মুসাফির এ মন

নীলাঞ্জন হাজরা

 

করাচি

আভি গিরানি-এ-শব মে কমি নহি আয়ি
নজাত-এ-দিদাহ্-ও-দিল কি ঘড়ি নহি আয়ি
চলে চলো কে উও মন্‌জ়িল অভি নহি আয়ি
–ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়

বিশুদ্ধ কবিতার প্রাসঙ্গিকতা কখনও ফুরোয় না৷ কাল তার পাঠ বদলে দেয়৷ ইঙ্গিত বদলে দেয়৷ তাকে তামাদি করতে পারে না৷ “রাত্রির জগদ্দল ভার কমেনি তো আজও/ হৃদয়ের, দৃষ্টির মুক্তির দিন নয় আজও/ আরও বহু পথ চলা, সে ঠিকানা আসেনি তো আজও।” এ কবিতার নাম ‘স্বাধীনতার ভোর’৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শিকল ভেঙে দু টুকরো এ উপমহাদেশে যে রক্তাক্ত স্বাধীনতার জন্ম, ‘শব-গজ়িদা’, রাত্রি-দংশিত, সেই মুক্তির ভোরের আহত স্বর এ সব পঙ্‌ক্তি৷ সে মুহূর্তে নিশ্চয়ই তেমনই ছিল তার পাঠ৷ কিন্তু সাতষট্টি বছর পরে তার পাঠ বদলে ফেলার স্পর্ধা করা যায়৷ করা যায় তেমন দিনে যে দিন পুরোদস্তুর ভিসা নিয়ে পাকিস্তানে পা রাখার সুযোগ পান ভারতীয় নাগরিক৷ এমনই ভিসা নিয়ে যার ওপর ছাপ মারা আছে— ‘পোলিস রিপোর্টিং এক্জেম্পটেড’৷ এমনই ভিসা নিয়ে যার ওপর আরও ছাপ মারা আছে— করাচি, মহেঞ্জো দাড়ো, ইসলামাবাদ, লাহোর৷ এবং এমনই ভিসা নিয়ে যার ওপর, কিমাশ্চর্যম, এ-ও ছাপ মারা আছে— ‘পোর্ট অফ এন্ট্রি: করাচি’ / ‘পোর্ট অফ এক্জিট: ওয়াগা’৷ সত্য এর উল্টোটাও৷ অর্থাৎ, সে দিনও হতে পারে কবিতার-পাঠ-বদলে-দেওয়া-তেমনই-স্পর্ধার দিন যে দিন এ রকমই ভারতীয় ভিসা নিয়ে হিন্দুস্তানের মাটিতে পা রাখতে পারেন পাকিস্তানের নাগরিক৷ সৌভাগ্যবান সে দুই নাগরিক উপলব্ধি করতে পারেন কীভাবে বদলে যেতে পারে ‘স্বাধীনতা’ কথাটার পাঠ৷ আর তাই স্বাধীনতার ভোরের আহত কবিতার পাঠও৷

করাচি বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়ে তাই উপলব্ধি করি কী হতভাগ্য পাকিস্তান-ভারতের স্কুলপাঠ্য বইয়ে বন্দি মহেঞ্জো দাড়োর সেই দাড়ি-বুড়ো— যাঁর ঘাড়ে আমাদের পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতার দায়িত্ব৷ সাতষট্টি বছর ধরে যে দায়িত্বকে আমরা করে ফেলেছি ‘গিরানি-এ-শব’, জগদ্দল রাত্রির ভার, যা বুঝি সরে না কিছুতেই৷ কোন দেশের মানুষ তুমি দাদু? উত্তর মেলে না৷ সদত হসন মন্টোর টোবা টেক সিংয়ের সেই উন্মাদ বন্দির মতো তাঁরও জানা নেই এর উত্তর৷ বহমান সিন্ধুনদের স্বাধীনতা মহেঞ্জো দাড়ো-দাদুর নেই৷ টোবা টেক সিংয়ের বিষণ সিংয়ের নেই৷ আমার-আপনার নেই৷ পাঁচ হাজার বছরের স্বাধীনতা কোন অন্ধকার ঘৃণার দংশনে বিষিয়ে গিয়েছে? ইমিগ্রেশন কাউন্টারে দাঁড়িয়েই উত্তরের খোঁজ শুরু করার স্পর্ধা করি৷ প্রশ্ন শুরু করি৷

