আমার অপার বাংলা : কবি তরুণ সান্যালের সাক্ষাৎকার

তরুণ সান্যাল | কবি

শিমুল সালাহ্উদ্দিন

 

আমার অপার বাংলা
দেবী প্রতিমার দীর্ঘ চোখের আলস্যে ঘুম ভেঙে যায়
মুখগুলি দৃশ্যহীন, মধ্যরাতে
একা পানসী ভাসানো বৈরাগ্যে
কোন অশ্রুময়তায়
অন্ধতায়

লাবণ্যনীহার ভার একা অঙ্গে ধরা যায় না বলে
পাকাধান ভেজা পাটে
দূরের বাঁশির সুরে
মনে হয়
অশ্রুত বিষাদ, শ্যামলিমা, এই
বিধ্বস্ত প্রতিমা বাংলাদেশ

(আমার অপার বাংলা/তরুণ সান্যাল)

বাঙালি যে মানুষদের ভুলে গেলে অন্যায় করবে তাদের একজন তিনি। ১৯৭১-এ রচিত ও প্রকাশিত সেই কবির কাব্যগ্রন্থের ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামের কবিতায় বেজে উঠেছিল নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্মজয়ঢাক। অপার ভালোবাসায় সে সময়ের হানাদার-আক্রান্ত পূর্ববাংলার মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রামের কথা তুলে ধরেছিলেন তিনি। এক অপার ভালোবাসায় তিনি লিখেছিলেন বাংলাদেশের হয়ে ওঠার এক বিশ্বাস্য চিত্র। নিভৃত, প্রচারের আলো থেকে অনেক দূরে থাকা এ কবির নাম তরুণ সান্যাল। একান্ত সাধনায়, পরম অভিনিবেশে যারা উজ্জ্বল করে গেছেন বাংলা কবিতার ভাণ্ডার, তিনি তাঁদেরই একজন।

অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের পাবনার পোরজনা গ্রামে কবি তরুণ সান্যালের জন্ম ১৯৩২ সালের ২৯ অক্টোবর। প্রাথমিক পড়াশুনা নওগাঁতে, দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে পারি জমান পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৭১ সালে, বাঙালি যখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে, তরুণ সান্যাল তখন ছিলেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ আলোড়িত করেছিল ১৯৬৮ সালেই ‘তোমার জন্যই বাংলাদেশ’ নামের কাব্যগ্রন্থের জনককে। মার্চের মাঝামাঝি (১৯৭১) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট হলে ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়ার জন্য একটি বিশেষ সভার আয়োজন করে। সেই সভায় তরুণ সান্যাল এবং অন্য নেতারা প্রথম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। শুধু নিজের লেখনীতে নয়, তরুণ সান্যাল সে সময় ছুটে বেরিয়েছেন এক শরণার্থী শিবির থেকে অন্য শরণার্থী শিবিরে। সে সময় প্রখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা ‘পরিচয়’-এর সম্পাদক ছিলেন তরুণ সান্যাল। ছিলেন শান্তি পরিষদের রাজ্য সম্পাদক ও ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। মূলত একক নেতৃত্বেই গঠন করেছিলেন ‘বাংলাদেশ সহায়ক কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি’। তাঁর এই অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতা ও কবিত্ব তিনি উজাড় করে দিয়েছিলেন বাঙালির স্বাধিকারের সংগ্রামে।

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু এই কবি, মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সম্মাননা গ্রহণ করতে এসেছিলেন ২০১২ সালের বিশে অক্টোবর। তখনই তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন কবি শিমুল সালাহ্উদ্দিন। সাক্ষাৎকারটি শ্রুতিলিপিতে সহায়তা করেছেন তরুণ গল্পকার সাব্বির জাদিদ। ২৮ আগস্ট, ২০১৭, সোমবার অদেখালোকে যাত্রা করেছেন কবি তরুণ সান্যাল।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: তরুণদা, আপনার মাটির বেহালা তো বেরোল ১৯৫৬-তে, প্রথম বই। সিরিয়াসলি কবে ভাবলেন যে কবিতা লিখবেন?

তরুণ সান্যাল: সত্যি কথা বলতে কি, কবিতা লিখব কি গল্প লিখব, আদৌ কিছু লিখব কিনা কিছু ভাবিনি। কবিতা স্বতঃস্ফূর্ত, আমার এটা আত্মজীবনী। শেষ পর্যন্ত জীবনটাকেই লেখা। ‘মাটির বেহালা’ আমাদের বাংলা কবিতাতে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে যে বইগুলি সব থেকে, প্রাথমিকভাবে, প্রথমে এসে মানুষের কল্পনাশক্তিতে যুক্ত করেছিল, ‘মাটির বেহালা’ তার ভেতর একটা। আমার সঙ্গে দিনকয়েক আগে, একটা টিভিতে কথা হচ্ছিল, তখন একজন তরুণ কবি বলতে শুরু করল যে, অনেক চেষ্টা করে আমি বইটা সংগ্রহ করেছি। সংগ্রহ করে আমার মনটা ভরে গেছে। আদতে ষাট বছর পরেও কবিতার বইটার প্রাসঙ্গিকতা রয়ে গেছে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এরপর, ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি, তখন আমরা হয়ত একটা স্বপ্ন বপন করেছি, এবং তখন আপনি কলকাতার প্রতিষ্ঠিত মানুষ হয়েও এই অঞ্চলের তখনকার রাজনীতির সাথে একভাবে আপনার যোগাযোগটা ছিল। এই যোগাযোগ কিংবা বাঙালির যে স্বপ্ন— বাংলাদেশ হবে; বাংলাদেশ নিয়ে আপনার কবিতা… তার পরের বইটা হলে—

তরুণ সান্যাল: পরের বইটা ছিল ‘অন্ধকার উদ্যানে যে নদী’।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এটা দ্বিতীয় বই। তৃতীয় বই কোনটা?

