অসমীয়া উপন্যাসে উপজাতীয় ঐতিহ্য এবং রংমিলির হানহি

সাহিত্যের উত্তর-পূর্ব | প্রথম বর্ষ, ষষ্ঠ যাত্রা | অক্টোবর, ২০১৭

গোবিন্দপ্রসাদ র্মা

 

অসমীয়া থেকে ইংরাজি : রাধিকা বড়ুয়া

ইংরাজি থেকে বাংলা : সোমদেব ঘোষ

 

 

ড. সর্মা আসামের একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমালোচক এবং লেখক। তাঁর লেখায় অনবরত উঠে আসে সমকালীন সমাজজীবনের ছবি। গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরিজি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান।

 

 

উপজাতীয় সমাজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, নিয়ম এবং প্রবিধান বর্ণনার এক মাধ্যম হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে রজনীকান্ত বরদলৈর মিরি জিয়রী (মিরির মেয়েরা, ১৮৯৫) আসামে উপন্যাসের একটি মৌলিক পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটায়। রজনী বরদলৈর পরে অরুণাচল প্রদেশের লামার দাই তাঁর পৃথিবীর হানহি (পৃথিবীর হাসি, ১৯৬৩) বইতে আদি গোত্রের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক চেতনাকে তুলে ধরেন। ঠিক একইভাবে তাঁর রংমিলির হানহি (রংমিলির হাসি, ১৯৮১) উপন্যাসে কার্বি সমাজের কিছু সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক তুলে ধরেন অসমীয়া লেখক রংবং তেরাং। মিরি জায়রী-তে বরদলৈ মিসিং সমাজের চিরস্থায়ী অপরিবর্তনশীল চরিত্রের সঙ্গে অসমীয়া পাঠকের পরিচয় করান। সময়ের সাথে সাথে আদি ও কার্বি উপজাতির সমাজে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব কীভাবে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক পরিবর্তন আনে, লামার দাই আর রংবং তেরাংয়ের লেখা পড়লে তা বোঝা যায়। আদিগোত্রীয় লামার দাই ও কার্বিগোত্রীয় রংবং তেরাং নিজনিজ সমাজের ভাল-খারাপ দু’দিকই বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন। এ’কাজে তাঁরা রজনী বরদলৈর উদাহরণ অনুসরণ করার চেষ্টা করলেও বরদলৈ নিজে মিসিং প্রজাতির সদস্য ছিলেন না বলে তাঁদের মতো সরাসরি সমালোচনা করেননি। নিজে দূরে থেকে যত্নবান মুগ্ধ দর্শকের ভূমিকা পালনই তাঁর কাজ ছিল। গ্রামপঞ্চায়েতের ওপর বিশ্বাস হারানোর সঙ্গে সঙ্গে আদিসমাজের প্রাচীন আদর্শ ও নিয়ম কীভাবে ভাঙল তার কথাই লামার দাই বলেছেন। সময়ের সাথেসাথে ভিন্ন-ভিন্ন চরিত্রের স্বার্থপর মানুষের জন্যই কেবাং নামের এই গ্রামপঞ্চায়েত তার পুরনো ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি হারিয়েছে। একইভাবে, বাইরের জগতের পরিবর্তনশীল বাণিজ্যিক সভ্যতার প্রভাবে গ্রামীণ কার্বি সমাজেও ভাঙন ধরার কথা তেরাং বলেছেন। রংমিলির হানহিপৃথিবীর হানহি, এই দুই উপন্যাসেই হানহি (হাসি) শব্দের প্রয়োগ হলেও অর্থের দিক থেকে এই দুই প্রয়োগ ভীষণভাবেই আলাদা। লামার দাইয়ের পৃথিবীর হানহি-তে হাস্যময় জগত হল কেবাঙের জগত। এ হাসি বাঁকা হাসি, কেননা কেবাং এখন অশুদ্ধ, পাহাড়ি গ্রাম্যসমাজে এর প্রতি আগেকার সেই শ্রদ্ধা আর নেই। আদিগোত্রের এক নিরীহ যুবক বাইরের কুটিল জগতের প্রভাবে পড়ে জালিয়াতি করে, লোক ঠকায়। কেবাঙের সামনে তার বিচার হয়। কিন্তু কেবাং কি পারবে আগেকার মতো বিচার দিতে? কেবাঙের প্রতি কারুর আস্থা নেই। এ অবস্থায় কেবাঙের হাসি কেমন হবে? বাঁকা? ফ্যাকাশে? উপন্যাসের শেষে অবশ্য কেবাং সফল হয়ে মানুষের আস্থা ফিরে পায়। এ তো গেল পঞ্চায়েতের কথা। রংবং তেরাঙের রংমিলি গ্রামের সাদাসিধে গ্রাম্যদের হাসি তাহলে কেমন হবে?