মহেঞ্জো-দাড়ো-তে পাওয়া সিন্ধুসসভ্যতার আমলে স্টিটাইট পাথরের মূর্তি (ন্যাশনাল মিউজিয়াম করাচি)

ভারত পাকিস্তানের ভিসা আইনের এক-একটা শব্দের ধারালো কাঁটাতার ছুঁয়ে ছুঁয়ে বুঝি আমি কত ভাগ্যবান৷ কেন ভাগ্যবান? কারণ, ভায়া, ভারতীয় তুমি পাকিস্তানে পৌঁছে (কিংবা পাকিস্তানিবাবু ভারতে পৌঁছে) সে শহরের দারোগার কাছে প্রত্যেক দিন সেলাম ঠুকে আসার বাধ্যতা থেকে ছাড় পেয়েছ৷ সে তো কেবল দু দেশের অতি-অতি-অতীব ভাগ্যবানেরাই পেয়ে থাকেন৷ ওই যে ছাপ— ‘পোলিস রিপোর্টিং এক্‌জেম্পটেড’৷ যিনি ছুঁলে ছত্রিশ ঘা, তাঁর কাছে গিয়ে রোজ জি হুজুর বলে আসতে হবে কোন অপরাধে? অপরাধ একটাই— এ দেশের নাগরিক হয়ে ও দেশে পৌঁছে যাওয়া৷ আমরা তা থেকে ছাড় পেয়েছি৷ যেমন ছাড় পেয়েছি আসা-যাওয়ার স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও৷ হপ্তা খানেক পরে লাহোরের পাশে ওয়াগা সীমান্ত হয়ে পাকিস্তান ছাড়ার সময় টুকটুকে ইমিগ্রেশন অফিসারের ভুরু এক লহমা কুঁচকে যায় আমার পাসপোর্টে ভিসার পাতা দেখে৷ মুম্বই থেকে উড়ানে করাচি হয়ে ঢুকেছিলেন না? জি৷ তা হলে ওয়াগা হয়ে বেরোচ্ছেন? ভারতস্থিত পাকিস্তানি দূতাবাস তো তেমন অনুমতিই দিয়েছে৷ সরকারি অতিথি কি না৷ হুম্৷ ফিরে আসা হাসিতে গুলফামে টোল পড়ে৷ আসলে আম পাবলিকের জন্য অন্য ব্যবস্থা৷ সদর দরজা দিয়ে ঢুকে খিড়কি দিয়ে বেরোনোর কোনও উপায় নেই৷ যে পথে ঢুকেছেন সে পথেই বেরিয়ে যান৷

আইনের কাঁটাতার পরতে পরতে৷ পাকিস্তানি বা ভারতীয় নাগরিক একে অপরের দেশে যেতে গেলে গন্তব্য দেশের সরকার বলে দেবে তিনি ঠিক কোন কোন শহরে যেতে পারেন৷ ভিসায় সেগুলির নাম থাকবে কুচকুচে অক্ষরে৷ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানতে পারি এই শহর-বন্দি-ভিসা আইনের কী ভয়ঙ্কর কড়াকড়ি৷ করাচিতে৷ কিন্তু সে কথা পরে, আপাতত পাকিস্তান যেতে পারছি এই উত্তেজনাতেই বুকের মধ্যে ঘোড়দৌড়৷

