হাসিহীন মস্করা

সুধীর নাওরোইবাম

[মণিপুরী থেকে অনুবাদঃ সদানন্দ সিংহ]

 

এক

সেই ভোরে পেটে কিছু একটা দানাপানি দিয়ে বেরিয়ে যাবার পর তোয়াইমা এইমাত্র ফিরেছে। আজ চারদিনের মতো হল সে ভাগচাষি হিসেবে জমি চাষের জন্যে জমি খুঁজে খুঁজে ঘুরছে। কিন্তু ঘোরাটাই নিষ্ফল।

ওকে দেখে ওর স্ত্রী জিজ্ঞেস করে, তুমি কি নাওরেমদার কাছে গিয়েছিলে? শুনেছি ওনাদের জমি নাকি ভাগচাষের  জন্যে দেবে। উত্তর  দেয় না তোয়াইমা। তার বিষণ্ণ মুখটাই হয়তো উত্তর জানিয়ে দেয়। একটা  বিড়ি ধরায় সে। আকাশের  কালো মেঘগুলিকে দেখে। মুখটা আরও বিষণ্ণ হয়ে যায়। সমস্ত আশাগুলি তার ভেঙে যাচ্ছে ক্রমশ।

ভাগচাষি হিসেবে কিছুদিন আগেও সে একজনের জমি চাষ করত। জমিটার মালিক বলতে গেলে একপ্রকার কেড়ে নিয়েই জমিটা বিক্রি করে দিয়েছে। এরকম যে হবে সে আশাই করতে পারেনি। ফলে সে জমিটাকে লাঙল দিয়ে মই লাগিয়ে ধান লাগানোর জন্যে প্রস্তুত করে রেখেছিল। বৃষ্টি হয়ে ক্ষেত জলে ভরে যাবার পর এবার সে কী জাতের ধান লাগাবে এইসব চিন্তায় মশগুল ছিল। কিন্তু জমির মালিক হঠাৎ যেন ধাক্কা মেরে তাকে মাটিতে ফেলে দিল। আর সে যেন চিৎ হয়ে পড়ে গেল। প্রতিবাদ করার কোনও সুযোগই পেল না।

অবশ্য এইভাবে জমি বিক্রির ইচ্ছে জমির মালিকেরও ছিল না হয়তো। ছেলেটাকে একটা চাকুরিতে ঢুকিয়ে দেবার পরিপ্রেক্ষিতেই তাকে এই জমি বিক্রি করতে হয়েছে। বকবক করেছিল জমির মালিক, “আজকালকার ছেলে সব ডিগ্রি-টিগ্রি নিয়ে সরকারি চাকুরি ছাড়া অন্য কিছুই করতে চায় না। আর আমারই হয়েছে মুশকিল।” উত্তর দেবার মতো কিছুই ছিল না তোয়াইমার। মালিক আরও বলেছিল, “রাগ করো না। এছাড়া আমার কোনও উপায়ই ছিল না। আমি জানি তুমি খুব কষ্টে পড়ে যাবে। সেটা শুধু সাময়িককালের জন্যে। আমি জানি অদূর ভবিষ্যতে তুমি সবকিছু কাটিয়ে উঠবে, তুমি শুধু কাজ করে যাও।”

তারপর আর কি করতে পারে তোয়াইমা? কাঁদো কাঁদো মুখে ফিরে এসেছিল। ছেলেকে কাজে ঢোকাবে বলে জমি বিক্রি ইচ্ছে করলে সব জমির মালিক করতেই পারে। এটা তোয়াইমাও জানে। তবু এতদিন ধরে জমি চাষ করে আসার পর হঠাৎ তাকে কিছু না জানিয়ে জমি বিক্রি করাটা অপরাধ বলে সে মনে করে। মালিক বলে যা খুশি তাই সে করতে পারে? বেশ রাগ হয় তোয়াইমার। বলে কিনা আবার– কাজ করে যাও। কি কাজ? কলুর বলদের মতো? শুধু খেটে যাবে আর যাবে। আসলে কাজকে ভালোবাসে তোয়াইমা। তাই কাজ থেকে দূরে থাকতে চায় না সে। কলুর বলদের মতো নিজেকে মনে হয় না তার। নিজেকে মনে হয় একটা খনির মতো। কাজের খনি। এই খনির মাধ্যমেই তার সমস্ত অন্ন, বস্ত্র সব বেরিয়ে আসে।