তরুণ সান্যাল: তৃতীয় বই আমার যদ্দুর মনে হচ্ছে, ১৯৬৮ সালে একটা কবিতার বই বেরিয়েছিল— ‘তোমার জন্যই বাংলাদেশ’।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন:  আমি এটার কথাই বলছি। ৬৮ সালে তখনও আমরা ঊনসত্তর দেখি নাই, একাত্তর দেখি নাই, তার আগেই একটা বই, আপনি কলকাতার মানুষ এবং বইয়ের নাম ‘তোমার জন্য বাংলাদেশ’ অথচ তখনও বাংলাদেশ হয়নি। এখন যে বাংলাদেশ আমরা দেখছি। তো সেই বইয়ের এই নামটা কেন দিয়েছিলেন? কী ভেবে? মূল ভাবনাটা কী ছিল?

তরুণ সান্যাল: শিমুল তোমায় আমি বলি, আমরা পশ্চিমবঙ্গের, কিন্তু আমরা কখনও পশ্চিমবঙ্গ বলতাম না। আমরা বাংলাদেশ বলতাম। আর বাংলাদেশকে বলতাম পূর্ববঙ্গ অথবা পূর্ব পাকিস্তান। অপরদিকে এই দু’টো বাংলা মিলে একটা অবিভাজ্য বঙ্গদেশের কথা ভাবতাম। ফলে তার উপর ভিত্তি করে ‘তোমার জন্যই বাংলাদেশ’ বলতে বাংলাদেশ নয়, অবিভক্ত বঙ্গ উদ্দেশ্য। যার ফলে আমার পরবর্তীকালে ‘এরই নাম বাংলাদেশ’ বলে একটা বই আছে। তাতে প্রথম সংস্করণের ভূমিকাতে লেখা ছিল— বাংলাদেশ বলতে আমরা পশ্চিমবঙ্গকে বোঝাতাম। কেননা পূর্ববঙ্গের লোকজন বাংলাদেশ নামটা অস্বীকার করেছে। কিন্তু সবচে’ মজার ব্যাপার হল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের সেই পুরনো দেশের নামটা ওরা নিয়ে নিল।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এই যে আমরা নিয়ে নিলাম, আপনি ষাটের দশকের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী কবি, এই সময়ে আমরা যারা লেখালেখির চেষ্টা করছি, এখানে পার্থক্যের জায়গাটা আমি আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই, আপনি যাকে বাংলাদেশ বলছেন সেই নামে যখন আমরা একটা দেশ অর্জন করলাম, তখনকারই এথনোসেন্ট্রিক অভিজ্ঞতাটা আসলে কেমন? এই বিষয়টাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন? দেশ হাতবদল হয়ে যাওয়া বা ভাগাভাগি হয়ে যাওয়া…

তরুণ সান্যাল: আমাদের খুব গৌরববোধ হয়েছিল যখন বাংলাদেশ সৃষ্টি হল, এটা সৃষ্টি হওয়ার পেছনে আমাদেরও কিছু অবদান ছিল। তো আমার মনে পড়ছে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা সেই সময় একবার দেখা করেছিলেন, সেই সময় জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল: এই যে বাংলাদেশের অভ্যূদয় হচ্ছে, এর পেছনে আমাদের কী ভূমিকা? তখন ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, একটা নতুন সন্তানের জন্ম হচ্ছে। তোমরা যারা লেখক কবি তোমরা তো ধাত্রীর কাজ করছ। ফলে একটা ধাত্রী-মার যে ভূমিকা তুমি সেইভাবে শিশুটিকে দেখ। এবং সে যেন পরিপূর্ণভাবে গড়ে উঠতে পারে তার জন্য আপ্রাণ ভূমিকা নাও। এইটা আমার মনে আছে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: তরুণদা, গতকাল তো আপনি আমাদের সম্মাননাটা গ্রহণ করলেন বাংলাদেশ থেকে, তো আমি আমার টেলিভিশনের নিউজে দেখছিলাম, হুইল চেয়ারে আপনি পুরস্কার নিচ্ছেন। তো বড় বেশি দেরি হয়ে গেল কি আমাদের জন্য, যে আমাদের বন্ধু, তাকে সম্মাননা জানানো?

