অশোক মুখোপাধ্যায়
পূর্ব প্রকাশিতের পর
স্নায়ুতন্ত্রের ক্রমবিকাশ
ধর্মীয় ভাববাদী ও অন্যান্য প্রাচীন ধ্যানধারণা থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ প্রথমে বুঝতে চাইল, চিন্তা করা বলতে আধুনিক বিজ্ঞানে ঠিক কী বোঝানো হয় এবং তার শারীরিক প্রক্রিয়াটি কী বা কোত্থেকে শুরু হয়। আমরা জানি, শারীরতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে দেখলে চিন্তা করা মানুষের এক বিশেষ ধরনের আচরণ (behaviour)। একথা শুনে মনে হতে পারে, কথাটা খুব বেশি সরল করে বলা হল। আচরণ বলতে যা বোঝায়, চিন্তা করার ব্যাপারটা কি ততটা সহজ সরল একটা জিনিস? তা নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু বিজ্ঞানীদের জানার পদ্ধতিটাই এমন যে, যে কোনও বিষয়কে বুঝতে হলে তার একেবারে সরলতম সংজ্ঞা থেকে শুরু করে ছোট ছোট প্রশ্ন করে এগোতে হয়। শারীরতত্ত্বে আচরণ মানে হল, বহির্বাস্তবের কোনও উদ্দীপনায় (stimulus) জীবের সাড়া দেওয়া (response)-র কার্যকলাপ। একটু সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলেই ধরা পড়বে, মানুষের চিন্তার প্রক্রিয়াও এক রকমের আচরণ, যা বহির্জগতের কিছু নির্দিষ্ট উদ্দীপনায় সাড়া দিতে গিয়ে সম্পন্ন হয়। আমরা এখানে অপ্রয়োজন বিধায় উদ্ভিদের আচরণ সম্পর্কে কিছু বলছি না। কেন না, মানুষের আচরণ বুঝতে গেলে অন্যান্য মনুষ্যেতর প্রাণীর দেহগঠন ও শারীরতত্ত্ব থেকে আলোচনা শুরু করতে হবে। বাইরের উদ্দীপনায় উদ্ভিদের সাড়া দেওয়ার কায়দাকানুন একেবারেই আলাদা ধরনের।
এখন বাহ্যিক পরিবেশের বিভিন্ন ক্রিয়ার প্রভাবে সাড়া দেওয়ার জন্য, অর্থাৎ, সেরকম এক একটি আচরণের জন্য প্রতিটি প্রাণীর রয়েছে একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। আর এই অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির কাজ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রয়েছে স্নায়ুতন্ত্র। প্রাণী-বিবর্তনের ধারাপথ অনুসরণ করলে দেখা যাবে, অ্যানিলিডা পর্বের আগেকার প্রাণীগুলির কোনও স্নায়ুকোষ নেই। তারপরেও অমেরুদণ্ডী প্রাণীগুলির দেহে স্নায়ুতন্ত্র তেমন বিকশিত হয়নি। শম্বুক (mullusca) পর্বের অক্টোপাস জাতীয় প্রাণীগুলির মাথায় একটা কেন্দ্রীয় স্নায়ুগ্রন্থি থাকার ফলে এদের আচরণ খানিকটা উন্নত ও জটিল ধরনের। বস্তুত, অমেরুদণ্ডীদের মধ্যে অক্টোপাসেরই মস্তিষ্ক:দেহ অনুপাত সবচাইতে বেশি। তবুও স্নায়ুতন্ত্র বলতে যা বোঝায় সেই অর্থে খুব একটা উন্নত নয়। এই কারণে অমেরুদণ্ডী প্রাণীগুলির বাহ্যিক ঘাত প্রতিঘাতে সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা অনেকটা বিকেন্দ্রীভূত, স্থানীয়ভিত্তিক। দেহের যেখানে বাইরের পরিবেশ ক্রিয়া করে সেখান থেকেই সংশ্লিষ্ট অঙ্গ একটা জবাব দিতে চেষ্টা করে। প্রাণীটির সামগ্রিক আচরণ হল এইরকম অনেকগুলি ছোট ছোট স্থানীয় উদ্দীপনায় সাড়াগুলির সরল যোগফল।