রাতে ঘুম আসে না তোয়াইমার। রাত কত হল সে বুঝতে পারে না। মেয়েটা অনেক রাত করে পড়াশুনা করত। কিন্তু আজ হারিকেনে দেওয়ার মতো কেরোসিন ঘরে নেই বলে অন্ধকার ঘরে মেয়েটার আওয়াজ পায় না সে। মেয়েটার পাশে বসে ওর মাও মাছ ধরার চাঁই বানাত অন্যদিন। ছোট ছেলেটারও আওয়াজ পায় না সে। সবাই আজ সকাল সকাল ঘুমোতে বিছানায় চলে গেছে। ঘরের ভেতরটা আজ খুব নীরব। পরিবারের লোকসংখ্যা ওদের চারজন মাত্র। সরকারের ঘোষণা মতো সে পরিবার পরিকল্পনাকে আপন করে নিয়েছিল। কিন্তু ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবার’-এর মর্মটা সে কোনওদিনই বুঝতে পারেনি। অন্যের জমি চাষ করে সে যা পেত তা সে টুক করে কোনদিন গিলে ফেলতে পারেনি। কিছু কিছু করে খরচ করে বছরটা কাটিয়ে দেবার চেষ্টা করে গেছে আজীবন। তার এখন মনে হয়, সে একটা বোকা পতঙ্গ। এতদিন সে অন্যের জমিকে নিজের জমি মনে করে চাষ করে গেছে। তার ফলটা সে এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কি অক্ষম এবং একটা শক্তিহীন জীব সে। কিন্তু কি আর করতে পারত সে। নিজের বলতে তার কিছু নেই বলেই বারবার তাকে পতঙ্গ হতে হচ্ছে রেশম পোকার মতো– যার শরীর থেকে পালকপ্রভুরা সিল্কের গুঁটি বের করে চলবে সারাজীবন। তাতেও সে রাজী। কিন্তু এখন সে কি যে করে। এই আকালের দিনে কে তাকে চাষ করার জন্যে জমি দেবে? কে তার দিকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেবে? বুঝতে পারে না তোয়াইমা।

দূরে কোথাও দুটো কুকুর ঝগড়া লেগেছে। কান তুলে সে শোনে। ঝগড়া চলছেই। সে বিছানা থেকে আস্তে আস্তে নেমে আসে। একটা কুপি জ্বালিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। ধান রাখার জায়গাটায় গিয়ে দেখে কতটুকু ধান রয়ে গেছে এখনও। পেছন থেকে মেয়ের গলা শোনা যায় হঠাৎ, বাবা। চমকে গিয়ে তোয়াইমা কুপিটা নিভিয়ে দেয়। তড়িঘড়ি করে সে বলে ওঠে, ঘুমোস্‌নি এখনও?

দুই

খুব বৃষ্টি পড়ছে। পুকুর-ঘাট-ক্ষেত-মাঠ সব জলে ভরে গেছে। চারিদিকে শুধু জল আর জল। মাছ ধরার আনন্দে অনেকে মত্ত খুব। রাত নেই, দিন নেই, শুধু জাল টেনে যাচ্ছে তারা। ধানের ক্ষেত ডুবে গেছে বলে অনেকে আবার খুব চিন্তিত। কিন্তু কেউ কারুর জন্যে চিন্তিত নয়। যে যার নিজের কাজ করে চলেছে। যে মাছ ধরছে সে শুধু মাছ ধরেই চলেছে। আর যে চাষী চিন্তিত তার ক্ষেতের জন্যে, সেও বকবক এবং অনর্থক দৌড়াদৌড়ি করে চলেছে। চারিদিকে হৈচৈ আর হৈচৈ। তোয়াইমা নৌকো করে সকালে বেরিয়ে যায়। গরুর জন্যে ঘাস নিয়ে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে চাঁইয়ের সাহায্যে ধরা মাছ। খুব বেশি নয় অবশ্য। রাতেও সে বেরোয় চাঁইয়ের মধ্যে মাছ ধরা পড়ল কিনা দেখবে বলে। বেরিয়ে ছোট ছোট গুঁড়ো মাছ নিয়ে আসে। সেই গুঁড়ো মাছ বিক্রি করে দিনে টাকা দশেকের মতো পেয়েও যায় সে। মাঝে মাঝে বেশি গুঁড়ো মাছ পেলে চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকার মতো পেয়ে যায়। তবে বড় মাছ সে আনতে পারে না। তার চাঁইগুলি সব ছোট মাছ ধরার। সব তার স্ত্রীর বানানো। বড় মাছের জন্যে চাঁই বানিয়ে পয়সা খরচ করতে চায় না সে। কারণ বড় মাছ খুব কমই ধরা পড়ে। তবুও মাঝে মাঝে বড় মাছও আটকে যায় তাদের চাঁইয়ে। তখন মাছের ঝটপটানিতে তাদের চাঁই ভেঙে যায়। মোরের তৈরী শক্ত চাঁই কেনার মত পয়সাও নেই তাদের। তারওপর তাদের তো কোনও নিজস্ব খাল-পুকুরও নেই যেখানে দামী চাঁই পাতবে।

একসময় জল আস্তে আস্তে কমতে থাকে। খালগুলি সরু হতে থাকে। জমিগুলি আবার মুখ তুলে দাঁড়ায়। জমির মালিকদের দাপাদাপিতে চাঁই পাতার জায়গা শেষ হতে থাকে। জল কমতে কমতে খালে আর নৌকোও চলে না। এক সকালে তোয়াইমা বেশ বড় একটা মাছ পেয়ে যায়। চাঁইসহ মাছটাকে ঘাসের বোঝার ভেতর ঢুকিয়ে সে বাড়িতে নিয়ে আসে। বড় মাছটার সঙ্গে কিছু ছোট মাছও রয়েছে। বাড়ির সবাই খুব খুশি। তোয়াইমা একটা বিড়ি ধরিয়ে বারান্দায় বসে টানছে। কিছু একটা ভাবছেও।

