প্রবুদ্ধ ঘোষ
ভারতীয় গণতন্ত্র নিশ্চয়ই এত ঠুনকো নয় যে, হিন্দুত্ববাদী শাসকের যথেচ্ছাচারে তা চুরমার হয়ে যাবে। ভারতীয় সংবিধানের পাতা এত পাতলা নয় যে ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্র তা সহজেই ছিঁড়ে ফেলবে বা বদলে দেবে। প্রত্যেক যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন, প্রগতিশীল, ন্যায়-পক্ষপাতী নাগরিকের কর্তব্য রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে সরব হওয়া। প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে রচিত রাষ্ট্রীয় ষড়জাল ছিঁড়ে ফেলা।
এই নিবন্ধটি লেখার সময় অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনার উল্লেখ করি। সেই ইস্কুলবয়সে উপপাদ্য প্রমাণের ধরতাই— ‘আমরা জানি’…
ঘটনা এক। একটি বিশেষ সাহিত্যকল্পনাকে-ইতিহাস-প্রমাণ-করার চলচ্চিত্র থিয়েটারে মুক্তি পাওয়ার পরে অঘোষিত নিয়ম জারি হয়েছে— হনুমানের জন্য থিয়েটারের একটি আসন সংরক্ষিত থাকবে। সেই সিটে হনুমানের ছবি রাখা হচ্ছে, তাতে ফুল-মালা। ‘রামায়ণ’-এর আধারে নির্মিত চলচ্চিত্র বলে হনুমানের জন্য আসন সংরক্ষণের উন্মাদপ্রায় আচরণ। দেশ এমন বুদ্ধিহীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলেছে। আদালত থেকে প্রশাসন প্রত্যেকেই আশ্চর্য নীরব। ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’ তথা অতি-অতি প্রচারে মিথ্যাকে সত্য প্রমাণ করতে, কাল্পনিক সাহিত্যচরিত্রকে বাস্তবেতিহাসের চরিত্র প্রমাণ করতে এবং অতিধর্মীয় রক্ষণশীল বিশ্বাসের কাছে যুক্তি-বুদ্ধি সমর্পণ করতে শাসক-মতাদর্শ প্রবল সক্রিয়।
ঘটনা দুই। উমর খালিদের ছবি পশ্চাদপটে ভেসে উঠেছে, কয়েক সেকেন্ডের জন্য। গায়ক রূপম ইসলাম গাইতে গাইতে মুষ্টিবদ্ধ হাত দেখিয়েছেন, কিছু কথা বলেছেন। তাতেই হা রে রে রে রবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আন্তর্জালবাসী। গায়ককে দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসবাদের সমর্থক ইত্যাদি দাগিয়ে চিৎকার করে জনসমক্ষে ঘৃণা (public shaming) প্রদর্শন শুরু করেছে। অথচ, রূপম সেদিন এটুকুই বলেছিলেন যে, বিচারব্যবস্থার প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে তিনি শুধু ন্যায়বিচারের দাবি করছেন। “উমর খালিদ এবং তাঁর মতো যাঁরা আছেন, তাঁদের বিচার চাই”— এই স্বরে জড়তা ছিল না কোনও। ভারতের একজন নাগরিক অপর এক ভারতীয় নাগরিকের ন্যায়বিচার প্রার্থনা করছেন— গণতন্ত্রে এটাই কি স্বাভাবিক নয়? না! অধুনা ভারতরাষ্ট্রে গায়ক রূপমের পদবি বিচার্য, উমরের ধর্মপরিচয় বিচার্য এবং ধর্মীয় সংখ্যাগুরু নেটিজেনের ধর্ম-অহং আধিপত্যকারী।
ঘটনা তিন। ভারতীয় কুস্তি সংস্থার সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিং মহিলা কুস্তিগিরকে যৌন হেনস্থার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। তিনি বিজেপির সাংসদও। কিন্তু, তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার চার্জশিট দাখিল করে ন্যূনতম তদন্তটুকু শুরু করতে দিল্লি পুলিশের প্রায় এক মাস সময় লেগে গেছে। ব্রিজভূষণের সমর্থনে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সদস্যরা অযোধ্যায় মিছিল আয়োজন করেছে। দেশের পদকজয়ী কুস্তিগিররা তাঁকে গ্রেপ্তারের দাবিতে ধরনায় বসেছেন, পুলিশের নির্যাতন সয়েছেন এবং হিন্দুত্ববাদী ব্রিজভূষণের জন্য আন্তর্জাতিক ক্রীড়াজগতে ভারতের মাথা হেঁট হয়ে গেছে। নাছোড়বান্দা কুস্তিগিরদের দাবির সামনে নতি স্বীকার করে দিল্লি পুলিশ যদিও বা চার্জশিট দাখিল করেছে, সেই চার্জশিটে পকসো ধারার উল্লেখ নেই। অভিযোগকারিণী এবং অন্যান্য নির্যাতিত কুস্তিগিরদের উপর্যুপরি দাবি সত্ত্বেও পকসো আইনে ব্রিজভূষণকে অভিযুক্ত করতে দিল্লি পুলিশের টালবাহানা চলছে।