তেরো বড় অপয়া সংখ্যা৷ কুছ পরোয়া নেই, তাও আমরা তেরো সাংবাদিকের দল মাঝ-ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানমুখী হয়ে গেলাম৷ আমাদের ভিসার ছাপে আশ্বাস ছিল, মহেঞ্জো দাড়ো যাওয়া যাবে৷ সকালে করাচি থেকে উড়ে যাওয়া, বিকেলে উড়ে ফেরা৷ করাচির সব থেকে পরিচিত ঠিকানা, ঠিক আমাদের কংগ্রেসের গান্ধি পরিবারের মতোই পাকিস্তানের আওয়ামি লিগ দলের প্রথম পরিবার ভুট্টো পরিবারের বিপুল এস্টেটের একটি বাড়িতে লাঞ্চের সময় হঠাৎই জানতে পারি, যাওয়া হচ্ছে না৷ কেন? পাকাপোক্ত উত্তর মেলে না৷ ভাসা ভাসা শুনি, তেরো জন সাংবাদিক যুক্ত জনা দুই সরকারি অফিসার যুক্ত জনা চারেক নিরাপত্তারক্ষী— মহেঞ্জো দাড়োর ছোট্ট ফ্লাইটে এতজনের জায়গা হচ্ছে না৷ দিনে মাত্র একটিই৷

আমরা বেপরোয়া— বাস ভাড়া করেই যাব৷ নিজেদের পয়সায়৷ না৷ কেন? অনুমতি নেই৷ কিন্তু এই যে ভিসার ছাপ? ফের কোনও পাকাপোক্ত উত্তর মেলে না৷ কানাঘুষো— ওটা উড়ে যাওয়ার অনুমতি৷ গড়িয়ে যাওয়ার নয়৷ পথে লারকানা অঞ্চল পড়বে, সেটা সিন্ধ্ প্রদেশের— যার রাজধানী করাচি— তার ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’, সেখানে বিভিন্ন ট্রাইবাল গোষ্ঠী সারাক্ষণ একে অপরের সঙ্গে ভয়ঙ্কর যুদ্ধে লিপ্ত৷ বাসে যাচ্ছ, হঠাৎ হাইওয়ের ওপরেই দুদিক থেকে শুরু হয়ে গেল গুলিবর্ষণ৷ হাইওয়ে দখল নিয়ে দুই ট্রাইবাল গোষ্ঠী লড়ছে, মাঝখানে ফেঁসে গেলে তুমি৷ মৃত্যু অবধারিত৷ সরকারি অতিথিদের তো আর এই বিপদ মাথায় নিয়ে যেতে দেওয়া যায় না! ইত্যাদি নানা আগডুম বাগডুম৷ কাজেই ভিসা থাকাই ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা নয়৷ পদে পদে পায়ে শৃঙ্খল৷ এমনকী আমরা যে এত ভাগ্যবান আমাদেরও— আম আদমির কথা তো ওঠেই না৷ না, ভারত বা পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকদের একে অপরের দেশে যাওয়ার কোনও স্বাধীনতা নেই৷ আমরা পরস্পরের সরকারি শত্রু৷

সত্যিই শত্রু? ২০১৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এই ‘শত্রুতার’ হাতে নাতে পরখ করার সুযোগ পেয়েছিলাম৷ সরকারি অতিথি, কাজেই করাচি বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কাউন্টারের জেরা থেকে মুক্তি পেয়ে গেলাম বেশ তাড়াতাড়িই৷ বেশ ম্যাড়মেড়ে এয়ারপোর্ট৷ করাচিকে সাধারণত তুলনা করা হয় আমাদের মুম্বই শহরের সঙ্গে৷ এয়ারপোর্ট দেখে অন্তত তা এক্কেবারে মালুম চলে না৷ বিশেষ করে তখন সবে তৈরি হওয়া মুম্বইয়ের পলকাটা হিরের মতো ঝলমলে নয়া সাজের এয়ার্পোটের সঙ্গে তো নয়ই৷ সেখান থেকেই সোজা আসছি ‘পিয়া’-র উড়ানে৷ পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স৷ যা যদ্দূর মনে আছে পাঁচ ঘণ্টা ডিলেড ছিল, আর যার বিমান-সেবিকা নিজের চাকরিতে ভয়ঙ্কর বিরক্ত৷ ফ্লাইট খালি৷ দেখেশুনে বেছে নিয়ে ইজের ইচ্ছে মতো একটা সিটে বসে পড়লাম৷ কিছুক্ষণ পরে মহাবিরক্তি নিয়ে তিনি একটা বাক্সে ঠান্ডা কী সব খাবার ছুড়ে দিয়ে চলে গেলেন৷ আর তার কিছু পরেই জানালা দিয়ে দেখলাম আরব সাগরের আকাশে খুনোখুনি সূর্যাস্ত৷

