শঙ্কর রায়
সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
আমরা ভারতে এক অস্বাভাবিক ও ভয়ার্ত সময়ের মধ্যে বাস করছি। যারা আজ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন, তারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের যা সবচেয়ে বড় অর্জন তাকেই ধ্বংস করতে মতাদর্শগতভাবে দায়বদ্ধ। যে অর্জনের কথা বলছি তা হল সংসদীয় গণতন্ত্র, যা ভারতবর্ষের অস্তিত্ব ও বিকাশের অন্যতম প্রধান শর্ত। অথচ এই ধ্বংসকাণ্ডের উপসর্গগুলি বর্তমানে প্রায়শই বিভীষিকার মত ফুটে উঠছে।
গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ১৮২-র মধ্যে ১৫৬ আসনে জয়ী হওয়া এমনই এক উপসর্গের উদগীরণ। রাজ্য-রাজনীতির আদলটা একেবারে উলটে গেল বিজেপির আসনসংখ্যা ২০১৭ থেকে ২০২২-এ ৯৯ থেকে বেড়ে ১৮২ হওয়ায় ও কংগ্রেসের আসন ৭৭ থেকে কমে ১৭-য় নেমে আসায়। অথচ গুজরাটে পুরসভা ও পঞ্চায়েত নির্বাচনগুলিতে বিজেপির আসনসংখ্যা অনেক কম ছিল। দলিত ও আদিবাসী অঞ্চলে কংগ্রেসের একাধিপত্যের ধারা হঠাৎ কী করে পালটে যায়। এটাই তো অস্বাভাবিকতার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত, যা আরও প্রকট হল মোরবি জেলার বিধানসভাগুলিতে বিজেপির বিপুল জয়ে। বিধানসভা নির্বাচনের মাসখানেক আগে ৩০ অক্টোবর মোরবি শহরে মচ্ছু নদীর উপর জুল্টো পুল ঝুলন্ত সেতু ভেঙে পড়ে অন্তত ১৪০ জন (যাদের অধিকাংশ মহিলা ও শিশু) প্রাণ হারায়। এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী মোরবি পুরসভা, যা বিজেপির দখলে। ব্রিটিশ আমলে গড়া সেতুটি জীর্ণ হয়ে পড়েছিল। মোরবি পুরসভা তার রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতির ভার দিয়েছিল অরেভা গোষ্ঠীর অজন্তা ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিকে যারা ঘড়ি তৈরি করে, যাদের একাজে কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। কোন যোগ্যতা দেখিয়ে তারা এই কাজের বরাত পেল, তাই এক গুরুতর প্রশ্ন। বিজেপি যে আকণ্ঠ দুর্নীতিদুষ্ট ও স্বজনপোষণে রপ্ত একটি দল, এক ঘড়ির কোম্পানিকে সেতু মেরামতের কাজের বরাত দেওয়া তারই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। অথচ মোরবি যে বিধানসভার অন্তর্ভুক্ত সেখানকার বিজেপি প্রার্থী কান্তিলাল আম্রুতিয়া কংগ্রেস প্রার্থী ও একাধিকবার উপর্যুপরি নির্বাচিত জয়ন্তীলাল প্যাটেলকে ৬০ হাজার বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাস্ত করেন। ওই জেলার তিনটি বিধানসভাতেই এবার বিজেপি জিতেছে। যদিও ওই তিনটে আসনেই ২০১৭ সালে ভাল ভোটের ব্যবধানে জিতেছিল কংগ্রেস।
তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে ঘড়ি উৎপাদনকারী অজন্তা ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিকে বরাত দেওয়ায় খুশি হয়ে মোরবি-র মানুষ দল বেঁধে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে? সহনাগরিক শতাধিক মানুষের বেঘোরে প্রাণ হারানোর ঘটনায় ভোটারদের বিবেক দংশন ঘটেনি, এটা মেনে নিতে হবে?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি ও তাঁর বশংবদ বিজেপি নেতারা এবং পোঁ-ধরা ‘গোদি মিডিয়া’ বলছেন যে মানুষ বিজেপি প্রার্থীকে জিতিয়েছে, কারণ তিনি মচ্ছু নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বহু মানুষকে বাঁচিয়েছেন— যেন তাঁর জন্যেই কয়েক শত মানুষ বেঁচে গিরেছেন। কি হাস্যকর ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যুক্তিহীন প্রচার! মোরবির নির্বাচকেরা যেন মোরবি ট্র্যাজেডি সত্ত্বেও এক সাঁতারুর অ্যাক্রোব্যাটিক্সে মোহিত হয়ে সঙ্ঘ পরিবারের প্রতি আবেগে উল্লসিত হয়ে দলে দলে গিয়ে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে পদ্ম প্রতীকের বোতাম টিপে বিজেপি প্রার্থীদের জিতিয়েছেন! এটাই কি মোদি ঝড়?