দেশের অর্থনীতিতেও টালমাটাল পরিস্থিতি বিদ্যমান। নাগরিক হত্যার বহু বন্দোবস্ত সাজিয়ে রেখেছে রাষ্ট্র। উপরোক্ত ঘটনাবলি দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৈন্য প্রকট করে। এমন আশ্চর্য আঁধারে ভরা পশ্চাৎমুখী সময়ে উমর খালিদ জেলে বন্দি থাকবেন, এ আর আশ্চর্য কী! প্রায় বিনা বিচারে হাজার দিনের বেশি জামিন না-পেয়ে তিনি জেলে আটকে। যুক্তি-মেধা-মানবিকতা-স্পষ্টবক্তব্যের অনুশীলনকারী আলোকোজ্জ্বল সত্তারা ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় জেলে আটকে। গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান শর্ত বিরুদ্ধতার স্বাধীনতা, শাসকের শর্তাবলি না-মানার স্বাধীনতা, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের স্বাধীনতা। আজ এই দেশে এগুলিই বিপন্ন।
২০২০ সালের ২৪-২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লি গণহত্যায় (pogrom) (সরকারি মতে, দাঙ্গা) উমর খালিদের উস্কানিমূলক ভূমিকা এবং প্রত্যক্ষ ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছে দিল্লি পুলিশ। দিল্লি পুলিশ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের প্রত্যক্ষ নির্দেশাধীন। গোদি মিডিয়া এবং পুলিশি প্রচার চলতে থাকে- উমর খালিদ নাকি সংখ্যাগুরু হিন্দুদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ভাষণ দিয়েছিলেন এবং দাঙ্গা-অগ্নিকাণ্ড-ভাংচুর ইত্যাদি অপকর্মে সরাসরি ‘সন্ত্রাসী সংখ্যালঘু’দের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০২০ সালের অগাস্টে গ্রেপ্তার হন উমর। কিন্তু, দিল্লি গণহত্যা প্রসঙ্গে কয়েকটি তথ্য ও বিষয় কমবেশি সকল নাগরিকই জানেন।
(১) সিএএ-এনআরসি বিরোধী নাগরিক আন্দোলন দিল্লিতে সেই সময় তুঙ্গে ছিল। ২০১৯-র ডিসেম্বরের মাঝামাঝি শুরু হওয়া ওই আন্দোলন ভারতব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্রদ্রোহী, মুসলিমরা সন্ত্রাসী দেশদ্রোহী ইত্যাদি প্রমাণ করতে আরএসএস-বিজেপি তৎপর ছিল। উল্টোদিকে ভারতের পতাকা এবং সংবিধান আন্দোলনকারীরা কবচের মতো জড়িয়ে ছিলেন। দিল্লিতে ঘটা সাম্প্রদায়িক তুলকালাম ওই আন্দোলনকে বিষিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত ছিল।
(২) ২০২০-র ৮ই ফেব্রুয়ারি বিজেপিকে হারিয়ে দিল্লির ক্ষমতা পেয়েছিল আম আদমি পার্টি। ভোটে জেতার দিনেই অরবিন্দ কেজরিওয়াল হনুমান মন্দিরে পুজো দিতে গেলেন, অন্যদিকে ততক্ষণে আরএসএস প্রতিবাদী জনগণের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে দিল্লির প্রকাশ্য সভায় প্রতিবাদী আন্দলনকারীদের বিরুদ্ধে “দেশদ্রোহীদের গুলি করে মারো” স্লোগান দেন মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর। ২৩শে ফেব্রুয়ারি বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র মৌজপুর চকে এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরাসরি উস্কানিমূলক ভাষণ দেন। আন্দোলনকারীদের গুলি করে মারার নিদান দেন। আন্দোলনরত মুসলিম নারীদের উদ্দেশ্যে অবমাননাকর বক্তব্য রাখেন।[i] গণহত্যায় প্ররোচনা দানের পরেই হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতীরা প্রতিবাদীদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
