শৈলেন সরকার
প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
ছত্তিশগড়ের থেকে রাজিধানী শহর রায়পুরবাসী এক দূর-সম্পর্কিত ভাইপো ফোন করল। জানতে চাইল, বিজেপিই ক্ষমতায় আসছে তো? বললাম, কোথায়?
–কেন বাংলায়?
বললাম, ‘আগে পঞ্চাশটা পাক।’ ওর কণ্ঠস্বরে এবার বিরক্তি। বলল, ‘তুমি আবার তৃণমূল করছ কবে থেকে?’ বললাম, ‘তৃণমূলের সঙ্গে আমার এ কথার কী সম্পর্ক, তুই জিজ্ঞেস করলি বিজেপি ক্ষমতায় আসছে কিনা, আর আমার যা মনে হচ্ছে বললাম।’ এবার ও যেন পিছু হটল একটু, বলল, সব সার্ভেতে তো একশোর ঘরে দেখাচ্ছে বিজেপি-র। এবার বললাম, কে কী দেখাচ্ছে কে জানে কিন্তু বিজেপি-র চল্লিশ পার করা কঠিন, আর ত্রিশের ঘরেও যদি পায়, তাতে কম কী হল, এক লাফে তিন থেকে তিরিশ। ভাইপো ফোন কেটে দিল।
বঙ্গের বিজেপি-র সভাপতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী মোদি বললেন, ‘দিলীপ ঘোষের মতো মানুষকে নেতা হিসেবে পেয়ে বাংলা গর্বিত।’ নিশ্চয়ই গরুর কুঁজে সোনা আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত দিলীপ ঘোষের কাছে প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য একেবারে নোবেল প্রাইজের সমতূল্য। যদিও অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল পুরস্কার নিয়ে দলের মন্তব্য ধরলে নোবেল প্রাইজ পেতে বিদেশিনী বিয়ে করতে হয়। যাই হোক খাতায় কলমে বঙ্গের বিজেপি হলেও দিলীপ ঘোষকে আর বঙ্গ বিজেপি-র নেতা বলা যাবে? বঙ্গ বিজেপি-র নেতা এখন কৈলাস বিজয়বর্গীয়, নাড্ডা, যোগী আদিত্যনাথ এবং সর্বোপরি আজকের চাণক্য হিসেবে ফোলানো বেলুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। হ্যাঁ, বঙ্গ বিজেপি-র এই একুশের বিধানসভা নির্বাচনের নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশিত হল। প্রকাশ করলেন… না কোনও বাংলার নেতা বা বাঙালি নয়, প্রকাশ করলেন এক গুজরাটি… মহামহিম অমিত শাহ, আর প্রকাশ করলেন বাংলার ভাষা বাংলাতে নয়, হিন্দীতে। পাশে দাঁড়ানো বোবা ও কালা লজ্জাহীন বাংলা বিজেপি-ওয়ালা দিলীপ ঘোষ। যদিও বিজেপি-র অতিরিক্ত বকবকানির জন্য বিখ্যাত নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী প্রশ্ন তুললেন, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করা উচিত ছিল দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষেরই, অমিত শাহের নয়।
দিলীপ ঘোষের কথা ছাড়ুন, এককালের মানে এই মাসছয়েক আগেরও বঙ্গের বিখ্যাত বিজেপি নেতারা সব কোথায় গেল বলুন তো? সেই সব রাহুল সিংহ, সায়ন্তন বসু, জয়প্রকাশ মজুমদার, রাজু ব্যানার্জিরা? বা প্রথম যুগের তৃণমূল ভাঙিয়ে নিয়ে আসা মুকুল রায়, অর্জুন সিং, সনৎ মণ্ডল বা নিশীথ প্রামাণিক? শোভন চট্টোপাধ্যায় তবু তার প্রেমকাহিনির জন্য কিছুদিন খবরের কাগজে বা মিডিয়ায় বিচরণ করলেন। গত দেড়-দুমাস ধরে বিজেপি-র মিটিঙের স্টার ক্যাম্পেনার শুধুই বিজয়বর্গীয় বা নাড্ডা বা যোগী আদিত্যনাথ। আর অবশ্যই অমিত শা-নরেন্দ্র মোদি জুটি। টাকার বিনিময়ে সভায় যাওয়া লোকগুলিকে কতক্ষণ আর তুমি হিন্দি ভাষায় দুর্বোধ্য চিৎকার শুনতে বাধ্য করতে পারো? ফলে যা হওয়ার হতে শুরু করল তাই, প্রথমে ওই বিজয়বর্গীয়, যোগী আদিত্যনাথ বা নাড্ডার সভা ফাঁকা হতে শুরু করল, পরে এমনকি অমিত শাহেরও। এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সম্মানার্থে দূরদূরান্ত বা এমনকি পাশের রাজ্য থেকে লোক আনানো হচ্ছে কিন্তু তাও আর কতদিন?