অরুণাচলীয় কেবাঙের মতো গ্রামপঞ্চায়েতের কথা রংমিলির হানহি-তে না থাকলেও, সর্বাসা বা গাঁওবুরহা নামে গ্রামের প্রধানের কথা বইতে পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত দক্ষতার জন্যই এই সম্মানীয় পদে সারাইক তেরাংকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। গ্রামের সবাই তাঁকে যথেষ্ট মান্য করে। পৃথিবীর হানহি-তে কেবাং কীভাবে বাইরের জগতের অর্থনির্ভর সভ্যতার খপ্পরে পড়ে তা বলা আছে। রংমিলির হানহি-তে গ্রামের সহজ সরল সৎ সর্বাসা সারাইক তেরাঙের সঙ্গে শিকারী সার্থে তেরনের সংঘাত তৈরী হয়। নয়া বাণিজ্যিক সভ্যতার পরোক্ষ প্রভাবে পড়া সার্থে তেরন মুখ্য বিচারক বা হাবিসেক, সারাইক তেরাং তাঁর অধীনস্থ। তা সত্ত্বেও সর্বাসা সারাইক তেরাংকে লোকে বেশি মান্য করে বলে হাবিসেক তেরনের মনে তেরাঙের প্রতি অসন্তোষ জাগে। তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহার করে অসৎ দুর্বৃত্ত হাবিসেক কীভাবে সৎ সরল সর্বাসার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র রচনা করেন সেটাই উপন্যাসের মুখ্য গল্প। তেরাংকে হটিয়ে হাবিসেক তেরন সিংনট তেরাংকে সর্বাসার পদে নিযুক্ত করেন। সিংনট তেরাং তেরনের মতোই দুশ্চরিত্র। সারাইক তেরাং ক্ষমতা বা পদলোভী নন, নিজের গ্রামকে তিনি ভালবাসের, গ্রামের উন্নতি হোক শুধু তাই চান। দুশ্চরিত্রদের হাতে গ্রামের প্রশাসন আসাতে তিনি খুব দুঃখ পেয়েছেন। এর পরেও রংমিলির মানুষ সারাইক তেরাংকে শ্রদ্ধা করে। তাতে সিংনট তেরাং লোক লাগিয়ে সারাইক তেরাঙের বাড়িতে আগুন লাগাবার চেষ্টা করেন, কিন্তু গ্রামের লোকেরা তাতে বাধা দেয়। অপরাধীদেরও তারা ধরে ফেলে। যারা তাঁর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ছাই করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল, সেই শত্রুদের সারাইক তেরাং ক্ষমা করে দেন। স্থানীয় মানুষের চেষ্টায় এবং রাজকীয় মন্ত্রী-পুরোহিত এবং হাবেক বিচারকদের সমর্থনে হাবিসেকের পদ থেকে শিকারী তেরনকে বরখাস্ত করা হয়। রংমিলি তখন হাসে– খোলা, সৎ হাসি।