(৩) কারা কোন উদ্দেশ্যে ভজনপুরার পেট্রোলপাম্প, গোরখপুরির বাজারে আগুন লাগিয়েছিল এবং সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের দিকে পাথর-গুলি ছুঁড়েছিল, তা তদন্তরিপোর্ট থেকে জানা যায়। মানবাধিকার রক্ষা সংস্থার হাই কমিশনারের তদন্ত রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃতি থাক, “large mobs of mostly young men chanting Hindu slogans started confronting the gathered protesters and subsequently stones were thrown from both sides. The mob also vandalized shops and homes. The Hindu mob – identifiable as such because of Hindu symbols and flags as well as its slogans kept growing. People were called in from other areas. They made provocative speeches, claiming themselves as victims and the Muslims as aggressors. Police did little to stop them – on the contrary, some policemen were seen to assist this crowd – throwing teargas shells in the same direction as the crowd pelted stones – that is to say towards the largely Muslim protesters”[ii]
(৪) শাসক দলের পক্ষ থেকে এবং গোদি মিডিয়ার পুনঃপুনঃপ্রচারে ‘দিল্লি দাঙ্গা’-কে সিএএ বিরোধী মুসলিমদের দ্বারা সংঘটিত ‘হিন্দুবিরোধী জেহাদ’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হয়। আরএসএসপন্থী বুদ্ধিজীবীরা একে ‘আর্বান নক্সাল-জেহাদি নেটওয়ার্ক’ বলে দাগিয়ে দেয়। কিন্তু বিভিন্ন তথ্যানুসন্ধানী দল এই দাবিকে নস্যাৎ করে প্রকৃত তথ্য তুলে আনে। মুসলমান সম্প্রদায়ের বাড়ি ও দোকানের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। তাঁরাই সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় আহত। ৫২ জন মৃতের মধ্যে ৩৯ জন মুসলমান পরিচিতির।[iii] রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দিল্লিতে সংঘটিত বীভৎসতা যেভাবে প্রচার করা হয়েছে, মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন বা কতিপয় সত্যনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যম তার বিরুদ্ধ বয়ান হাজির করে।
উপরোক্ত তথ্য-তত্ত্ব এবং আরও অনেকগুলি সমধর্মী তথ্য-তত্ত্ব কমবেশি আমাদের সকলের জানা। তবু, উমর খালিদকে অভিযুক্ত হিসেবে জেলে ভরে দেওয়া হয়। আদালতে ট্রাঙ্কে করে হাজার পাতার চার্জশিট দাখিল করা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। ইউএপিএ তো দেওয়া হয়েইছিল, তার সঙ্গে প্রাণঘাতী অস্ত্র আইনের ধারা, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস, পুলিশের বিরুদ্ধে পাথর ছোঁড়া ইত্যাদি ধারা চাপিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর হোয়াটসঅ্যাপের কথোপকথনকেও রাষ্ট্রদ্রোহিতার প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়। উল্লেখ্য, এই ব্যাপারে সবচেয়ে সরব যে অর্ণব গোস্বামী, তাঁর হোয়াটসঅ্যাপের কথোপকথন ফাঁস হতে জানা যায় যে, পুলওয়ামায় জওয়ানদের ওপরে হামলার পরে তিনি উল্লাস প্রকাশ করেছিলেন। বালাকোটে সার্জিকাল স্ট্রাইকের নকশা ও খবর তাঁর হোয়াটসঅ্যাপের কথোপকথনে প্রকাশ হয়েছে ঘটনার আগেই।