বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
নোটন নোটন পায়রাগুলি
১
জীবনে কিছু কিছু দিন বিশেষ। প্রতিটা মুহূর্ত তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে মন চায়। প্রতিটা ছোট ছোট পদক্ষেপে আনন্দ উঠলে ওঠে। অতি সাধারণ দৈনন্দিন খুঁটিনাটিতেও অফুরান প্রাণের সঞ্চার। মনে হয় এই দিনটার একটা মুহূর্তও কোনওদিন ভোলা যাবে না।
হীরকের জীবনে আজ সেইরকম একটা সোনাঝরা দিন।
গত দু বছর, হয়তো গোটা চার বছরই। সব সময় মনে একটাইপ্রশ্ন, পারবে তো?
নিজের মনে না হলে বাবা মনে করিয়েছে। সদ্য পাকধরা চুলে আঙুল চালিয়ে বিমল বলেছে, দেখি তো চ্যাটার্জী সাহেবদের, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কেমন টপাটপ উপরে উঠে যায় সবাই। পারবি, তুই পারবি। আমি জানি। রেজাল্ট তো খারাপ না তোর। শুধু অধ্যাবসায়টা ধরে রাখতে হবে। আমাদের তো ওইটাই সম্বল।
মা কথাটা তুলেছে অন্যভাবে। ভাতের থালায় ডাল ঢালতে ঢালতে মনে করিয়েছে, তোদের দিকে তাকিয়ে সংসারটা ধরে রেখেছি হীরু। তোর বাবা আর কদিন এই সংসারটা একা টানতে পারব বল তো? তোর উপরেই ভরসা। এরপর চিনুটাও আছে। তুই দাঁড়িয়ে গেলে, ব্যস। আমার আর কী চিন্তা।
টিচাররা স্কুলের মানসম্মানের কথা বলেছে। মনে করিয়েছে স্কুল ফাইনালে কী করেছ সেটা ভেবে নিজেকে মাথায় তুলে নেচো না। দেখেছ তো শান্তায়নকে। Complaceny brings downfall.
ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই কথা। কে কোন কোচিং যাচ্ছে, ব্রিলিয়ান্ট আর ওঅ্যাইজি ফাইল কতগুলো সলভ করেছে, জয়েন্ট টার্গেট করবে না শুধু আইআইটি এইসব। প্রতিযোগিতায় নাবার একটা উত্তেজনা আছে। নেশা।
এই সব কিছুর মধ্যে জীবনটা যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল। কিংবা দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল দরজার বাইরে। গল্পের বইরা তাকে। ছবির খাতায় একটা আঁচড় পড়েনি। আগে একটা হিল্লে হোক, তারপরে আবার ক্রিকেট, ফুটবল কিংবা যৌবনের অফুরান হাতছানি। লক্ষ্য শুধু মাছের চোখ।
সেসব এখন অতীত। অন্তত হীরকের জন্য। আজ চলেছে যাদবপুর। ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অ্যাডমিশান হয়ে গেছে। হস্টেলে জায়গা পেয়ে গেছে। এবার লোটাকম্বল নিয়ে পৌঁছানো। তার জীবনের পথ তৈরি। আর পিছলানোর কোনও সম্ভাবনা নেই। এক্সপেক্টেশনের চাপ নেই। যে কথাটা মনের মধ্যে বুগবুগি কাটছে সেটা হল বাড়ির কোনও শাসন নেই। সে এবার পুরোপুরি স্বাধীন।
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় নীলিমা হীরকের মাথায় ঠাকুরের ফুল ছুঁইয়ে এই কথাটাই বলেছে, সাবধানে থাকিস হীরু। একা থাকবি, ভেবেই আমার বুক কাঁপছে।
–আরও পাঁচশো ছেলে থাকবে মা। হীরক মনে করিয়েছে।
–সেটাই তো আরও ভয়। অন্যের কথায় যেরকম নেচে উঠিস। একা থাকলে কোথাও ভয়টা কমত।
খুশির হাসি গলায় ছলকাল। ঠিকঠাক ভেবে বলো তো মা। আমি একা থাকলে ভয় না অনেকের সঙ্গে থাকলে বেশি চিন্তা?
রূপা পিছন থেকে ফুট কেটেছে, কলকাতার মেয়েরা দুর্গাপুরের মত ল্যাবা নয় রে হীরু, যা করবি ভেবেচিন্তে। এক হাটে কিনে আরেক হাটে বেচে দেবে।
–দিদি, আমি কি বাজারের আলু কুমড়ো যে আমাকে কেনাবেচা করবে লোকে?
–ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিস, এখন তো তোর অনেক ডিম্যান্ড।
–এখনও একটা ক্লাস করলাম না, কীভাবে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেলাম?
–ঢোকাটাই আসল, হয়ে তো যাবি। হাত উলটে নির্বিকার গলা রূপার।
–যদি না বিপথে চলে যায়। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বিমল মনে করিয়ে দিল।
–তুই কিছু করলি না, কিন্তু আর কেউ করল। তাতেও ক্ষতি হতে পারে। কলকাতা এত বড় শহর, রাস্তাঘাটে কতরকমের গণ্ডগোল হয় রেডিওতে শুনি। ভয়ে আমার বুক কাঁপে। নীলিমা আনন্দ আর দুঃখের মিশ্র আবেগে কেঁদে ফেলল।
অন্যদিন হলে হীরু এত উপদেশে রেগে যেত। আজ জেলখানার দরজার বাইরে পা রাখার উত্তেজনা। সেটাই মুখর হল।
আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পথের বাধা
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।
–ওইটাই, ওইটাই তো ভয়। এই বয়সে আবেগ এত বেশি। সেই জন্যেই সাবধান করতে চাই হীরু। আর যা করিস, কর। কিন্তু রাজনীতিটা এড়িয়ে চলিস বাবা। বিমল হীরকের মাথায় হাত ছুঁইয়ে বলল, ওতে কারুর লাভ হয় না। দেখলাম তো কতগুলো তাজা প্রাণ দেশ উদ্ধার করতে গিয়ে শেষ হয়ে গেল। তোদের যাদবপুরটা আবার নকশালদের খোদ আড্ডা ছিল। একটু সামলে থাকিস।
বাবার সব কথার মধ্যে তোদের যাদবপুরটা খুব মনে ধরল হীরুর। এখনও শুধু কাউন্সেলিং-এর জন্য গেছিল। কি বিশাল জায়গা জুড়ে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি। এটা এখন তার। সে অর্জন করেছে। নিজের চেষ্টায়, পরিশ্রমে, বাবার ভাষায় অধ্যাবসায়ে। এই আনন্দটা বুকে নিয়ে বাড়ির চৌকাঠ ডিঙ্গাল হীরক।
কাউন্সেলিং-এর দিন বাবা গেছিল সঙ্গে। আজকেও যেতে চেয়েছিল। কিন্তু হীরক একদম বেঁকে বসেছে। দেখো বাবা, হস্টেলে যাব। বাবার হাত ধরে ঢুকলে আমাকে আরও বেশি র্যাগিং করবে। তুমি সেইটা চাও?
কোন বাবা মা সেটা চায়? বিমল আর নীলিমা এই ভয়েই তো মরছে। শুনেছে হস্টেলে নতুন ছেলেদের উপর নানারকম অত্যাচার হয়। ছেলেকে কিছু বলতে পারে না। বিমলের অগত্যার গতি চ্যাটার্জীসাহেব। উনি অবশ্য হেসে উড়িয়ে দিলেন। ওসব একটু আধটু হয়। না হলে পরে ওদেরই খারাপ লাগবে, বলার মত কোনও গল্প জমল না। তাছাড়া হত আমাদের শিবপুর, তাও চিন্তা করতাম। যাদবপুরে সব ডে স্কলার, বাড়ির থেকে কলেজ করে। ওভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং হয় নাকি?
সুতরাং আজ হীরককে স্টেশান থেকেই বিদায় জানিয়েছে বিমল। তবে হীরক একা ছিল না। দুর্গাপুরের অনেকেই চলেছে হীরকের মত। মণীশ বলে ছেলেটাকে তো ভালো করেই চেনে বিমল। একই ব্র্যাঞ্চে পেয়েছে, থাকবেও এক হস্টেলে। তোমরা দুজন এক ঘরে থাকতে পাও কিনা একবার দেখো মণীশ। তাহলে দুজনেরই সুবিধা।
মণীশের বাবা আরই কলেজের প্রফেসার। উনি অনেক বেশি জানেন এসব ব্যাপারে। প্রফেসার মিত্র গলায় সেই গাম্ভীর্য ছড়িয়ে বললেন, ওটাই তো মুশকিল যাদবপুরের। আমাদের এখানে যেমন নতুন ছেলেদের আলাদা হস্টেল, ওদের সেরকম নেই। যেখানে বেড ফাঁকা, ঢুকিয়ে দিল। যেন হাসপাতাল।
ট্রেন না ছাড়া অবধি এরকম অবান্তর কথা চলতেই থাকবে। মণীশ উশখুশ করছিল। ব্ল্যাক ডায়মন্ড তো লেগে যাচ্ছে, আমরা এগিয়ে গিয়ে জায়গা নেওয়ার চেষ্টা করি এবার।
–হ্যাঁ হ্যাঁ যাও, কিন্তু হুড়োহুড়ি কোরো না।
–হীরু, মা কী বলে দিয়েছে মনে রাখিস। জানালা দিয়ে বাইরে হাত রাখবি না। চলন্ত ট্রেনে দরজার কাছে আসবি না। বিমল যথাসম্ভব গলা নাবিয়ে বলে দেয় হীরককে।
ট্রেনের দরজা দিয়ে ঢোকার পরেই এক অন্য জীবন শুরু হয়ে গেল হীরকের। মণীশের।
–সুমন্ত্রকে দেখলাম না তো? ও কি আজকে যাচ্ছে না?
–ও ব্যাটা দুধুভাতু। নিশ্চয় বাবা মার হাত ধরে চলেছে। তাই স্টেশানে কোথাও লুকিয়ে বসেছিল। একচোট হেসে নিল মণীশ। গলায় আজ এক অন্য নেশা। পৃথিবীকে দেখার চোখ পাল্টাতে শুরু করেছে।
–প্রণীত, আনন্দ ওদের কী খবর?
–দেখা হয়নি কদিন। শিবপুর তো পনেরোদিন বাদে শুরু হবে। ওদের গ্যাংটা তখনই যাবে। সবাই মিলে মাইথন বেড়াতে গেছে। জানালার পাশে জায়গা নিতে নিতে মণীশ বলল।
কে কোথায় যাবে তার ভিত্তিতে ওদের বন্ধুত্বের স্থানবদল হতে শুরু করেছে। মণীশের সঙ্গে এতদিন সেরকম দহরম মহরম ছিল না হীরকের। এবার হবে।
বিমল এতক্ষণে জানালার ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। স্যুটকেসটা চোখে চোখে রাখিস হীরু। কামরার চারদিকে চোখ বুলাল বিমল। কোথায় ওটা দেখতে পাচ্ছি না তো।
–সিটের নিচে, পায়ের তলায়। ব্যাজার মুখে জানাল হীরক। ট্রেনটা না ছাড়া অবধি তার বড় হয়ে যাওয়াটা আটকে আছে।
–আচ্ছা, আচ্ছা। মাঝে মাঝে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে নিস।
মণীশের বাবা এবার জানালার ফ্রেমে মুখ বাড়াল। মণীশ, হস্টেলে পৌঁছেই আমাকে একটা ফোন করে দেবে। নাহলে তোমার মা চিন্তা করবে।
–শিবতোষবাবু, আমাকেও একটু জানিয়ে দেবেন। আমার বাড়িতে ফোন নেই তো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়। এখন তো আমাদের ছেলেরা একসঙ্গে পড়বে, থাকবে। খোঁজখবর তো রাখতেই হবে।
বিমলের মুখটা আত্মপ্রসাদে ভরে গেল। ইঞ্জিনিয়ার ছেলের বাবা হয়ে তার স্ট্যাটাসটা বদলে যাচ্ছে। কলেজের প্রফেসার আর মিলিং মেশিনের অপারেটারের ব্যবধানটা মুছে দিয়েছে তার ছেলে। হীরকের দিকে উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে রইল বিমল, ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চোখের আড়ালে যাওয়ার আগের মুহূর্ত অবধি।
জানালার বাইরে চেনা পৃথিবীটা পিছন দিকে ছুটে যাচ্ছে। মুখে এসে লাগছে দুর্গাপুর ছাড়ানো অচেনা হাওয়া। মাঝে মাঝেই হীরক প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিচ্ছে। হস্টেলে জমা দেওয়ার জন্য অনেকগুলো টাকা খামে ভরে রাখা আছে। বাবা মানিব্যাগে রাখতে দেয়নি।
–তোর ভয় লাগছে না মণীশ?
–কিসের ভয়? ডোন্ট কেয়ার ভাব মণীশের।
–না মানে, আজ রাতে হস্টেলে থাকতে হবে তো। ওরা র্যাগিং করবে। শুনেছি মারধোর করে।
–আমি অতনুদাদের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি। তেমন কিছু নয়, দুএকটা চড়চাপড় পড়বে এই আর কি। বেশি কিছু হলে ওরা তো আছেই।
–আমিও অতনুদার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। কিন্তু ওরা তো এ ব্লকে থাকে। আমাদের হয়েছে সিডি ব্লকে। ওরা সেভ করতে পারবে না।
–বেশি কিছু হলে ওদের রুমে শেল্টার দেবে। অত প্যানিক করিস না। আমাকে অতনুদা বলেছে, ভালো গানটান গাইলে নাকি তেমন কিছু করে না। আমি সেফ। তুই গান প্র্যাক্টিস করেছিস কিছু?
মণীশ খুব ভালো গান গায়। তাই ও বিন্দাস। হীরকের গলায় গান আসে না। গত কয়েকদিন স্নান করার সময় একটা গান প্র্যাকটিস করার চেষ্টা করেছিল। রূপা শুনতে পেয়ে সে আরেক হেনস্থা। গান গাইতে হবে ভেবে গলাটা শুকিয়ে গেল।
–ভেবে কী হবে। কথাটা অন্য দিকে ঘোরাতে চাইল। দুর্গাপুর থেকে আর কে যাচ্ছে জানিস? অন্য স্কুলের?