করাচির পথে সূর্যাস্ত

করাচি পৌঁছে যখন এয়ারপোর্টের গেট দিয়ে বোরচ্ছি তখন রাত্রি এগারোটা পার হয়ে গিয়েছে৷

বেরিয়েই চোখ ঝলসে গেল৷ কম সে কম এক ডজন টেলিভিশন চ্যানেলের তীব্র স্পটলাইট৷ হাতে হাতে বুম৷ তার থেকেও বেশি সংখ্যক খবরের কাগজের সাংবাদিক৷ আর তাঁদের থেকেও বেশি করাচি প্রেস ক্লাবের প্রতিনিধি৷ প্রত্যেকের হাতে মালা, হাতে গোলাপ৷ সে কী হুড়োহুড়ি, হই হল্লা, চিৎকার চ্যাঁচামেচি৷ পাক্কা আধঘণ্টা লাগল হ্যান্ডশেক আর কোলাকুলি শেষ হতে৷ আর তার পরেই লক্ষ করলাম এই ভিড়ের এক পাশে গত পাঁচ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছেন শুধু আমারই জন্যে, যাঁদের অনায়াসেই বলা যেতে পারে করাচির সাহিত্য-সমাজের হু’জ হু— করাচির সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পত্রিকা ‘আজ’-এর সম্পাদক আজমল কামাল, এই সময়ের পাকিস্তানি উর্দু সাহিত্যের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কবি অফজ়াল আহমদ সৈয়দ, তাঁর স্ত্রী— নিজে জরুরি কবি— তনভির আঞ্জুম, কবি ঔপন্যাসিক গল্পকার আজ়রা আব্বাস, কবি সাংবাদিক আনোয়ার সেন রায় (না একেবারেই বাঙালি নন)৷ ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁরা বসে আছেন বিমান বন্দরে আমাকে স্বাগত জানাবেন বলে৷ কেন? না, পাকিস্তানের সাম্প্রতিক কবিতায় আমার আগ্রহ৷ তাঁরা বসে আছেন, কারণ এয়ারপোর্ট থেকে তাঁরা আমায় নিয়ে যাবেন নির্ধারিত হোটেলে৷ দ্রুত চেক-ইন করেই আমরা ছুটব রাত্রের খানা খেতে৷ কিন্তু ততক্ষণে তো রাত একটা বেজে যাবে? বাজুক না! কোনও তাড়া নেই! এমনই পেয়েছিলাম সেদিন ‘শত্রুতার’ প্রথম আস্বাদ৷ যা অনেকটাই, পুরোটা নয়, অনেকটাই, বজায় ছিল প্রায় সারাটা সফর ধরেই পরবর্তী ছ দিন৷

আজমল আমার হাত ধরে টেনে সবে প্রেস ক্লাবের প্রতিনিধিদের আলিঙ্গন থেকে আর টেলিভিশনের বাড়িয়ে ধরা বুম থেকে মুক্ত করছে, বাধা পড়ল তখনই৷ দলছুট হওয়া চলবে না৷ মালা আর গোলাপের পিছনে অপেক্ষমান অটোমেটিক রাইফেলধারী পুলিশের বেষ্টনী আর তার পিছনে একটা জাপানি মিনিবাস, যার সামনে পিছনে সার সার হুটার লাগানো পুলিশের জিপ৷ দলছুট হওয়া চলবে না৷ এখান থেকে হোটেল, হোটেল থেকে এর এক দফা স্বাগত-অনুষ্ঠান তারপর ডিনার৷ উঠে পড়তে বাধ্য হলাম সেই বাসে৷ পেল্লায় এক পাঁচতারা হোটেলে চেক-ইন করার সময়েই লক্ষ করি সে কবি সাহিত্যিকের দল লবিতে অপেক্ষমান! আর তার পরেই ঠিক করে ফেললাম আর নয়, যথেষ্ট৷ দলের অনেককে ভীষণ অসন্তুষ্ট করে হয়ে গেলাম দলছুট৷