দুমাস আগেও মনে হচ্ছিল বিজেপি তাহলে এসেই গেল। এতদিন উত্তরভারতীয় জাত-পাত সংস্কৃতি বাংলায় তার জয়পতাকা ওড়াল। কিন্তু না। কংগ্রেসের দিল্লি-নেতারা যেমন প্রদেশ কংগ্রেসের স্বাধীনতা কেড়ে রাজ্য কংগ্রেসকে স্থায়ীভাবে খোঁড়া করে দিয়ে গেছে, বিজেপি-র দিল্লি নেতারাও সেই একই রাস্তায় হাঁটলেন। ভাবলেন দিলীপ ঘোষ-রাহুল সিংহদের দিয়ে হবে না কিছু। সুতরাং ভয় দেখাও টাকা ঢালো। আসলেন মুকুল-অর্জুন-খগেশ্বর মুর্মু-নিশীথ-সনৎ। না এতেও পেট ভরল না, নাও শুভেন্দু-রাজীব-সব্যসাচী-শোভন। দিল্লির নেতারা ভাবলেন এনারা আসবেন আর সঙ্গে সঙ্গে দল বেঁধে হাজার হাজার মানুষ এই মহাপুরুষদের পথ অনুসরণ করে—। বিজেপি-র একজন প্রশান্তকিশোর থাকলে তিনি অবশ্যই বাধা দিতেন। এই লোকগুলিই যে আসলে তৃণমূলের দূর্নীতি আর অনাচারের মুখ, এই লোকগুলিই যে আসলে তৃণমূলের জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ তা না বুঝে এই সব মুকুল-শুভেন্দুদের নিজদলে এনে এঁদের হাতেই দল তুলে এঁরা নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই ডাকলেন। এঁদের দলবদলে একদিকে তৃণমূল হালকা হল, অন্যদিকে বিজেপি যে তৃণমূলের বিষ স্বেচ্ছায় গ্রহণ করল তা ধারনা করার ক্ষমতা দিলীপ ঘোষ বা রাহুল সিংহদের থাকলেও দিল্লির কর্তাদের অবশ্যই ছিল না। তাদের হাতে তখন এক চাণক্য অমিত শাহের সঙ্গে বাংলার আর এক চাণক্য মুকুল রায়। এবার নির্বাচনের মুখে এই চাণক্য মুকুলের হাত ধরে যেন দলবদলের বান ডাকল। শুরু হল পশু-পাখি ক্রয়-বিক্রয়ের মেলার মতো ‘যোগদান মেলা’। বিষ বিজেপির মাথায় উঠল। মোট ২৯৪ আসনের বিজেপি নির্বাচন প্রার্থীদের নাম এখনও পুরো ঘোষণা হয়নি, এর মধ্যেই তৃণমূল-কংগ্রেস বা বাম দল থেকে গিয়ে বিজেপি-র হয়ে নির্বাচন প্রার্থীর সংখ্যা প্রায় দেড়শো। বিজেপি এক্ষেত্রে অন্য দলগুলির দুরকম সুবিধা করে দিল। একদিকে এই লোকগুলি যারা অনেকেই ২০১৪ সাল থেকে টাকার লোভে বা ভয়ে তৃণমূল বা বাম-কংগ্রেসের নানা দায়িত্ব নিয়েও বিজেপি-র সঙ্গে যোগাযোগ রেখে নিজ দলের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত চালাচ্ছিল তা থেকে তৃণমূল বা অন্য দলগুলিকে বাঁচিয়ে দিল। অন্যদিকে এই সব লোকগুলির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের রাগ-ক্ষোভের পুরোটাই বিজেপি গ্রহণ করল। এবং এটা ঘটল একেবারে নির্বাচনের এক-দেড়মাস আগে। আর কিছু মানুষ যদিও বা বিজেপি-র প্রতি আশা নিয়ে তাকিয়েছিল এই দলবদলুরা সেই সব মানুষদের আশায় ছাই ঢালল।
কিন্তু একটা রাজ্য দখলের আশা যারা করছেন তাদের নিজেদের একেবারে কমিটেড ভোটার কত? একটা দল একটা রাজ্যে ক্ষমতা দখল করবে তার তো অন্তত শতকরা পঁচিশ ভাগ কমিটেড ভোটার থাকতেই হবে। (তৃণমূল কংগ্রেস কিন্তু কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হওয়া এবং কংগ্রেসি ঘরানারই দল। বাংলায় এই ঘরানার ভোটার বরাবরের জন্য অন্তত পঁয়ত্রিশ শতাংশ)। গত লোকসভার ভোট পার্সেন্টেজ দেখে বিজেপি-র দিল্লির নেতারা মাথা গরম করে ফেলেছিলেন। শ্যামাপ্রসাদের বাংলা এই এল বলে। সেটা যে সিপিএমের-ই এক বিরাট অংশ ভোটার তা তাদের যদি সত্যিকারের কোনও