–আমাদের অমিত যাচ্ছে সেটা তো জানিস।
–কেন ওর তো খড়গপুরে যাওয়ার কথা শুনেছিলাম।
–ওরকম সবাই ভাঁজে। আইআইটি হলেই হল শুধু? ওই র্যাঙ্কে শুধু ফিজিক্স নিয়ে পড়তে পারবে। তাই ডিসাইড করেছে যাদবপুরে ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে পড়বে। মোহিত বলে একটা ছেলে আবার ম্যাড্রাস আইআইটিতে মেকানিক্যাল পেয়েও যাচ্ছে না। যাদবপুরেই চলেছে।
–কেন?
–কতরকমের পাবলিক থাকে। বাবা-মা ছেলেকে অতদূর একা ছাড়বে না। নাহলে আইআইটিতে মেকানিক্যাল কেউ ছাড়ে?
মুখটা হঠাৎ শুকিয়ে গেল হীরকের। নিজের এই আনন্দের মধ্যে রমেনের কথা মনে পড়ে গেল। অস্ফূট গলায় বলল, রমেনের খবর শুনেছিস তুই?
মণীশও এবার থমকে গেল। শুনলাম। আমি ভাবতে পারছি না একদম। ওকে আমি অত চিনতাম না, কিন্তু বেশ হাট্টাকাট্টা ছেলে ছিল। ভেতরে ভেতরে এত দুর্বল? জানি জয়েন্টে র্যাঙ্ক পায়নি, সো হোয়াট! তাই বলে এরকম একটা স্টেপ নেবে?
শুকনো হাসল হীরক। সেটা আসল কারণ না রে। আমি ওর বাড়িতে গেছিলাম। ওর ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে।
–তাহলে কী হয়েছিল? মেয়েঘটিত?
–আসলে জয়েন্টে পায়নি, কিন্তু ও চাইছিল কলকাতায় গিয়ে প্রেসিডেন্সি কিংবা সেন্ট জেভিয়ার্সে ফিজিক্স নিয়ে পড়বে। হায়ার সেলেন্ডারিতে স্টার পেয়েছে, চান্স পেতেই পারে। কিন্তু বাড়িতে রাজী নয়।
–কেন? আবার জয়েন্টে বসাতে চায়?
–উহু। কেসটা অন্যরকম। ওর হাত দেখে জ্যোতিষ বলেছিল বাইশ বছর হওয়ার আগে যেন বাড়ির থেকে দূরে না যায়। অপঘাত মৃত্যুর যোগ আছে। তাই বাবা-মা চায়নি দুর্গাপুরের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করুক।
–যাব্বাবা! জয়েন্টে পেলে কী করত?
–বাড়িতে না কি ঠিক করাই ছিল র্যাঙ্ক যাই হোক না কেন, দুর্গাপুর আরই কলেজেই পড়তে হবে ওকে। সেই জন্যেই তো আইআইটি পর্যন্ত দেয়নি।
–তাই বলে সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি বলে প্রমাণ করার জন্য ট্রেনের তলায় ঝাঁপ দেবে?
–আমি চিনতাম রমেনকে। খুব জেদি ছেলে। বাড়িতে এই নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি করে বেরিয়ে গেছিল। তারপর এই খবর। মাথাটা গলা থেকে পুরো আলাদা হয়ে গেছিল। দৃশ্যটা মনে করেই বমি পেল হীরকের। কি শান্ত লাগছিল রমেনের অক্ষত মাথাটা। সব দৌড় পেরিয়ে চলে গেছে ঘুমের দেশে।
নিস্তব্ধতার কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছিল তাদের রৌদ্রোজ্জল দিনটা। মণীশও গুম হয়ে থাকল কিছুক্ষণ। খানিক বাদে বলল, চল যাই হীরু, ট্রেনটা একটু জরিপ করে আসি। দেখি আর কেউ যাচ্ছে না কি। সুদীপ, প্রশান্ত ওরাও তো শুনেছি যাদবপুরে অ্যাপ্লাই করেছে ইকনমিক্স নিয়ে।
–ওদের কি এখনি শুরু?
–না, মাস খানেক বাদে। এখন কাউন্সেলিং চলবে। মণীশ একটু অন্যদিকে মাথাটাকে সরাতে চাইছিল। এই মুহূর্তে রমেন ওদের মাথার দখল নিয়েছে।
বাবা বারবার হীরককে বলে দিয়েছে সুটকেস ছেড়ে কোথাও যাবি না হীরু। ও কি তাহলে স্যুটকেস সঙ্গে নিয়ে যাবে?
–তুই কি মেন্টাল? এই দামড়া স্যুটকেস নিয়ে তুই সারা ট্রেন ঘুরে বেড়াবি? হো হো করে হেসে উঠল মণীশ। কী আছে বল তো ওটায়? কয়েকটা জামাকাপড়, কে নেবে? আমারটায় আবার বাবা রেজনিক হ্যালিডের বইটা গুঁজে দিয়েছে। পপ চাইছে আমি নেক্সট ইয়ার আরেকবার আইআইটি ট্রাই করি। আমার স্যুটকেসটা কেউ ঝেড়ে দিলে আমি অ্যাওয়ার্ড দেব।
–তুই আবার আইআইটি দিবি? খুব অবাক হল হীরু।
–খেপেছিস? আমার গাঁড়ে অত দম নেই। আসছে বছর আবার হবে-তে আমি বিশ্বাসী নই। রেজনিক হ্যালিডে ছাড়, ফার্স্ট ইয়ারের একটা বই যদি আমি টাচ করেছি, তাহলে আমার নাম বদলে রাখিস।
–তার মানে? না পড়লে পাশ করবি কী করে?
–চোতা করে। লাইফ এনজয় করার সময় এখন, সারাদিন মাগগা মেরে বরবাদ করব নাকি?
–তুই পরীক্ষায় টুকবি?
–কেন টুকিসনি কখনো? খুব অবাক হল মণীশ। আমি তো ক্লাস টেনেও হিস্ট্রি পেপার টোপো মেরেছিলাম। ওসব আকবর বাবর মনে রেখে কে সময় নষ্ট করবে।
–তোরা একেকটা পিস ছিলি মাইরি। বাইরে থেকে বোঝা যেতো না।
–হ্যাঁ, আমাদের গ্যাংটায় সবাই একেকজন খেলোয়ার ছিল। ওদের মিস করব খুব। তুই কিছু ভাবিস না হীরু। আমার সঙ্গে থাকলে দুদিনে তোকেও ওস্তাদ পিলু বানিয়ে দেব। এবার চল, ট্রেনটা টহল মেরে আসি।
হীরক তার জায়গায় রুমাল পেতে পাশের লোকটাকে স্যুটকেস দেখতে বলে চলল মণীশের সঙ্গে। সিট নিয়ে মণীশের এত মাথাব্যাথা নেই। ফিচেল হেসে হীরকের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, বর্ধমানে অনেক মেয়ে ওঠে, দেখেছি আগের দিন। দাঁড়িয়ে থাকলে গা ডলাডলি করা যাবে একটু।
ট্রেনে কামরার পর কামরা পার করার মধ্যে একটা উত্তেজনা আছে। কোনও কারণ নেই, উদ্দেশ্য নেই তাই বোধহয় আনন্দটা আরও বেশি। দুটো কামরা পেরোতেই এক ঝাঁক মেয়ে। দুর্গাপুরের। হীরকের মুখ চেনা, কয়েকজনকে কোচিং ক্লাসে দূর থেকে দেখেছে আগে। সিনিয়ার, সামার ভ্যাকেশানের শেষে কলকাতা ফিরছে। কথাবার্তায় সেই উচ্ছলতা। দেখা গেল মণীশ এদের মধ্যে পরিচিত। ওরা দল বেঁধে আন্তাকসারি খেলছিল। মণীশকে দেখে হই হই করে উঠল। এই মণীশ, তুই আমাদের টিমে আয় না, কিশোরকুমারের গান সাপ্লাই দিবি।
–বসব কোথায় বলো? কোনও জায়গা তো রাখোনি
–ওরে তোর জন্য কোল পেতে রেখেছি, আয় বাবা কোলে আয়। চারদিকে হাসির ফোয়ারা উঠল।
এদের মুখে কিছুই আটকায় না মনে হল। পাশের মেয়েটা হাসতে হাসতে বলল, লজ্জা পাস না। দিদির কোলে ভাই বসে না? কাজল টানা চোখ, মুখে অদ্ভুত দীপ্তি। ঠোঁটের কোণে হাসি চলকালে চারপাশ আলোকিত হয়ে ওঠে।
–এই প্রমিতা, তুই কি র্যাগিং শুরু করে দিলি না কি এখানেই? জানালার ধার থেকে কথা ছুঁড়ে দিল কালো সালোয়ারের মেয়েটা। হাওয়ায় চুল উড়ছে পতপত করে। গলার হাসিতে মাদকতা। হীরকের একটু নার্ভাস লাগছিল।
–র্যাগিং তো কলেজে এলেই করব। তুই তো ইলেক্ট্রনিক্সে, আজ না বসলেও ক্লাসে যেদিন আসবি কোলে বসাব। মুচকি হেসে বলল মেয়েটা।
–প্রমিতাদি আমাকে না, ওকে বসিও। হীরক, ও আমার সঙ্গেই। বেচারা একটা কোল খুঁজে বেড়াচ্ছে।
–দিদির কোল ভাই, সেটা মনে রাখলে অবারিত দ্বার। কোনও পুশুমুনু করার জন্য নয়। হাসতে হাসতে চোখ টিপল প্রমিতা। এদের সবাইকে চিনিস তোরা?
আলাপ করে এগিয়ে গেল ওরা। মণীশ প্রমিস করল ফেরার সময় এখানে বসে আন্তাকসারি খেলবে। হীরকের একটু প্র্যাক্টিস দরকার। ওকে আজ রাতে হস্টেলে গান গাওয়াতে পারে ভেবে প্যানিক করছে সকাল থেকে।
এর পরের কামরাতে যার সঙ্গে দেখা হল তার জন্য তৈরি ছিল না হীরক। শানু। বাবার সঙ্গে কলকাতা যাচ্ছে। এই এক বছরেই চেহারার কি পরিবর্তন হয়েছে ছেলেটার! চোখের দৃষ্টি অস্বচ্ছ। জামাকাপড়েও অযত্নের ছাপ। হীরকের সঙ্গে কথা হয় না আজকাল। গত বছর অদ্ভুতভাবে হায়ার সেকেন্ডারিতে অঙ্কে ফেল করে শানু। দুর্গাপুরে সে এক ইন্দ্রপতন। জয়েন্ট এন্ট্রান্সের তো কোনও চান্সই নেই। এ বছর আবার জয়েন্ট দিচ্ছিল শানু। মাঝেমাঝে দুই একবার তার সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু সেই শানু কোথায়? হঠাৎ ওর দুহাত আঁকড়ে ধরেছিল একদিন। আমি কিচ্ছু মাথায় রাখতে পারছি না রে হীরক। না হলে বল এ প্লাস বি হোল কিউব আমি মনে রাখতে পারছি না? বাবা কিছুতেই বিশ্বাস করছে না। ভাবছে বাবাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আমি অভিনয় করছি। আরও ধরে ধরে পেটাচ্ছে।
–তুই কেন কিছু মনে রাখতে পারছিস না শানু?
–জানি না রে। একদিন বাবা আমাকে খুব কেলাল। মাথা জোরে ঠুকে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। তার পর থেকেই— বাবাকে বললে আরও রেগে যায়। বলে বাহানা। তুই আমাকে বাঁচা হীরু।
–কীভাবে বাঁচাব তোকে? আমি কীভাবে হেল্প করব?
–কিছু একটা কর, বাবাকে এসে বল। না হলে, না হলে আমার হয়ে পরীক্ষা দিয়ে দে।
–সেটা কী করে দেব শানু? জয়েন্ট তো আমাকেও দিতে হবে। তাছাড়া ছবিওয়ালা আই কার্ড থাকে, অন্য কেউ দেওয়া যায় নাকি?
ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল শানু। আমি যে কী করি হীরু। আমার মাথার মধ্যে আজকাল কীরকম করে জানিস? রাত্রিবেলা শুয়ে ভয় লাগে, মনে হয় আমি একটা নীল গহ্বরে ডুবে যাচ্ছি। চোরাবালির মত। কিন্তু চোরাবালির রং নীল কেন হবে বল তো?
হীরক কী করবে বুঝতে পারেনি। খুব মায়া হচ্ছিল শানুর জন্যে। ওকে জড়িয়ে ধরেছিল হীরক। একবার দুই হাতে একটা পায়রা ধরেছিল। গরম শরীরটা খুব দ্রুত হদস্পন্দনে তিরতির করে কাঁপছিল ওর দুহাতের আঁজলায়। শানুকে জড়িয়ে ধরে ঠিক সেই অনুভুতিটা ফিরে পেয়েছিল হীরক।
শানু জানালার গরাদ ধরে বাইরে তাকিয়েছিল। কাকু চোখের সামনে খবরের কাগজ মেলে বসেছিল। শানু হঠাৎ জানালা থেকে মুখ ফেরাতেই হীরকদের দেখতে পেল।
–এই হীরু, কোথায় যাচ্ছিস রে?
–আমরা কলেজে, আমতা আমতা করে বলল হীরক। কোনও কোনও মুহূর্তে আনন্দের কথা লুকাতে পারলে ভালো লাগে।
ততক্ষণে শানুর বাবা কাগজ থেকে মুখ তুলেছেন।
–কোন কলেজে যাচ্ছ হীরু?
–যাদবপুর।
–আর তুমি?