তরুণ সান্যাল: সেটা আমি বলতে পারব না। এটা লেট বাট নট নেভার। আগেও দু’বার সম্মাননা জানানো হয়েছে। এটা তৃতীয় সম্মাননা জানানো হল। তবে এবার আমি দেখলাম, ১৯৭১ সালের আন্দোলনে যাদেরকে আমি প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি, এবার কিন্তু তারাই সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। আদতে প্রথমবার এবং দ্বিতীয়বার যারা সম্মাননা পেয়েছিল সবার কথা আমি জানি না। কিন্তু আমি বুঝতে পারি এদের দেখে যে, তারা বোধহয় অনেকেই সেই পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। আমাদের দেশে তো রাজনীতি আছে। ফলে আমাদের দেশে যারা পশ্চিমবঙ্গে পুরনো সরকারে ছিলেন, তারা হয়ত অনেককে পছন্দই করেন না। ফলে তাদের নামটামও দেন না। হয়ত তারা নিজেরাও কোনওভাবেই সেই আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন না।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সেই সময়ের বহু মানুষের সাথে আসলে সম্মেলন কেন্দ্রেই হয়ত দেখা হয়েছে, চোখাচোখি হয়েছে, কথা হয়েছে। আপনার কালকের অনুষ্ঠানের অনুভূতিটা কেমন? বা অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতাটা যদি বলতে বলি আপনাকে… কেমন লেগেছে আপনার? এই সফরটা কেমন লাগছে?

তরুণ সান্যাল: প্রশ্নটা জটিল। উত্তর দেয়াটা আরও কঠিন। তার কারণ, তারা আমাকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছে। তাদের কোনও আচরণ যদি আমার খারাপও লাগে আমার পক্ষে বলাটা একটু কঠিন। যদিও আমাকে সবাই ঠোঁটকাটা জানে, অভদ্র তো জানে না। তবু বলি, অনুষ্ঠানটি, ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, প্রায় নটা থেকে প্রায় দেড়টা পর্যন্ত চলেছে। আমার মতো বৃদ্ধ মানুষ, আশি বছরের, এই চার ঘণ্টা সাড়ে চার ঘণ্টা সময় বসে থাকাটা, একটা জায়গায়, আমার কাছে খুব কষ্টসাধ্য হয়েছে। আর যখন শুনছিলাম, বক্তারা যেসব কথা বলছিলেন, সেগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এবং আমার কাছে আরও কষ্ট হয়েছে, আমার তো ধারণা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের যে লড়াইটা শুরু হয়েছিল ভাষাকে নিয়ে, বাহান্ন সালে, একুশে ফেব্রুয়ারি গোটা পৃথিবীতে ভাষা দিবস হিসেবে পালন হয়। আমার ইচ্ছে ছিল, আমি তো প্রথম থেকেই দেখলুম, ওই অনুষ্ঠানে প্রথম থেকে ভাষাটা ব্যবহার করা হয়েছে ইংরেজি। আমার পাশে ছিল একদা কালান্তর পত্রিকার ওয়ার্ল্ড করেসপন্ডেন্ট ছিলেন বাংলাদেশের, দিলীপ চক্রবর্তী, এবং এখন সপ্তাহ পত্রিকার সম্পাদক; তাকে বললাম, এই যে ইংরেজিতে কথা বলছে এটা আমার ভালো লাগছে না। তার আগের দিনে, তখন তারা ডিনার করতে দিয়েছিল, তখন আমাকে কথা বলতে বলেছিলেন। এবং আমার আগে যারা বক্তা ছিলেন, ইংরেজিতে কথা বলেছেন। আমি প্রথমে ইংরেজিতে বলি যে, আমি এখানে যেহেতু বাংলাদেশে এসেছি, এবং বাংলাদেশ আজ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাংলাভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছে, আপনারা আমাকে ক্ষমা করুন, আমারও মাতৃভাষা বাংলা এখানকার মাতৃভাষা বাংলা; আমাকে বাংলায় কথা বলার অনুমতি দিন। সকলে হাততালি দিয়েছিল। তখন আমি বাংলাতেই বক্তৃতা করেছিলাম। এবং সকলে খুশি হয়েছিল, এটা বলতে পারি। এর পরের দিনের মিটিংটাতে দেখলাম ইংরেজি। একজন ইংরেজ মহিলা বা আমেরিকান মহিলা, তিনি অনেকক্ষণ ধরে আমেরিকান ইংলিশে বক্তৃতা করলেন। কেউ বুঝেছিল কি না জানি না। হয়ত বুঝেছিল, কারণ, বক্তৃতা শেষে অনেকে হাততালিও দিয়েছিল। তবে শেষে কিন্তু প্রধানমন্ত্রী, তিনি সমস্ত কিছুকে ঠিকঠাক করে দিলেন বাংলাতে বক্তৃতা করে। এটা আমার খুব ভালো লেগেছিল।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: তরুণদা, আপনার কবিতার দিকে যাই আমরা। কবিতা নিয়ে আপনার কথা শুনতে চাই। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া হল কবিতায়। তরুণদা, বাংলাদেশে আপনার বই পাওয়া যায় না আসলে, আমি নেট ঘাটাঘাটি করে আপনার তিনটি কবিতা পড়তে পেরেছি। এবং আপনার কিছু তথ্য আমি পেয়েছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে যেটা বলা হয়েছে, মিলনসাগর নামের একটা ওয়েসাইটে, বলা হয়েছে যে, তরুণ সান্যাল কবিতা লিখেছেন, তার কণ্ঠ বলিষ্ঠ, স্পষ্টভাষী, আবেগী গদ্যে এবং ছন্দে উনি লেখেন। আমি যে কবিতা দু’টি পড়েছি, সিঙ্গনন্দী গ্রাম নিয়ে আপনার প্রতিবাদী কবিতা। তো কবির যে প্রতিবাদের স্বরূপ, এই বিষয়টাকে আপনি আসলে কীভাবে দেখেন?