গল্পটা এইভাবে পড়লে মনে হয় প্রাচীন প্রথা এবং রীতিনির্ভর কার্বি সমাজ কোনও নতুন প্রভাব মেনে নেবে না, আধুনিক প্রগতিশীল সভ্যতা তারা মেনে নেবে না। যেহেতু উপন্যাসের মূল চরিত্র সারাইক তেরাং সম্পূর্ণ লেখকের নিজের সৃষ্টি, তাতে মনে হতেই পারে লেখক নিজেও হয়ত কার্বি সমাজে পরিবর্তনের বিরুদ্ধে। আসলে কিন্তু তা নয়। উপন্যাসে প্রাচীন কার্বি সমাজের সদগুণ এবং তার ভাল দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে; সারল্য, সততা এবং সত্যতাই সমাজের অমূল্য সম্পদ। কার্বি সমাজের উন্নতির জন্য আধুনিককালের শিক্ষা, সংস্কৃতি, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের পরিবেশ অত্যন্ত জরুরী। নয়া সভ্যতার অর্থপিপাসা, দুর্নীতি, ব্যভিচার ও ক্ষমতালোভ কার্বি সমাজের কাছে এক ধরনের অভিশাপ, উন্নতির পথে এরা বাধা সৃষ্টি করে, তাই এদেরকে এড়িয়ে চলাই সমাজের মঙ্গল। প্রাচীন কার্বি সমাজের সদগুণের প্রতীক এবং প্রতিভূ সারাইক তেরাং তাই আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার বিপক্ষে নন। তিনি চান গ্রামের ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজে গিয়ে পড়াশুনো করুক, দেশ ও দশের কথা জানুক, শিক্ষিত হোক। বিদেশী সাহেব মুর এবং কারওয়েলের মতো মানুষ, গ্রামে গ্রামে যাঁরা এই আধুনিক শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, সারাইক তেরাং তাঁদের শ্রদ্ধা করেন। কার্বি পাহাড়ের নাম তখন ছিল মিকির পাহাড়। মিকিরে মুর ও কারওয়েলের ক্রিশ্চিয়ান মিশন বা টিকা পাহাড়ের ক্রিশ্চিয়ান মিশন যে আদপে খারাপ নয়, রংমিলির হানহি উপন্যাসে সেই কথাই বলা আছে। মিকির পাহাড়ের মিশন রংমিলি গ্রাম থেকে অনেক দূরে, তাই এগারো-বারো বছর বয়সী সারাইক তেরাং সেই মিশনে পড়ার সুযোগ পাননি। নিজের বড় ছেলেমেয়েদেরও দূরত্বের কারণেই মুর-কারওয়লের মিশনে পড়ানোর সুযোগ পাননি তিনি। আধুনিক কার্বি সমাজের গণমান্য ব্যক্তি লরেন্স হান্সে মিশনারিদের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। সারাইক তেরাং হান্সেকে শ্রদ্ধা করেন, তাঁর বাড়ি যান, তাঁর সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন। শিক্ষার প্রতি এই মুগ্ধতার জন্যই তিনি তাঁর ছোটছেলেকে স্কুলে পাঠিয়েছেন। ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি স্কুলে নয় যদিও, সারাইক তেরাং ছেলেকে পাঠিয়েছেন সমতলে নগাঁও জেলার কামপুরে এক অসমীয়া স্কুলে। কাছের বন্ধু ধনেশ্বর মাস্টার এই স্কুলের শিক্ষক, এঁর কাছেই তাঁর ছেলে থাকবে, এঁর তত্ত্বাবধানেই সে শিক্ষালাভ করবে, এটাই সারাইক তেরাঙের ইচ্ছা। লেখক যেন বলতে চাইছেন এরকম পরার্থপরতা কার্বি সমাজের ভালই করবে। ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি এবং অসমীয়াদের প্রতি ঘৃণা কার্বি সমাজের উন্নতি এবং ভালর পথে বাধাই। উপন্যাসে এটাও বলা আছে যে অসমীয়া সমাজের আন্তরিক সহযোগিতা এবং সাহায্য পেলে কার্বি সমাজের পক্ষে নিজের পায়ে দাঁড়ানো আরও সহজ হবে। এটা আরও ভাল করে দেখানো আছে উপন্যাসের একদম শেষের দিকে, যেখানে সমস্ত শাশ্বত রীতিনীতি মেনে খোরসিং তেরাঙের নেতৃত্বে কার্বি দরবার বসেছে। ১৯৩৯ সাল থেকে কার্বি গোত্র থেকে আসাম বিধানসভার একমাত্র সভ্য এই খোরসিং তারাং (আসাম প্রকাশন পরিষদ, গুয়াহাটি ১৯৮১, পৃ: ৭৩, পাদটীকা)। সমতলের অসমীয়া মানুষও এই দরবারে অংশগ্রহণ করে উৎসাহ দেন এবং সমর্থন জানান। এমন সময় পাগুড়ি (পাগড়ি) পরা গোস্বামী নামধারী এক ব্যক্তি এই সভার সভাপতি নির্বাচিত হন (পৃ: ১৮৮)। ইনি যে তখনকার দিনের বাস্তব মানুষ মহেশচন্দ্র গোস্বামী সে নিয়ে খুব একটা সন্দেহ নেই।