–আমরা একসঙ্গেই। ইলেক্ট্রনিক্স।
–দ্যাখ শানু। দেখে শেখ। একদিন এদের ছাড়িয়ে উপরের ক্লাসে উঠে গিয়েছিলি। এবার ওরা সবাই তোকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাবে। পড়ে থাকিস তুই ভ্যাবলার মত।
শানুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল আরও। চোখের চাহনিতে একটা ত্রস্ত হরিণের প্রতিচ্ছবি।
দৌড়ে এগোতে গেলে কাউকে পেছোতেও হয়। পিছিয়ে যাওয়াদের চোখের সামনে দাঁড়াতে এত অস্বস্তি হবে সেটা জানা ছিল না হীরকের।
২
ডাক্তার সেন চেয়ার হেলান দিয়ে দুই হাতের মধ্যে পেনটাকে ধরে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন শানুর দিকে। শানু কী করবে বুঝতে পারছিল না। আলগা করে হাসার চেষ্টা করল।
–তুমি এখন কেমন বোধ করছ শান্তায়ন? ডাক্তারের গলা খুব গভীর, গমগম করে। কিন্তু শব্দগুলোর কোণাগুলো ছেঁটে দেন, ধার না রেখে।
–ভালো। চোখ পিটপিট করছিল শানু।
–তোমার কি চোখে জ্বালা করে? মুখে স্মিত হাসি টেনে বললেন ডাক্তার সেন।
শানু লজ্জা পেল। না তো।
একবার ওর চোখটা চেক করিয়ে নেবেন পরমেশবাবু। আবার শানুর দিকে ফিরে বললেন, তাহলে তোমার কি অন্য কোনও কষ্ট হয়?
–রাত্রে ঘুমাতে পারি না। একটু ইতস্তত করে যোগ করল, ভয় লাগে।
–দিনের বেলা খুব ঘুমায় আজকাল। একটু বেশিই ঘুমায়। পরমেশের গলার অনুযোগের সুরটা কান এড়ায় না।
ডাক্তার পরমেশের কথা অগ্রাহ্য করে শানুর উত্তরে ফিরে গেলেন।
–কিসের ভয় তোমার শান্তায়ন?
–রাত্রে ঘুমালেই আমি স্বপ্ন দেখি, ভালো লাগে না।
আবার হাসলেন ত্রিদিব সেন। স্বপ্ন দেখা তো ভালো। তাহলে কি তুমি দুঃস্বপ্ন দেখো?
–আমি সমুদ্রতীরের স্বপ্ন দেখি। বালি ধরে হেঁটে যাচ্ছি।
–ও কিন্তু বড় হয়ে সমুদ্র দেখতে যায়নি, যা দেখেছে সেই ছোটবেলায় অ্যামেরিকা থাকতে।
ডক্টর সেন ডান হাত নাড়িয়ে পরমেশকে থামালেন। ওনার চোখ শানুর উপরে, ঠোঁটে প্রশ্রয়ের হাসি। কী বলতে চাইছিলে বলো।
শানুর গলা এখন অনেক গভীর থেকে উঠে আসছিল। ভেবে ভেবে বলছিল, কিন্তু কী বলবে তা নিশ্চিত জেনে বলার মত। এই সমুদ্রের বালিগুলো অন্যরকম। নীল রঙের বালি। পুরো স্বপ্নটাই নীল রঙের। বিভিন্ন শেডের নীল। বালি নীল হলেও সেটা সমুদ্র-নীল নীল নয়। ফ্যাকাশে নীল। সাদা জামায় মা নীল দিয়ে কাচে, ঠিকমত না গুললে হালকা ছোপ ছোপ থেকে যায়, অনেকটা সেরকম নীল। ছোট বড় ছোপ। আমি ওই ছোপগুলো এড়িয়ে এড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছি। আর কেউ যেন, না কারা যেন আমার পিছনে আসছে। তাদের ছায়া আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে, লম্বা হচ্ছে। আমি ছুটতে শুরু করি। এখন আর এড়াতে পারি না, ওরকম একটা ছোপের মধ্যে পা পড়ে যায় আর হঠাত বালি সরতে থাকে। শানুর হাতের আঙুলগুলো উত্তেজনায় কাঁপছিল। ও একটু ঝুঁকে পড়ে টেবিলের উপর রাখা কলমদানিটা আঁকড়ে ধরে নিজেকে শান্ত করতে চাইল। কলমদানির কলমগুলো টকটক করে নড়ছিল। ডক্টর সেন মন দিয়ে শুনছিলেন। শানু চোখ তুলে ওর দিকে চাইতে উনি না থামার জন্য ইশারা করলেন। বালির ভিতর থেকে একটা টান উঠে আসছিল, আমি আর সামলাতে পারিনি। বালির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি, যেন নীল রঙের একটা চোরাবালি। যত ঢুকছি নীল রং আরও গাঢ় হচ্ছে। এত নীল চারদিকে, আমার শ্বাসরোধ হয়ে আসে। ছটফট করতে করতে ঘুম ভেঙে যায়। কথা থামিয়ে হাঁফাচ্ছিল শানু।
–এরকম কি রোজই দেখো?
–না, সব দিন না। মাঝে মাঝে। আবার অন্যরকমও দেখি। কোনওদিন বালি ছেড়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাই। জলের মধ্যে ঢুকে যাই। সেখানেও নীল রং। ঘন নীল। নীল রংটা আমাকে সব জায়গায় তাড়া করে করে বেড়ায়।
-ওর কি ছোটবেলায় সমুদ্রে গিয়ে কোন ব্যাড এক্সপিরিয়েন্স হয়েছিল?
–না, কই না তো। ভুরু কুঁচকে ভাবতে ভাবতে মাথা নাড়ল পরমেশ। অ্যামেরিকায় থাকতে একবার সানফ্র্যান্সিসকোতে গেছিলাম ওকে নিয়ে। তখন খুব ছোট। বেশ আনন্দই তো করেছিল সেখানে।
–হুম। ডাক্তার সেন শানুর হিস্ট্রিবুকে নোট নিতে নিতে মাথা তুললেন। ও কতক্ষণ ঘুমাচ্ছে একটু নোট করবেন তো।
–আমি তো করি। ঘুম খুব বেড়ে গেছে। দিনের অনেকটা সময় পড়ে পড়ে ঘুমায়।
–ডিপ্রেশানের জন্য। কিন্তু ঘুমানোটা ওর জন্য খারাপ কিছু নয়। শুধু আমার জানা দরকার।
–আসলে আমার সব থেকে বেশি চিন্তা ওর ভুলে যাওয়াটা। আজকাল কিচ্ছু মনে রাখতে পারে না। এমনকি যে সমস্ত অঙ্ক এক সময় চোখ বুজে করে ফেলত, এখন হাবার মত চেয়ে থাকে। বলে কিচ্ছু না কি মনে নেই। I am really exasperated Doctor. মাঝে মাঝে মনে হয় ও যেন ইচ্ছা করে আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এরকম করছে।
–শাস্তি তো ও পাচ্ছে, আপনাকে কেন শাস্তি দেবে! আপনি কি কিছু করেছিলেন? একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন ডক্টর সেন।
–আমি যে চাইতাম ও খুব ভালো রেজাল্ট করুক, দশের মধ্যে নাম হোক। ওকে নিয়ে যে আমার একটা স্বপ্ন ছিল, সেটাকে ভেঙ্গে চুরচুর করে শাস্তি দিচ্ছে। পরমেশ নিজেকে সামলাতে পারছিল না।
–এভাবে ভাববেন না। এতে ওর উপর আরও চাপ তৈরি হয়। আচ্ছা শান্তায়ন, তুমি ওই পাশের বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ো তো। আচ্ছা মিস্টার বোস, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে একটু বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। ওর গম্ভীর গলায় শব্দগুলোর ধার একটুও কাটছাঁট না করেই বললেন ডক্টর সেন।
শানু চিত হয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছিল। পরমেশ একটু ক্ষুণ্ণ হয়েই বেরিয়ে গেল। ত্রিদিব সেন বাঁ হাতে শানুর চোখ একটা একটা করে বড় করে তার মধ্যে টর্চের আলো ফেলে ভালো করে দেখলেন। মুখ হাঁ করিয়ে জিভটা দেখলেন।
–হুম। তোমার আর কি কোন অসুবিধা হয় শান্তায়ন?
শানু উঠে বসার চেষ্টা করছিল। উনি না না করে উঠলেন। রিল্যাক্স। তুমি শুয়ে শুয়েই আমার কথার জবাব দাও। দাঁড়াও, আমি মাথার দিকটা একটু তুলে দিচ্ছি, তাহলে তোমার কথা বলতে সুবিধা হবে। প্যাডেল করে মাথার পিছনটা বেশ খানিকটা তুলে দিলেন ডাক্তার সেন।
–তোমার বাবা বলছিলেন, তুমি খুব ভুলে যাও।
ফিক করে হাসল শানু। অঙ্ক ভুলে যাই।
–আর কী ভুলে যাও?
–যা ভুলে গেছি, সেটা ভুলে গেছি কী করে জানব? শানু ঠিক বুঝতে পারছিল না কিভাবে ডাক্তারের কথার উত্তর দেবে। তারপর একটু ভেবে বলল, বাবা মা মাঝে মাঝে অনেক পুরানো কথা বলে আমার বিষয়ে, আমি নিজেই মনে আনতে পারি না।
–কিরকম?
–যেমন বাবা বলে আমি নাকি মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। আমাকে ছবিও দেখিয়েছে, কিন্তু আমি মনে করতে পারিনি। আমি যে মাধ্যমিক দিয়েছিলাম সেটাই মনে নেই।
ডক্টর সেন শানুর কেস হিস্ট্রিতে চোখ বুলালেন। এটা তো আগে বলোনি।
–তাহলে কি আমি আরও বেশি বেশি ভুলে যাচ্ছি? আগে হয়তো মনে ছিল, এখন মনে নেই? শানুকে খুব চিন্তিত দেখায়। আমি যদি আরও বেশি ভুলে যাই, বাবা ঠিক মারবে। একটা ভয়ের ছায়া চলে গেল শানুর মুখের উপর দিয়ে।
–তোমার বাবা কি মারে?
–না তো। মনে করার চেষ্টা করল শানু। ছোটবেলায় মারত। এখন আর মারে না। আমি হায়ার সেকেন্ডারিতে ম্যাথে গোল্লা পেলাম, তখনও মারেনি।
–তুমি তো অঙ্কে ভালো ছিলে, তাহলে গোল্লা পেলে কী করে?
–আমি কোয়েশচেন পেপার দেখেই খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। কিচ্ছু মনে করতে পারছিলাম না। আমি বুঝতে পারছিলাম না সাদা পাতাগুলো কীভাবে ভরাব। বাথরুমে যাবার নাম করে হল থেকে পালিয়ে গেলাম। কেউ বুঝতে পারেনি।
–বাবা তবুও মারেনি?
–না, মারেনি তো। কাঁদছিল। ভাবলেশহীন গলায় বলল শানু।
–তাহলে বললে কেন আরও বেশি ভুলে গেলে বাবা মারবে?
–এইবার মনে পড়েছে। হঠাৎ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল শানুর মুখ।
–কী মনে পড়েছে?
–ক্লাস নাইনে অঙ্কে নাইন্টি ফাইভ পেয়েছিলাম বলে বাবা খুব মেরেছিল। আমার সাইকেলটা ভেঙে দিয়েছিল। বাবা চায় আমি অঙ্কে হান্ড্রেডে হান্ড্রেড পাই।
শানুর গলায় খুব একটা ওঠাপড়া ছিল না। অনুযোগ কিংবা অনুতাপ, কিছুই ছিল না সেই বলায়। হঠাৎ হেসে উঠল শানু।
–হাসলে কেন? কিছু মনে পড়েছে?
–না, মনে হল বাবা খুব পারফেকশান পছন্দ করে। পারফেক্ট হান্ড্রেড না হলে পারফেক্ট জিরো। ছক্কা না হলে পক্কা। গুলগুল করে হাসি উঠে এল শানুর বুকের ভিতর থেকে।
–তোমার আর কোনও কষ্ট হয় শান্তায়ন?
–আমার মাথায় ব্যাথা করে মাঝে মাঝে।
–কিরকম ব্যাথা?
–অনেকসময় আমার মাথায় একেকটা কথা ঘোরে। কথাগুলো আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। বড় হতে থাকে। আমার সারা শরীর মন ছেয়ে ফেলে। আমি কিছুতেই তার থেকে বেরোতে পারি না। একটা অসহায় ভঙ্গি শানুর গলায়। তখন আমার খুব কষ্ট হয়।
–কিরকম কথা শান্তায়ন?
ডাক্তার সেনের গলা শান্ত। কিন্তু বলার মধ্যে একটা এগিয়ে নিয়ে চলার চেষ্টা আছে। উনি চান শানু বলুক, কিন্তু জোর করতে চাইছেন না। ওনার গলায় একটা শান্ত মাধুর্য আছে যেটা শানুর দ্বিধা কাটিয়ে দিচ্ছিল।
–অনেক সময় আমার বন্ধুদের কথা মনে হয়। হয়তো কোনও আনন্দের কথা। আনন্দটা বুঝতে পারছি কিন্তু কথাটা কী ছিল ধরতে পারছি না। কে বলেছিল সেটাও মনে করতে পারছি না। আমি মনে করার চেষ্টা করি, খুব চেষ্টা করি। কিন্তু ঠিক যেন পেটে আসছে, মুখে আসছে না। হাতের মধ্যে এসে আবার পিছলে পালিয়ে যাচ্ছে। আমি অস্থির হয়ে উঠি। উত্তেজনায় মুঠি পাকাচ্ছিল শানু। সেই সময় আমার রাগ হতে থাকে। আমি রাগে হাতের কাছে যা পাই ছুড়ে ফেলি। আমাদের বাড়ির কাজের মাসি আমাকে দেখে একদিন পাগল পাগল বলে চিৎকার করে উঠেছিল। মা ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু আমি মাকে ছিটকে ফেলে দিলাম। আমি সেই চিন্তা থেকে বেরোবার জন্য দরজা খুলে রাস্তা দিয়ে ছুটলাম। কিন্তু যতদূর যাচ্ছি, মাথার থেকে ভাবনাটা কিছুতেই সরছে না। আমাকে জাপটে ধরছে, ঠিক যেন নাগপাশ। আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। হাঁফাচ্ছিল শানু। উত্তেজনায় আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসেছিল।
–তুমি এবার নেবে এসে এই চেয়ারটায় বসো শান্তায়ন।
শানু সামনে এসে বসার পর ত্রিদিব সেন বললেন, তোমার যখন এরকম চিন্তা মাথায় আসবে তুমি জোর করে অন্য কিছু ভাবতে শুরু করবে। একটা নির্দিষ্ট কিছু। আচ্ছা, তোমার কোন ফুল ভালো লাগে শান্তায়ন?
