কলকাতা, নয়… — ৪র্থ পর্ব

অশোককুমার মুখোপাধ্যায়

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

খাটাল কাহিনি

পুরনো কলকাতার অনেক পাড়ার মতোই স্কট লেনেও খাটাল ছিল। তবে এ-পাড়ার খাটাল নিয়ে লিখতে বসলে একটা মাঝারি গোছের বই হয়ে যায়। খাটাল মানে তো শুধু গরু আর দুধ নয়, দুধ আর দুধে জল মেশানো নয়, বিচালি কি জাবর কাটার গল্প নয়, অথবা শুধু গোময়-ঘুঁটে কি গোমূত্রের কারবার নয়— এ গোয়ালাদের গল্পও বটে।

বিহার থেকে জমি হারিয়ে ধান্দার টানে কলকাতার চাঁপাতলায় আস্তানা গেড়েছিলেন গোটা দশেক গোয়ালা। সত্যি বলতে হলে, নিজেদের চওড়া গাড়ি রাখবার জায়গায় খাটাল চালাবার উদ্দেশ্য এদেরকে জড়ো করেছিলেন পাড়ার পয়সাওলা সেন বংশের কেউ। খাটালের মধ্যেই ওদের শোয়াবসা। তবে কয়েকজন খাটিয়া পেতে রাস্তায়। হরিণঘাটার দুধ সত্ত্বেও, চাঁপাতলার কিছু খুঁতখুঁতে পরিবার (যার মধ্যেও আমরাও) এ-খাটালের দুধ নিত। আমাদের বাড়িতে এই দুধ ঢোকবার বড় কারণ যদি হয় এক মায়ের তার দুই পিলেপটকা ছেলেকে দুধে-ভাতে রাখবার ইচ্ছে, মেজ-ছোট দুটি কারণই হল, খাটালটি এক-ডাকের নাগালে— আমাদের বাড়িতে কেউ মুখে রুমালচাপা না-দিয়ে হাঁচলে খাটাল থেকে শোনা যায়। আমরাও ওদের হাম্বা শুনতে পাই। ওদের আর আমাদের মাঝে শুধু একটি চাতাল-ওলা লাল বাড়ির ফাঁক।

মহিলা-ছুট এই বলিষ্ঠ গোয়ালা বাহিনীর নেতা রঘুনন্দন। আমাদের বাড়িতে প্রতি বিকেলে যার আসা-যাওয়া। বাড়ি-বাড়ি দুধ বিক্রি করা ছাড়া কিছু বিনি পয়সার কাজ থাকত গোয়ালাদের— পাড়ায় দুজনের গাড়ি চালু না হলে (মাত্র দু-জন গাড়িওলাই ছিলেন, একজন সেন বংশের), সওয়ারি বোঝাই বাহনটিকে ধাক্কা মারা। নির্জন দুপুরে কোনও ঘোড়ার নাল পালটাবার সময়, চতুষ্পদটি যাতে কোনও বেয়াদবি না করে, দেখা। ভরদুপুরে সব্জিবোঝাই ঠেলাগাড়ি যেত বৈঠকখানা বাজার উদ্দেশে। যে সার্কাসটি প্রায়ই দেখা যেত— সব্জিবস্তার নড়াচড়াতে ভারসাম্যের বদল, ফলে ঠেলাগাড়ির সামনের দিকটি অকস্মাৎ আকাশের দিকে যেতে চাইছে। লুঙ্গি-পরা চালক ভাববার সময় না পাওয়াতে, সামনের হাতল আর ঠেলার শরীরের মাঝে যে চৌখুপি, তার মধ্যে বেদম ভয় পাওয়া মুখে শূন্যে ঝুলছে। পেছনের দু-জন (কখনও একজন) ঠেলনদার অবাক। এর পরে হয়ত সম্বিৎ ফিরলে তারা দড়ি টানাটানি করে ওজন বিতরণের অঙ্কটি ঠিক করবার চেষ্টা করবে। আপাতত, তাদের মাথা ফাঁকা। এই সময়েই রঘুনন্দন বাহিনী হাত বাড়িয়ে দিত।

আরও একটি কাজে ডাকা হত খাটালবাসীদের— চোর ঠ্যাঙানো। অবশ্য চোর-গুণ্ডা শায়েস্তা করার ব্যাপারে আমার পঁয়তাল্লিশ ইঞ্চি ছাতির (পঞ্চান্ন নয় কিন্তু) বাবাও পাড়ার সেজদা। আমাদের বাড়িতে যে দুই চোর গুণ্ডা এসেছিল, তাদেরকেও হুঙ্কার সহযোগে খিল খুলে পিটিয়েছিলেন তিনিই। রাত তখন দুটো। সব কিছু হয়ে যাওয়ার পর দোতলা-তিনতলা থেকে নেমে এলেন দুই বাসিন্দা।

