চণ্ডী মুখোপাধ্যায়
সাংবাদিক, চলচ্চিত্রবেত্তা, বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন-এর সভামুখ্য
সিনেমার জন্যে অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে দেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। দুটো কাজ একসঙ্গে হয় না। সিনেমা তৈরি একটা পুরো সময়ের কাজ। যতদূর মনে পড়ছে সময়টা সাতাত্তর। ‘চিত্রবাণী’-তে প্রথম আলাপ। সেই প্রথম আলাপেই জিজ্ঞেস করি, ‘আর কবিতা? কবিতা লেখাও কি ছেড়ে দেবেন?’ বুদ্ধদেবের পরিচয় আমার কাছে তখন কবি হিসেবেই। ছয়ের দশকের কবিদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই ধারায় আরও চার জন ছিলেন— শামশের আনোয়ার, ভাস্কর চক্রবর্তী, সুব্রত চক্রবর্তী এবং দেবারতি মিত্র। এঁরা সব সাতের দশকের। অন্যেরা আগেই প্রতিষ্ঠানের অঙ্গ হয়ে উঠেছেন। এঁরা কিন্তু প্রতিষ্ঠানকে এড়িয়েই চলছেন সযত্নে। এঁদের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠানের অঙ্গ হলে তাদের কবিতার ক্ষতি হবে। বুদ্ধদেবের কলেজ সহপাঠী ছিলেন আনন্দবাজারে মালিক সম্পাদক অভীক সরকার। শামশেরের অর্থের প্রয়োজন ছিল। অভীক সরকারকে বলে শামশেরের চাকরির ব্যবস্থাও করেছিলেন বুদ্ধদেব। শুধু কবিতার জন্যে সেই চাকরি নেননি শামশের। প্রাতিষ্ঠানিক চাকরিজীবন তাঁর কবিতার ক্ষতি করতে পারে এই ভয় ছিল তাঁর। কিন্তু সিনেমা আর কবিতা এই দুটোকে আলাদা ভাবেননি বুদ্ধদেব। দূটোই তাঁর কাছে সমার্থক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বিশ্বাস থেকেই ছবি করেন তিনি। বুদ্ধদেবের কাছে একজন চলচ্চিত্রকার হলেন, যিনি মানুষের বাস্তবতা নিয়ে ক্যামেরায় কবিতা লেখেন। বিষয় বদলেছে, বিষয়ের সঙ্গে আঙ্গিক বদলেছে, কবিতা ও চলচ্চিত্রের সমার্থক সম্পর্ক কিন্তু বদলায়নি। তাঁর প্রথম ছবি ‘দূরত্ব’ থেকে শেষ ছবি ‘উড়োজাহাজ’ পর্যন্ত এই বিশ্বাস থেকে সরেননি তিনি। এর মাঝখানে রয়েছে তাঁর নির্মিত ২০খানা ফিচার এবং বেশ কিছু তথ্যচিত্র। যাই হোক না কেন সমস্ত চলচ্চিত্রেই তিনি কবিতার কাছে ঋণী রইলেন। যেমন কবিতার ক্ষেত্রে আবার চলচ্চিত্রের কাছে ঋণী হয়ে ওঠেন। বুদ্ধদেব বিশ্বাস করতেন সাহিত্যের কোনও শাখার সঙ্গে যদি সিনেমার সবচেয়ে মিল থাকে তা হল কবিতা। তবে চলচ্চিত্রকে শেষ অবধি চলচ্চিত্রই হয়ে উঠতে হয়। কবিতাকে কবিতাই। কিন্তু এই দুই মাধ্যমের মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্রটা খুব রয়েছেই। বুদ্ধদেব বলতেন, ‘আমাকে যেমন কবিতা সাহায্য করেছে চলচ্চিত্র নির্মাণে, তেমনিই আবার চলচ্চিত্র করতে করতে আমি দেখেছি আমার কবিতার আঙ্গিক বদলেছে, শব্দব্যবহার বদলেছে। সাজানো বদলেছে। ফলে আমি যেমন কবিতার কাছে ঋণী সিনেমা করতে গিয়ে, তেমনই আবার চলচ্চিত্রের কাছে ঋণী আমি কবিতা লিখতে গিয়ে।’
