ভোটরঙ্গ: শুভচন্দ্রদের অশুভ দাপাদাপি

কল্যাণ বসু

 


প্রাবন্ধিক, শিক্ষক

 

 

 

রাজ্য-রাজনীতিতে ভোটকেন্দ্রিক ডামাডোলে জন্ম নেওয়া বর্ণময় বোলচালের অনুসন্ধানে নেমে সন্ধান মেলে কত কথা দলবদল নিয়ে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে নিমকহারাম দলবদলুদের পান্ডাদের নিয়ে। লিখতে বসে দিশেহারা অবস্থা, কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলব। এমন এক সঙ্কটকালে মুশকিল আসান হিসাবে দেখা মিলল এক প্রাজ্ঞ ভদ্রলোকের, কোনও এক কলেজে অধ্যাপনা করেন তিনি। শিয়ালদা মেন লাইনের ট্রেনে দলবল নিয়ে এসে বসলেন, নিত্যযাত্রী সবাই। শুরু হল সাম্প্রতিক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা। প্রায় সবাই প্রশ্নকর্তা আর সেই স্যার অবলীলায় সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছেন লঘু চালে। পাশে একটা সিট পেয়ে বসলাম এবং মূলত শ্রোতা হিসাব অচিরেই আড্ডায় মজে গেলাম। নেতানেত্রীদের বোলচালের ওপর নির্ভর করে কীভাবে পাবলিকের বোলচাল নির্ধারিত হয় তার প্রমাণ মিলল আরও একবার। শ্রুতিধর হিসেবে সেদিনের সেই আড্ডার কিছু অংশ প্রশ্নোত্তরের আকারে পেশ করা যাক।

প্রশ্ন: করোনার বিরুদ্ধে ভারতে বিশ্বের বৃহত্তম গণটিকাকরণের সূচনাপর্বে মোদিজির ভাষণ কেমন লাগল স্যার?

স্যার: খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম, ভাবছিলাম ডায়ালগ-মাস্টার আবার নতুন কোনও ডায়ালগ ঝেড়ে বসেন কিনা। কিংবা বিনে পয়সায় সবাইকে টিকা জোগান দেওয়ার কথা বলতে গিয়ে সরকারের জায়গায় ‘আমি দিচ্ছি’ ঘোষণা করে না বসেন। সকালে বাজারে গিয়ে যেমন এক মোদি-ভক্তের মুখে শুনলাম ‘মোদি হেব্যি টিকা বানিয়েছে।’ তার মানে টিকার আবিষ্কারকও মোদি! বিস্ময় কাটতে না কাটতেই বাড়ি ফিরে খবরের কাগজে খবরটা দেখে চক্ষু চড়কগাছ! সত্যি সত্যিই ত্রিপুরার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন মোদিজি নাকি করোনার ভারতীয় টিকা আবিষ্কার করেছেন! ভাবুন, এইসব ‘রাম’-ভক্তদের ভরসাতেই পদ্মবনবিহারীরা দেশের শাসনক্ষমতায় উপবিষ্ট, এবার স্বপ্ন দেখছে পশ্চিমবঙ্গ দখলেরও। না, শুধু এইসব সাধারণ পাবলিকের কথা বলে নাক সিঁটকে লাভ নেই। এই তো কিছুদিন আগে  কেন্দ্রীয় জলশক্তিমন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত উত্তর ২৪ পরগণার গাইঘাটার চাঁদপড়ায় এসে বলে গেলেন করোনার কারণে লকডাউনের সময় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষকে বিনামূল্যে চাল-গম জোগানোর জন্য মোদিজির নাকি নোবেল পুরস্কার প্রাপ্য! আমি বলতে চাই, বিপুল শস্যভাণ্ডার মজুতের পিছনে দেশের যে কৃষক সমাজ তাঁদের কথা বেমালুম উপেক্ষা করে সব কৃতিত্ব মোদিজির মুকুটে? আর কৃষি আইন নিয়ে দুর্বিষহ আন্দোলনরত সেই কৃষকদের (মৃত্যুও হয়েছে আড়াইশোর বেশি কৃষকের) প্রতি মোদি সরকারের ভূমিকা কী তা তো দেশ-বিদেশের মানুষ দেখছেন। করোনাকালে মোদিজির ভূমিকা কী? না, টিভির পর্দায় বক্তৃতা আর করোনা তাড়াতে কখনও হাততালি, কখনও থালা-ঘটি-বাটি কাসর-ঘন্টা বাজানো, কখনও বা বাড়ির সব আলো নিভিয়ে দোরগোড়ায় মোমবাতি বা প্রদীপ জ্বালানোর নিদান। আর হ্যাঁ, করোনার উপদ্রব যখন তুঙ্গে তখন পারস্পরিক দূরত্ববিধির তোয়াক্কা না করা মাস্কবিহীন সাধু-সন্ন্যাসী ভক্তবৃন্দদের বিরাট সমাগমসহ  রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিনি। করোনা অতিমারির ক্ষেত্রে মোদিজির এইসব ব্যক্তিগত অবদানের জন্য তাঁকে নোবেল দেওয়া উচিত, এই দাবি নোবেল কমিটির কাছে পাঠালে তার ফিডব্যাক কেমন হবে ভেবে রোমাঞ্চ হচ্ছে।