–কী হয়েছে দেবুবাবু?
–দেখছেন না হাতে কী, এই দিয়ে গরাদ বেঁকিয়ে ঢোকবার তাল করছিল, এই দেখুন গরাদ ব্যাঁকা.., মাটিতে পড়ে থাকা একটি লোহার রড দেখিয়ে বাবা বোঝাতে তৎপর।

একজন বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিও তো আওয়াজ পাচ্ছিলাম…’

–ও! পাচ্ছিলেন? তাহলে কী করছিলেন এতক্ষণ…
–আমি ওপর থেকে টুকটুক করে কাঁইবিচি ফেলছিলাম ওদের মাথায়, যদি ঘাবড়ে ঘিয়ে পালায়—

‘তেঁতুলের বিচি ফেলে ভয় দেখাচ্ছিলেন!…এই চোর গুণ্ডা দুটোকে…’, যে কোনও সুস্থ লোকের মতো বাবাও হইহই করে হেসে উঠলেন। দোতলার বাসিন্দা বেশ ভদ্রলোক। বাঘা হস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্টের গলায় হাঁক পেড়ে রঘুনন্দনকে ঘুম থেকে ডেকে আনলেন। চোরকে থানায় নিয়ে যেতে হবে যে, ভদ্রলোকেরা তো আর চোরকে স্পর্শ করে না! গরু বাঁধার দড়ি দিয়ে বাঁধা হল দুই অপরাধী। রঘুনন্দনই দড়ি টানতে-টানতে নিয়ে চলল থানায়। ওপরের বাসিন্দা দু-জন গেলেন ওর সঙ্গে। বাবা যাননি, কারণ ওঁর পেনাল কোড অনুযায়ী শাস্তি তো দেওয়া হয়েই গেছে, আবার কেন?

রঘুনন্দন বা তার কোনও ভাইয়াকে মাঝরাতে ঘুম ভাঙানো বেশ শক্ত। ওরা সারাদিন খাটছে কিন্তু মাঝরাতে প্রায় অচেতন অবস্থা, সহজে ঘুম ভাঙবে না। এই নিয়েই তর্ক হয়েছিল দু-দলের। যাদের সদ্যই গোঁফদাড়ি গজিয়েছে। তর্ক থেকে আরও তর্ক, তারপর বাজি। যারা বলেছিল ঘুম ভাঙবে না, সেই ছজন কাঁধ পালটাপালটি করতে-করতে রঘুনন্দনের দেশোয়ালি ভাই লছমনকে (যাদের জিভ মনে-প্রাণে বাঙালি, তারা বলত লক্ষ্মণ) খাটিয়া সমেত রেখে এল গোলদিঘির পাড়ে। রাস্তায় কেউ হরিধ্বনি করেছিল কিনা জানা নেই। করে থাকলে নিশ্চিত ভুল করে করেনি। যথারীতি লছমনের ঘুম ভাঙেনি, কিন্তু সকালে ঘুম ভেঙে পাশেই মধুবাবুকা তালাও দেখে (মধ্য-কলকাতার বয়স্করা মনে করবার চেষ্টা করুন, ষাট-ছেষট্টির অনেক চামড়া ভাঁজ খাওয়া রিকশাওলা কলেজ-স্কোয়ারকে মধুবাবুকা তালাও আর ডাফরিন হাসপাতালকে জেনানা হসপিট্যাল বলতেন) সে বিপুল ভয় পেয়ে গিয়েছিল। যে তিনজন বাজিতে হেরে গেল তারা গোলদিঘি যাত্রীদের ঢাকা সিদ্ধেশ্বরী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে নিয়ে গিয়ে ঢাকাই পরোটা খাইয়েছিল— চারটে ঢাকাই ন জনে ভাগ করে খাওয়া!

গোয়ালাদের সাদা-কালো চরিত্রের পাশাপাশি পাড়ায় আধ ডজন রঙিন চরিত্রও ছিল। যাদের একজন বিনয় ভৌমিক, আমরা দুভাই বিনয়কাকু বলতাম। বিনয়কাকু বাবার বন্ধু, আশুকাকুরও। বাবা আর কাকুর মাঝামাঝি ওর বয়েস। ফলে, বাবাকে বলত সেজদা, কাকুকে আশু। কাকুই দেখিয়েছিল, ‘দ্যাখ্‌, দ্যাখ্‌ হাঁটার সময়ে বিনয়দাকে পাশ থেকে দেখলে ঠিক জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো লাগে। হা-হা…’ আজও অক্ষর পড়তে বা লিখতে, কখনও, বিনয়কাকুকে মনে পড়ে।