এতই যদি মোদি-মুগ্ধ হয়ে থাকেন গুজরাটের মানুষেরা, তাহলে আগেরবারের (২০১৭) থেকে ভোটের শতাংশ কমে ৬৪ হল কেন। মোট ভোটারদের ৬৪ শতাংশের ৫২ শতাংশ যদি বিজেপিকে ভোট দিয়ে থাকেন, তাহলে তো রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার কার্যত বিজেপিকে বয়কট করেছে।
গুজরাটে পোস্টাল ব্যালটের ৪০ শতাংশও বিজেপি প্রার্থীরা পাননি। বরং কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টি মিলে ৫৪ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। এই ভোট ইভিএমে বোতাম টিপে হয় না। এই ভোটারেরা ভোটের কাজে নিয়োজিত রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারে কর্মরত কর্মচারী ও আধিকারিক এবং পুলিশ ও সামরিক বাহিনিতে কর্মরত, এবং তার সাথে রাজ্যের প্রতিবন্ধী ভোটাররা। সেই ভোটগুলো ইভিএম ও ভিভিপ্যাট মারফত কারচুপি করা যায় না। পোস্টাল ব্যালটে প্রতিফলিত হয় প্রকৃত ভোটের রায়। কাজেই ভোটযন্ত্রে কারচুপি হয়নি, এটা বলা যায় না। গত বছর বিহারে বিধানসভা ভোটের পরে আইআইটির এক অধ্যাপক ও কমপিউটার সায়েন্সের এক বিভাগীয় প্রধান আমাকে জানিয়েছিলেন যে এই ভোটে ইভিএম-ভিভিপ্যাটের কারসাজি হয়নি, তা ধরে নেওয়া যায় না। ‘Certainly it can be manipulated in a very opaque manner, by bugging the firmware of the machines and it can evade the test runs. If the VVPATs are checked by the voter and All VVPATs are counted then it is as good as ballot paper voting.’ বলা বাহুল্য, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের যোগসাজস ছাড়া এটা হতে পারে না, যা ২০১৯-এ স্পষ্টতই হয়েছিল। সেবার ২৬টি আসনেই জিতেছিল বিজেপি ও ওই রাজ্যে ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, যা মোটেই স্বাভাবিক ছিল না। তাই তৎকালীন কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনারের কাজে খুশি হয়ে পরবর্তীকালে তাঁকে রাজ্যপালের পদে বসিয়ে পুরস্কৃত করেছিল বিজেপি সরকার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যায়তন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থশাস্ত্রের এমারিটাস প্রোফেসর ডঃ প্রণব বর্ধন সম্প্রতি ফেডারেশন সোসাইটি-আহুত ‘সেন্টার স্টেট রিলেশন্স অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ফেডারেলিজম’ নিয়ে প্রদত্ত ভাষণে বলেন “The Prime Minister and his associates talk about cooperative federalism, but it’s a fraud. Our country is heading towards autocracy.”