–আমার আগে অপরাজিতা ভালো লাগত।
–এখন আর লাগে না?
–না, নীল রঙে আমার ভয় করে।
–তাহলে কোন ফুল ভালো লাগে এখন?
অনেকক্ষণ ভুরু কুঁচকে ভাবল শানু। বোধহয় গোলাপ। লাল গোলাপ।
–ওকে, তাহলে এবার যখনই তোমার মাথায় এরকম কোন চিন্তা আসবে তুমি তোমার প্রিয় গোলাপফুলের কথা ভাববে। লাল গোলাপের কথা। খুব মন দিয়ে ভাববে। একটা গোলাপ, কিংবা গোলাপের তোড়া। জোর করে শুধু ওইটাই ভাববে। মনে থাকবে তো?
খুব বাধ্য ছেলের মত মাথা নাড়ল শানু। ঠিক আছে।
–আর কোনও কষ্ট আছে তোমার?
–আমার হাতের আঙুলগুলো খুব কাঁপে। আমি কিছু লিখতে গেলেই লেখাগুলো আঁকাবাঁকা হয়ে যাচ্ছে আজকাল।
–কই দেখি লেখো তো। একটা সাদা কাগজ আর কলম এগিয়ে দিলেন ডাক্তার সেন।
–কী লিখব?
–যা ইচ্ছা, যা প্রাণে চায় লেখো।
শানু কলম হাতে কিছুক্ষণ ভাবল। সাদা কাগজে একটু আঁকিবুঁকি কাটল। তারপর লিখতে শুরু করল। গভীর মনোযোগের সঙ্গে। ভুরু কুঁচকে, জিভটা দাঁতের ফাঁকে ঘষতে ঘষতে। ডাক্তার সেন ওকে গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে দেখছিলেন। শানু একবার লেখা শুরু হতেই কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি লিখে চলল। সেটা একটু অবাক করল ওনাকে। ওর চিন্তার গতি ডক্টর সেনকে মুগ্ধ করছিল। শানুর মোটেই থামার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু উনিই ওকে থামতে বললেন। কাগজটা হাতে নিয়ে পড়লেন শানুর লেখা। ইংরাজিতে লিখেছিল শানু। লেখাটা খুব বেঁকেচুরে এগিয়েছে। একটা শব্দের সঙ্গে পরের শব্দ অনেকসময় মাখামাখি হয়ে গেছে। সব শব্দ ভালো করে পড়াও যাচ্ছে না। তবু উনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেন।
Things in my life has a way of disappearing. When I was much younger, Mayapisi showed me an album of family photographs. Mayapisi and I looked at those photographs for a long time and she recited the names of those people whom I have never seen. The photograph that impressed me a lot was my father’s at a young age. He was smiling. He does not smile anymore. My mother does not either. I feel I have caused them great grief. My mother had an album which has photographs of my childhood in America. In one of those photographs I have a friend called Alice. There was a friend named James also. My mother told me that I spent a lot of time playing with them. They disappeared too. But for those photographs I don’t remember them at all. I feel I forgot many such friends. My friends have forgotten me as well. I have disappeared from their lives.
–বাহ, খুব ভালো লিখেছ তো। এই দেখেছ অনেক কিছু কেমন মনেও আছে তোমার! তোমার কি কোনও বন্ধুর কথা খুব বেশি মনে হয়।
মাথা নাড়ল শানু।
–কে?
–নাম ভুলে গেছি। মনে করতে পারছি না।
–তাহলে তার কথা মনে করো কী করে?
শানু গভীর ভাবনায় ডুবে গেল। যেন কিছু মনে করতে চাইছে। কিংবা বলবার ভাষা খুঁজে বেড়াচ্ছে। যখন কথা বলল, খুব দূর থেকে ভেসে আসা শব্দবন্ধের মত শোনাল। বাবার ঘরের দেওয়ালে অনেকদিন একটা ছবি আটকানো ছিল। একদিন সেটা পড়ে ভেঙে যায়। সেখানে আর কোনও ছবি লাগানো হয়নি। ওই জায়গাটা জুড়ে একটা পরিষ্কার দেওয়াল পরে আছে। বোঝা যায় কিছু ছিল। কিন্তু কার ছবি ছিল সেটা আর মনে করতে পারি না।
ডাক্তার সেন অনেকক্ষণ শানুর দিকে চেয়ে রইলেন। তার চোখে এক গভীর মমতা ভেসে উঠেছিল। মানসিক রোগী তার কাছে অনেক আসে। তবু এই ছেলেটির কথার মধ্যে এক নিবিড়তা আছে। বুদ্ধির দীপ্তি মাঝেমাঝেই বিদ্যুৎ ঝলকের মত চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। তার মনে হল এক সজীব ঘাসফুলের উপর একটা পাথর চাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওর পক্ষে সম্ভব হলে এখুনি সেই পাথর সরিয়ে ঘাস ফুলকে রোদ হাওয়ার মধ্যে বের করে আনতেন। কিন্তু ডাক্তার হয়ে তিনি জানেন সেটা একবারে সম্ভব নয়। তাকে ওই পাথরের চারপাশে ক্রমাগত খুঁচিয়ে যেতে হবে। হয়তো একদিন আলু ফাঁক, পটল ফাঁক বলতে বলতে তিনি বলে উঠবেন চিচিং ফাঁক আর সেই পাথরটা এক ঝটকায় সরে গিয়ে বাইরের সব আলো বাতাস টেনে আনবে এই ছেলেটির জীবনে। তিনি ডাক্তার, তাই জানেন ধৈর্য ধরতে হয়।
সেই কথাটাই উনি বললেন পরমেশকে।
–আপনার ছেলের অসামান্য চিন্তাশক্তি। খুবই ভাবুক।
–জানি ডাক্তারবাবু। ছোটবেলায় রূপকথায় পড়েছি রাজপুত্র ব্যাং হয়ে গেছে। আমার ছেলের সেই অবস্থা। গলাটা ভারী হয়ে এল পরমেশের। আমার মনে হয় আমিই সেই রাক্ষস, যার শাপে রাজপুত্র ব্যাং হয়ে গেছে।
–এভাবে ভাববেন না। টেনসাঁইল স্ট্রেংথ জানেন তো। প্রতিটা মেটেরিয়ালের আলাদা আলাদা স্ট্রেংথ। এখন মেটেরিয়াল হ্যান্ডেল করার সময় তো আমরা জানি, কোনটাকে কতটা বাঁকানো যায়। মানুষের ক্ষেত্রে আমরা জানি না। কেউ অনেক চাপ নিয়েও একদম সোজা থাকে। যেন বটগাছ। আবার কেউ একটু চাপেই ভেঙে যায়। জানলে হয়তো আমরা সেই চাপ দিতাম না। তাই না?
এই ব্যাখ্যা পরমেশকে সেভাবে শান্তি দিতে পারল না। মাঝেমাঝে ছেলের উপর খুব রাগ হয়। কিন্তু একান্তে বসে নিজেকেই দোষারোপ করে আবার।
–আচ্ছা শানু। তুমি একটা কথা মনে রেখো। লেখার সময় বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের কব্জিটা ধরে থাকবে। এতে লেখা একটু ধীরে হবে হয়তো। কিন্তু হাত কাঁপবে না। আর শোন, তোমার লেখা খুব ভালো। তুমি এভাবে নিজের কথা খাতায় লিখে রাখবে, আর এরপর যখন আসবে, নিয়ে এসে আমাকে দেখাবে। কেমন?
শানু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। ওর মাথায় তখনও হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের কথা ঘুরছিল। ডাক্তারের উপদেশ মনে পড়তেই ও চোখ বন্ধ করে লাল গোলাপ খুঁজতে শুরু করল।
–আচ্ছা শান্তায়ন তুমি এবার একটু বাইরে যাও। আমি তোমার বাবার সঙ্গে একটু মেডিসিনের আলোচনাটা সেরে নিই।
শানু বেরিয়ে যেতে ডক্টর সেন বললেন, আচ্ছা পরমেশবাবু, আমি ওর একটা নিউরোইমেজিং করাব আরেকবার। আগেরটা তো প্রায় এক বছর আগে হয়েছিল। লেট মি সি দ্য ডিফারেন্স।
–ওষুধ কিছু বদলাবেন?
–না, অ্যান্টি ডিপ্রেসান্ট চলতে থাকুক। বেশি তো আর কিছু দেওয়ার নেই। আচ্ছা, একটা ঘুমের ওষুধ লিখে দিচ্ছি। আপনার কাছে রাখবেন। যদি রাতে ঘুমাতে খুব অসুবিধা হয়, সেদিন শুধু দেবেন।
–কোনওভাবে ওকে একটু তাড়াতাড়ি ভালো করে তোলা যায় না?
–আমার কাছে কোনও জাদুদণ্ড নেই পরমেশবাবু।
–কোনওরকম শক টক দিয়ে—
পরমেশের মুখের কথা কেড়ে নিলেন ত্রিদিব সেন। আমি ওটাতে খুব একটা বিশ্বাস করি না জানেন। অনেক সময় এতে হিতে বিপরীত হয়।
–আসলে কী জানেন, ওর বয়সটা তো বেড়ে যাচ্ছে। জীবনটা নিয়ে কিছু তো করতে হবে ওকে। আমি তো সারা জীবন আর থাকব না। একটা গ্রাজুয়েশান না করতে পারলে কোনও চাকরিবাকরিও করতে পারবে না। হায়ার সেকেন্ডারিটাও পাশ করতে পারল না। বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল পরমেশ। সুতপা এই অবস্থায় দেখলে নিশ্চয় খুব অবাক হত। ভেজা গলায় বলল পরমেশ, আমার ছেলে স্কুল ফাইনালে গোটা স্টেটে নাইনথ হয়েছিল ডাক্তারবাবু। ডিস্ট্রিক্টে প্রথম। তারপর দেখুন…
–শক্ত হোন। কী হতে পারত সেটা ভেবে তো এখন লাভ নেই। শুধু শুধু ওর উপর চাপ সৃষ্টি হবে। আমি একটা কথা বলতে পারি। ওর যদি অঙ্কের ফর্মুলা মনে রাখতে অসুবিধা হচ্ছে, ওকে আর্টস নিয়ে পড়তে দিন। ইংরাজিটা তো বেশ ভালো লিখল দেখলাম। হয়তো ওটা নিয়েই পাশ করে যাবে।
–তাতে কি আর আজকালকার দিনে কোনও লাভ হবে?
–লাভলোকসানের হিসাবটা সরিয়ে ভাবতে হবে এখন। তাতেই ওর আসল লাভ। যাই হোক। আমি তো টিচার নই, ডাক্তার। আপনি বরং প্রফেসার মানুষ। যা ভালো বুঝবেন করবেন। কিন্তু ওকে চাপমুক্ত রাখুন।
৩
যেরকম ভয় পেয়েছিল অত কিছু হল না। মণীশ আর হীরক একই রুম পেয়ে গেল।
একেকটা ঘরে চারটে লোহার খাট। প্রতিটা খাটের পাশে একটা কাঠের টেবিল আর ছোট কাঠের দেরাজ। ঘরের একেকটা কোণা নিয়ে তাদের নিজস্ব পৃথিবী। হীরকের দুর্গাপুরের বাড়ি তেমন কিছু বড় তো নয়, কিন্তু পরিষ্কার। এই ঘরে পরিচ্ছন্নতার লেশমাত্র নেই। ছাদের কালো ঝুলের পিছনে আদতে কি রং ছিল বলা মুশকিল। ঘরের এক কোণায় পুরনো স্টেটসম্যান ডাঁই করে রাখা। বৃষ্টির জল পড়ে হলুদ হয়ে গিয়েছে। হীরক সেখান থেকে একটা ইঁদুর দৌড়ে পালাতে দেখেছে। খাটের তলাটা দেখার দুর্ভাগ্য হল রাতে। যখন তাকে খাটের তলায় মশা মারতে পাঠানো হল। মশা সেখানে কিছু কম ছিল না, কিন্তু তার চাইতেও বেশি ছিল ধুলো। মাথা গোঁজ করে বসে মশা মারা অত সোজা ছিল না। ধুলোর জন্য একটু বাদেই হাঁচতে শুরু করল। যতবার হাঁচে, খাটের ছাদে মাথা ঠুকে যায়। কিন্তু দশটা মশা না মারা অবধি বেরোনোর উপায় নেই। মণীশ ততক্ষণ দিলীপদাকে গান শুনাচ্ছিল। এই খাটটা দিলীপদার, সিভিল থার্ড ইয়ার। তাদের রুমমেট।
দুপুরবেলা ঘরে যখন বেডিং নিয়ে ঢুকেছিল, দিলীপদা খালি গায়ে জাঙ্গিয়া পরে ঘুরে বেরাচ্ছিল। ওদের দেখে যারপরনাই বিরক্ত। যাস শালা, মুরগিগুলো এত তাড়াতাড়ি এসে গেলি? আমি ভাবলাম খালি ঘরে দুপুরবেলায় একটু খিঁচে নেব। হীরক আর মণীশ কী করবে বুঝতে পারছে না। হাতে ব্যাগ, পিঠে বেডিং। দোতলা অবধি টেনে এনেছে, পিঠ টনটন করছে।
–ক্যালার মত দাঁড়িয়ে থাকিস না। ওগুলো পিঠ থেকে নাবিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়া। আচ্ছা শোন, নিচে নেবে দেখবি মেন রাস্তার ধারে জগার দোকান। ওখান থেকে এক প্লেট ঢপ আর চা নিয়ে আয়। শালা মেস চালু হবে পরশু থেকে, পেটে ছুঁচো ডিগবাজি খাচ্ছে।
ওরা চলে যাচ্ছিল। দিলীপদা আবার পিছন থেকে ডাকল। শোন, দরজা ভেজানো থাকবে। ঠেলে ঢুকবি না। আমি কাজ সেরে তোদের ঢুকিয়ে নেব। বলে চোখ টিপল দিলীপদা।
ঢপটা কি খাবার সেটা ওদের জানা ছিল না। কিন্তু বোঝা গেল বেশ পপুলার। তেকোনা করে কাটা পাঁউরুটির স্যান্ডুইচ ব্যাসনে চুবিয়ে ভাজা। ফিরে এসে পনেরো মিনিট দাঁড়ানোর পর দিলীপদা দরজা খুলল। এখন পরনে লুঙ্গি। নাম ধাম জানার পর বলল, তোরা খুব লাকি। আমার ঘরে জায়গা পেয়েছিস। আর কেউ মারধোর করবে না। রাত্রে সবার সামনে আমি তোদের একটু ক্যালাব। ওটা কিছু না, ভালো হলে সেরে যাবে। কিন্তু তারপর আর কেউ দিলীপের মুরগিতে হাত দেওয়ার সাহস পাবে না।
এটা বরাভয় না শিয়রে শমন সেটা ওরা বুঝতে পারেনি। একটু বাদে অনিকেত বলে একটা ছেলে এল। এও ফার্স্ট ইয়ার, জলপাইগুড়ি থেকে এসেছে।
–তোর এত দেরি হল কেন?