তরুণ সান্যাল: শোনো বাবা, আমি যখন রবীন্দ্র পুরস্কার পেলাম, তখন যারা পুরস্কার দিয়েছিলেন, মানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার; তারা আমার পরিচিতিতে বললেন, উনি রাজনীতি বিষয়ক কবিতা লেখেন। সেখানে আমাকে প্রত্যুত্তর দিতে হল। আমি বললাম যে আমি কখনও রাজনীতি নিয়ে লিখিনি। তো গুঞ্জন শোনা গেল। আমি বললাম যে, একজন কবির কাছে একটা ফুল, একটা নদীর স্রোত, একটা রমনীর মুখ, একটা শিশুর কণ্ঠ— কোনও জায়গাতে যখন কোনও রাজনৈতিক যন্ত্রণা আসে, সে বিষয়েও তিনি লেখেন। ফলে ওগুলোও ফুল চাঁদের মতোই চমৎকার। আমি বললাম যে, আমার মনে পড়ছে, ১৯৫৯ সালে কলকাতা শহরে খাদ্য আন্দোলন হয়েছিল। তখন আমি সেই আন্দোলনটাতে হেঁটেছিলাম। সেখানটাতে পুলিশের অসম্ভব আক্রমণ হয়েছিল। তাতে আমি শুনেছিলাম একটা শিশু চিৎকার করে বলছে– মা আমাকে মারছে। আমাকে মারছে। তো আমার কানে যেটা বাজছিল, আমি যখন ওটা নিয়ে কবিতা লিখেছিলাম, ঘটনা হল যে, আমার কাছে ওই শিশুটির চিৎকারকে মনে হচ্ছিল: মা, চাঁদ উঠেছে, আমাকে দেখাও। আর এখানে আমাকে মারছে মা তুমি প্রতিবাদ করো। দু’টো একই। সমগোত্রীয়। কবির কাছে এগুলোই ভাবনায় আসে। তারপর বলেছিলাম, দু’রকম সমাজ আছে। রাজনৈতিক সমাজ আর নাগরিক সমাজ। রাজনৈতিক সমাজে আমি লক্ষ করে দেখেছি রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে তাদের যে গ্রামীণ দফাদার বা চৌকিদার— তাদের নিয়ে যে রাজনৈতিক সমাজ এই সমাজের মধ্যে অনেক দুর্নীতি আছে। নাগরিক সমাজের উপর তাদের নির্ভর করতে হয়— পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন। ফলে নাগরিক সমাজ স্পষ্ট সত্য কথা বলতে চায়, শুনতে চায়। আর নাগরিক সমাজে তারা শিষ্ট রচনা করে এবং তারই সঙ্গে সঙ্গে তারা রাজনৈতিক বিষয়ে মত প্রকাশ করে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে যে মামলাটা হয়েছিল ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ লেখার কারণে, সেই সময়ে আপনি তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। যেখানে তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিল সুনীল গাঙ্গুলী আরও কে কে। এবং আমি আপনার সাক্ষ্যটা পড়েছি। সেখানে আপনি একটা প্রশ্ন করেছিলেন যে, অশ্লীলতা আসলে কাকে বলে! মানে এই জায়গাটা নিয়ে আপনি কথা বলেছিলেন। দাদা এতদিন পর, কবিতার এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার পর আপনার কবিতার নন্দন নিয়ে জানতে চাই, সেটা আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন, আপনার কাছে কবিতা কী? যাতে আমাদের এখানকার তরুণ কবিরা আপনাকে বুঝতে পারে। সেই কারণে আমি এটা জানতে চাচ্ছি।

তরুণ সান্যাল: তোমাকে আমি প্রথমে বলি যে, ওর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার ব্যাপারে কোর্টে সাক্ষ্যের জন্য আমাকে ডেকেছিল মলয় রায়। মলয়ের সাথে আমার খুব যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু আমার একটা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, যে কোনও রাষ্ট্রশক্তির অধিকার নেই কোনও সৃষ্টিশীল রচনার ক্ষেত্রে মত প্রকাশ করার। ফলে আমি কোর্টে সেই কথাটাই বলেছিলাম, এই বইটি শালীনতা অশালীনতার আলোচনার বিষয় নয়। বিষয়টা হল রাষ্ট্রে তাদের অধিকার আছে কি না এই কাজটি করার। আর দ্বিতীয়ত তোমার যে প্রশ্নটা ছিল, আমি কবিতা বলতে কী মনে করি। এটা আমি বারবার করে লিখেছিও। প্রথমত একটা জনজাতি, যে কোনও জনজাতির অত্যন্ত গভীরে একটা নিজস্ব স্রোত আছে। মানে হাজার হাজার বছর ধরে একটা স্রোতধারা প্রবাহিত হচ্ছে। তো কবির কাজ তলার ভেতর যে প্রবাহটা রয়েছে, ওটা অনেকটা চাপা কলের মতো, যাকে তোমরা টিউবয়েল বলো, টিউবয়েলে যেমন তোমরা জল তোলো, তেমনি আদতে একজন কবি, তিনি ভেতরে যে লোকজগত আছে, সেটাকে তুলে এনে সেটাকে শিল্পসম্মত করে তোমার কাছে পৌঁছে দেন। ফলে তোমার কাছে সেটা ভালো লাগে। আর দ্বিতীয়ত, আমার কাছে আমার দেশের জনজাতির যে মহিমা, অনুরূপভাবে যদি ভাবি যে চীন দেশের মানুষের জনজাতির একটা মহিমা আছ, পাশের আসামেও আছে। তলার দিকে যেমন গোটা পৃথিবীটা এক, তেমনি সমস্ত মানবজাতির যে সম্পর্কটা পরস্পরের সাথে কতিপয় মিল আছে, যার ফলে তুমি যে একটা কবিতা লিখলে স্কটল্যান্ডের কোনও এক ব্যক্তি সেটার অনুবাদ পড়ল, পড়ে বলল চমৎকার তো! কেন বলল? আদতে তার জনজাতির ভেতর গভীর যে মানবিক নিরীক্ষণ আছে, তোমার নিরীক্ষণের সাথে সেটা মিলে গেছে। অর্থাৎ আমার ভেতরে যা আছে একজন পাবলো নেরুদার মধ্যেও তা আছে। তিনি যেখান থেকে উৎসারিত করেন আমিও সেখান থেকে উৎসারিত করি। আমারটা হয়ত ততটা শিল্পসম্মত হয় না বলে পাবলো নেরুদা অনেক বেশি খ্যাত আমি কম খ্যাত, এই। আমি, বলছি, আদতে একজনই কবি, লেখেন একটাই কবিতা।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: এবং কবি কি সারাজীবন একটা কবিতাই লেখেন?