“কারবি মানুষের দুরবস্থা দেখে ও অনুভব করে তিনি এক মর্মস্পর্শী বক্তৃতা দিলেন।

‘অসমীয়ারাও আমাদের সমস্যা বোঝে, তাই না আংহাই (মামা)?’

‘তা তো বটেই।'” (পৃ: ১৯৯)

কার্বি পাহাড়ে সমতলের অসমীয়াদের উপস্থিতিকে ভাল বলা হলেও, নেপালী মারওয়ারী বা অন্য কয়েক সম্প্রদায়ের মানুষকে লোভী এবং অত্যাচারীরূপে দেখানো হয়েছে এই উপন্যাসে। একই মনোভাব পাওয়া যায় রংমিলির হানহি প্রকাশের চার বছর আগে প্রকাশিত জয়ন্ত রংপির পুওয়াতে এজাক ধনেশ (ভোরে ধনেশপাখির উড়ান, ১৯৭৭) বইতে।

কাল্পনিক গল্পের মাধ্যমে যেমন কার্বি সমাজের সামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে, ঠিক তেমনই কিছু সত্যিকারের রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনার মাধ্যমে এই কাল্পনিক ভূখণ্ডের ওপর বাস্তবতার এখটা প্রলেপ বোলানো হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের পটভূমিকায় লেখা এই উপন্যাসটি। এই সময়টা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের যেমন শেষের দিক, তেমনই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা সারা পৃথিবীতে। এই দুই ঐতিহাসিক ঘটনা উপন্যাসে স্থান পেয়েছে, এদের দ্বারা কার্বি সমাজও কীভাবে প্রভাবিত হয়েছে সে কথাও উপন্যাসে বলা আছে। সমতলের কিছু কাছের সহযোগীদের কাছে সারাইক তারেং মহাত্মা গান্ধীর নাম শুনে থাকলেও তাঁর মতাদর্শে প্রভাবিত হননি। নগাঁওতে বন্দুক কিনতে গিয়ে বন্দুক দোকানের মালিক করুণা মিস্ত্রির কাছে গান্ধীর কথা শুনলেও সারাইক তেরাঙের সে বিষয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না, গান্ধী সম্পর্কে তাঁর কৌতূহলও তেমন দেখা যায় না (পৃ: ৪৯)। নগাঁওবাসী অসমীয়া করুণা মিস্ত্রি ও রংমিলিবাসী কার্বি সারাইক তেরাঙের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে আদর্শ কারবি-অসমীয়া সম্পর্ক কী হওয়া উচিত তার একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় :

“‘বুঝলে গাঁওবুরহা, আজকাল বন্দুক পাওয়া বেশ কঠিন হয়েছে।’

‘কেন?’, অবাক হয়ে তাকিয়ে সারাইক জিজ্ঞেস করল।

‘বড়সাহেব (মুখ্য প্রশাসক) বন্দুকের সরবরাহ থামিয়ে দিয়েছেন। গান্ধী ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লব শুরু করেছেন, তাই।'” (পৃ: ৪৯)