এসব সত্ত্বেও বিরোধীদের সামগ্রিকভাবে হতাশ হওয়ার কারণ নেই। এক, হিমাচল প্রদেশে এবার বিধানসভা ভোট শুধু কংগ্রেস ৬৮ আসনের মধ্যে ৪০টি আসনে জেতেইনি, ২৬টি আসনে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে, যেখানে বিজেপি ১০টি আসনে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি শতাংশ ভোট পেয়েছেন বিজেপি-র বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম ঠাকুর— ৭৫ শতাংশেরও বেশি। মোদিজি বলেছেন কংগ্রেসে মোট ভোটের শতাংশ হিসেবে ১ শতাংশেরও কম ব্যবধানে এগিয়ে। কিন্তু এই কথা বলে কংগ্রেসের (যেমন রাহুল গান্ধির পদযাত্রা, ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেলা ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধি ভডরা-র সফল যৌথ উদ্যোগে কংগ্রেসের এককাট্টা হওয়া) সাফল্যকে ছোট করা যায় না। একথা ঠিক, বিক্ষুব্ধ বিজেপি প্রার্থী কোনও কোনও আসনে সঙ্ঘ পরিবারকে পর্যুদস্ত করেছে। কিন্তু তাতে বড়জোর পাঁচটা আসন বাড়ত। তবে হয়ত হিমাচলে ইভিএম-ভিভিপ্যাটের খেলা হয়নি যতটা গুজরাটে হয়ে থাকতে পারে (সম্ভবত হয়েছেই, নাহলে গুজরাটে এত আসনে জেতা অসম্ভব)।
আপ মহানেতা ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছিলেন এবার গুজরাটে তাঁর দল জিততে চলেছে এবং তিনি মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন তাঁর নামও ঘোষণাও করেছিলেন। কিন্তু আপ মাত্র পাঁচটি আসনে জিতেছে ও ১২৩ জন আপ প্রার্থী জামানত খুইয়েছেন। কাজেই কেজরিওয়াল এখন মৌনীবাবা। কিন্তু আপ-এর কৃতিত্ব দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ভোটে ২৫০টি আসনের মধ্যে ১৩৪টিতে জয়লাভ ও বিজেপির ১৫ বছরের একটানা (অপ)শাসনের অবসান। তবে কেজরিওয়ালকে আত্মসমালোচনা করতে হবে। তাঁর পাল্টা হিন্দুয়ানি (যাকে বিকল্প হিন্দুত্ব বলা অনুচিত, কারণ তিনি হিন্দুরাষ্ট্রের কথা বলেননি এখনও) চপেটাঘাত খেয়েছে গুজরাটের ভোটে। মানুষ তাঁর রাজনৈতিক হিন্দুয়ানির মুখে পদাঘাত করেছে। কেজরিওয়ালকে বিরোধী জোটের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে হবে। অবস্থান ও স্লোগান পাল্টাতে হবে।
ভারতের মানুষ এখন এক অস্বাভাবিক রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে আছে, কারণ মোদিজি ও তাঁর প্রধান সাকরেদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতকে যেনতেনপ্রকারেণ হিন্দুরাষ্ট্র করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সংসদে ‘ব্রুট মেজরিটি’র লাগামহীন ও নগ্ন প্রয়োগ করে ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব কায়েম করার এক নিলাজ ও লাগাতার প্রয়াস চলছে।
এই অস্বাভাবিক অবস্থার অবসানকল্পে সঙ্ঘ পরিবারের ফ্যাসিবাদী ষড়যন্ত্রের বিরূদ্ধে এককাট্টা হবার সময় হয়েছে। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানে বিধানসভা নির্বাচন ২০২৩-এ। তারপরে ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচন। এখন জোট বেঁধে তৈরি হওয়ার সময়। আওয়াজ তুলতে হবে, ইভিএম-ভিভিপ্যাটের পরিবর্তে আবার ব্যালট পেপারে ভোটের দাবিতে, যা দুনিয়ার অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশেই জনাদেশ নির্ধারণের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে আজও কায়েম রয়েছে।
মোদি-শাহ চক্র ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে ২০২২ গুজরাট মডেল অর্থাৎ এবারের গুজরাট বিধানসভায় গৃহীত রণকৌশল অবলম্বন করতে পারে এমনকি আরও আগ্রাসী রণকৌশল অবলম্বন করতে পারে। এই অনুমানের ভিত্তিতেই নিজেদের সংগঠিত করে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের সুপরিকল্পিত গণতন্ত্রনিধনের প্রচ্ছন্ন নাশকতার মোকাবিলা করতে হবে বিরোধীদের। একটা জরুরি কথা সাফ সাফ বুঝে নিতে হবে। আরএসএস-বিজেপির লক্ষ্য ভোটারের মন জয় করা নয়, ইভিএম-এ বেশি ভোট নথিবদ্ধ করে যেনতেন প্রকারে জয় সুনিশ্চিত করা, যার জন্যে জনগণের দরবারে ভোট চাওয়া/ভিক্ষা অত্যাবশ্যক নয়।
https://www.econ.berkeley.edu/profile/pranab-bardhan
Very cogent analysis of recent voting pattern and reliability on EVM is undoubtedly questionable