তরুণ সান্যাল: একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করেন। সেটা হয়ে উঠবে কি না জানি না।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: তার মানে কবিতা হয়ে ওঠাটাকে আপনি কি সংগ্রাম হিসাবেই দেখেন?

তরুণ সান্যাল: কবিতার তো নিজস্ব একটা সংগ্রাম আছে। একটা শিশু যখন মায়ের পেটে থাকে তখন হার্টবিটটা যে হচ্ছে মায়ের, বাচ্চাটা শুনতে পাচ্ছে। তার ভেতর থেকে তার ছন্দবোধ প্রথম জন্মাচ্ছে। তারপর যখন সে জন্মাল, তার আলো হাওয়া সমস্ত কিছুর ভেতরে সে আশ্চর্য একটা বিরোধিতা পায়। তখন সে কাঁদে। পেটে থাকতে থাকতে বাচ্চাটি চারের উপর ভিত্তি করে চলে। ধরো এই যে, এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা মধ্যখানে চর, তারিমধ্যে শুয়ে আছে শিব সওদাগর— এই চারের মাত্রাতেই শিশুর কবিতাটা চলে। তেমনি আস্তে আস্তে বিকশিত যখন হয় তখন নিজের চর্চার ভেতর দিয়ে একটা ছন্দবোধ তৈরি হয়। তো বলা যেতে পারে শুধু এটাই যে, সমস্ত শিশু যেমন এক, সমস্ত কবিতাও শৈশবের এক। মানুষ যখন বড় হয়, আমার ধারণা, জন্মের পর থেকে বা জন্মের আগে থেকে যে ছন্দ সে শুনছে এবং বাইরের অভিজ্ঞতা থেকে বারো চোদ্দ বছর পর্যন্ত তার যে অভিজ্ঞতা হয়, সারাজীবনে সেই অভিজ্ঞতাটাকে সে চর্চা করে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: পঞ্চাশের হয়েও আপনি ‘কৃত্তিবাস’ এবং ‘শতভিষা’— যে দুইটা গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যস্রোত আপনাদের সময়কার— তার থেকে আপনি একেবারে আলাদা ছিলেন এবং কখনওই প্রচলিত ধাঁচের কবিতা লেখেননি। আপনার এই অভিযাত্রাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

তরুণ সান্যাল: ১৯৫৪ সালে বা ৫৩ সালে ‘কৃত্তিবাস’ বেরোল, আমি ‘কৃত্তিবাস’-এর কয়েকটা সংখ্যায় লিখেছি। পরপর। এদিকে ‘পরিচয়’-এ নিয়মিত লিখতাম। ‘সাহিত্যপত্র’-এ লিখতাম। দেশেও লিখতাম। ফলে আমার মধ্যে পরস্পরের কবিতা নিয়ে খুব বিরোধিতা ছিল না। আমরা সবাই একটি পরাধীন দেশ থেকে স্বাধীন দেশে এসেছিলাম। এবং আমার অধিকাংশ কবিবন্ধু পূর্ববঙ্গের অধিবাসী ছিল। যে দেশের প্রকৃতিতে তারা বড় হয়েছিল সেই তরুণ বয়সে তারা পশ্চিমবঙ্গে চলে গিয়েছিল। ফলে আমাদের কবিতা আদতে বাংলাদেশি কবিতা ছিল। ফলে জীবনানন্দের মাছরাঙা, আমাদের দেশে নদী, আমাদের দেশের পশ্চিমবঙ্গের এটা ওটা সব মিলিয়ে সেগুলো আমাদের কবিতাতে আসত। ফলে এই কবিতার ভেতরে সুনীলও যা লিখেছে, আমি যা লিখেছি, শক্তিও যা লিখেছে, যদিও শক্তি পশ্চিমবঙ্গবাসী কিন্তু তার ঝোঁকটা ছিল আমাদের সাথে, সে যা লিখছে তার সঙ্গে জীবনানন্দ দাসের কোনও তফাত নেই।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: হ্যাঁ, সেটা তো বললেনই। একটা কবিতাই সবাই লিখতে চায়। কিন্তু আপনাদের সাথে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, বেলাল চৌধুরী এনাদের যোগাযোগটা কেমন ছিল। আপনি যে বললেন বাংলাদেশের কবিতাই লিখতেন।