ছুটতে ছুটতে ঘরে গিয়ে স্যুটকেসটা ছুড়ে ফেলে নেমে আসি৷ এর পর আমাদের সংবর্ধনা-পার্টি৷ অসম্ভব৷ দলপতি সুদীপ্ত সেনগুপ্তকে বলি৷ সুদীপ্তদা দীর্ঘদিনের বন্ধু৷ আপত্তি করে না৷ কেবল বলে— চুপচাপ কেটে যাও৷ এরা জানতে পারলে আটকে দেবে৷ আক্ষরিক অর্থেই কেটে যাই৷ একজন তাঁর বড় সেডান গাড়ি নিয়ে লবির সামনে হাজির হন৷ তিনজন আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ঝড়ের গতিতে গাড়ির মধ্যে পাচার করে দেন৷ হোটেল থেকে বেরোনোর মুখে গার্ড গাড়ি আটকায়— স্যার, কাঁহা গয়েথে? ঠিক মনে নেই কে উত্তর দিলেন, কিন্তু বেশ ঝাঁঝের সঙ্গেই দিলেন— আরে তুমকো মালুম নেহি, হিন্দ সে আখবরওয়ালে আয়েঁ হ্যায়৷ হমলোগ করাচি প্রেস ক্লাব সে হ্যায়ঁ! আমি তখন পিছনের সিটে সম্পূর্ণ মুখ ঢেকে গাড়ির অন্ধকারের মধ্যেই একটা উর্দু কাগজ পড়ছি৷ দুঁদে ডিটেকটিভ হলে, ওইখানেই ধরা পড়ে যেতাম৷ গার্ড একটা লম্বা সেলাম ঠুকে ছেড়ে দিল৷ করাচি প্রেস ক্লাবের দাপটই আলাদা, সেটা বুঝেছিলাম পরে৷

আমরা কোথা দিয়ে কোথায় চললাম কে জানে৷ শুনশান রাস্তা৷ ঝকঝকে তকতকে৷ হলদেটে আলোয় ধোয়া৷ অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা জায়গায় এসে গাড়ি পার্ক করে দেওয়া হল৷ তখন রাত একটা তো বটেই৷ লোকে লোকারণ্য৷ হৈ চৈ, গাড়ির হর্ন, দোকানের ছোকরাদের খদ্দের-ধরা চিৎকার৷ সে এক মহামেলা৷ আলোয় আলো৷ কিন্তু কান বা চোখ নয়, সেখানে পৌঁছনো মাত্র আসল হামলাটা হল নাকের ওপর৷ দূষণ যে এত সুগন্ধী হতে পারে তা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি আগে৷ ধোঁয়া মানেই তো বায়ু দূষণ৷ কিন্তু সে ধোঁয়া যখন উঠতে থাকে শত শত সার সার তন্দুরে পুড়তে থাকা হরেক কিসিমের কাবাব থেকে, আর বিরাট বিরাট পিতলের হাঁড়ির মধ্যে থেকে তখন রসনা ও নাসা যেমন ব্যাকুল হয়ে ওঠে, সে ব্যাকুলতা একমাত্র বড়ে গুলাম আলির ঠুংরিতেই পাওয়া যেতে পারে৷