ছেলেটা খুব অবাক হল। আসার তো সেরকম টাইম বাধা ছিল না। ট্রেন যেমন যেমন লেগেছে, তাই এসেছে।
–শালা আমাকে চোদাচ্ছিস? ঘরে যেন বাজ পড়ল। অনিকেত কেন, হীরকরাও কেঁপে উঠল। তোর দার্জিলিং মেল কখন আসে আমি জানি না বাঞ্চোত?
অনিকেতের গলা এতক্ষণে একেবারে মিনমিনে। আসলে আমার কাকা কলকাতায় থাকে কিনা, আমাকে স্টেশানে রিসিভ করতে এসেছিল।
–তোর কাকা কলকাতায় থাকে? তাহলে তুই হস্টেল পেলি কী করে? এখুনি তোর নাম কাটানোর ব্যবস্থা করছি।
এবার অনিকেত ছেলেটা একলাফে দিলীপদার পায়ের কাছে। সরি দাদা, ভুল হয়ে গেছে।
–দাদা কিরে, স্যার বল। আমার বাপ তোর মত ক্যালানে ছেলে পয়দা করবে না।
–সরি স্যার।
–কিসের জন্য সরি?
–দেরিতে আসার জন্য। কাঁচুমাচু মুখে বলল অনিকেত।
হীরক আর মণীশ ওর এই অবস্থা দেখে মুচকি মুচকি হাসছিল। ওদের দিকে না তাকিয়েই দিলীপদা বজ্রগম্ভীর স্বরে হাঁকল, মুখের হাসি রুমালে মুছে নে, নাহলে তোদের ঝুঁটি কেটে দেব।
–আর এই যে হস্টেলে মিথ্যে কথা বলে জায়গা পেলি তার সরিটা কি তোর বাপ এসে বলবে?
–আমি তো মিথ্যে বলিনি।
–চোপ! ঠাস করে একটা চড় পড়ল অনিকেতের গালে। অনিকেতের হাতে তখনও স্যুটকেস, পিঠে বেডিং। বেচারা ঘুরে পড়ে গেল।
দিলীপদার সেদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। অনিকেত অমনি শুয়ে আছে। দিলীপদা বলল তোর কাকার ছেলেমেয়ে কটি? তোকে কাকিমা বাড়িতে রাখতে চায়নি বুঝি?
–দুই মেয়ে। আমার বোন।
–মুখে বলিস বোন বোন, প্যান্টের তলায় নাচে ধোন। জানি না ভেবেছিস? মালগুলো কত বড়?
অনিকেতের চোখে ততক্ষণে জল এসে গেছে। বড় বোন হায়ার সেকেন্ডারি দেবে। ছোট বোন ক্লাস ফাইভে।
–আরে তাহলে একটা তো বেশ ডবকা। আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিবি?
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল অনিকেত।
–তাহলে ওঠ। এত কান্নাকাটি করার কিছু হয়নি। এখানে কি তোর জামাই আদর হবে ভেবেছিলি নাকি? যা চোখে মুখে জল দিয়ে আয়। তুই এখন সম্পর্কে আমার শালা হয়ে গেলি, বেশি ঝাড় খাবি না।
–তোরা হাঁ করে কি দেখছিস? তোদের বোনের খবর তো কিছুই পাইনি এখনও। ভাই বোন কী আছে?
মণীশ জানাল, আমি একা। কোনও ভাইবোন নেই।
কেন, তোকে পয়দা করেই কি বাপের দ্য এন্ড বেরিয়ে গেছিল? মণীশের মত ছেলেও লাল মুখ করে কোনও জবাব খুঁজে পেল না।
হীরক দিদির কথা বেমালুম চেপে গেল। বলল, আমরা দুই ভাই। আমি বড়।
–এই জন্যেই শালা মাল তুলতে পারা যায় না আজকাল। কেউ আর মেয়ে পয়দা করছে না। সিগারেট খাস?
হীরক খায় না। মণীশ খায়।
–পকেটে আছে?
মণীশ পকেট থেকে উইলসের প্যাকেটটা এগিয়ে দিল। দিলীপদা একটা নিয়ে ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে প্যাকেটটা লুঙ্গির গোঁজে ঢুকিয়ে রাখল। মণীশের দিকে তবুও চেয়ে আছে দেখে ও থতমত খেয়ে পকেট থেকে দেশলাই বের করে জ্বালিয়ে দিল এবার।
লম্বা একটা সুখটান দেবার পর দিলীপদার মুখের রেখাগুলো একটু নরম হল। ততক্ষণে অনিকেত এসে গেছে। বিছানায় উঠে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসল দিলীপদা রাজার মত। শোন, আমি এখন বেরিয়ে যাব। ফিরতে সন্ধে হবে। ঘরের বাইরে বেশি ঘোরাঘুরি করিস না। আজকে ক্লাস শুরু হয়নি, অন্য কেউ তোদের তুলে নিয়ে চলে যাবে। খামোখা এক্সট্রা ক্যালানি খেয়ে যাবি। তার চেয়ে এই ঘরটা পরিষ্কার কর। ঝাঁট দে ভালো করে। আমিও আজ সকালে এসেছি এক মাস বাদে। ওই কাগজগুলো তুলে নিয়ে বেচে দিয়ে আয়।
–কোথায় বেচব?
–জগার কাছে। বলবি দিলীপ স্যারের কাগজ। শুধু ওজন করিয়ে রাখবি, টাকা আমি গিয়ে নেব। বুঝেছিস?
তিনজনে একসঙ্গে ঘাড় নাড়ল।
–আমি ফিরতে ফিরতে যেন ঘর একদম চকাচক হয়ে যায়।
ওরা সব পরিষ্কার করেছিল, শুধু খাটের তলা ছাড়া। সেই শাস্তি নিয়ে হীরক দিলীপদার খাটের তলায় মশা মারছিল। যখন বেরিয়ে এল ওর মুখের উপর পুরু ধুলোর সর। ওকে দেখে অনিকেত ফিক করে হেসে ফেলল।
–এই ল্যাওড়া! এখানে কি যাত্রাপার্টি হচ্ছে যে খ্যাক খ্যাক করে হাসছিস? যা, তুই গিয়ে এবার কুড়িটা মশা মেরে আন। এই হীরু, তোর মশাগুলো রাখ এই কাগজের উপর। জালি করে একজন আরেকজনের মশা নিয়ে দেখাবি, সেটা হবে না।
দিলীপদার ঘনঘন মুড সুইং ওরা ধরতে পারছিল না। এই ভালো করে কথা বলছে, তার পরের মুহূর্তে অশ্রাব্য ভাষায় গালি। হীরক এইসব ভাষা শুধু বস্তিতেই শুনেছে। জানে, কিন্তু কোনওদিন নিজে এমন গালাগালি দেয়নি। রাতে খাওয়ার পর সেটাও হয়ে গেল। তাদের সি ব্লকের উল্টোদিকে ডি ব্লক। মাঝখানে মেস। সবাই নিজের নিজের মুরগিদের জামাকাপড় খুলিয়ে বারান্দায় দাঁড়াতে বলল। ওদিকে ডি ব্লকের সবাই জানালায়। এরপর শুরু হল গালাগালি। পিছন থেকে দিলীপদার মত সিনিয়ররা তদারক করছে। যে গলা খুলে চেঁচাচ্ছে না, পিছন থেকে ক্যাঁত করে এক লাথি। কেউ একবারও থামার সাহস দেখায়নি। এরকম প্রায় আধঘণ্টা চলল। পুরো ঘটনাটায় হীরকের বমি পাছিল। এরা সবাই বিভিন্ন স্কুলের থেকে ভালো রেজাল্ট করেই তো এখানে এসেছে। অথচ মুখের ভাষা দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনও বস্তির অশিক্ষিত গুণ্ডা। কেন এরকম? কেনই বা এমন ধরে ধরে মারছে? কাদের উপর এত রাগ যার ঝাল নতুন ছেলেদের উপরে মেটাচ্ছে?
এর উত্তর দিলীপদা দিয়েছিল দিন সাতেক বাদে। তাদের র্যাগিং শেষ। প্রথম দুচারদিনের পরে তেমন কিছু আর হয়নি। এখন দিলীপদা একেবারে ইয়ার দোস্ত। অনিকেতের কাঁধে হাত দিয়ে বলল, তোর বোনকে নিয়ে অনেক কথা বলেছি। কিছু মনে করিস না ভাই।
–তাহলে বললে কেন?
ধোঁয়া ছেড়ে দিলীপদা খেঁকিয়ে উঠল, ওরকম ন্যাকানোচোদা হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়? শুধু বই মাড়ালে হয় না, এগুলো তোদের ট্রেনিং। তোদেরও দায়িত্ব নেক্সট ইয়ারের মুরগিদের সাইজ করা।
কে যে এই মহান দায়িত্বের ট্র্যাডিশান চালু করেছে হীরক জানে না। ভালোয় ভালোয় মিটে গেছে, এটাই শান্তি। বাড়িতে একদিন বাদে বাদে ফোন করে খবর জানিয়েছে এতদিন। গায়ে হাত পায়ে আস্ত আছে জেনে ওদের নিশ্চিন্তি।
ধীরে ধীরে এই নতুন জীবনের স্বাদ রপ্ত হচ্ছিল হীরকদের। মেসের খাওয়া মোটেই সহ্য হচ্ছিল না। সেটা হতে আরও কদিন লাগবে। নিজেদের ঘরে সেটল করে গেছে। নোংরাগুলো আর চোখে লাগে না। বাড়িতে মণীশের নিজের বিশাল ঘর ছিল। এখানে শুধু একটা কোনা। দিলীপদার পারমিশান নিয়ে টেবিলের সামনের দেওয়ালে ম্যাডোনা আর মাইকেল জ্যাকসনের পোস্টার লাগিয়েছে। ওয়াকম্যান কানে লাগিয়ে গান শোনে। হীরক নিজের কোনায় সেরকম কিছু ঝোলায়নি এখনও। অনিকেত আবার বিবেকানন্দের পোস্টার লাগিয়েছে। অনিকেতের খাট দিলীপদার উল্টোদিকে। দিলীপদা বিবেকানন্দের ছবি দেখে ব্যাজার মুখে বলল, এটা তুই কী কেলো করলি? আমার টেবিলের দেওয়ালে সামান্থা ফক্স মাই ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বিবেকাননদর চোখের সামনে। দেখতে খারাপ লাগে না? দিলীপদার দেওয়ালে সামান্থা ফক্স, ব্রুক শিন্ড ছাড়াও ডেবোনিয়ারের সেন্টার স্প্রেড সাঁটা আছে। অনিকেত বিবেকানন্দকে খুলে দেরাজের গায়ে সেঁটে দিল। মুখ উল্টো দিকে হয়ে গেল। সেটা দিলীপদার পছন্দ হল। একে বলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। যে যার ফিল্ডে খেলছে।
ঘরের জানালাগুলোয় কোনও শিক নেই। খুব বড় জানালা, পাশ দিয়ে চলে গেছে আনোয়ার শাহ রোড। আলো বাতাস খুব খেলে। তবে বৃষ্টির সময় জানালা বন্ধ না থাকলে ঘর ভেসে যাবে। উল্টোদিকের ফ্ল্যাটবাড়ির জানালাগুলো বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। না হলে ছেলেরা জানালার ধারেই বসে থাকত হয়তো।
কলেজ যাওয়ার পথে অনিকেত বলছিল, ছেলেগুলো এত ফ্রাস্টো থাকে কেন বল তো?