[iv] অথচ তাঁর সাজা হওয়া দূরে থাক, শাসকের সঙ্গে যোগসাজশে তিনি সমাজের অন্যতম ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে উমর খালিদ রাষ্ট্রদ্রোহিতার একাধিক ধারায় বিচারাধীন রয়ে গেলেন; তদুপরি গোদি মিডিয়ার প্রচারে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত হয়েও গেলেন। ২০২১ সালের ১৫ই এপ্রিল উমর খালিদ পুলিশের দিকে পাথর ছোঁড়ার অভিযোগ থেকে জামিন পেয়েছিলেন। বিচারক বলেছিলেন, “cannot be permitted to remain behind bars on the basis of sketchy material against him”[v] উমরের সঙ্গে একই মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন খালিদ সাইফি। তাঁর বিরুদ্ধেও পোক্ত প্রমাণ পেশ করতে পারেনি দিল্লি পুলিশ; উপরন্তু তাঁকে পুলিশি হেফাজতে বেধড়ক মারধরের অভিযোগ ওঠে। সাইফির জামিন মঞ্জুর করার সময় বিচারক দিল্লি পুলিশের তদন্তে বহু গলদ এবং প্রতিহিংসাপ্রবণ মনোভাব খুঁজে পেয়েছিলেন।[vi] ২০২১-র জুনে দিল্লি পুলিশের একটি আবেদন পত্রপাঠ খারিজ করে দেন বিচারক। দিল্লি পুলিশ চেয়েছিল সাইফি ও উমরকে হাতকড়া পরিয়ে (যা ঘৃণ্য আসামীদের সঙ্গে করা হয়) আদালতে নিয়ে যেতে, কিন্তু বিচারক জানিয়ে দেন উমর ও সাইফি কোনও গ্যাংস্টার না।
অভিযোগের সত্যাসত্য প্রমাণের বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হতে অনেক বাকি। এর মধ্যে উমর বহুবার জামিনের আবেদন করেছেন। ২০২২-র ডিসেম্বরে বোনের বিয়েতে উপস্থিত থাকার জন্য এক সপ্তাহের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পেয়েছিলেন। বাকি সব বার উমরের জামিনের আবেদন বারবার খারিজ করেছেন বিচারকরা। ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্র’ করেছেন উমর, এই অভিযোগে রাষ্ট্র তাঁর জামিন না-মঞ্জুর করছে। ২০২২-র অক্টোবরে তাঁর আবেদন খারিজের সময় বিচারকদের পর্যবেক্ষণ ছিল যে, “খালিদের সঙ্গে অন্য সহ-অভিযুক্তদের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ছিল। সহ-অভিযুক্তদের মধ্যে শারজিল ইমাম বিতর্কযোগ্য (arguably) বয়ানে ষড়যন্ত্রের অন্যতম মাথা।” গোদি মিডিয়ার একাংশ প্রচার করতে শুরু করে যে, ২০২০ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি উমর জাকিরনগরে শারজিল ইমামের সঙ্গে দেখা করে হিন্দুবিরোধী দাঙ্গার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। উমর জেল থেকে লেখা এক চিঠিতে জানাচ্ছেন যে, “In reality, on the night of February 16, 2020 – and even the police would attest to this– I was 1136 kms away from Delhi, in Amrawati, Maharastra. And Sharjeel Imam on that night– nobody can dispute this either- was in Tihar jail, as he had been arrested about 20 days earlier in a different case.”[vii] প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি পেশ হয়নি এখনও, তবু ‘বিতর্কযোগ্য বয়ান’-কেই প্রাধান্য দেওয়া হল। উমর খালিদ সিএএ-এনআরসি বিরোধী সভার ভাষণে দুটি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন- ‘ইনকিলাবি সালাম’ এবং ‘ক্রান্তিকারী ইস্তিকবাল’। ইনকিলাব এবং ক্রান্তির মতো শব্দে রাষ্ট্র আক্ষরিক অর্থে দ্রোহের ভূত দেখছে! দৈনন্দিনে বহু ব্যবহৃত ওই শব্দদ্বয়ের ব্যাখ্যা করে বিচারকরা বলেছেন, “বিপ্লব শব্দটি সবসময় যে রক্তপাতহীন হবে, তা না। বিপ্লবের আগে ‘রক্তপাতহীন’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া প্রয়োজনীয়। শুধু বিপ্লব/ক্রান্তি/ইনকিলাব শব্দটি রক্তপাতহীন অনুষঙ্গে উচ্চারিত হবে, তা জরুরি না”[viii]– অতএব উমর খালিদের ভাষণে রাষ্ট্র সাঙ্ঘাতিক দ্রোহের ‘পরিকল্পনা’ খুঁজে পেল। রাষ্ট্রের কোনও আচরণের বিরুদ্ধে ন্যায্য প্রতিবাদ করলে বা জনমত সংগ্রহ করলে, রাষ্ট্র যদি তাতে বিপন্ন বোধ করে, তাহলেই ইউএপিএ চাপিয়ে দেয়। ইউএপিএ এমন এক কালা কানুন, যা প্রয়োগ করে অসাংবিধানিক অমানবিক উপায়ে বিনা চার্জশিটে কাউকে কমপক্ষে ৬ মাস জেলবন্দি রাখা যায়। এই আইনে নেহাৎ সন্দেহের বশে তথা কোনও ব্যক্তি বেআইনি কাজ করতে পারে এমনটা ভেবে নিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পচানো যায়। এই মুহূর্তে ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক ইউএপিএ-আফস্পার মতো আইন। আর, ভারতীয় গণতন্ত্রের কাছে সবচেয়ে আতঙ্কের এমন শাসক যারা এই আইনগুলির যথেচ্ছ প্রয়োগে প্রশাসনকে ব্যবহার করে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদীদের জেলবন্দি রাখে।
উমর খালিদ নিজের ভারতীয়ত্বের প্রমাণ, নিরপরাধ হওয়ার প্রমাণ বারবার বিভিন্ন ভাষণে দিয়েছেন। একুশ শতকে অত্যাধুনিক সমাজনীতির যুগে সন্ত্রস্ত একজনকে নিজের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হচ্ছে, এটা দেশের পক্ষে ভাল বিজ্ঞাপন নয়। বহু ভিডিও, বহু সাক্ষাৎকার এবং লেখাপত্তর আন্তর্জালে ছড়িয়ে রয়েছে যেখানে উমর ব্যথিত হৃদয়ে শাসকের অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিগুলিকে প্রশ্ন করছে। ২০১৬ সালে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উমর খালিদ, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, কানহাইয়া কুমারদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ‘ভারতবিরোধী ভাষণ’-এর অজুহাতে। সামাজিক পরিসরে হিন্দুত্ববাদী শক্তির মদতে এবং গোদি মিডিয়ার প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় উমরকে হেনস্থা হতে হয়েছে বারংবার। তার জীবন সংশয় হয়েছে। ইউটিউবের এক মর্মস্পর্শী ভিডিওতে উমর খালিদ নাগরিক পরিসরে একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, “আমি কি ভাল ভারতীয় নই?”[ix] পাঠক যদি ভিডিওটি অনুগ্রহ করে দেখেন, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি অনুভব করবেন যে, উমর ব্যাথিত, হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের দ্বারা সন্ত্রস্ত কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শের দৃঢ়তা থেকে সরে আসেননি। গণতন্ত্রকে বাঁচাতে চেয়েই প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ভাবনার রসদ দিয়েছিলেন দর্শককে। আর, সেটাই তিনি দিয়ে আসছিলেন। তাই তাঁকে এত ভয় রাষ্ট্রের। ২০২০ সালে সিএএ-এনআরসি বিরোধী সভায় যে বক্তব্য তিনি রেখেছিলেন, তার কিয়দংশ এরকম, “আমরা হিংসার জবাব হিংসা দিয়ে দেব না। আমরা ঘৃণার বদলে ঘৃণা ছড়াব না। ওরা যদি ঘৃণা ছড়ায়, তাহলে আমরা ভালবাসার কথা বলব। ওরা যদি আমাদের ওপরে লাঠি চালায়, আমরা তাহলে ত্রিবর্ণ পতাকা আরও আঁকড়ে ধরব। ওরা যদি আমাদের গুলি করে, আমরা তাহলে ভারতের সংবিধান বুকে জড়িয়ে ধরব। যদি ওরা আমাদের জেলে ভরে, তাহলে আমরা সবাই জেলে যেতে যেতেই ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা, হিন্দুস্তাঁ হামারা’ গাইব।”[x] ভারত রাষ্ট্রের বর্তমান ভাগ্যবিধাতাদের এটুকু লজ্জা পাওয়া উচিত যে, একজন ভারতীয়ের এই প্রকাশ্য বক্তব্যের জন্য তাকে সন্ত্রাসী, ষড়যন্ত্রকারী দেগে দেওয়া হয়েছে। শাসকের প্রতিহিংসামূলক মনোবৃত্তির জন্য ‘সন্দেহের বশে’ একজন নাগরিককে হাজার দিনেরও বেশি জেলে আটকে রাখা হয়েছে।