কিন্তু মেরুদণ্ডী প্রাণীগুলির ক্ষেত্রে স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ এমনভাবে ঘটেছে যে তার একটা অংশ সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এমনকি বাকি স্নায়ুকোষগুলিরও নিয়ন্ত্রণ ভার গ্রহণ করেছে। তার ফলে, এদের দেহের যেখানেই পরিবেশ ক্রিয়া করুক না কেন, এরা তাতে সমগ্রভাবে বা কেন্দ্রীয়ভাবে সাড়া দিতে চেষ্টা করে। অর্থাৎ, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ বিভিন্ন ঘটনায় আলাদাভাবে সাড়া দিলেও সাড়াগুলির মধ্যে একটা সংযোগ বা সম্পর্ক থাকে। স্নায়ুতন্ত্রের যে অংশ এই নিয়ন্ত্রণের দায়ভার বহন করে তার নাম কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র (central nervous system— সংক্ষেপে সিএনএস)। মৎস্য জাতীয় প্রাণী থেকে শুরু করে বিবর্তনের পথ বেয়ে উভচর ও সরীসৃপ পার হয়ে এসে পক্ষী ও স্তন্যপায়ী পর্যায়ের প্রাণীদের মধ্যে এই কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র ক্রমাগত উন্নততর ও জটিলতর কাঠামো ও কার্যক্ষমতা অর্জন করেছে। আর, মানুষের ক্ষেত্রে তা চূড়ান্তভাবে বিকশিত হয়ে উঠেছে।
এই বিকাশের মূল ধারা অনুসরণ করলে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সমস্ত পর্যায়ের প্রাণীর কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র গঠনের মূল নকশাটা প্রায় একই। যত উন্নততর প্রাণী, তাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতা তত বৃদ্ধি পেয়েছে, অনুপুঙ্খ বেড়েছে, কাজকর্মের সামর্থ্য, পরিধি ও জটিলতা বেড়েছে। এই মূল নকশা একটু বুঝে নেওয়া যাক (চিত্র-১)।
এতে প্রথমে দেখা যাচ্ছে, মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়ে অনেকগুলি স্নায়ুতন্তু এক সঙ্গে দড়ির মতো পাকিয়ে একটা মোটা স্নায়ুরজ্জু তৈরি করেছে। একে বলা হয় সুষুম্না কাণ্ড বা মেরুরজ্জু (spinal cord)। এটি সামনের বা উপরের দিকে গিয়ে মস্তিষ্কের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই মস্তিষ্কের আবার প্রধান তিনটি ভাগ রয়েছে: (ক) অগ্রমস্তিষ্ক (fore brain) বা গুরুমস্তিষ্ক (cerebrum); (খ) মধ্যমস্তিষ্ক (mid-brain); এবং (গ) পশ্চাদমস্তিষ্ক (hind brain) বা লঘুমস্তিষ্ক (cerebellum)।
বিভিন্ন পর্যায়ের প্রাণীর মস্তিষ্কের এই তিনটি অংশের আকার ও গুরুত্ব সমান নয়। যত নিম্নতর প্রাণী, তার পশ্চাদমস্তিষ্কের আনুপাতিক আয়তন ও গুরুত্ব তত বেশি। অন্যদিকে, উন্নততর প্রাণীর ক্ষেত্রে অগ্রমস্তিষ্কের আনুপাতিক আয়তন ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পশ্চাদমস্তিষ্কের আয়তন ও গুরুত্ব কমতে থাকে। যদি বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রাণীগুলির মস্তিষ্কের লম্বালম্বি প্রস্থচ্ছেদ নিয়ে তুলনা করা হয়, এটা আরও ভালো বোঝা যায়।
দ্বিতীয়ত, এটা লক্ষ করা দরকার, বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের গঠনবৈচিত্র্য ও ক্রিয়াগত বৈশিষ্ট্য কীভাবে বিকাশ লাভ করেছে। মস্তিষ্কের একটা অংশ শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে স্নায়ুকোষের দ্বারা পরিবাহিত হয়ে আসা সংবেদনগুলি গ্রহণ করার জন্য ধীরে ধীরে বিশেষায়িত হয়েছে। এই অংশকে এক কথায় বলা হয় সংবেদক অঞ্চল (sensory area)। আর অন্য একটা বিশেষায়িত অংশ থেকে স্নায়ুকোষের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাছে প্রাপ্ত সংবেদনের উত্তরে সাড়া দেওয়ার কাজের নির্দেশ যায়। এর নাম সঞ্চালক অঞ্চল (motor area)। নিম্নতর প্রাণীর মস্তিষ্কের সংবেদক অঞ্চল তুলনামূলকভাবে ছোট এবং সঞ্চালক অঞ্চল মস্তিষ্কের অধিকতর জায়গা জুড়ে থাকে। উন্নততর প্রাণীর মস্তিষ্কে সংবেদক অঞ্চল উন্নততর এবং প্রশস্ততর। তাছাড়া, অগ্রমস্তিষ্কে আবার বিশেষ বিশেষ সংবেদন গ্রহণ করার জন্য আলাদা আলাদা জায়গা বিশেষায়িত হয়েছে। পক্ষান্তরে সঞ্চালক অঞ্চলের আপেক্ষিক আয়তন কমে গেছে (চিত্র-২)।