প্রশ্ন: বিজেপি দলের বিভিন্ন দৈর্ঘ্যপ্রস্থের নেতা যত না চেঁচিয়ে ভাইপোকে তোলাবাজ, চোর বলছেন, তৃণমূলছুট শুভেন্দু তার থেকে বহুগুণ চেঁচিয়ে বলছেন। চোর শব্দটা শেষ পর্যন্ত ওরা করোনার টিকার সঙ্গেও যুক্ত করলেন! এই বিষয়ে কী বলবেন স্যার?

স্যার: দেখুন, এই প্রশ্নের চারটি বিষয়ের উল্লেখ আছে। একটা পার্টি, দুজন মানুষ (‘ভাইপো’ সর্বনামে একজন, অন্যজন সরাসরি শুভেন্দু নামে) ও কিছু কলঙ্কজনক বিশেষণ (তোলাবাজ, চোর)। এক এক করে বলি। প্রথমে সর্বনাম প্রসঙ্গে। মমতা ব্যানার্জির ভ্রাতুষ্পুত্র অভিষেককে বিরোধীরা যা খুশি বদনাম দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভাইপো সম্বোধন করছে। অভিষেক প্রকাশ্য জনসভায় চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন সাহস থাকলে তাঁর নামোল্লেখ করে ওইসব বদনাম দেওয়া হোক। কিন্তু ওইসব বীরপুঙ্গবেরা মানহানি মামলার ভয়ে সেই ভাইপো সম্বোধনকেই হাতিয়ার করেছেন। মানহানির মামলার ভয় কতটা তা অহর্নিশ নিজেকে স্বঘোষণায় বীর প্রতিপন্ন করা শুভেন্দুর এক বক্তৃতায় নগ্নভাবে উন্মোচিত। মেদিনীপুরের এক জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে টেট কেলেঙ্কারিতে যুক্ত সেই অঞ্চলেরই দুজনকে অভিযুক্ত করলেও তাদের নাম নিতে সাহস পাননি তিনি। মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজেই বলেছেন ‘নাম বলা যাবে না, ডিফেমেশনের সমস্যা আছে।’

এই সমস্যার কথা মাথায় রেখেই ট্রেন কমপার্টমেন্টে পাবলিক প্লেসে আমিও এখন যা যা বলব আভাসে ইঙ্গিতে স্বনির্মিত সর্বনামে সম্বোধনে বিশেষণে। শুরু করি শুভচন্দ্রকে দিয়ে। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের রূপকথা ‘ঠাকুরমার ঝুলি’-র হবুচন্দ্র রাজা ও গবুচন্দ্র মন্ত্রীর মতো শুভচন্দ্র। বোঝা গেল না? তাহলে চন্দ্র শব্দের প্রতিশব্দগুলি, যেমন, শশী, সোম, শশাঙ্ক, বিধু, ইন্দু ইত্যাদি থেকে একটা তুলে নিয়ে ভাবুন। তাঁর বাবা শাসক দলের নেতা, অনেকের দাদা। সেই বিচারে তাঁকেও ‘কাঁথির ভাইপো’ বলা হচ্ছে। দলবদলের বিশ্বাসঘাতকতা, চুরি, তোলাবাজির অভিযোগ তুলে তাঁকে ‘মেদিনীপুরের কালো সন্তান’ আখ্যা দিয়েছেন এক নেতা। তাঁর দুধক্ষীর খাওয়া টকটকে টুসটুসে চেহারা দেখে তিনি তাঁকে ‘গৌর সোনা’-ও বলেছেন। তাঁর বাংলা উচ্চারণ দেখে অনেকে তো তাঁকে ‘ওড়িয়া বাঙালি’ বলে ডাকতে শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রী যেমন ‘গৃহবাসী’ বলতে গিয়ে ‘গ্রহবাসী’ বলে বসেছেন, তেমনি পুলিশের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করার সময় শুভচন্দ্র কনস্টেবলকে কনওসটবল্ বলে গেলেন, ঠিক যেমন দলবদলু সাংসদ অর্জুন ক্রিমিনালকে কিছুতেই কিরিমনাল ছাড়া বলতে পারেন না! অন্যকে বেনামে আক্রমণ করলে বুমেরাং হতে পারে যে শুভচন্দ্রবাবুর মতো পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ সেটা বুঝলেন না?