মণীশ বিন্দাস। এগুলো হচ্ছে রিয়্যাকশান। চার বছর ধরে গাঁতিয়ে এসেছে সবাই, তার ঝাল তোলে এই চার বছর। বাড়িতে গেলে দেখবি এরাই মেনি বিড়াল।
কদিনের মধ্যেই এরা ওরা রইল না আর। লবি দিয়ে গেলে হঠাৎ কেউ মুরগি বলে দাঁড় করিয়ে হেনস্থা করার নেই। হস্টেল জীবনের স্রোতে মিশে গেল সবাই। যাদবপুরের হাওয়াও লেগে গেল কদিনেই। মণীশের যে কথা সেই কাজ। ক্লাসে ওর সঙ্গে দেখা হওয়া মুশকিল হল কদিনের মধ্যেই। হয় সত্যেনদার ক্যান্টিনে না হলে ইউনিয়ান অফিসে। ওর সাফ কথা। মস্তি করে নিই কদিন, বইপত্র তোলা রইল। ফাইনাল ইয়ারে আবার দেখা যাবে।
ক্লাসে অনিকেত আর বুদ্ধ হল হীরকের বন্ধু। অনিকেত তিস্তাপারের ছেলে। ওরকম খোলামেলা জায়গা ছেড়ে এসে কলকাতায় দমবন্ধ লাগছে। মাঝেমাঝেই কাকার বাড়ি গড়িয়ায় পালিয়ে যায়। বুদ্ধ কলকাতার ছেলে, ট্র্যাঙ্গুলার পার্কে বাড়ি। ওরা যখন হেঁটে হেঁটে হস্টেল থেকে ক্লাস করতে আসে, বুদ্ধ আসে বাসে ঝুলতে ঝুলতে। প্রথম পিরিয়ডটা মিস করে মাঝে মাঝেই। এর মধ্যে একদিন ক্লাস বাঙ্ক করে ওরা এসি ক্যান্টিনে বসে কফি খাচ্ছিল। এদিকটায় সায়ান্স আর আর্টসের ছেলেমেয়েরা আসে, বেশি কালারফুল। এদের নতুন স্টুডেন্ট আসে ইঞ্জিনিয়ারিঙের মাস খানেক বাদে। তাই এখন অনেক নতুন মুখ। এইখানেই কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে একমুখ দাড়িওলা তীর্থদা ওদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল।
আমার নাম তীর্থ। কেমিক্যাল থার্ড ইয়ার। তোদের সঙ্গে বসতে পারি? ছোটখাটো চেহারার ছেলে, শ্যামলা বরণ। গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি। ওরা চিনে গেছে। তীর্থদা জি এস। কলেজের প্রথম দিনে গান্ধিভবনে ভাষণ দিয়েছিল।
সঙ্গে সঙ্গে একটা মেয়েও এল। তোরা তো ফার্স্ট ইয়ার? আমি রূপসী, সিভিলের সেকেন্ড ইয়ার। মেয়েটা নামের সঙ্গে মানানসই, যদিও বেশ পৃথুলা গড়ন। কিন্তু খুব চটকদার। টানা টানা করে আঁকা চোখ, বড় বড় কানের দুল, চওড়া গলার হার। পরনে কমলা রঙের তাঁতের শাড়ি। হয়তো তীর্থর সাদামাটা পোশাকের জন্যেই ওর গেটআপটা খুব জমকালো লাগছিল। রূপসীর কাঁধেও অমনি একটা ঝোলা।
তীর্থদা খুব নরম গলায় কথা বলছিল। অথচ সেদিন ভাষণ দেওয়ার সময় বেশ আগুন ঝরছিল গলা দিয়ে। দেশের সমাজ, রাজনীতি নিয়ে তোদের কোনও অবস্থান আছে?
ওরা কী বলবে বুঝতে পারছিল না।
–দেশের কথা একটুও ভাবিস, না কি শুধু নিজের আখের গোছাতে চাস? রূপসীদি টাসটাস করে বলে উঠল।
বুদ্ধ রেগে গেল। রাজনীতি করি না, কিন্তু তাই বলে নিজের আখের গোছাবার কথা ভাবছি শুধু সেটাও সত্যি নয়। আমার কাকা সিপিএম-এ অ্যাক্টিভ। আমি বেশ কাছ থেকে দেখেছি ওদের কাজকর্ম।
–কেমন লাগে ওদের কাজ?
–অনেক ভালো কাজ করতে দেখেছি। বন্যার সময় কাকাদের দেখেছি রাস্তায় এসে দাঁড়ানো লোকের পাশে গিয়ে সাহায্য করতে।
–আমরা কিন্তু এসএফআইকে ঢুকতে দিই না যাদবপুরে। এসএফআইও না, ছাত্র পরিষদও নয়। রূপসীদি খুব অহঙ্কারের সঙ্গেই বলল। যদিও এসএফআই আর্টসের দিকে থাবা গাড়ার চেষ্টা করছে। মাঝেমাঝে বাইরের লোক এনে মিছিল বের করে, ইঞ্জিনিয়ারিঙের স্টুডেন্টদের কাছে কলকে পায় না।
–তাহলে তোমরা কী? নকশাল? অনিকেত জলপাইগুড়ির ছেলে। নকশালবাড়ির ছোঁয়া হয়তো পেয়েছে একটু। যদিও সেই সময় ও খুব ছোট ছিল।
তীর্থদা হেসে বলল, দ্যাখ এক সময় যাদবপুরে আগুন জ্বলেছে। সে বারুদের গন্ধ পুরো তো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি। কিন্তু সাতাত্তরে আমরা অ্যাপলিটিক্যাল ফ্রন্ট তৈরি করি। কোনও রাজনৈতিক দলের চামচাগিরি যাতে না করতে হয়। এটা তো বুঝিস যখনই ক্ষমতায় থাকা দলের স্টুডেন্ট উইংগুলো ঢুকে যায়, ওরা সরকারের প্রতিনিধি হয়ে ছাত্রদের স্বাধীন ভাবনাচিন্তাকে গলা টিপে দেয়। যাদবপুরে ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস ফ্রন্ট সবরকমের মতামতকে প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে। তুই যদি আমাকে জিজ্ঞেস করিস, আমার কি রাজনৈতিক ভাবধারা, আমি বলব আমি তথাকথিত নকশালপন্থায় বিশ্বাস করি। তবে আমাদেরও অনেক সংশোধন চলছে। একবার ভিতরে আসলে সব জানতে পারবি।
–ভিতরে আসব ভাবছ কেন?
–আমি কিছুই ভাবিনি। তোদের ভাবতে বলছি। শুধু নিজেরটা ভেবে আমরা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি, বেশিরভাগ সেটাই করে। যে দৌড় তোদের বাবা মা শুরু করিয়ে দিয়েছে, কলের পুতুলের মত সেই ট্র্যাকে দৌড়াতে দৌড়াতে সবাইকে পিছনে ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে পারিস। কিন্তু যদি একবার দাঁড়িয়ে ভাবিস, জীবনের বৃহত্তর মানে খুঁজতে চাস, সেইজন্যেই তোদের সঙ্গে কথা বলা।
–তার মানে এমন নয় যে তোদের গ্রামেগঞ্জে গিয়ে আন্দোলন করতে হবে। ছাত্রদের প্রয়োজন, শিক্ষার পরিকাঠামোর উন্নয়ন করা সেগুলো তো পরবর্তী প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের জন্যেই। রূপসীদি বটুয়া থেকে বিড়ি ধরিয়ে জ্বালাল। তোরা খাবি?
হীরক এই কদিনে সিগারেট খাওয়া ধরেছে। কিন্তু বিড়ি খায়নি কোনদিন। রূপসীদির পাতলা ঠোঁটে জ্বলন্ত বিড়ি দেখে কেমন একটা রোমাঞ্চ হল। নিল একটা। রূপসীদি ওর বিড়ির সামনে জ্বলন্ত দেশলাই ধরে বলল, তোরা তো ইলেক্ট্রনিক্সের স্টুডেন্ট। ল্যাবগুলোর অবস্থা দেখেছিস? পৃথিবী এগিয়ে চলেছে, নতুন করে কিছু হচ্ছে এখানে?
তীর্থদা বলল, জানিস কি ডিএসএফ কিভাবে শুরু হয়েছিল? ছাত্রদের প্রয়োজনেই। ছাত্রদের পাশে দা্ঁড়ানোর জন্য একটা অ্যাপলিটিক্যাল প্ল্যাটফর্ম। আটাত্তরে এখানকার স্টুডেন্টদের বাগে আনার জন্য এঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িংএর কোয়েশ্চেন এমনভাবে সেট করেছিল, যে বেশিরভাগ ছেলে হল ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়। স্পন্টেনিয়াস মুভমেন্ট ছিল এটা। আমরা অরবিন্দ ভবন ঘেরাও করি।
তীর্থদা চোখ জ্বলজ্বল করে এমনভাবে বলছিল যেন নিজেও ছিল সেইসময়। অরবিন্দ ভবনে উপাচার্যকে ঘেরাও করা হয়। সিপিএমের সরকার কী করল? পরদিন পুলিশ ঢুকিয়ে দিল, ধর্নায় বসে থাকা ছাত্রদের পেটানোর জন্য।
–সেদিন কিন্তু এসএফআইয়ের টিকিও দেখা যায়নি। পরদিন গেটের কাছে নিজেদের লিফলেট বিলি করছিল। রূপসীদি গনগনে গলায় বলে উঠল। যাদবপুর এসএফআইকে ক্ষমা করেনি।
–এক্সামিনেশান সিস্টেমে পচন ধরে গেছে। প্রযুক্তিবিদ্যা এভাবে শেখানো যায় না। এসবের বিরুদ্ধে কথা বলতেই আমরা ডিএসএফ তৈরি করলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টি থেকে এসএফআইকে ল্যাজামুড়ো সমেত বের করে দেওয়া হয়েছে। সরকারের দালালি এখানে করতে দিই না আমরা।
রূপসীদি ঝোলা থেকে লিফলেট বের করল। আগামী সোমবার আমাদের মিছিল আছে। শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ নিয়ে। ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের সুরক্ষার জন্য। তোরা জয়েন কর। সবাই একসঙ্গে না হলে এই লড়াই এগিয়ে নেওয়া যাবে না।
ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিল।
তীর্থদা এবার নিজের ঝোলা থেকে দুটো পাতলা ম্যাগাজিন বের করল। ছাত্রদিশা আর নিশান। রাজনীতি আর সংস্কৃতি হাত ধরাধরি করে চলে। এই দুটো ম্যাগাজিন রাখ। বুদ্ধ হাতে নিয়ে উলটেপালটে দেখল।
–দ্যাখ ইউনিভার্সিটিতে শুধু ক্লাস করতে তো আসা নয়। এখানে অনেক রকম ক্লাব আছে। ড্রামা ক্লাব, মিউজিক ক্লাব। সায়ান্স ক্লাব আছে। যার যেটাতে ইন্টারেস্ট। তোদের যেটা ভালো লাগে জয়েন কর। অ্যাক্টিভ থাক, শুধু চোতা মুখে নিয়ে বসে থাকিস না। রূপসীদি উঠে দাঁড়াল। তীর্থদা আমি চলি, এবার একটা ক্লাস করতে হবে আমাকে।
–আমাকেও উঠতে হবে রে। তোদের সঙ্গে আরও কথা হবে। সোমবার দিন মিছিলে আসতে ভুলিস না।
ওরা চলে গেলে অনিকেত বলল, তোরা যাবি নাকি?
বুদ্ধ লিফলেটে চোখ বোলাচ্ছিল। অনেক দরকারি কথা তো তুলেছে ওরা। যেতে পারি। দেখি তখন কী ক্লাস থাকবে।
–আমি এসব পলিটিক্সে নেই। একবার ঢুকলে আর বেরোবার পথ পাব না। অনিকেত রাজনৈতিক আন্দোলন খুব কাছ থেকে দেখেছে। জড়াতে চায় না।
–হীরু তুই? তোর কী মত?
হীরক এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। শুধু নিজেরটা নিয়ে ভাবার মধ্যে একটা সঙ্কীর্ণতা আছে। বাইরের পৃথিবী আজ ডাক পাঠিয়েছে যেন। সেই ডাক এক কথায় উপেক্ষা করতে মন সায় দিচ্ছিল না। ভাবছিল যাওয়া উচিত। কথাগুলো তো ভালো। বুদ্ধ যেতে চায়, অনিকেত চায় না। তার হ্যাঁ না বলাটা কাস্টিং ভোটের মত। হেসে বলল, দেখি, যেতে পারি। নিজের ক্লাসের বাইরে অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়ে যাবে এই ফাঁকে। আর কিছু না হোক।
৪
–তোরা কী পেয়েছিস বল তো? পড়তে এসেছিস না চড়তে? বিজয়েতা কোমরে হাত দিয়ে দরজা আটকে দাঁড়িয়েছিল। পরনে জিন্স, লাল রঙের কুর্তি। চুল ঝুঁটি করে পিছনে টানা। কপালে লাল টিপ। রাগে গাল লাল হয়ে টসটস একেবারে। মুখের প্রতিটা ভাঁজে বিরক্তি।
বিজয়েতার কথা শুনে ক্লাসে বসে থাকা গুটিকতক ছেলেমেয়ে খিক খিক করে হেসে উঠল।
সেমন্তী কুনালের কানে কানে ফিসফিস করছিল। এবার হি হি করে হেসে উঠল। ওরা কি গরু না কি যে চড়তে যাবে বিজু? বাকিদের হাসিটা এবার হো হো।
বিজয়েতা চোখের দৃষ্টি ক্লাসের দিকে ফেরাল। আমি এখানে ছ্যাবলামি করার জন্য দাঁড়িয়ে নেই। ড্যাম সিরিয়াস। এখানে অ্যাডমিশান নিয়েছি পড়াশোনা করার জন্য, ক্লাসে বসে মাছি তাড়ানোর জন্য নয়।
গ্যালারির একদম ওপরের বেঞ্চে বসে নোট লিখছিল অভিজিৎ। চোখের পিছনে চশমাটা ঠেলে দিয়ে বলল, মাছি তাড়ানোর জন্য গরুদের লেজ থাকে। গরুদের ক্লাসে ঢুকতে দেওয়া হোক।
হোক, হোক বলে ক্ষীণ ধবনি উঠল।
হীরক, বুদ্ধ আর অনিকেত দরজার সামনে মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার একটু সাহস পেয়ে অনিকেত বলল, তুই তো খেপলে রক্ষেকালী রে বিজু।
না, না ট্র্যাফিক পুলিশ। টিপটা দেখছিস না, রেড সিগন্যাল লাগিয়ে রাস্তা আটকেছে। বুদ্ধ মজা করে ব্যাপারটা হাল্কা করার চেষ্টা করছিল।
–তুইও এরকম করছিস বুদ্ধ? তোকে অন্তত একটু সিরিয়াস ভেবেছিলাম।
–উ তু ব্রুটাস? অভিজিতের ফোড়ন এল আবার শেষ বেঞ্চের থেকে।
হীরক এবার একটু তেজ দেখাল। কলেজে এসে সব ক্লাস করতে হবে তার কোন কমপালশান আছে নাকি? যেটা করতে ভালো লাগবে করব। যেটা পোষাবে না, কাটব।
অভিজিৎ আবার গলা তুলল। ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্সে তোর প্রক্সি কাকে ফিট করেছিস হীরক?
সেটাই খুঁজে বেরাচ্ছিল হীরকের চোখ। শুভাশিসকে বলে দেওয়া ছিল। ওকে তো দেখা যাচ্ছে না। শুভাশিস কি ক্লাস করেই চলে গেছে নাকি রে?