তা সত্ত্বেও বন্দুকের লাইসেন্স পাওয়ার উপায় বাতলে দিল করুণা মিস্ত্রী। সারাইক তেরাংকে নিয়ে নগাঁও ক্রিশ্চিয়ান মিশনে নিয়ে গেল করুণা, সেখানকার শাদা চামড়ার পাদুরী (পাদরী) শংসাপত্রে লিখলেন যে সারাইক তেরাং ও তাঁর গোত্রের মানুষ ব্রিটিশরাজের অনুগত প্রজা। বুনো হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচতে সারাইক তেরাঙের একটা বন্দুক লাগবে। শংসাপত্র দেখে বড়সাহেব সারাইককে লাইসেন্স দিয়ে দিলেন। এমনভাবেই সমতলের অসমীয়া বন্ধুর মধ্যস্থতায় কার্বি পাহাড়ের গ্রামের প্রধান বন্দুকের লাইসেন্স পেলেন।

১৯৪২ সালের ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল কংগ্রেসের আন্দোলন যেমন কার্বি পাহাড়ে তেমন প্রভাব ফেলেনি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কানাঘুষো কথা বা উড়ন্ত বিমান ছাড়া তার তেমন প্রভাব পড়েনি কার্বি পাহাড়ে।

লামার দাইয়ের পৃথিবীর হানহি-তেও মাল কেনাবেচার কারণে উপজাতীয় মানুষ ও সমতলের অসমীয়ার মধ্যে সাক্ষাতের কথা লেখা আছে। সমতলের ডিব্রুগড়ে এই সাক্ষাৎ ঘটে। শহুরে আদবকায়দার সঙ্গে পরিচিত এক অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীর সঙ্গে এক অনভিজ্ঞ যুবক প্রথমবারের জন্য সমতলে আসে। রংমিলির হানহি-তেও সারাইকের সঙ্গে এক অনভিজ্ঞ যুবক নগাঁওতে আসে। এই দুই যুবকের কাছে সবই নতুন, সবই অচেনা অজানা। তুলনামূলকভাবে দুই অভিজ্ঞ ব্যক্তির, অরুণাচলী হোক কি কার্বি, সমতলের লোকের সঙ্গে যথেষ্ট চেনাজানা আছে।

পৃথিবীর হানহি এবং রংমিলির হানহি, উভয় বইতেই ভালবাসার গল্পের মাধ্যমে আদিসমাজ ও কার্বি সমাজের সামাজিক প্রথা, নিয়ম এবং প্রবিধান, বিশ্বাস এবং সংস্কৃতি দেখানো হয়েছে। এইদিক থেকে দেখতে গেলে পৃথিবীর হানহির মতো রংমিলির হানহি-কেও সামাজিক তথ্যচিত্ররূপে বর্ণনা করা যেতে পারে, যদিও মানবিক পরিস্থিতি ও ঘটনার দক্ষ বিবরণ এই দুই উপন্যাসকে শাদামাটা তথচিত্রের ঊর্ধ্বে তুলে অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে রচিত উপন্যাসের মর্যাদা দিয়েছে। রংমিলির হানহি বইতে আফিমখোর যুবক সেং তেরন যক্ষ্ণায় আক্রান্ত। মৃত্যুপথযাত্রী এই যুবক সারাইকের যুবতী কন্যা আমফুককে ভালবাসে। একসময়ে সেং তেরন এক সুচরিত্র যুবক ছিল, বাবার মৃত্যুর পর সে তার বাড়ি পুনর্নির্মাণ করতে দৃঢ়সংকল্প ছিল। কিন্তু আফিমের নেশা তার তখনও ছিল। তাকে বলা হয়েছিল আফিম ছাড়তে পারলে সে তার বাড়িও নতুন করে তৈরী করতে পারবে, আমফুকের সঙ্গে তার বিয়ে হওয়াতেও কোন বাধা আসবে না। কিন্তু তা না হওয়াতে সারাইক অন্য গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে আমফুকের বিয়ে দিয়ে দেন। সামাজিক প্রথামত আমফুক বাবার কথা মেনে নিলেও অসুস্থ সেং তেরনকে সে তখনও ভালবাসে। প্রথম প্রেমিকের কাছে বিদায় নিতে গিয়ে সে তিরস্কৃত হয়, সেং তেরন তাকে প্রতারক বলে গালি দেয়। আমফুকের যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা শোনার পর অবশ্য সেং তেরন তাকে বিদায় জানায়। এমন নয় যে তখনকার দিনে কার্বি পাহাড়ে প্রেম-ভালবাসা ছিল না। ছিল বৈকি, কিন্তু যুবক-যুবতীরা সামাজিক প্রথা মেনে যুক্তিসম্মতভাবেই কাজ করত। গানবাজনা, নাচ, অভিসারের মধ্য দিয়ে যুবক-যুবতীদের মধ্যে শারীরিক আকর্ষণ গড়ে উঠলেও সবসময় তা রোম্যান্টিক সম্পর্ক অবধি যেত না।