আর ভাইপো সম্বোধনে ক্রমাগত বিভিন্ন কুৎসা চিৎকার করে বলে গেলে সেটারও যে পাল্টা হতে পারে তারও প্রমাণ মিলছে। থুতু উপর দিকে ছিটালে কিংবা কাচের ঘরে বসে অন্যের দিকে ইট ছুড়লে কী হয় শুভচন্দ্র ভালই টের পাচ্ছেন। তিনি ভাইপোকে যত বেশি চোর বলছেন (তিনি যাকে যশস্বী প্রধানমন্ত্রী বলে ক্রমাগত পদলেহন করছেন তাঁকে দেশজুড়ে এক সময় ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ বলে চিৎকার করে সম্বোধন করেছে, যেই চিৎকারে কদিন আগে অবধি তিনিও সামিল ছিলেন কিন্তু) পাবলিক তত তাঁর উদ্দেশ্যে বলছে ‘চোরের মায়ের বড় গলা’। কিংবা ভাইপো বিদ্রূপ করে বলছেন ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আমি আজ চোর বটে’। যে টেট কেলেঙ্কারির কথা শুভচন্দ্র বলছেন মেদিনীপুর জুড়ে বহু ছেলেমেয়ের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধেই আছে, তিনি দল ছাড়ার আগে থেকেই সেটা শোনা যায়। ভাইপোকে তোলাবাজ বলছেন অথচ হলদিয়া থেকে কোটি কোটি টাকা তোলা তোলার অভিযোগ শুভচন্দ্রের বিরুদ্ধেই। নারদা-সারদা কাণ্ডে অভিযুক্ত অনেকের মতো তাঁর বিরুদ্ধেও বিস্তর টাকা বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ প্রবল। ভাইপোকে চিটিংবাজ, তোলাবাজ, চোর ইত্যাদি যে যে বিশেষণে আক্রমণ করেছেন তার সবগুলিই শুভচন্দ্রের দিকে ব্যুমেরাং হয়ে ফিরেছে। তবে বিশ্বাসঘাতক, নিমকহারাম, বেইমান, বিভীষণ, মীরজাফর ইত্যাদি শব্দ একান্তই তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। তিনি যেমন বলে বেড়াচ্ছেন ভাইপো বললে কাকে বোঝানো হচ্ছে বলতে হয় না, তেমনি বিশ্বাসঘাতক বললেই আসমুদ্রহিমাচল এখন শুভচন্দ্রর দিকেই আঙুল তুলছে। আর বলবেই না কেন? প্রথমত, যে দলে থেকে প্রায় দশ বছর মন্ত্রিত্ব ও বহু সুযোগসুবিধা ভোগ করলেন, ভোটের ঠিক প্রাক্কালে সেই দল ছেড়ে বৃহত্তর লিপ্সায় সেই দল ও তার নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে নিরন্তর কুৎসা করে চলেছেন। দ্বিতীয়ত, জনসভায় ঘুরে ঘুরে তিনি আগের দলের অন্দরমহলের কথা দৃষ্টিকটুভাবে নির্লজ্জের মতো রসিয়ে রসিয়ে জনসমক্ষে পেশ করছেন। তৃতীয়ত, প্রধান বিরোধী দলের এক সাংসদ জানিয়েছেন তাঁর জেতার পিছনে শুভচন্দ্রের অবদান ছিল। ভাবা যায় কোন মাত্রায় বিশ্বাসঘাতকতা! তিনি যে ২০১৪ সাল থেকেই তলায় তলায় সেই বিরোধী দলের সঙ্গে সংযোগ রেখে চলেছিলেন সে কথা শুভচন্দ্র নিজেই জানিয়েছেন! চতুর্থত, কতটা বেইমান হলে তিনি পশ্চিমবঙ্গকে মোদিজির হাতে তুলে দেওয়ার কথা চিৎকার করে ঘোষণা করতে পারলেন। পঞ্চমত, দলবদলের কয়েক দিনের মধ্যেই একটা কেন্দ্রীয় সংস্থার সর্বোচ্চ পদ পাওয়ার পর শুভচন্দ্র বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এত তাড়াতাড়ি আমায় বিশ্বাস করবেন ভাবিনি।’ তিনি যে চরম বিশ্বাঘাতকতার পরিচয় দিয়েছেন সেটা এই স্বীকারোক্তিতেও ধরা পড়ল না কি? ষষ্ঠত, তিনি নিজে বিশ্বাসঘাতকতা করেই ক্ষান্ত হননি, অন্যদের বিশ্বাসঘাতক বানাতেও ব্রতী হয়েছেন। অন্যদের দল ভাঙানোর কাজ তো করছেনই, সঙ্গে নতুন আর এক বেইমানির প্রস্তাব দিচ্ছেন। কী সেটা? বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি সিপিএম কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলছেন, ‘আপনারা সারা বছর সিপিএমের ঝান্ডা কাধে নিয়ে পার্টি করুন কিন্তু ভোটটা দিন বিজেপিকে।’ ভাবুন কতটা বিশ্বাসঘাতকতার প্রস্তাব!

