ্কা যে একবার এপিএমসি-র আধিপত্য খর্ব হলে বেসরকারি অপারেটর/ব্যবসায়ী/কমিশন এজেন্টরা দাম নির্ধারণ করবে যা তাদের পক্ষে যাবে না।

সরকারি সংগ্রহব্যবস্থা কৃষকদের একটি বড় ভরসা। তা কৃষকের উপযুক্ত দামে ফসল বিক্রি করতে সাহায্য করে। মান্ডি সিস্টেম ভেঙে গেলে কৃষক বেসরকারি ক্রেতাদের বলতে পারবে না যে হয় আমাকে সরকার ঘোষিত এমএসপি-এর সমান বা বেশি দাম দিন অন্যথা আমি নিজের পণ্যটি মাণ্ডি বা এপিএমসিতে বিক্রি করতে যাচ্ছি। কৃষকরা এই মুহূর্তে রাস্তায় নেমেছেন কারণ তারা আশঙ্কা করছেন যে মান্ডি এবং এপিএমসি সিস্টেম খর্ব হলে তারা বিশ বাঁও জলে পড়বেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে বর্তমানে বাসমতির রেট খোলা বাজারে ৩৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ফলে গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সারা দেশ জুড়ে কৃষকদের ‘সাবধানতা অবলম্বন’ করার এবং ‘ভুল তথ্যে’ বিভ্রান্ত না হওয়ার আবেদন করলেও তা খুব কাজে লেগেছে বলা যাবে না। তার জোটসঙ্গীর পদত্যাগের ঘটনায় একথা স্পষ্ট।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...