রংবং তেরাং এভাবেই কার্বি সমাজের ভিন্ন-ভিন্ন দিক খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন উপজাতীয় গোত্রের সমাজসম্পর্কিত সাহিত্যে রংমিলির হানহি যে এক উজ্জ্বল অবদান, সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। উত্তর-পূর্ব উপজাতীয় সাহিত্যের যে ধারা রজনীকান্ত বরদলৈর হাতে শুরু, রংবং তেরাঙের পরে লামার দাইয়ের হাতে তা সমৃদ্ধ। শুধু উপজাতীয় সাহিত্যধারায় নয়, পুরো অসমীয়া সাহিত্যে রংমিলির হানহি এক বিশিষ্ট উপন্যাস এবং এক মূল্যবান সাহিত্যকীর্তি। রজনীকান্ত বরদলৈ যে সাহিত্যধারা চালু করেন, সেই ধারাকে আরও শক্তিশালী করতে গিয়ে দুই লেখকই নিজ সম্প্রদায়ের নিছক বর্ণনা দিয়েই কাজ সারেননি, তাঁদের সমাজের বহু সমস্যার সুন্দর আলোচনা করে পাঠকের চিন্তার যথেষ্ট খোরাক জুগিয়েছেন। রজনীকান্তের উপন্যাসে মিসিং সমাজের প্রতি তাঁর ভালবাসা প্রকাশ পায়। দাই আর তেরাঙের উপন্যাসে নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি সেই ভালবাসা তো দেখতে পাওয়াই যায়, তার সঙ্গে সমসাময়িক পরিস্থিতির অকপট সমালোচনাও পাওয়া যায়। এই ধারা অনুসরণ করেই অরুণাচল প্রদেশের সম্প্রদায়কে বিষয়বস্তু করে বই লিখেছেন য়েছে দরজে ঠংছি : সোনাম (১৯৮১), লিংঝিক (১৯৮৩), মৌন ওঁঠ মুখর হৃদয় (২০০১) এবং শব কটা মানুহ (২০০৪)। বিষ্ণু রভা’র মিসিং কানেং (প্রথম প্রকাশনার সাল অজানা; বিষ্ণুপ্রসাদ রভা’র রসনাওয়ালী বইতে পুনর্মুদ্রিত, ১৯৭৯) একই ধারায় লেখা। তথ্যচিত্র সাহিত্য ও উপন্যাস হওয়া ছাড়াও এর মধ্যে এক আলাদা সমৃদ্ধতা আছে। মিসিং সমাজ ও সংস্কৃতির বর্ণনা ছাড়াও উপজাতীয় মানুষ ও অসমীয়া মানুষের মধ্যে এক সুস্থ পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সম্বন্ধে আলোচনা আছে। এই সম্পর্কে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে অসমীয়া মানুষ বাধা সৃষ্টি করে তাদের সমালোচনাও এই উপন্যাসে করা হয়েছে।

উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছে : বোরা, পবিত্র অার খনিন্দ্র কুমার ডেকা (সম্পাদক) ২০০৯, শমন্বয়ের রূপকার, গুয়াহাটি, ডিহুন।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...