সবশেষে সেই পার্টির কথা যেখানে যোগ দিয়ে শুভচন্দ্র তাঁর ফেলে আসা পার্টিকে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বলে অবিরাম গাল দিচ্ছেন। তাঁর নতুন পার্টিকে কী বলা হচ্ছে সেটা কি জানেন? ‘তৃণমূলের বি টিম’, ‘বিজেমূল’, ‘ভারতীয় জাঙ্ক পার্টি’, ‘ওয়াশিং মেশিন’…..। ওয়াশিং মেশিন না বলে ‘ভারতীয় ভ্যাট পার্টি’ বলা আমি বেশি যুক্তিসঙ্গত মনে করি। কারণ ওয়াশিং মেশিন বললে শোধনের কথা প্রচ্ছন্ন থাকে যা ইতিবাচক। কিন্ত দলবদলু বিভিন্ন কলঙ্কে অভিযুক্ত এই নেতারা অ-শোধনীয় পরিত্যক্ত বর্জ্য, যাদের ঠিকানা একমাত্র ভ্যাটের সঙ্গেই তুলনীয়। ঠিক কি না? পশ্চিমবঙ্গের দুই যুযুধান রাজনৈতিক দলের আদর্শগত দেউলিয়াপনা এইভাবে সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিনিয়ত প্রকট হয়ে উঠছে।

প্রশ্ন: স্যার, এই ভোটের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য কি দলবদল নয়?

স্যার: অবশ্যই। আর এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যেও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন, এক, দলবদলের সব অভিমুখ মূলত বিজেপির দিকে। দুই, অজুহাত হিসাবে দলবদলুরা বিভিন্ন কথা বলছেন… মানুষের জন্য কাজ করতে পারছিলাম না, আগের দলে দমবন্ধ হয়ে আসছিল, মোদিজির হাত শক্ত করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই, বাবার ইচ্ছা ছিল বিজেপিতে যোগ দেই ইত্যাদি আরও কত কী। তিন, বিজেপিতে ঢোকার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার তাঁদেরই যাঁদের তৃণমূলী হিসাবে এক্সপেরিয়েন্স আছে। চার, ভোটের পর প্রার্থী কেনাবেচা তো পড়েই আছে, শুধু দলবদল করানোর পিছনে কতশো কোটি টাকা মোটাভাইরা ঢেলেছে তার অনুসন্ধান প্রয়োজন। পাঁচ, দলবদল নিয়ে একটা রসিকতা না করে পারছি না। কোন দল ক্ষমতায় আসতে চলেছে এই ঘ্রাণ পাওয়ার ক্ষেত্রে যাকে মাস্টার পার্সন বলা হয় সেই সুব্রত মুখার্জি যেহেতু তৃণমূল ছাড়েননি, তাহলে বলতে হয় তৃণমূলই ক্ষমতায় থাকবে।

প্রশ্ন: নন্দীগ্রামে মমতার চোট পাওয়াকে ঘিরে দলবদলু শুভচন্দ্রদের প্রতিক্রিয়া ভোটে কীরকম প্রভাব ফেলতে পারে?