করাচির ফুড-স্ট্রিট, খয়াবান-ই-সাদি। রাত্রি বারোটার পর

প্রায় দু কিলোমিটার লম্বা ফুড স্ট্রিট, যাকে আমরা ‘খাইবার পাস্’ বলে বাংলা করতেই পারি৷ যদিও তার সরকারি নাম বোধ হয় খয়াবান-এ-সাদি৷ বা সাদি সরণি৷ এ সাদি ইরানের বিখ্যাত ফারসি কবি৷ এ অঞ্চলের নাম ক্লিফ্টন৷ মূল বিরাট চওড়া রাস্তার পাশে একটা সার্ভিস লেন৷ তারও পাশে চওড়া ফুটপাথ৷ তার পাশে সারসার রেস্তোরাঁ৷ কাবাব, বিরিয়ানি, নেহারি, ডাল-গোস্ত, নান, পরাঠে, এ সব তো আছেই, পাশাপাশি আছে চিনা, ইতালিয়ান, কন্টিনেন্টাল রেস্তোরাঁও৷ মায় ম্যাকডোনাল্ড পর্যন্ত৷ রেস্তোরাঁগুলোর মধ্যে টেবিলে বসে খাবার ব্যবস্থাও আছে কিন্তু আসল ব্যবস্থাটা দোকানের বাইরে, সামনের ফুটপাথে৷ সার সার পুরোদস্তুর পালঙ্ক৷ পালঙ্কের ওপর গদি আর ছড়ানো ছিটানো তাকিয়া৷ আর সেই গদির ওপর জাঁকিয়ে বসে দম-গোশ্ত বা নেহারি সাবড়ে যাচ্ছে মা-বাপ-ভাই-বোন-বেয়াই-বুনাই-জগাই-মাধাই৷ খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে পরের দফার জন্য জিরিয়ে নেওয়া৷ একদিকে উষ্ণ ধোঁয়া আর এক দিকে কাছেই আরব সাগর থেকে ভেসে আসা সিরসিরে মাঝরাতের বাতাস পিঠে-বুকে নিয়ে রাত দেড়টা নাগাদ আমরা দুনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক শহরে এক স্বর্গীয় আহারে বসে পড়ি৷ কাউকে দেখে এক পলকের জন্যও মনে হয় না, এই বুঝি ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে রক্তে ভেসে গেল চারপাশ! তা কিন্তু যেতেই পারত৷ মাঝেমাঝেই যায়৷ তবু সন্ত্রাসকে কিছুতেই জিতে যেতে দেবে না করাচির মানুষ, নিজের চোখে তা দেখে এসেছি৷

যাঁদের সঙ্গে এসেছি এই ডিনারে, তাঁরা প্রত্যেকেই একদিকে রাষ্ট্রের রক্তচোখ অন্য দিকে ভয়ঙ্কর উগ্র মুসলমান সন্ত্রাসবাদীদের মুখে তুড়ি মেরে লেখালিখি করেন৷ তাই তাঁদের কবিতার জাতই আলাদা৷ কিন্তু এই দুনিয়ার সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হয়ে গেলাম আমি? বহু বহু বছর আগে ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়-এর কবিতা পড়ার জন্যই প্রধানত উর্দু শিখেছিলাম কলেজ জীবনের শেষে৷ তার পর ২০০০ সাল নাগাদ মনে হল, আচ্ছা আজকের দিনের পাকিস্তানের কবিরা কীরকম লেখালিখি করছেন? নেটে খোঁজ করতে করতে কয়েকজন লেখকের কয়েকটি কবিতা পেলাম৷ পড়ে আমি স্তম্ভিত৷ কিন্তু কীভাবে তার খোঁজ পাব?

ফের ইন্টারনেট ঘাঁটতে ঘাঁটতেই মিলে গেল এক ভদ্রলোকের ই-মেল আইডি— আজমল কামাল৷ করাচির বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা ‘আজ’-এর মালিক ও সম্পাদক৷ নিজের আর্জি জানিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়ে দিলাম৷ আর তার শেষে লিখলাম, ভালো কথা, আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শহরের মানুষ৷ আপনি কি তাঁর লেখা-পত্তর কিছু পড়েছেন? ঝটিতি উত্তর এল৷ প্রথমে আমাকে আধুনিক পাকিস্তানি উর্দু কবিদের বহু বই পাঠানোর প্রতিশ্রুতি৷ শেষে একলাইন— ‘নীলাঞ্জন, আপনি জানতে চেয়েছেন আমি রবীন্দ্রনাথের কোনও লেখা পড়েছি কি না৷ আপনি নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছেন৷ তাঁর লেখা না পড়লে দক্ষিণ এশিয়ায় কোনও মানুষ কি নিজেকে শিক্ষিত বলে দাবি করতে পারে? বিশেষ করে তাঁর Crisis in civilization যদি না পড়া থাকে?’ বুঝলাম তিনি এমন এক প্রশ্ন, এমন এক মাপকাঠি ছুড়ে দিয়েছেন যাতে প্রত্যহ যে সব বাঙালির সঙ্গে ওঠা বসা করি, তাঁদের অনেকেরই শিক্ষাদীক্ষা নিয়েই সন্দেহ জাগার আশঙ্কা প্রবল৷