তরুণ সান্যাল: তোমার শুনতে কষ্ট হবে, তবু বলি, আল মাহমুদ আমার সমবয়সী বন্ধু। একই সময়ে লিখেছি। শামসুর রাহমান সামান্য বড়। আর অনেকেই একই প্রজন্মের মানুষ। কিন্তু ঘটনা হল যে, আমি ক’বছর আগে বাংলা একাডেমিতে এসেছিলাম, ৯১ না কোন সালে যেন, আমাকে অনেক কবিরা প্রশ্ন করেছিল, আমাদের কবিতা এবং পশ্চিমবঙ্গের কবিতার ভেতর মৌলিক তফাৎ কী দেখেন? আমি যদিও খুব তফাৎ দেখি না, তবু তোমাকে একটা কথা বলি, তোমার লড়াইটা আমাদের চেয়ে বেশি। তার কারণ, ধরো, আমার পেছনের দিকে তাকিয়ে আমি বাল্মিকী থেকে শুরু করে মধ্যযুগের সমস্ত কবিদের পেয়ে যাই। তারপর ধরো ঈশ্বরগুপ্ত থেকে ধরে একদম রবীন্দ্রনাথকে পাই। তার আগে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে পাই। পরবর্তীকালে সত্যেন দত্ত হয়ে একদম জীবনানন্দ আমি পড়েছি। এটা উত্তরাধিকার। আর তোমাদের উত্তরাধিকার, তুমি ক্ষমা করে দিও, বললাম, তোমার উত্তরাধিকার হল পাকিস্তান হওয়ার পর। তোমাকে ধাক্কা দিয়ে একদম পাকিস্তানি করে দিয়েছিল। ফলে তোমার উত্তরাধিকারে রবীন্দ্রনাথ তো নেই-ই, বরঞ্চ রবীন্দ্রসঙ্গীত বন্ধ করেছিল। নজরুল ইসলামও তোমার নেই। এবং তোমার জীবনানন্দও নেই। তোমার এগুলো ছিল না। তোমাকে লড়াই করে দখল করতে হয়েছে। ফলে দু’টো দু’রকম হবে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: ফলে আমাদের, মানে যারা জিজ্ঞেস করেছিল তাদের লড়াইটা বেশি। কিন্তু এখন অবস্থাটা কি একই রকম আছে? কলকাতায় বাংলাভাষা এখন যে অবস্থানে আছে, সেখানে কি কলকাতার আমার বয়সি একজন কবির লড়াই আমার চেয়ে বেশি না কম বলে আপনি মনে করেন? আমি তো মনে করি ওদের লড়াই আমার চেয়ে বেশি। অরিজিৎ কিংবা কিশোরের লড়াইটা আমার চেয়ে বেশি।

তরুণ সান্যাল: শোনো, একদিকে তুমি বলতে পারো তুমি একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বাধীন ভাষার কবি। আমি একটা বৃহৎ রাষ্ট্রের বহু আঞ্চলিক ভাষার একজন আঞ্চলিক কবি। দু’জন আলাদা। ফলে তোমার যে মহিমা, আমার মহিমাটা এক নয়। তুমি যখন কোথাও কবিতা নিয়ে যাও, তুমি বাংলাদেশের স্বাধীন দেশের কবিতা নিয়ে যাও। আমি যখন কবিতা নিয়ে যাই আমি একটা ভারতবর্ষের মতো সাধারণ দেশের তাদের আঞ্চলিক ভাষার কবিতা নিয়ে যাই। তা সত্ত্বেও আমি বলব, পরাধীনতা, অনেক সময় হয় কী, লড়াই করিয়ে ভালো লেখা লেখায়। রবীন্দ্রনাথ পরাধীন দেশের মানুষ ছিলেন। মাইকেল মধুসূদন পরাধীন দেশের মানুষ ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম পরাধীন দেশের মানুষ ছিলেন। ফলে তাদের কবিতা যে মহিমা পেয়েছে, আমি বলি, আমার কবিতার মহিমার কাছে পশ্চিমবঙ্গের কবিতার মহিমা কখনও পৌঁছতে পারবে না।

শিমুল সালাহউদ্দিন: হ্যাঁ, এই জায়গায় আপনি অবশ্যই মহিমান্বিত। কিন্তু আপনি ইকোনোমিক্স পড়িয়েছেন দীর্ঘ সময়, আপনি তো এটা নিশ্চয় মানবেন, যখনই কোনও ক্রাইসিস হয়, যখনই কোনও সঙ্কট থাকে, তখন সমাধানের আকুতিটাও বেশি থাকে। উপযোগের জায়গাটাও তখন বেশি তৈরি হয়।