স্যার: নন্দীগ্রামে মমতা আহত হওয়ার পর বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএমের তরফে যেভাবে সেটাকে নাটক বা ভণ্ডামি বলা হয়েছে তা সত্যিই কলঙ্কজনক। সবচেয়ে খারাপ নজির রাজনৈতিক অসৌজন্য। প্রধানমন্ত্রী এতবার রাজ্যে আসছেন অথচ একবারের জন্যও এই মুহূর্তে ভারতের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর আরোগ্য কামনা করে কোনও বার্তা পাঠাননি। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চারদিনের মাথায় প্রতিক্রিয়া জানালেন, তাও কটাক্ষের সুরে। অথচ উনি যখন করোনা থেকে সেরে উঠেছিলেন মমতা তাঁর শরীরের মঙ্গলকামনা করে সবসময় মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়েছিলেন। শুভচন্দ্রের তরফেও উড়ে এসেছে একই ধরনের বিদ্রূপ। ভোটবাক্সে এর প্রতিফলন ঘটবেই। তবে এটা ঠিক রাজনৈতিক অসৌজন্য পশ্চিমবঙ্গে অভিনব কোনও বিষয় নয়, বিগত কয়েক দশক ধরেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবনমন ঘটেছে, যার দায় কোনও দলই এড়াতে পারে না।

প্রশ্ন: আর ‘ডাবল সিলিন্ডার’ তত্ত্ব নিয়ে কী বলবেন?

স্যার: শুভচন্দ্র দলবদলের পর থেকেই বলে চলেছেন ‘যশস্বী ‘প্রধানমন্ত্রীর হাতে পশ্চিমবঙ্গকে তুলে দিতে চান। এর অনুষঙ্গ হিসেবেই তিনি ডাবল ইঞ্জিন তত্ত্বের মাহাত্ম্য প্রচার করছেন। এবং সেই সঙ্কীর্তনে গলা মিলিয়েছেন বহিরাগত হিন্দিভাষী একগুচ্ছ গেরুয়া নেতাসহ প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং! কী সেই মাহাত্ম্য? বলা হচ্ছে কেন্দ্রে শাসক বিজেপি। তাই পশ্চিমবঙ্গও বিজেপির দখলে এলে রাজ্যের উন্নতি হবে সর্বোচ্চ। কিন্তু এই তত্ত্ব চরম অগণতান্ত্রিক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী। তাহলে তো উন্নতির জন্য সব রাজ্যকেই বিজেপি-শাসিত হতে হবে, অর্থাৎ দেশজুড়ে একটাই দল থাকবে বিজেপি! এর থেকে ইউটোপিয়ান আর কী হতে পারে! উল্টোদিক থেকে ভাবলে রাজ্যে যদি বিজেপি ছাড়া অন্য দল ক্ষমতায় থাকে তাহলে কি কেন্দ্র যথোপযুক্ত সাহায্য না করে বৈমাত্রেয়সুলভ আচরণ করবে? সেটা কি সংবিধানস্বীকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সরাসরি বিরুদ্ধাচারণ নয়? এরকম একটা বিপজ্জনক বেআইনি অনৈতিক তত্ত্ব প্রধানমন্ত্রীসহ বিজেপির অন্যান্য নেতামন্ত্রীরা কীভাবে মঞ্চে দাঁড়িয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে ঘোষণা কছেন সেটাই আশ্চর্যের।

প্রশ্ন: প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ কেন্দ্রীয় গেরুয়া বাহিনি যেভাবে পশ্চিমবঙ্গে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করছেন এবং বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থাকে অপব্যবহারে মেতেছেন তাতে তো মনে হচ্ছে রাজ্যটার দখল নেবেনই। আপনি কী বলেন স্যার?

স্যার: জীবন সায়াহ্নে ‘পদাতিক’ কবি সুভাষ হাসপাতালে শুয়ে লিখেছিলেন: ‘চেয়ারে পা তুলে দিয়ে/ আপিসের এক বড়োবাবু/ ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন/ অবসরের আগে/ আরও একটা বড় লিফটের।’ পরের লোকসভায় কেন্দ্রে গদিচ্যুত হওয়ার আগে কেন্দ্রের বড়বাবুরাও পশ্চিমবঙ্গ দখলের মাধ্যমে একটা বড় লিফট্ চাইছেন, যদিও সেটা যে তাঁরা “ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন” বুঝছেন না।

আড্ডা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু অনন্যোপায়, তাই আমার স্টেশন আসতেই নামতে হল।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...