বিবর্তনের দিক থেকে বিকাশের মাত্রার সাপেক্ষে বিচার করলে এর কারণ বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় না। যত নিম্নতর ও সরলতর প্রাণী, তার সংবেদন গ্রহণ করবার ক্ষমতার পরিধি ততই সঙ্কীর্ণ। যেমন, মাছেদের দর্শন-শ্রবণ-আস্বাদন প্রভৃতি সংবেদন গ্রহণ করার কোনও দেহাঙ্গ নেই। তাই তাদের মস্তিষ্কে এই সব সংবেদন গ্রহণ করার মতো কোনও ব্যবস্থা নেই। মাছের চোখ থাকলেও তার কার্যকারিতা প্রায় নেই বললেই চলে। ব্যাং বা সাপের বেলায় দর্শনের ভূমিকা নেই বললেই চলে, শ্রবণযন্ত্রও বিকশিত হয়নি। মস্তিষ্কও তাদের সেইভাবেই গঠিত। পাখিদের দর্শন-শ্রবণ-ঘ্রাণের ইন্দ্রিয় উন্নত ও শক্তিশালী বলেই মস্তিষ্কে তাদের পাঠানো বার্তা গ্রহণ করবার ব্যবস্থাও তৈরি হয়েছে। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। আবার নিম্নতর স্তন্যপায়ী প্রাণীর ঘ্রাণের ব্যবস্থা বেশি উন্নত, দর্শনানুভূতির ক্ষমতা আপেক্ষিক অর্থে দুর্বল। কিন্তু উন্নততর স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে শ্রবণ ও দর্শন অনুভূতি গ্রহণের ক্ষমতা বেড়েছে ও ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে, আর ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের ভূমিকা খর্ব হয়ে গেছে। মস্তিষ্কের গঠনের মধ্যেও এর ছাপ পড়েছে। পাখি ও স্তন্যপায়ীদের শ্রবণ ও দর্শনের জন্য অগ্রমস্তিষ্কে বিশেষ জায়গা নির্দিষ্ট হয়েছে।
বিপরীতক্রমে, যত নিম্নতর প্রাণী, তার দেহাঙ্গগুলি বা গোটা শরীর সঞ্চালনের প্রয়োজন তত বেশি। কেন না, তা অধিকাংশ সময় লক্ষ্যহীন, এলোমেলো, অনির্দিষ্ট এবং তার ফলে অসফল। সুতরাং তাদের মস্তিষ্কের সঞ্চালক অঞ্চল তুলনায় বড়। কিন্তু বিবর্তনের পথে প্রাণী যত উন্নত হয়েছে, ততই তার চলাফেরা বা অঙ্গচালনা সুনির্দিষ্ট, সুনিয়ন্ত্রিত ও উদ্দেশ্যপূর্ণ হতে থাকে। সাফল্যের অনুপাতও বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কের সঞ্চালনকেন্দ্র আকারে ছোট হয়ে জটিল ও বিশেষায়িত অঙ্গসঞ্চালনের দক্ষতা অর্জন করতে থাকে। কিংবা অন্যভাবে বলা যায়, মস্তিষ্কের এই বিকাশের ফলেই তাদের সঞ্চালন দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
এছাড়া, বিবর্তনের গতিপথে মস্তিষ্কের আরও একটা লক্ষণীয় বিকাশ ঘটেছে। নিম্নতর মেরুদণ্ডী প্রাণীগুলির মস্তিষ্কের প্রায় যাবতীয় এলাকা সংবেদক ও সঞ্চালক অঞ্চলে বিভক্ত। এমনকি পাখিদের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু স্তন্যপায়ী পর্যায়ের, বিশেষ করে, উন্নততর স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্কে রয়েছে অসংখ্য সংযোগ স্নায়ুকোষ (association nerves)। মানুষের ক্ষেত্রে এদের সংখ্যা ও বিস্তৃতি সবচাইতে বেশি। এই সংযোগ স্নায়ুগুলির কাজ খুব নিবিড়ভাবে জানা না গেলেও বোঝা যায়, স্মৃতি সংরক্ষণ, প্রত্যক্ষণ, মানুষের বেলায় যুক্তি প্রয়োগ, কল্পনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে, অর্থাৎ, মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ উচ্চতর কার্যকলাপের ক্ষেত্রে এদের খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
[ক্রমশ]