থমথমে গলায় বিজয়েতা বলল, ক্লাস হয়নি। একেটি এসে যখন দেখল ক্লাসে মাত্র সাতজন বসে, হি রিফিউজড টু গো অন।
অনিকেত একদম ডোন্ট কেয়ার এবার। প্যাকাটিটা একটা আকাট। একেটি লোকটি খুব সিড়িঙ্গে চেহারার, তাই ওর নিকনেম প্যাকাটি। বহু বছর ধরে ওর এই নাম চলে আসছে। ইন্ডিপেন্ডেন্সের সময় থেকে একটা চোতা বানিয়ে রেখেছে, ক্লাসে এসে গত তিরিশ বছর ধরে ওটাই ঝাড়ছে। কী হবে বল তো বিজু মেকানিক্স পড়ে? আমরা হচ্ছি ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার, মেকানিক্স পড়ে কী করব?
–তুই তাহলে এবার ডিন হয়ে যা। ডিসাইড করবি কোন কোর্সে কী পড়ানো হবে। বিজুর গলায় শ্লেষ ঝড়ে পড়ল। কটা ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কথা বলেছিস তুই? জানিস চাকরি করার সময় কোন সাবজেক্ট কাজে লাগে আর কোনটা লাগে না?
অনিকেতের বাবা স্কুল মাস্টার। থতমত খেয়ে চুপ করে গেল।
বুদ্ধ দাঁত বের করে হাসল। এত রাগ করছিস কেন রে বিজু? আমার বাবা ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, দাদু ছিল সিভিল। অনেক কথা বলেছি ওদের সঙ্গে। শুধু ক্লাস করে কেউ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যায় না।
–তাহলে কী করে হয়? লাল চেয়ারে বসে? তোরা কোন শিক্ষা নিতে ক্লাসের বাইরে ঘুরছিলি!
এতক্ষণে বুদ্ধ, হীরক, অনিকেত ক্লাসে ঢুকে বেঞ্চের দখল নিয়ে নিয়েছে। তোদের জন্যেই গেছিলাম রে। পরিকাঠামোর উন্নতি, ল্যাবগুলোর মডার্নাইজেশান— এইসব দাবিতে ডিএসওর মিছিল ছিল। সবার সঙ্গে গলা না মিলালে ভিসির কানে কোনও কথা উঠবে?
এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল কণিষ্ক। এবার সেও বিজয়েতার সঙ্গে গলা মিলাল, তোরা মিছিল করলি আর ভিসির চেয়ার কেঁপে গেল? এরকম আশা করিস?
–ওরে মাথাকাটা, এসব একদিনে হয় না। না শুনলে এরপর অরবিন্দ ভবন ঘেরাও হবে।
হীরকের কথায় একটুও পাত্তা দিল না বিজয়েতা। ঘেঁচু হবে। বছরের শুরুতে এইসব দাবী নিয়ে মিছিল হয় তোদের মত মুরগি ধরার জন্য।
–ঠিক বলছে বিজু। তোরা যদি ক্লাসে থাকতিস, আমাদের এই ক্লাসটা মিস হত না। সেমন্তী মাঝে মাঝে ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছিল।
–আচ্ছা শুধু আমাদের বলছিস কেন? ক্লাসে তো আরও কুড়িজন থাকার কথা। সে চাঁদবদনরা কোথায়?
–ঝাড় আছে, আজ আমার কাছে সবাই ঝাড় খাবে। কড়া গলায় শাসাল বিজয়েতা।
–পারবি মণীশদের সঙ্গে? ওদের একটা গ্যাং।
–ক্লাসে এলে তবে তো। এখন সংস্কৃতির প্রেপ চলছে। তার আগে কদিন ক্লাসে ঢোকে দ্যাখ। সেমন্তী অনেক খবর রাখে বোঝা গেল। ওদের ধরতে হলে তোকে টিটি রুমে যেতে হবে।
অভিজিৎ উপর থেকে এবার তার কিস্তিমাতের ঘোষণাটা শোনাল। যেন দেবদুলাল খবর পড়ছে। সেই টোন। একেটির নেক্সট ক্লাসে টেস্ট। আজ বলে গেছে।
–তাই ভাবি গুরু, তুমি কেন মাথা গুঁজে নোট লিখে যাচ্ছ।
ফিক করে হাসল এবার অভিজিত। রোগা লম্বা, চোখে গোল চশমা। ছোট করে ছাঁটা মাথার চুল খাড়া হয়ে থাকে। ক্লাসের কার্টুন। সিভিলের সুনয়না বলে একটা মেয়ের সঙ্গে স্কুলজীবন থেকে প্রেম। ক্লাসে ওকেও খুব কম দেখা যায়। চশমার উপর দিয়ে চোখ টিপল। এটাকে বলে স্মার্ট মুভ। যেদিন থাকা দরকার আমাকে ক্লাসে পেয়ে যাবি।
–শুধু পুরনো নোটস নিয়ে লাভ হবে না এবার অভিজিত। একেটি কী বলে গেল মনে আছে? দুটো ক্লাস মিস হয়েছে, ওর যা পড়ানোর ছিল কিন্তু হয়নি, সেগুলো সিলেবাসে ইনক্লুডেড।
এবার হীরকদের মাথায় বাজ পড়ল। ওরে শালা, এ তো হাতে হ্যারিকেন।
–না, না প্যান্ট হলুদ।
–অন্তত চোখে হলুদ সর্ষেফুল তো বটেই। ওদেরকে চিন্তিত করতে পেরে খুশি হয়ে এবার বসল বিজয়েতা। যা না বুদ্ধ, তোর বাবা দাদু তো সবাই ইঞ্জিনিয়ার। ওদের কাছেই ক্লাস করে নিস।
–ওদের সাবজেক্ট আলাদা ছিল। বেজার মুখে বলল বুদ্ধ।
–এখানে কোচিং ক্লাস হয় না কেন রে? বেশ নোটস পেয়ে যেতাম, ক্লাস করার ঝামেলা নেই। ভালো হত, তাই না বুদ্ধ? সেমন্তী লেগ পুল করছে না সিরিয়াস সেটাই ভাবছিল বুদ্ধ।
কণিষ্ক ইন্ধন জোগাল। এক কাজ কর বুদ্ধ। তোর ডিএসওর দাদাদের গিয়ে বল, একেটির আগেন্সটে একটা এজিটেশান করতে।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ আমাদের দাবী হবে, টেস্টে অ্যাপিয়ার করার জন্য ফিফটি পারসেন্ট মার্ক্স দিতে হবে। তারপর যে যা কুড়াতে পারে।
ফাঁকা ক্লাসরুমে হাসির রোল উঠল।
–এগুলো হাসির কথা নয়। এই কমাসেই যদি তোরা সবাই এরকম করতে থাকিস, সিনিয়ার ইয়ারে কী করবি? আমরা এখানে পড়তে এসেছি। বহু ছেলেমেয়ে এখানে পড়ার জন্য জীবন বাজি রাখতে পারে। আর আমরা সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে চাইছি না।
–কী দিচ্ছিস বিজু, তুই এবার আমাদের ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ দাঁড়াবি? কী জ্বালাময়ী ভাষণ।
–আমি সিরিয়াস। আমাদের ক্লাসে আর কোনও প্রক্সি পড়বে না। যে প্রক্সি দিবি, আমি উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করব। তারপর যদি এতে কারও পার্সেন্টেজ না থাকে, থাকবে না। বিজু নিজের ব্যাগ খুলে বই বের করে সেটায় চোখ রাখল। তাতে যদি মাথা ঠান্ডা হয়।
–আমাদের বলে লাভ নেই বিজু। আমরা সেরকম কিছু ক্লাস মিস করি না। এমনকি কেকেবির ম্যাথ ক্লাসেও লাস্ট বেঞ্চে হামাগুড়ি দিই। বলতে হলে ওদের বল। হীরক পিস অফার নিয়ে বিজয়েতার পাশে গিয়ে বসল। আমাদের উপর খেপছিস কেন বল।
–ওদের মানে কাদের? ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল বিজু।
–কেন মণীশ, সৌগত, সুজন— ওরা কোন ক্লাসটা করে?
–কেন, আমি কি তোদের স্পোক্সপারসন? তোদের মুখে কি টেপ লাগানো আছে? থাকিস তো মণীশের সঙ্গে এক রুমে, তুই বলতে পারিস না?
–অত টেনশান নিস না বিজু। এতদিন গাঁতিয়ে পড়াশোনা করেছে সবাই, কলেজে ঢুকে দুটো দিন বুকে হাওয়া ভরেছে। কটা দিন বেলুন হয়ে আকাশে উড়বে। তারপর হাওয়া বেড়িয়ে গেলে আবার ফুশ হয়ে মাটিতে পা পড়বে।
–অভিজিৎ ঠিকই বলেছে বিজু। কদিন বাদেই দেখবি ঠিক হয়ে যাবে। আসলে সব কটাই তোরেসের ঘোড়া। যেই দেখবে তুই মেকানিক্সে আশি পেয়েছিস আর ওরা চল্লিশ, জেতার তেজ ফিরে পাবে আবার। তখন দৌড়াতে শুরু করবে।
–শুধু চোখটা বেঁধে দিতে হবে। চোখে ঠুলি না বাঁধা থাকলে আমরা ভালো করে দৌড়াতে পারি না।
সবাই খুব হাসল। যদিও ইঙ্গিতটা নিজেদের দিকেই।
কিন্তু বুদ্ধর কথাগুলো সত্যি। প্রথম কয়েকটা টেস্টে দুই একজন ছাড়া সবাই বেশ কম পেল। ফেলও করল বলা যায়। তারপর বেশ কিছু ছেলেমেয়ে সিরিয়াস হয়ে গেল। পড়তে ভালো না লাগলে অন্তত চোতা বানানোর পরিশ্রমটা করল। ক্লাসেও অ্যাটেন্ডেন্স বেশ স্টেবল হল। কিন্তু কয়েকজন শুধরাবার নয়। মণীশ তাদের মধ্যে একজন। আসলে পাশও করে গেছিল কিনা।
যাদবপুরে পাশ করার হালহদিশ প্রথমেই রপ্ত করে নিয়েছিল যে।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা মণীশকে পাকড়েছিল হীরক আর অনিকেত। সে ছেলে ফুঁ ফুঁ করে উড়িয়ে দিয়েছিল একদম। ধুস, ওসব বিজু টিজুর কথায় কাঁপার পাত্র আমি নই।
–ফেল করলে কী করবি?
–ফেল করব কেন? প্যাকাটি গত তিরিশ বছর ধরে এক চোতা থেকে পড়াচ্ছে। কী কোশ্চেন করবে তার একটা বাঁধা গত আছে ওর। সব আমি জোগাড় করে ফেলেছি।
–কী জোগাড় করেছিস?
ফস করে ড্রয়ার থেকে এক তাড়া নোটস বের করল মণীশ। লাস্ট ইয়ারের নোটস। মুখ থেকে হাসি চলকে পড়ল।
–কোথায় পেলি মণীশ? অনিকেতের চোখ এবার উত্তেজনায় চক চক।
–প্রমিতা। ওর গতবারের চোতা। জেরক্স করে নিয়েছি। মেয়েরা খুব গোছানো হয়, সব সামলেসুমলে রাখে।
–তোকে কেন দিল রে মণীশ? সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল হীরক।
–তুই কি প্রমিতাদির সঙ্গে লাইন মারছিস নাকি মণীশ? উত্তেজনায় হীরক আর অনিকেত এবার একেবারে মণীশের খাটে উঠে এল।
–আমি কেন লাইন মারব? প্রমিতা আমার সঙ্গে লাইন মারছে। হাসতে হাসতে চোখ টিপল মণীশ।
–ও তো আমাদের সিনিয়ার!
–তো? মণীশের একদম ডোন্ট কেয়ার ভাব। দ্যাখ গিয়ে ফার্স্ট ইয়ার থেকে ফোর্থ ইয়ার— সবাই ওর সঙ্গে লাইন মারার জন্য দাঁড়িয়ে আছে
–তুই কি সিরিয়াস?
–দ্যাখ সিরিয়াস মানে কী? সব ব্যাপারে তোরা সিরিয়াস ভাবিস নিজেদের। আসলে তো কপিক্যাট। কপি করিস অন্যের জীবন। অন্যের শ্যাডো হওয়াটাই তোদের জীবনের লক্ষ্য।
–তার মানে?
–মানে কী আবার? এতদিন যারা ইঞ্জিনিয়ারিং কি ডাক্তারিতে চান্স পেয়েছে তাদের মত হতে চাইতিস। আর এখন? তুই বল না হীরু, স্কুলে থাকতে তো ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানতি না। কাউকে জোরে শুয়োরের বাচ্চা অবধি বলতে পারতি না। এখন কথায় কথায় গালাগালি ঝাড়ছিস? কেন? কারণ তোদের মনে হয়েছে হস্টেল লাইফে ওটাই নর্ম। তোদের ফলো করতে হবে। এটা শ্যাডো লাইফ ছাড়া কী? মণীশ মিত্র কারও ছায়া হয়ে বাঁচবে না আর।
হীরক আর অনিকেত ওর জ্বালাময়ী ভাষণে থ মেরে গেছে দেখে মণীশ খুশি হল। এতগুলো বছর আমি সিরিয়াস লাইফ লিড করেছি। বাপের উপদেশ, তোদের পিয়ার প্রেসারে সবকিছু সিরিয়াসলি করেছি। শপথ নিয়েছি আগামী চার বছর আর কোনও কিছু সিরিয়াসলি নেব না। জীবনটা হবে নদীর মত। যেদিকে ঢাল পাবে নেবে যাবে।
–গুরু কী দিচ্ছ। ঢাল দিয়ে নাবার সময় আমাদের দিকেও একটু তাকাস মাঝেমাঝে। অনিকেতের চোখ এখনও ওই নোটসের দিকে।
–ফ্রি পাওয়া যাবে না অনি। মাল ছাড়তে হবে।
–তুই নোটস নিয়ে পয়সা নিবি?
–তোর রুমমেটদের কাছ থেকে? আমি তোর স্কুলের বন্ধু। হীরকের গলায় অবিশ্বাস। তুই কবে থেকে এরকম চামার হলি মণীশ?