আমৃত্যু বামপন্থী ভাবনায় বিশ্বাসী তিনি। প্রথম ছবি ‘দূরত্ব’ থেকে শেষছবি ‘উড়োজাহাজ’ অবধি সেই বিশ্বাসে অটল থেকেছেন। এমনকি কমলকুমার মজুমদারের কাহিনি নিয়ে যখন তিনি ‘তাহাদের কথা’ করেন তখন কোথায় যেন অন্তঃস্রোতে থেকে যায় স্বপ্নভঙ্গের পরেও এক নতুন দিনের স্বপ্নের গল্প। এর আগেও কমলকুমারের গল্প নিয়ে ছবি করেছেন তিনি— ‘নিম অন্নপূর্ণা’। সত্তরের উত্তাল সময় থেকে দূরে থাকতে পারেন না রাজনীতি-সচেতন বুদ্ধদেব। তাঁর নগর ট্রিলজি— দূরত্ব, গৃহযুদ্ধ এবং আন্ধিগলি। এই তিনটি ছবিতেই তিনি ধরে রেখেছেন সত্তরের বিপ্লবস্বপ্নের স্বপ্নদেখা ও স্বপ্নভঙ্গের ছবি।
ওডিশার বারিপদায় ‘তাহাদের কথা’-র শুটিঙে টানা দশদিন থাকার সুযোগ হয়। সেখানে বুঝি চলচ্চিত্র নির্মাণ বুদ্ধদেবের কাছে লাইফ সাপোর্ট। তখনই বলেন, জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে ছবি নির্মাণের বড় ইচ্ছে। সে সুযোগ হয়নি তাঁর। কিন্তু অন্য একটি সুযোগ পান। কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ১৩টি কবিতা নিয়ে ছবি করান। কবির তেরোটি কবিতা নিয়ে আধঘন্টা করে তেরোটি ছোট ছবি। বুদ্ধদেবের নিজস্ব স্টাইলে। রবীন্দ্র-কবিতাকে নতুন করে আবিষ্কার। এই কবিতা প্যাকেজের নাম দিয়েছিলেন ‘ত্রয়োদশী’। বন্ধু বুদ্ধদেবের নিজস্ব উদ্যোগে ছবিগুলো দেখার সুযোগ পাই। সরকারি উদাসীনতায় সাধারণের জন্য মুক্তি পায়নি এই ‘ত্রয়োদশী’। তবে এই তেরোটা থেকে বেছে চারটে— ‘বাঁশিওয়ালা’, ‘ইস্টিশন’, ‘পুকুরধারে’, এবং ‘কৃষ্ণকলি’ নিয়ে আরেকটি প্যাকেজ তৈরি হয়। তার নাম হয় ‘কোয়ার্টেট’। এই চারটের নির্বাচনের আগে বুদ্ধদেব এই প্রতিবেদকেরও মত নিয়েছিলেন। ‘কোয়ার্টেট’ সাধারণের জন্যে দেখানো হয়।
সাহিত্য অ্যাকাডেমির অনুরোধে কবি শঙ্খ ঘোষের ওপর এক তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন বুদ্ধদেব। শঙ্খ ঘোষের মৃত্যুর পর এই নিয়ে কথা হয় বুদ্ধদেবের সঙ্গে। কবির চোখে কবি প্রসঙ্গে এক লেখার কথা বলি তাঁকে। রাজিও হন। কিন্তু কথার খেলাপ কখনও তো করোনি তুমি। তাহলে কথা না রেখেই চলে গেলে কেন অবেলায়।