চাণক্য থাকত তাহলেই টের পেত। কিন্তু সিপিএম কি এবার তাহলে নিজেদেরই ভোট দেবে? দেবে মানে সবাই যে ফেরত আসবে তা বলা না গেলেও ফেরত আসবে অনেকেই। আসবে তরুণ ব্রিগেডের সৌজন্যে। তাছাড়া প্রবীণরাও বুঝতে পারছেন আর একটা নির্বাচন যদি বিজেপি-র জন্য ছেড়ে দেওয়া যায় তাহলে চিরদিনের জন্য বাংলা থেকে বিদায় নিতে হবে। হ্যাঁ, রায়দিঘির প্রবীণ নেতাও দেখলাম পুরনো দল সিপিএম ছেড়ে দেওয়া কর্মীদের একেবারে বাড়ি গিয়ে গিয়ে কথা বলছেন। মানুষের ভালোর জন্য দল ছেড়ে দেওয়া কর্মীদের ফের দলের হয়ে কাজ করবার কথা বলছেন। অর্থাৎ বিজেপি-তে চলে যাওয়া অনেক ভোটই এবার সিপিএম ফেরত পাবে।
আর একটু অবাক হওয়ার মতো ঘটনা হলেও ফুরফুরা শরীফের সিদ্দিকির বাম-কংগ্রেসের জোটে যোগ দেওয়ার জন্যও বিজেপি-র ক্ষতি হবে। গত লোকসভাতে পরিসংখ্যান কী বলছে জানি না, তবে হাওড়া, নদিয়া, বা আমার পরিচিত মেদিনীপুর বা দুই চব্বিশ পরগনার অনেক মুসলমানই তৃণমূলের ওপর বিতৃষ্ণায় সিপিএমের প্রতি হতাশায় বিজেপি-কে ভোট দিয়েছিল। আমার ধারণায় মোট সাতাশ পার্সেন্ট মুসলিম ভোটারের যথেষ্ট বড় অংশই। এবার সেই ভোট বিজেপি পুরোটাই হারাবে। অর্থাৎ সেই ভোট চলে আসবে সিদ্দিকির কাছে বা সিদ্দিকি হয়ে বাম-কংগ্রেস জোটে। কমবে বিজেপি-র অবাঙালি ভোটও, হ্যাঁ শতকরা দশ ভাগ যে ভোটের পুরোটাই লোকসভা ভোটে বিজিপির খাতায় যোগ হয়েছিল। অর্থাৎ নির্বাচনের আগের দেড়-দুই মাসে এমন কিছু ঘটেছে যার ফলে বঙ্গ-ভোটে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। ভুল বললাম, নাটকীয় হবে কেন, এটাই তো হওয়ার ছিল।
অর্থাৎ বিজেপি শোচনীয়ভাবে আশাহত হবে। কিন্তু সত্যিই কি হবে? ২০১৪ সালে সারা ভারতের এক লাখের ওপর ইভিএম-এর ফেরত আসার হিসেব ছিল না। নির্বাচন কমিশনের দাবি মতে সেই সব নাকি ছিল ভোটে ব্যবহৃত না হওয়া মেশিন। ভোটিং মেশিন ছাড়া আর একটি সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নরেন্দ্র মোদি কদিন আগে পুরুলিয়ার এক সভায় পুলওয়ামার কথা উল্লেখ করে ফের সামরিক বাহিনি-ভিত্তিক উগ্র জাতীয়তাবাদের আগুনে ফুঁ দিতে চেয়েছেন। কিন্তু না, বাংলায় এই জাতীয় আগুনে কাজ হবে না কোনও। তবে কাজ করতে আসা নিরাপত্তাকর্মীদের ওপর মারাত্মক হামলা হলে? বা এই বঙ্গেই একটা দাঙ্গা? বা পাশের দেশ বাংলাদেশে একটি হিন্দুবিরোধী ভয়ঙ্কর দাঙ্গা? হ্যাঁ, তারপর তো ‘গোদি মিডিয়া’ বা ‘হোয়াটস অ্যাপ’ ইউনিভার্সিটি আছেই। ভাবতে পারেন বাংলাদেশে হিন্দুবিরোধী দাঙ্গা হলে তাতে কার হাত থাকবে? অনেকেরই থাকতে পারে। এখনকার দিনে কেন বহু আগেও বিভিন্ন গুপ্তচর বাহিনির মাধ্যমে অন্য দেশে দাঙ্গা বা অরাজকতা তৈরি করা হত না? হয়, এখনও হয়। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু মুজিবের জন্মশতবর্ষে মোদির বাংলাদেশ যাওয়া নিয়ে হচ্ছে তো অনেক কিছুই। বাংলাদেশের কাগজগুলি বলছে বাংলাদেশের এই সরকারের নির্বাচন ও স্থায়ীত্বের পেছনে মোদি সরকারের অবদানের প্রতিদান দিতে চাইছে হাসিনা সরকার। হ্যাঁ স্পষ্টই পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করেই বলছে।
দুরাত্মার কিন্তু ছলের অভাব হয় না।