আজমল কামাল। উত্তরাখণ্ডের আউলি-র পথে

সেই বন্ধুত্ব আজ ‘আপ’ থেকে ‘তুম’-এ নেমে এসেছে৷ আর আজমলের মাধ্যমেই পেয়ে গিয়েছি বিশেষ করে অফজ়াল আহমদ সৈয়দ, সরোয়ত হুসেন, সয়ীদউদ্দিন আর আজ়রা আব্বাসের মতো যুগান্তকারী কবির কবিতা৷ সে বিষয়ে কোনও এক সময় নিশ্চয়ই আসব, কিন্তু এখন করাচির সেই আশ্চর্য ফুড স্ট্রিটের কথা৷ সেই গমগমে রাতে, রাত্তির আড়াইটে পর্যন্ত চলল আমাদের আড্ডা আর খাওয়াদাওয়া৷ কী খেয়েছিলাম? সিম্পল খানা৷ গোশ্ত নেহারি৷ ডাল গোশ্ত৷ আর নান৷

দুনিয়াতে যত খাবার খেয়েছি, তার মধ্যে পাঁচ সেরা খাবারের তালিকায় আমি চোখ বুজে রাখব বিফ নেহারি৷ অবশ্য তা মাটন, মানে ভেড়ার মাংসেরও হয়৷ তবে নেহারির মাংস যে মুখে দিলে গলে যায় কিন্তু গলে না, ঠিক ততটুকুই চেবানোর জন্য বাকি থাকে যাতে সেই চেবানোর প্রক্রিয়ায় তার অনির্বচনীয় সুবাস চুঁইয়ে চুঁইয়ে নাক, মস্তিস্ক দিয়ে প্রতিটি ইন্দ্রিয়ে ছড়িয়ে পড়ে৷ বিভিন্ন শহরে যে নেহারি খেয়েছি, তার মধ্যে করাচির সেই বোট বেসিন ফুড স্ট্রিটের নেহারি এক থেকে ১০ নম্বরে তার পর অন্যরা৷ ১১ নম্বরে আমি পাটনার নেহারিকে রাখব৷ ১২ নম্বর নিয়ে দিল্লির জামা মসজিদের উল্টোদিকের কয়েকটি ছোট দোকান আর লখনৌয়ের আমিনাবাদের কয়েকটি দোকানের মধ্যে মারামারি হবে৷ কলকাতায় রফি আহমদ কিদওয়াই স্ট্রিটে ওয়েলেসলি হোটেলের উল্টোদিকে একটা ছোট্ট দোকানের গোশ্ত নেহারি বেশ ভালোই৷ তবে বেলা দশটার পরে মেলে না৷

কী এই আশ্চর্য খানা? গরুর বা ভেড়ার পাছার মাংসের টুকরো, যাকে পরিভাষায় বলে ‘শ্যাঙ্ক্স্’ তার তরল স্ট্যু৷ যা মূলত খাওয়া হয় ভোরবেলা৷ শীতকালে৷ কিন্তু করাচি বা পাটনায় আমি রাতবিরেতেও খেয়েছি অসাধারণ নেহারি৷ তবে নেহারি ভোরবেলাতেই খাওয়ার কথা৷ আসলে উর্দুতে নেহারি বানানটি দেখলে দেখা যাবে ‘নুন’-এ মানে ‘ন’য়ের সঙ্গে কোনও ‘ই’ বা ‘এ’ নেই৷ উচ্চারণ করা যেতেই পারে ‘নহারি’৷ আসলে কথাটা এসেছে আরবি শব্দ ‘নহার’ থেকে, যার মানে ভোর৷ আর এই ভোরবেলাতেই পেট পুরে খাওয়ানো হত নেহারি৷