–সেন্টু দিয়ে কোনও লাভ নেই। মণীশ নরম হওয়ার নয়। হাসতে হাসতে বলল, আমাকে ইনভেস্ট করতে হয় না? টাইমের কথা ছেড়ে দে। ক্যান্টিনে বসে একঝাঁক মেয়ের খাওয়াদাওয়াগুলো আমাকেই ম্যানেজ করতে হয় কিনা। বাপের কাছে আর কত চাইব? আজকে আবার সিনেমা দেখতে যেতে হবে।
–প্রমিতাদির সঙ্গে?
–প্রমিতা একা না, সঙ্গে লেডিজ হস্টেলের আরও দুজন থাকবে। দুটো ভ্যাকান্সি আছে, চাইলে তোদের সঙ্গে নিতে পারি।
–কালকে প্যাকাটির টেস্ট।
–তাহলে বসে বসে গাঁতা।
–আর তুই? নোটস পেলেও পড়তে তো হবে তোকেই।
–ওসব অন্য ছকে হবে। আমি রাতে এসে চোতা বানাব। কোশ্চেন কী সেট করবে মোটামুটি জানা। শুধু অ্যান্সারগুলো টুকে নিতে হবে। বিন্দাস।
দিলীপদা মিনিট পাঁচেক আগে ফিরেছিল। ওদের গুজুর গুজুর দেখে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল। এবার খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল। তোকে কী ট্রেনিং দিয়েছি মাইরি। তিন মাস হয়নি, লেডিজ হস্টেল থেকে ছাম তুলে নিয়েছিস। দিলীপদা তার চোয়াড়ে গালে হাত বুলাল। পিতৃপুরুষের দান এই থোমার কাটিংটা একটু শোধরাতে পারেনি ভগবান। সারা জীবন মেয়েদের লেঙ্গি খেয়ে গেলাম।
–কোথা থেকে ফিরলে দিলীপদা?
–এই যে সন্ধ্যাবেলার টিউশানিটা ঝেড়ে আসলাম। ক্লাস নাইন।
–আমাকে একটা দেখে দাও না দিলীপদা।
–কাকে পড়াও, ছেলে না মেয়ে? মণীশ জানতে চাইল।
–সেলিমপুরের মেয়ে। যোধপুর গার্লসে পড়ে।
–ইল্লি! তুমিও তো ভালোই চালাচ্ছ দিলীপদা। একেবারে কচিকাঁচা দেখে ধরেছ।
মণীশের কথায় নিজের কপালের দিকে আঙুল দেখাল দিলীপদা। আমাকে মেয়ের বাবারা বিন্দাস হয়ে পড়াতে দেয়। কেন জানিস? জানে শত ঘুষ দিলেও কোনও মেয়ে আমার থোবনা দেখে প্রেমে পড়বে না। দিলীপদার বলার মধ্যে মজা থাকলেও নিজের চেহারা নিয়ে ওর দুঃখটা খাঁটি।
–আরে পুরুষের তেজটা আসল দিলীপদা। তুমি যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে খিস্তি ঝাড়ো, পুলিশ কোয়ার্টারের মেয়েগুলো তোমার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে। পুলিশের বাচ্চা তো, তেজকে সমীহ করে খুব।
–ওরে শালা, তোরা তো আমাকে র্যাগিং করা শুরু করেছিস এবার। তোদের আবার খাটের তলায় মশা মারতে পাঠাতে হবে দেখছি।
সবাই হো হো করে হেসে উঠেছিল।
ওরা যে মাত্র কয়েক মাস আগে এই জীবনে ঢুকেছে আজকাল সেটা যেন মনেই পড়ে না হীরকের। যেন এখানেই কতকাল। তিনমাসে একবার গেছিল শুধু দুর্গাপুরে। বিশ্বকর্মা পুজোর সময়ে। বাড়িতেও সে এখন একটু অন্যরকম। যেন অতিথি। মা বাজার করতেও পাঠায়নি। বরং বাবাকে দিয়ে একগাদা বাজার করিয়ে আনে। ছেলেটা ওখানে কী অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে আছে। দুদিন আমার হাতে পেটপুরে খেয়ে যাক।
দুপুরে খেতে বসে দেখল এলাহি খাবার। হস্টেলের গল্প হচ্ছিল। ওখানে কী খেতে দেয় রে তোদের? এই প্রশ্নটা নীলিমা আর না হলেও একশোবার করেছে।
–দেখলে অজ্ঞান হয়ে যাবে মা। মুখে দেওয়া যায় না একদম।
–তাহলে তোরা কী খাস?
–অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। যারা অনেকদিন ধরে আছে, ওই জলের মত ডাল দিয়েই ভাতের পাহাড় সাজিয়ে বসে মা। আর চিকেন দেয় কতটুকু জানো? হাত দিয়ে দেখাল হীরক। কোনওদিন হয়তো শুধু গলা পেলাম, ওই চিবিয়েই ভাত খাই।
নীলিমা তাড়াতাড়ি মুরগীর আর একটা ঠ্যাং খুঁজতে শুরু করল। সেই জন্যেই এত রোগা লাগছে তোকে। কণ্ঠার হাড়গুলো যেন ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, চোখের কোনে কালি।
–ধুস, ওসব কিছু না। আমার তো অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে, ওই দিয়েই দিব্যি খেয়ে নিচ্ছি। অনিকেত কী করে জানো মা? বেচারা একদম হস্টেলের খাওয়া মুখে তুলতে পারে না। রাত্রে খাওয়ার পরে এক প্যাকেট মেরি বিস্কুট কিনে চিনি দিয়ে খায় বসে।
–জলপাইগুড়ির ছেলেটা? আহারে। ও হয়তো বাড়িও যেতে পারেনি। এবার যাবার সময় টিফিন বাক্সে করে খাবার দিয়ে দেব, নিয়ে যাস ওর জন্যে।
নীলিমা হাত পাখা দিয়ে হাওয়া করছিল। হঠাত দেখল মার হাতের সোনার বালাটা ঝলকাচ্ছে না তো। খাওয়া থামিয়ে হীরক কিজ্ঞেস করল, তোমার বালাটা কোথায় গেল মা?
নীলিমা অত গা করল না। ওই এতদিনের পুরনো, তাই নতুন ডিজাইন করতে দিয়েছি।
নিশ্চিন্ত হল হীরক। কেমন ডিজাইন দিলে শুনি?
নীলিমা একটু এদিক ওদিক দেখল। রূপাটা ধারে কাছে নেই। গলা নাবিয়ে বলল, আসলে রূপার জন্য বানাচ্ছি। তোর বাবা পাত্র দেখা শুরু করেছে কিনা। তোর তো হিল্লে হয়ে গেল। একটা চিন্তা ঘাড় থেকে নেবেছে। এবার রূপার একটা সুরাহা হয়ে গেলে, ব্যস। চিনুর দায়িত্ব তোর উপরে। ছেলের দিকে গর্বের চোখে তাকায় নীলিমা। তার এই ছেলেই সংসারের হাল ধরবে। তোর আর কতদিন আছে রে হীরু?
–সবে তো ঢুকলাম মা। চার বছরের কোর্স তো আর এক বছরে করা যাবে না। একটু বিরক্ত হয়েই বলল, কিন্তু মনে মনে নিজেকে সাবধান করল হীরক। সে আজকাল বড্ড তীর্থদা আর রূপসীদিদের সঙ্গে ভিড়ে গেছে। মিছিলে গেছে কয়েকবার। দুদিন ওদের মিটিং-এ গিয়েছিল। তারপর ক্লাস টেস্টে সেরকম সুবিধা করতে না পেরে, ক্লাস কেটে আর যাচ্ছিল না ওদের সঙ্গে। কদিন আগেই তীর্থদা ওদের ধরেছিল সত্যেনদার ক্যান্টিনে। কী ব্যাপার তোদের দেখি না কদিন? আয় আয় চা খাই এক সঙ্গে।
ওরা বসতে একথা সেকথার পর জিজ্ঞেস করেছিল, তোরা কালবেলা পড়েছিস?
বুদ্ধ বলেছিল— পড়েছি, তাতে কী হল? তোমার মনে হয় না বড্ড বেশি রোম্যান্টিক?
–রোম্যান্টিসিজম কি খারাপ? মানুষের কথা ভেবে নিজের জীবন বাজি রাখাটাও কি বেঁচে থাকা নয়? সব মানুষের জন্য সমান অধিকার, বাঁচার সমান সুযোগ খোঁজার যে আইডিয়া সেটা কি অন্যায়? নাকি চোখে ঠুলি বেঁধে কর্পোরেট রেসে দৌড়ে চলাটাই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে? লিকলিকে চেহারার তীর্থদার একমুখ দাড়ি। পরনের জামাকাপড় খুব সাধারণ, কলেজ জীবনের কোনও ফ্যাশনের ছোঁয়া কোনওদিনই লাগেনি। কিন্তু তীর্থদার একটা উপস্থিতি আছে। সেটা হীরক অস্বীকার করতে পারেনি।
–আমি বলছি না, তোদের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া বন্ধ করে গ্রামে চলে যেতে হবে। যাওয়া হয়তো দরকার নিজের দেশটাকে জানার জন্য। কিন্তু না গিয়েও অনেকভাবে মানুষের জন্য করা যায়। আর কিছু না হোক, প্রতিবাদ তো করা যায়।
তীর্থদার কথা শুনতে শুনতে গা শিরশির করে, মন ছটফট করে ওঠে কিছু করার জন্য। কিন্তু গুটি কেটে বেরোনোর সাবধানতায় খুব মেপে মেপে বলেছিল, তীর্থদা, সেই প্রতিবাদের ফলটা কী? গন্তব্য কোথায়?
কিছু কিছু ছবি মাথায় সেঁটে যায় সারা জীবনের মত। খুব ছোটবেলায় পেয়ারা গাছ থেকে পড়ে হীরক বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল। আস্তে আস্তে ঝাপসা থেকে আলোর দিকে পৌঁছানোর মুহূর্তে দেখেছিল মার ঝুঁকে পড়া উদ্বিগ্ন মুখ যার প্রতিটা কুঞ্চন হীরকের জন্য ভালোবাসায় জারিত। কলকাতায় বসে বাড়ির কথা ভাবলেই মুখটাই চোখে ভাসে শুধু। তেমনি খোদাই হয়ে আছে রক্তে মেখে মাঝরাস্তা জুড়ে পড়ে থাকা নিঃসাড় অতীনদা। গলায় গোঙানি চেপে রেখার হাত ধরে হীরক বাড়ির দিকে ছুটছে। সেই ছবিটাকেই তুলে এনেছিল তীর্থদার সঙ্গে কথায়। আমি আমার ছোটবেলায় অতীনদার গুলিলাগা শরীরটাকে ওর নিজেরই বাড়ির দোরগোড়ায় পড়ে থাকতে দেখেছি। নকশাল করত। তিন বছর বাদে বাড়িতে ঢুকেছিল অতীনদা।
–ভয় পেয়ে গেলি তাতেই? তীর্থদা উপহাস করেনি, কিন্তু গলায় চ্যালেঞ্জ।
হীরক সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারেনি। ভয় তো সে পেয়েছিল। কিন্তু তার চেয়েও কিছু বেশি। কথাগুলো সেভাবেই এল; একটা দুটো করে। বৃষ্টিশেষে আলশে থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ার মত। মরে যাওয়ার ভয়, তীর্থদা? অস্বীকার করব না। কিন্তু আরও বেশি ভয় সেই মৃত্যুর আগে পিছে কিছু না দেখায়। কী লাভ হয়েছিল অতীনদার মৃত্যুতে? কিছু কি বদলেছিল, সমাজের? শুধু কমলামাসির জীবনের মানে হারিয়ে গিয়েছিল। তাই বলছি সঠিক গন্তব্য কি আর জানা আছে তোমাদের?
তীর্থদার নিজের কি সব উত্তর নখের ডগায় ছিল? কিন্তু জানার খামতি মুড়ে দিয়েছিল বিশ্বাসে। চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলেছিল, গন্তব্য জানি রে। শুধু এখন তার পথটা এলোমেলো হয়ে আছে। তবে সেই পথ খুঁজে বের করার কাজটা কিন্তু আবার শুরু হয়েছে।
পথ যে খুঁজে পাওয়া যাবেই সে বিষয়ে তীর্থদার হয়তো দৃঢ় বিশ্বাস আর আত্মপ্রত্যয় ছিল। কিন্তু হীরক আর বুদ্ধের অতটা নয়। সেদিন ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে বুদ্ধ সেই কথাই বলেছিল।
বুদ্ধর মধ্যে একটা আদর্শগত দিক আছে, ভাবপ্রবণতা। সেটাই প্রথম দিন আলাপ হওয়ার পর থেকে টেনেছিল হীরককে। কিছুটা বুদ্ধর জন্যেই সেও জড়িয়ে পড়ছিল রাজনীতিতে। কিন্তু যখন সেই ছেলেই বলল, ভগবানে বিশ্বাস করার মত অন্ধের মত ওদের পথ অনুসরণ করতে পারব না। দেশের জন্য, সমাজের জন্য কিছু করতে চাই। কিন্তু এই কদিনে এমন কিছু দেখিনি যাতে মনে হয় ওদের সেরকম নেতৃত্ব আছে। এখন একটু আলগা দিলেই ভালো। কী বলিস?
তাই করবে হীরক। রাশ টানতে হবে। একটা পুরো পরিবার তার দিকে চেয়ে অপেক্ষা করছে। সে রাজনীতিতে ভেসে গেলে চলবে না। কোনও হাতছানিতেই নয়। বরং দিলীপদাকে ধরে দুটো টিউশানি যদি বাগাতে পারে, বাবার কাছ থেকে মাসে একশো টাকা কম নেবে সে।
চাকরি পেলেই মাকে একটা মোটা দেখে সোনার বালা গড়িয়ে দেবে হীরক।
(ক্রমশ)
ছায়াপাখি-র সমস্ত পর্বের জন্য ক্লিক করুন: ছায়াপাখি – বিশ্বদীপ চক্রবর্তী