উমর খালিদ গত বছর সেপ্টেম্বরে জেল থেকে চিঠি রোহিত কুমারকে চিঠি লিখেছিলেন। উমর খালিদ সহ্যশক্তি আর ধৈর্যের অপর নাম হয়ে উঠেছেন। যিনি গোদি মিডিয়া, হিন্দুত্ববাদী শক্তি, সংশয়বাদী লিবেরাল, পুলিশ, রাষ্ট্রনেতা সকলের ছড়িয়ে রাখা অপ্রমাণিত অভিযোগের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে লড়ে যাচ্ছেন ন্যায়বিচারের জন্য। তবু, ইস্পাতসম সহ্যশক্তি কখনও কখনও হাজার দিনের একাকীত্বে যন্ত্রণাদিগ্ধ হয়। জেলের বাইরের সুখী, উৎসবমুখর দুনিয়ায় একবার পা রাখার জন্য হৃদয় ছটফট করে। নিজের সংখ্যালঘু পরিচিতি, অনমনীয় দ্রোহীসত্তা এবং প্রশ্ন করার প্রতিস্পর্ধার জন্যই বোধহয় জীবন থেকে বছরের পর বছর মুছে যাচ্ছে, এমন বোধ হয়। “How do we fight against this monstrous machine of lies and falsehood? The purveyors of hate and falsehood have so many resources – money, pliant 24×7 news channels, lots of them, troll armies, and the police too. To be honest, Rohit, it makes me feel pessimistic at times. At times I also feel lonely. Lots of people far more privileged than me who were together in this fight against fascism, in the movement against CAA-NRC/NPR, today choose to remain silent when I am singled out for these lies. It makes you feel unwanted. It makes you feel a stranger in your own land.”[xi] এই নিঃসঙ্গতা আর কারাযন্ত্রণা ভারতের গণতন্ত্রের অসহায়তা আর অসুখকে চিহ্নিত করে। তবু উমর চিঠি শেষ করেন আশাবাদী হয়েই। বিষাদবিধুর একাকীত্বের ভেতর প্রাণশক্তির উচ্ছলতা খুঁজে পেতে চান। ভারতীয় সাংবিধানিক পরিসর তাঁকে ন্যায়বিচার দেবে- এই ভরসায় অপেক্ষা করেন।
রাজনৈতিক বন্দি কমিউনিস্ট অনুপ রায় প্রায় ৩৫০০ দিন জেলে বন্দি হয়ে আছেন। দশ বছর। তাঁর জামিন মঞ্জুর হয়ে গেলেও এবং তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের আনা একটি অভিযোগও প্রমাণ না হলেও, তিনি এখনও জেলে বন্দি। কারণটাও খুবই অদ্ভুত। অদ্ভুত দু’টি কারণে। (১) তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি (জমি, বাড়ি) আদালতে বন্ধক রাখতে পারছেন না, কারণ তাঁর ব্যক্তিগত বাড়ি বা জমির মালিকানা নেই।[xii] একজন কমিউনিস্ট এদেশের বৃহত্তম প্রান্তিক শোষিত জনগণের প্রতিনিধি। তাই ব্যক্তিগত সম্পত্তি জামিনে বন্ধক রেখে জেল থেকে মুক্তি পাওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব। (২) রাষ্ট্র একজন কমিউনিস্টের প্রতি তথা রাষ্ট্রীয় মতাদর্শের প্রতিস্পর্ধীর প্রতি কতটা প্রতিহিংসামূলক হলে তবে এমন শর্ত আরোপ করতে পারে?! বিচারক এবং আইনকাঠামো রাষ্ট্রের মতাদর্শগত দমনযন্ত্রের অংশ, সেজন্যই এমন রায়? অথচ আইনব্যবস্থার মানবিক হওয়ার কথা ছিল, শোষিত নিরপরাধের ন্যায়ের পক্ষে থাকার কথা ছিল।
২০১৮ সাল থেকে ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় ভারতের কবি, সমাজকর্মী, আইনজীবী, অধ্যাপকরা জেলে বন্দি। দলিত, আদিবাসী, নিপীড়িত জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রকে সওয়াল করার অপরাধে তাঁরা বন্দি। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাঁরা যে কী ষড় করছিলেন, তা চার-পাঁচ বছরেও শাসক প্রমাণ করতে পারেনি। কিন্তু, তাঁরা মুক্তিও পাননি। ক্ষমতাবান শাসকের হাতে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সবকটি উপাদানের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তা সত্ত্বেও তারা সোমা সেন, সাইবাবা, হ্যানি বাবু, ভারভারা রাও, গৌতম নাভালখা, রোনা উইলসনদের বিরুদ্ধে প্রমাণের কুটোটুকুও জোগাড় করতে পারেনি। রোনা উইলসনের কম্পিউটারে পাওয়া তথ্য পুলিশ চার্জশিটে পেশ করেছিল; অথচ, উদ্ঘাটিত সত্য অন্য প্রমাণ দিল। রোনা উইলসন এবং একাধিক অভিযুক্তের কম্পিউটারে আগে থেকেই (জুন, ২০১৬) ম্যালওয়ার ভরে দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের একপ্রকার ফাঁসানো হয়েছে, ভিত্তিহীন প্রমাণ সাজিয়ে।[xiii] তারপরও শাসক ও গোদিমিডিয়া বিভিন্ন অজুহাতে এঁদের জেলে আটকে রাখার পক্ষে সওয়াল করেছে।
ভারতীয় গণতন্ত্র নিশ্চয়ই এত ঠুনকো নয় যে, হিন্দুত্ববাদী শাসকের যথেচ্ছাচারে তা চুরমার হয়ে যাবে। ভারতীয় সংবিধানের পাতা এত পাতলা নয় যে ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্র তা সহজেই ছিঁড়ে ফেলবে বা বদলে দেবে। প্রত্যেক যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন, প্রগতিশীল, ন্যায়-পক্ষপাতী নাগরিকের কর্তব্য রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে সরব হওয়া। প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে রচিত রাষ্ট্রীয় ষড়জাল ছিঁড়ে ফেলা। তাহলেই দেশ রক্ষা পাবে। ভারতীয় গণতন্ত্রের অসহায়তা দূর হবে। অন্ধকার সময়েও এটুকু আশার আলো জ্বলে থাক।
তথ্যপঞ্জি:
[i] ২৫শে ফেব্রুয়ারি দিল্লি উচ্চ আদালতের বিচারক মুরলীধর শর্মা পুলিশকে ভর্ৎসনা করেন কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর, পরবেশ ভার্মাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের না করার জন্য। তার পরের দিনই তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয় অন্য আদালতে।https://www.theatlantic.com/ideas/archive/2020/02/what-happened-delhi-was-pogrom/607198/
[ii] https://www.ohchr.org/sites/default/files/Documents/Issues/Religion/Islamophobia-AntiMuslim/Civil%20Society%20or%20Individuals/RitumbraM2.pdf
[iii] https://thewire.in/communalism/delhi-riots-2020-a-critique-of-two-purported-fact-finding-reports
[iv] https://www.newsclick.in/What-Arnab-Goswami-WhatsApp-Leaks-Tell-About-State-Democracy
[v] Live law report
[vi] https://thewire.in/law/umar-khalid-saifi-acquitted-court-riots
[vii] https://thewire.in/rights/umar-khalid-on-his-two-years-in-jail-i-feel-pessimistic-at-times-and-also-lonely
[viii] https://twitter.com/LiveLawIndia/status/1582298945619120128?s=20
[ix] https://www.youtube.com/watch?v=tW0wf4ILFH4
[x] https://scroll.in/article/1037982/a-letter-to-lady-justice-umar-khalid-had-some-faith-in-your-blindfold-is-he-not-worth-defending
[xi] https://thewire.in/rights/umar-khalid-on-his-two-years-in-jail-i-feel-pessimistic-at-times-and-also-lonely
[xii] অভিষেক মুখার্জ্জীর ফেসবুক পোস্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য। https://www.facebook.com/permalink.php?story_fbid=pfbid0KnsNMLCodXnzMFu3uq7hN9ajgQa25rwgmtkV4JZZEDC5c9px2WTYGG2zCLU7cJ5Nl&id=100006593987007
[xiii] https://scroll.in/latest/986517/bhima-koregaon-key-evidence-against-accused-activists-was-planted-using-malware-says-report
*মতামত ব্যক্তিগত