বিনয়কাকু ঘোর কমিউনিস্ট। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি। চামড়ার রঙ হলুদ ঘেঁষা। চিন-পন্থী ছিল বলেই বোধহয় মুখের আদলেও চিনে-চিনে ভাব! বাষট্টি সালে ভারত-চিন যুদ্ধের সময়ে এক বছর জেলে কাটিয়েছে— জ্যোতি বসু, উৎপল দত্তের সঙ্গে। ইংরিজিতে এমএ। আইন পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি। হিন্দিতেও কোবিদ না কী যেন। জার্মান ফ্রেঞ্চ চাইনিজ তিনটে ভাষাতেই পণ্ডিত। আবার লাইব্রেরি সায়েন্সেও ডিপ্লোমা করেছিল। তবু ঠিক কী যে করত বিনয়কাকু অনেকদিন অবধি বুঝিনি। লাল পতাকার মিছিল বেরুলে দেখতাম বিনয়কাকু শ্লোগান দিচ্ছে, অন্যরা সঙ্গত করছে।

পুজোর প্যান্ডেলে নাটক হলে বিনয়কাকু পরিচালক থেকে শিল্প নির্দেশক থেকে অধিকারী সব কিছু। জানালায় উঁকি মেরে মাঝে-মধ্যে দুয়েকটি ইংরেজি শব্দও শিখিয়ে দিয়ে যায়। শুনশান গরমের দুপুরে বাংলা থেকে ইংরেজি ট্রানস্লেশন করতে কানের গোড়া থেকে শিরদাঁড়া সর্বত্র ঘাম গড়াচ্ছে, কী করা যায়? ঠিকঠাক না হলে সন্ধেবেলায় খড়মপেটা। ঠাকুর আমাদের কথা শুনতেন। বিনয়কাকু রাস্তায়, জানালার সামনে। হাত নেড়ে ডাকতেই জানালার গরাদে মুখ রেখে বাংলাটা একবার দেখে নিত, তারপর আমার অনুবাদ। যে-যে জায়গা দুর্বল এবং ফাঁক, সহজ ইংরেজি শব্দ বলে বুঝিয়ে দিত। কথার সঙ্গে ভেসে আসত জর্দা পানের গন্ধ। চুপচাপ দেখিয়ে আবার রাস্তার মোড়ে মিলিয়ে যেত।

বাবার অবশ্য সন্দেহ হত ঠিকই।

–নিজে করেছিস?

মাথাটা যদিও হ্যাঁ বলার মতোই নাড়াতাম। কিন্তু ততটা জোর থাকত না নিশ্চয়ই। অতএব দণ্ডমুণ্ডের কর্তার সন্দেহ ঘনীভূত।

–কে? বিনয় এসেছিল?

এরপর তো হ্যাঁ বলা ছাড়া উপায় নেই। বিনয়কাকুর নাম শুনলে বাবা নরম। গণনাট্য সঙ্ঘের আমলে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে পাওয়া লাল তারা খোদাই করা ব্যাজ, যা আমাদের বাড়িতে বহুদিন যত্নে রাখা ছিল, বিনয়কাকু দেখতে পেয়ে চাইল। বাবা বললেন, ‘তুমি নেবে…?’, দশ সেকেণ্ড বিরতি, ‘…নাও।’ এইটুকু বোঝবার মতো বুদ্ধি তখন হয়েছে যে, বাবা তাঁর একটা পাঁজর দান করে দিলেন পাড়াতুতো ভাইটিকে।

পঁচিশে বৈশাখে অভিনয় প্রতিযোগিতা। অনেক পাড়া যোগ দিয়েছে। আমাদের পাড়াও নাম লেখাল। কে পরিচালনা, মহলা দেওয়ানো এইসব করবে? কেন… বিনয়দা। বিনয়কাকুর বকুনি খেয়ে, ভালোবাসা পেয়ে ছেলেরা রবীন্দ্রনাথের বিনি পয়সার ভোজের মহলা দিল অনেকদিন ধরে। শেষ সপ্তাহে তো সকাল-সন্ধে রিহার্সাল। নাটক হবার তিনদিন আগে চিঠি পেল বিনয়কাকু— বিশ্বভারতীতে চাকরির ইন্টারভিউ। নাটকের দিন যেতে হবে বোলপুর-শান্তিনিকেতন। ছেলেদের মাথায় হাত। বিনয়দা চলে গেলে নাটক হবে কী করে? গভীর সমস্যা। খুব সহজে, নুন-মাখানো আমলকি চুষতে-চুষতে আমাদের অনুবাদ শেখানোর মতো, সমস্যার সমাধান করে দিল বিনয়কাকু।

–দূর দূর চাকরি তো অনেক পাব, নাটকের এমন প্রতিযোগিতা তো রোজ-রোজ হবে না…

বিনয়কাকু গেল না বিশ্বভারতী। পাড়ার ছেলেরা বিনি পয়সার ভোজ করে পুরস্কার জিতেছিল সেবার।

(ক্রমশ)


সমস্ত পর্বের জন্য ক্লিক করুন: কলকাতা, নয়… – অশোককুমার মুখোপাধ্যায়

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...