তরুণ সান্যাল: এখন ধরো পশ্চিমবঙ্গের একটা কবিতা ফেডারেশন আছে। গোটা পৃথিবীর কবিতার সাথে তার ঘনিষ্ঠতা আছে। এবং এই ঘনিষ্ঠতার ভেতর দিয়ে আমাদের একটু আগের যারা লিখেছেন তারা ভীষণরকমভাবে পৃথিবীর কবিতার সাথে যুক্ত ছিলেন। তাছাড়াও ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক সমাজ গোটা পৃথিবীর কবিতা পড়তে দিয়েছে। আমরা পড়তে পেরেছি। তোমাদের দেশে আইয়ুব খান থেকে শুরু করে তার আগের যে সমস্ত শাসকরা গোটা পৃথিবীর স্বাধীন কবিতা তোমাকে পড়তে দেয়নি। তার ফলে আমার একটা স্বাধীন অভিব্যক্তি হয়েছে, তোমাকে এক সময় চেপে রাখা হয়েছে। ভেতরের চাপ এবং বাইরের চাপে তোমার অসুবিধা হয়েছে, আমি মনে করি তুমি রাজনৈতিকভাবে জয়ী হয়েছ। জয়ী হওয়ার ফলে শেষ পর্যন্ত সাহিত্যের ক্ষেত্রে জোয়ারটা অনেক বড় হওয়ার কথা।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: একটা জিনিস জানতে চাই, এখন যে বাংলাদেশ আপনি দেখছেন, যে বাংলাদেশে আপনি এলেন, এবং এখন আমাদের বাংলা একাডেমি হয়েছে, সেখানে আপনি এসেছেন। আপনি যখন বই লিখলেন তোমার জন্যই বাংলদেশ, তো মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি খুশি হয়েছিলেন নতুন একটা শিশু জন্মগ্রহণ করেছে, তো সেই স্বপ্নের বাংলাদেশের সাথে আপনার দেখা এই বাংলাদেশের মিল কতটুকু?

তরুণ সান্যাল: শোনো, তুমি আমার বইয়ের কথা বলেছ, ওই বইটাতে একটা কবিতা ছিল: ‘সকলেই ফুল চায়, খোপায় শয্যায় ভাসে….বিবাহেরও ফুল ফোটে, বিপ্লবেরও যেমন আগুন! এমনকি ধান ও ফুল মধু দুধ ক্ষীর হয়ে ওঠে। সকলেরই ফুল তাই প্রস্তাবনা/ স্মারকলিপি ও দাবি/ ফুল তাই প্যারেডের বুলেটের…’ কবিতার নাম হল ‘ফুলগুলো’। আর যখন বংলাদেশ হল, সেই সময় আমার এই কবিতাটাই আদতে প্রথম বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে লেখা হয়েছে। আমি শুধু নই অনেকেই লিখেছেন। যখন আন্দোলনটা খুব তীব্র হয়েছে তখন মহাদেব সাহা আমার কাছে ছিলেন। সেই সময়, আমার মনে আছে, একটা জায়গায় কবি সম্মেলনে আমরা কবিতা পড়তে গেছি, তখন এই কবিতাটা আমি পড়েছিলাম। এটার নাম হল ‘মাটি’। বড় কবিতা। তার মাঝখান থেকে বলছি। ‘নির্মম মাটির পিণ্ড/ চষা মাঠে গুড়ো করি,/ মুখহীন অবয়বহীন/ অনাদিকে।/ ধুলো হয়ে চূর্ণ সাদা রেণুগুলি/ উড়ে যায় দক্ষিণের উদ্যম দমকায়…

শিমুল সালাহউদ্দিন: এই সময়ে বাংলাদেশে যারা কবিতা লিখছে, যারা এত বিপর্যয়ের ভেতরেও কবিতা নিয়ে স্বপ্ন দেখছে, তাদেরকে কিভাবে স্নেহাশিষ দেবেন?

তরুণ সান্যাল: কবি কাউকে স্নেহাশিষ দেয় না। আমি রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা বলি, আমি সেদিন এটা, প্রথমদিন তোমাদের ওখানে যে ডিনার দিয়েছিল সেখানে বলেছিলাম। বহুদিন আগে আমি যখন ছাত্র ছিলাম, ‘শিশু সাথী’র পুজো সংখ্যায় একটা কবিতা পড়েছিলাম, সেটা হল: ‘সূর্য কখন আলোর তিলক পরালো তোমার ভালে, অজানা ঊষার কালে। কিন্তু তোমার ভিক্ষার মাঝে দেন নাই তিনি ফুল, তোমার আপন হৃদয়েতে ছিল মাধবীলতার মূল…’ আমি শুধু তরুণ কবিদের বলব, যারা কবিতা লেখে তাদের জনজাতির গভীরে গোপনে আছে যে মহাস্রোত, তা হল যে, তারা চিত্র-বিচিত্র-চিত্রকল্পের ভেতর দিয়ে বিভাসিত হয়, সে বিষয়ে দারুণভাবে চৈতন্যধর হতে হবে। দ্বিতীয়ত, এগুলোকে প্রকাশ করতে গেলে পরে কবিতার ছন্দ সম্পর্কে খুব সচেতন হওয়া দরকার। আমাদের দেশে কেন, পৃথিবীতে বাঙালি কবিতায় যদি রবীন্দ্রনাথকে ভাবো, লক্ষ করে দেখবে রবীন্দ্রনাথের বড় অংশের কবিতা স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা। রবীন্দ্রনাথের গানের অধিকাংশই স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা। আদতে আমার মনে হয় বাঙালি কবিদের স্বরবৃত্ত ছন্দটা পরীক্ষা করা উচিত। আর অক্ষরবৃত্ত তো স্বাভাবিক, আমাদের দেশের ধর্মই ছিল, আগে বলা হত মায়ের ছন্দ মেয়েলি ছন্দ, স্বরবৃত্ত। ওটা হল শূদ্রছন্দ। আর ব্রাহ্মণ ছন্দ হল অক্ষরবৃত্ত। যাতে সমস্ত পণ্ডিতদের বইপুস্তক লেখা। তারপর মিলিয়ে টিলিয়ে পাঁচটা বৃত্ত তৈরি হয়েছে। পাঁচটা বৃত্ত রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে বিকশিত হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে শুরুতে স্বরবৃত্ত, পরে অক্ষরবৃত্ত, এরপর দুটো মিলে মাত্রাবৃত্ত। কথনের ভেতর অক্ষরবৃত্ত। উভয় মিলে মাত্রাবৃত্ত। এগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার। প্রত্যেকটি কবিতাই একটি বিস্তৃত চিত্রকল্প। কবিতাটা যেন সেই চিত্রকল্পের উপযুক্ত প্রাসঙ্গিকতা পায়। আর মানুষকে ছাড়া কবিতা হয় না। ফলে মানুষকে বাদ দিয়ে অন্যকিছু হতে পারে, কবিতা হবে না। একেকটা কবিতার ভেতরে একেকটা বিশ্বজগত ঘুমায়।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: দাদা, আপনি কি তরুণদের কবিতা পড়েন, আপনার পরে যারা লিখছেন?