খাওয়ানো হত? ইয়েস, খেতে দেওয়া হত৷ কাদের? দিল্লি আর লখনওয়ের রাজমিস্তিরিদের৷ কাহিনিটা এরকম— তখন মুঘল বাদশাদের দিন শেষ৷ অওধ বা লখনওয়ের রাজত্বেরও টিমটিমে অবস্থা৷ মানে ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়-তৃতীয় দশক— ১৮২০-৩০, এরকম সময়৷ কোষাগারের হাঁড়ির হাল, কিন্তু কী দিল্লি কী লখনও বাদশার শরীরে তো রাজরক্ত বইছে, প্রাসাদ বানানোর শখ যে সেই রক্তে৷ কিন্তু তাতে তো বিপুল খরচ৷ আজকের মতো মেশিনপত্তর তো ছিল না৷ হাজারে হাজারে শ্রমিক লাগত৷ অনেক মাথা চুলকে একটা উপায় বার করা গেল৷ শ্রমিকদের টাকা দেওয়ার বদলে, পেট পুরে খেতে দাও৷ সেখানেও একটা চালাকি— ব্যাটাদের কাজে যোগ দেওয়ার আগেই এমন একটা খাবার খাইয়ে দাও যাতে সারা দিন আর কিছু খেতে না চায়। অথচ খেতে উপাদেয়। বাদশার হেঁসেলের বাঘা বাঘা শেফদের পরামর্শে তৈরি হল নেহারি৷ তাতে যে পরিমাণ ক্যালরি থাকে তা ‘বার্ন’ করতেই শ্রমিকদের সারা দিন লেগে যায়৷ পেটে খিদে নেই৷ গায়ে তাকত৷ শ্রমিক খুশ৷ বাদশাও খুশ৷ আজও দিল্লি-লাহোর-করাচির বহু অঞ্চলে মুসলমান রাজমিস্তিরিরা কাজে লাগার আগে এক বিশাল বাটি নেহারি খেয়ে নেন৷

এহেন ‘সাবঅলটার্ন’ খানাই কালে হয়ে দাঁড়াল বড়লোকেদের শখের নেহারি৷ সে নেহারির মজা এখানেই যে তার মধ্যে একটা মৌলিক সারল্য আছে৷ গোশ্তের টুকরো তেলে ভেজে নিয়ে জিরে বাটা, ধনে গুঁড়ো, রসুন বাটা, অল্প গরম মশলায় তা সাঁতলে হাঁড়ির মধ্যে প্রচুর পরিমাণ জল দিয়ে হাঁড়ির মুখ ময়দা দিয়ে সেঁটে দিয়ে অন্তত আট ঘণ্টা সিদ্ধ৷ মানে সারা রাত ধরে৷ তার পরে বিশাল বাটিতে সেই নরম ধূমায়িত মাংসের ঝোল অল্প পেঁয়াজ ভাজা, সরু সরু আদার কুচি ছড়িয়ে সামান্য লেবুর রস নিংড়ে গরম নানের সঙ্গে পরিবেশন৷ ওঃ! সে পরমান্ন৷

সেই পরমান্ন খেয়ে আমি জেদ ধরি কাল সকালে ফের খাওয়া যায় না? আলবৎ যায়, জানালেন সকলে৷ ঠিক হল ফের সেই সরকারি আতিথেয়তার ঘেরাটোপ থেকে পালাতে হবে৷ কাজেই রাত তিনটে নাগাদ আমাকে হোটেলে নামিয়ে দেওয়ার পর ঠিক হল, কাল ভোরে (মানে আজই) সাড়ে চারটে নাগাদ আজমল তার গাড়ি নিয়ে আসবে৷ আমায় তুলতে৷

 

(আবার আগামী সংখ্যায়)


মুসাফির এ মন-এর সবগুলি পর্বের জন্য ডিসট্যান্ট সিগনাল দেখুন

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...