এমন সময় মেয়েটা বলে ওঠে, বাবা, এটা কি আমাদের চাঁইয়ে ধরা পড়েছে? তাহলে তো চাঁইটা বোধহয় নষ্ট হয়ে গেছে।

–হোক নষ্ট। প্রতিদিন নষ্ট হোক, প্রতিদিন এমন মাছ ধরা পড়ুক।

–তবে মাছটাকে ভালো করে আনতে পারলে না? জ্যন্ত হলে আরও ভালো হত। নিজের স্ত্রীর কথাগুলি শুনে তোয়াইমা উত্তর দেয়, জ্যন্তই তো। চার-পাঁচদিন আগের ধরা মাছও তো বাজারে বিক্রি হয়। তারপর তোয়াইমা ঘরের ভেতর ঢুকে একটা থলি নিয়ে বেরিয়ে আসে। মাছটাকে থলির ভেতর ঢোকায়। একটু হেসে আবার বলে, থলিটা কেনার পর এতবড় মাছ আর আগে ঢোকাইনি। বাজারে গেলে কমে বোধহয় শ’খানেক টাকার মতো পাওয়া যাবে। ভাগ্য সহায় থাকলে কত বড় মাছও যে ধরা পড়ে। ভগবান যে নেই তা নয়।

–তবে তুমি কিন্তু আবার গ্রামের ভেতরে বিক্রি করে বসো না। বাকিতে নিয়ে নেবে তাহলে।

–না, না, আমি বাজারে গিয়েই বিক্রি করব।

এমন সময় বাইরে থেকে বাঁজখাই একটা গলার আওয়াজ ভেসে আসে, তোয়াইমা কোথায়? মহাপাপী তোয়াইমা কোথায়? চমকে ওঠে তোয়াইমা। শুধু তোয়াইমা নয়, বাড়ির সবাই চমকে ওঠে। দুমদাম পা ফেলে একজন বয়স্ক লোক বাড়ির মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন। বয়স্ক লোকটা হুঙ্কার দিয়ে বলতে থাকেন, অন্যের জমিতে এসে ঘাস তোলার সময় মাছ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছ কেন হে মহাচণ্ডাল? গতকাল কলামুদের চাঁই হাতাতে গিয়ে ধরা পড়ে যে মার খেলে তা এর মধ্যেই ভুলে গেলে? চেহারাটা তো হয়েছে রুগি বেড়ালের মতো। ইদানীং কীসব আরম্ভ করলে তুমি?

বয়স্ক লোকটা তোয়াইমার থলির ভেতর হাত ঢুকিয়ে টুক করে মাছটা বের করে আনেন। মাছটাকে তুলে ধরে দেখেন। একটু যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। তারপর তোয়াইমার দিকে তাকিয়ে ভ্রূকুটি করে বলতে থাকেন, ছি ছি ছি। মাছটাকে তো ঘাসের বোঝার ভেতরে ঢুকিয়ে চুরি করে এনেছ, সেই সঙ্গে আমার চাঁইটাকেও নষ্ট করে এসেছ। মোরের তৈরী দু’শ পঞ্চাশ টাকায় কেনা চাঁই ওটা। চুরি করতে গিয়ে সব নষ্ট করে দিয়েছ। মহাপাপী তুমি, মহাচণ্ডাল ……। মাছটা নিয়ে বয়স্ক লোকটা চলে যান। বুনো বেড়ালের মুখে পড়া পায়রার মতো কোনও উত্তর দেওয়ারও সময় পায় না তোয়াইমা। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শেষ নিভন্ত বিড়িটাতে আবার টান মারতে থাকে। তারপর মুখ তুলে তাকাতেই সে দেখে– তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে সবাই তার দিকে একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখটাকে অন্যদিকে ঘোরায় সে। শব্দহীন একটা মরা হাসি হাসে। জীবনের সমস্ত ঘটনাগুলিই যেন তার কাছে একটা হাসিহীন মস্করা হয়ে দাঁড়িয়াছে এখন।

 

(মণিপুরের সমকালীন গল্পকারদের মধ্যে সুধীর নাওরোইবম একজন অতি পরিচিত নাম। এ যাবৎ তাঁর বেশ কিছু গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। হাসিহীন মস্করা গল্পটি লেখকের ‘মৈ চংলবা চেক’ গল্পগ্রন্থ থেকে নেওয়া। রচনাটি ঈশানকোণ ওয়েব পত্রিকা থেকে সম্পাদকের অনুমতিক্রমে আহৃত ও প্রকাশিত। মূল রচনার লিঙ্ক – http://www.ishankon.com/archive/ishankon2/page10.html )

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...