তরুণ সান্যাল: হ্যাঁ হ্যাঁ। আমাকে যারা বই দেয় এমন কোনও বই নেই আমি যা পড়ি না। শুধু তাই না, আমাকে অনেকেই টেলিফোন করে বা লিখিতভাবে জানতে চায়। আমার যা বলার তাই বলি।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: আপনার পরবর্তী কবিদের অভিযাত্রাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? আপনার পরবর্তী সময়ের খুব প্রিয় কোনও কবি আছেন?

তরুণ সান্যাল:মি খুব দুঃখী প্রজন্মের মানুষ। আমার দেশ ভাগ হয়ে গেছিল। আমি একটা বড় দুর্ভিক্ষ দেখেছি। আন্দোলন দেখেছি। মানুষকে মরতে দেখেছি। এবং নানা রকম আর্ত অবস্থায় তাদের দেখেছি। আমাদের পরবর্তী জেনারেশন এর কোনওটাই অনুভব করেনি। ধরো তুমি একটা মেয়েকে ভালোবাসো, প্রতিদিন তাকে দেখতে চাও, এবং দেখার ব্যাপারটা যদি এমন হয়— তুমি দূর থেকে দূরবীন দিয়ে তাকে দেখবে। আর তুমি কাছে দাঁড়িয়ে তার সাথে আলাপ করা, কখনও স্পর্শ করা— দুইটা আলাদা জিনিস। ফলে আমার কাছে দুঃখ, যন্ত্রণা,কষ্ট— স্বদেশ। আমি তাকে স্পর্শ করেছি। আমার পরবর্তী প্রজন্ম এই স্পর্শটা করেনি। সুতরাং যে সমস্যাটা হয় তাই হয়েছে। আমি ভালো মন্দটা বলতে পারি না।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: সেটা তো বিচার করার বিষয়ও হয় না। জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে কবিতার সাথে কি সব সময় থাকেন?

তরুণ সান্যাল: শোনো বাবা, আমার এমন কোনও দিন যায় না, যেদিন আমি কোনও কাব্যগ্রন্থ পড়ি না। এবং প্রায়শই আমাকে কবিতা লিখতেও হয়। চাপও আছে। কারণ অনেকেই যারা পত্রিকা বের করে তারা চায়। আমি চিরকাল মনে করি আমি একজন ব্রাহ্মণ। কবিতা এটা কখনও ব্রাহ্মণের লেখার কথা না। কিন্তু মুসলমানের ভেতর যে ব্রাহ্মণ, খৃস্টানের মধ্যে যে ব্রাহ্মণ সেই কবিতাটা লেখে। আসলে যে বিশেষ উন্নত মেধা থেকে জিনিসটাকে দেখে, দৈব আত্মা থেকে দেখে। ফলে আমি এটা বলতে পারি, তুমি যা লিখবে আমি যা লিখব, এই সমস্ত ক্ষেত্রে একটা প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষের সৃজনধর্মিতা থাকবে।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: অনেক ধন্যবাদ দাদা আপনাকে, আর দেরি না করাই, শতরূপাদি কটমট করে তাকাচ্ছে, ফ্লাইট মিস করবেন।

তরুণ সান্যাল: তোমাকেও ধন্যবাদ, কোলকাতায় এলে জানিও।

শিমুল সালাহ্উদ্দিন: নমস্কার।

শিমুল সালাহ্‌উদ্দিনের জন্ম ১৭ অক্টোবর, ১৯৮৭। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর। সক্রিয় সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট ও আবৃত্তি সংগঠন ধ্বনি’র। পেশায় ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের ‘শিল্প-সংস্কৃতি ও বিনোদন’ বিভাগের প্রধান। প্রকাশিতব্য সাক্ষাৎকারগ্রন্থ: “আলাপে, বিস্তারে”। প্রকাশিত বই: ৪টি কাব্যগ্রন্থ। শিরস্ত্রাণগুলি (ঐতিহ্য, ২০১০), সতীনের মোচড় (শুদ্ধস্বর, ২০১২), কথাচুপকথা… (অ্যাডর্ন বুকস্, ২০১৪) এবং সংশয়সুর (চৈতন্য, ২০১৬)।

(বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত bdnews24.com -এ ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত হয় এই সাক্ষাৎকারটি। এখানে প্রকাশকের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হল।)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...