প্রবুদ্ধ বাগচী
এটা উপেক্ষা করার বিষয় নয় যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন হচ্ছে। হচ্ছে, হয়েই চলেছে। আগেও হয়েছে খোদ হাসিনার আমলে। তারও আগে। আসলে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা গত সাত দশক ধরেই নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে থাকেন। ঠিক যেভাবে শ্রীলঙ্কায় থাকেন ভারতীয় তামিলরা। এ-দেশে থাকেন মুসলিমরা, কোনও কোনও রাজ্যে আইনের তোয়াক্কা না করেই যাদের ইচ্ছে করলেই পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়, গায়ে আগুন দিয়ে ভিডিও সম্প্রচার করা যায়। গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে অবশ্যই এই নিপীড়নের মাত্রা বেড়েছে এবং তা প্রচারের আলোয় এসেছে বেশি। কিন্তু যে অন্তর্বর্তী সরকার এখন ওই দেশে প্রত্যক্ষভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের উপদেষ্টা পরিষদে আছেন বিধানচন্দ্র রায়, প্রিয়ক ভট্টাচার্য যাঁরা নামপরিচয়ে সংখ্যালঘু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপি-র ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ধর্মপরিচয়ে সংখ্যালঘু। আবার মেঘমল্লার বসু সম্ভবত লিগের সমর্থক। বিষয়টা একেবারেই একমাত্রিক নয়
মূলধারার দেশীয় মিডিয়ার প্রতি বহুদিনই কোনও ভরসা নেই। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দিনের আলো দেখেছিল জাতীয়তাবাদের মাতৃদুগ্ধে, পরে সেবামূলক ভাবনা হয়ে রাষ্ট্রের ‘চার নম্বর’ প্রতিবাদী চোখের খেতাব পেয়েও আজ অনেকদিন হল তারা সব ‘বিগ বসেদের’ আস্থাশীল পাবলিক রিলেশন অফিসারের ভূমিকায় গ্যাঁট হয়ে বসে গেছে। আর, অ্যালগরিদম-নির্ভর সোশাল মিডিয়া মূলত লাইক ও শেয়ারের তথ্য বিশ্লেষণ করে সংবাদ বা মতামতকে বহুভোগ্যা করে তোলে। যেটুকু ভরসা, তা ওই বিকল্প সংবাদমাধ্যমে, চেষ্টা করলে তার কিছু নাগাল এখনও পাওয়া যায়। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের ডামাডোলে একটা ন্যারেটিভ নির্মাণ করার চেষ্টা হচ্ছে যে শেখ হাসিনাই ভাল ছিলেন, তার আমলেই নাকি ওপারের সংখ্যালঘুরা নিরাপদে ছিলেন— তাই তাঁকে সাদরে এ-দেশে ডেকে এনে তোয়াজ করার প্রয়াস চোখে লাগার মতো। সত্যিই কি তাই?
২০১৩-২০২১ সময়কালে প্রায় চার হাজার (প্রকৃত সংখ্যা ৩৬৭৯) জন সংখ্যালঘু নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হন। এই তথ্য দিচ্ছে বাংলাদেশের হিন্দু বৌদ্ধ ক্রিশ্চান সংখ্যালঘুদের সম্প্রীতি কমিটি। ২০২১-এর দুর্গাপুজোর সময় বাংলাদেশের সাতাশটি জেলায় ১১৭টি ধর্মস্থান ধ্বংস করা হয়, ৩০১টি পরিবার নিপীড়িত হন। এই হামলার কোনও বিচার হয়নি। ওই একই সময়কালে গড়ে দৈনিক ৭৫০ জন সংখ্যালঘু নিপীড়নের কারণে ভারতে চলে এসেছেন। ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২২ সালে যথাক্রমে ১২০, ১৪৯ ও ১৫৪টি সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর নিপীড়ন হয়— একটিরও বিচার ও সাজা হয়নি। কার্যত, হাসিনার সরকারে সংখ্যালঘু-বিষয়ক কোনও দফতরই ছিল না। এই উপমহাদেশের সব সরকারেই সাধারণত এই দফতর থাকে। আগস্ট মাসের গণঅভ্যুত্থান মূলত ছিল হাসিনার স্বৈরাচারী জমানার বিরুদ্ধে গণরোষ। বিগত কয়েকবছরে ভারতে ও ইউরোপে আগত বহু বাংলাদেশি পর্যটক প্রকাশ্যে বলেছেন বাংলাদেশে নির্বাচন হয়ে যায় ভোটের আগের মাঝরাতেই— ‘মিডনাইট ইলেকশন’। আওয়ামি লিগের যে গণভিত্তি তাঁদের মধ্যে কিন্তু সংখ্যালঘুরাও আছেন— ফলে এই জনরোষে অন্তত পাঁচশোর ওপর আওয়ামি লিগের সংখ্যালঘু সমর্থক অভ্যুত্থানের জনতার হাতে পেটানি খেয়েছেন। আর যাই হোক এঁদের ‘নির্যাতন’ সংখ্যালঘু-নিপীড়ন আখ্যা পেতে পারে কি? আবার রিয়া গোপ নামের এক ছ-বছরের কিশোরী, সৈকত দে নামের এক যুবক, হবিগঞ্জের রিপন শীল প্রত্যক্ষভাবে পুলিশি আক্রমণে বুলেটবিদ্ধ। শাসকের বুলেটের সম্ভবত কোনও ধর্মভেদ থাকে না।
এটা উপেক্ষা করার বিষয় নয় যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন হচ্ছে। হচ্ছে, হয়েই চলেছে। আগেও হয়েছে খোদ হাসিনার আমলে। তারও আগে। আসলে ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা গত সাত দশক ধরেই নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে থাকেন। ঠিক যেভাবে শ্রীলঙ্কায় থাকেন ভারতীয় তামিলরা। এ-দেশে থাকেন মুসলিমরা, কোনও কোনও রাজ্যে আইনের তোয়াক্কা না করেই যাদের ইচ্ছে করলেই পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়, গায়ে আগুন দিয়ে ভিডিও সম্প্রচার করা যায়। গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে অবশ্যই এই নিপীড়নের মাত্রা বেড়েছে এবং তা প্রচারের আলোয় এসেছে বেশি। কিন্তু যে অন্তর্বর্তী সরকার এখন ওই দেশে প্রত্যক্ষভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের উপদেষ্টা পরিষদে আছেন বিধানচন্দ্র রায়, প্রিয়ক ভট্টাচার্য যাঁরা নামপরিচয়ে সংখ্যালঘু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপি-র ছাত্র সংগঠনের সভাপতি আবার ধর্মপরিচয়ে সংখ্যালঘু। আবার মেঘমল্লার বসু (সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা) সম্ভবত লিগের সমর্থক। তিনি রাজনৈতিক চিহ্নের ওপরে উঠে বাংলাদেশের একদল বুদ্ধিজীবীর সম্প্রীতির আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন। বিষয়টা একেবারেই একমাত্রিক নয়।
ইস্কনের নাম এই নিপীড়ন কাহিনিতে প্রাধান্য পাচ্ছে মিডিয়ায়, যার কেন্দ্রে আছেন এক ‘সাধু’— ইনি কিন্তু ইস্কন থেকে বিতাড়িত এবং পরে নিজেই ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ভিত্তিতে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার অবশ্যই তাঁর আছে। কিন্তু তাঁর আইনজীবী আক্রান্ত হয়েছেন, এটা আষাঢ়ে খবর, আন্তর্জাতিক মিডিয়া একে স্বীকার করেনি। কিন্তু দেশের মিডিয়া ভুল খবর দেওয়ার পরেও তাঁদের ভুল স্বীকার করেনি, সূত্রের খবর ইত্যাদি বলে দায়সারা ভাব দেখিয়েছে। এটা আপত্তির কথা, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সেই দেশের খবর প্রচারের ক্ষেত্রে আরও খুঁটিয়ে তার প্রমাণাদি নজর করছেন না, যাকে খবরের পরিভাষায় ‘ডিবাঙ্ক’ বলা হয়। এখানে একটু উল্লেখ করা দরকার, ট্রাম্প যেবার নির্বাচনে হেরে যান তার আগে তাঁর উদ্বাহু প্রচারে বিপুল খবর মার্কিন দেশের আনাচেকানাচে ঘুরেছিল। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ তাঁদের নিজস্ব ‘ফ্যাক্ট চেকিং’ ব্যবস্থার মাধ্যমে চিহ্নিত করেছিলেন এগুলোর আশি শতাংশের বেশি ‘ফেক নিউজ’। এ-দেশের সংবাদমাধ্যমে পুঁজির অভাব নেই কিন্তু প্রযুক্তির কার্যকরী প্রয়োগেই তাদের বড় অনীহা। কারণ সে-ক্ষেত্রে এইভাবে সুনির্দিষ্ট প্রামাণ্যতা মেনে খবর পরিবেশন করতে গেলে তাদের কিছু ‘রক্তদান শিবির’ আর সরকারি প্রকল্পের ‘বিজ্ঞাপন’ ছাড়া আর তেমন কিছু মালমশলা থাকবে না। অথচ যে-কোনও দেশীয় বা আন্তর্জাতিক টেনশনে সঠিক খবর পরিবেশনা সংবাদমাধ্যমের পেশাগত দায়— এসব স্রেফ তারা ভুলে মেরে দিয়েছে অথবা শয়তানি করে ভুলে আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইস্কনের মতো প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব কোথায় এটা প্রথম থেকেই বোঝা যাচ্ছিল না, এখন বোঝা যাচ্ছে। সারা দুনিয়াতেই ইস্কন একটি বৈষ্ণব ভাবাদর্শ প্রচারের প্রতিষ্ঠান বলেই পরিচিত। বছরে একবার রথটানা বা মায়াপুরের সুগন্ধি প্রসাদ বিতরণ করা ছাড়া এমনকি স্থানীয় রাজনৈতিক ইস্যুতেও তাদের কোনও সামান্য উপস্থিতি আমরা দেখিনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বা সামাজিক আবর্তেও এর আগে তাদের নাম কখনও আসেনি। কিন্তু তুলসি গ্যাবার্ড, যাকে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি মার্কিন প্রশাসনের উঁচু পদে বসিয়েছেন, তিনি কিন্তু ও-দেশে ইস্কনের বড় নেতা। বাংলাদেশের বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান ধোয়া ‘তুলসি’পাতা নয়।
এবার একটু ভিন্ন কথা। একটু পুরনো খবরের কাগজ খুলে দেখুন, জুন ২০২২-এ ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের যৌথ বৈঠকে বলা হয়েছিল, বিদ্যুৎ সেইরকম একটা ক্ষেত্র যেখানে দুই দেশ এক হয়ে কাজ করতে পারে। ততদিনে ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় আদানির বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কাজ প্রায় শেষের পথে। তার জমি দখল করা হয়েছে প্রত্যক্ষভাবে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে, এমনকি তাঁদের পারিবারিক গোরস্থান অবধি নিয়ে নেওয়া হয়েছে ৯২৭ একরের (প্রস্তাবিত ২২০০ একর) এই কারখানায়। তাঁদের প্রতিরোধ আটকাতে স্থানীয় গ্রামের পর গ্রাম বিদ্যুতের তার কেটে দেওয়া হয়েছে, আদিবাসীরা বাধ্য হয়েছেন চড়া দরে কেরোসিন কিনতে। এইসব খবর কোনও সংবাদমাধ্যমে সেইভাবে বেরোয়নি, বেরোনোর কথাও নয়। কিন্তু জুন ২০২৩ থেকে ১৫০০ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র তাদের পুরো উৎপাদন রফতানি করছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভলেপমেন্ট করপোরেশন ও পাওয়ার গ্রিড করপোরেশন অফ বাংলাদেশের সঙ্গে ‘আদানি পাওয়ার লিমিটেড’ ২৫ বছরের চুক্তি— ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ রফতানির পরিমাণ বাড়বে। এতে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু আমাদের দেশে বিদ্যুৎ রফতানি করতে হলে প্রাথমিক শর্ত হল, দেশকে ‘বিদ্যুৎ-উদ্বৃত্ত’ বলে চিহ্নিত করতে হয়— ভারত আদৌ তেমন কোনও উদ্বৃত্ত দেশ নয়। কিন্তু ওই আবশ্যিক শর্ত না মেনেই কার্যকর করা হয়েছে এই চুক্তি। আবার ঝাড়খণ্ড সরকারের নিয়ম হল সেই রাজ্যে যিনি বিদ্যুৎ উৎপাদন করবেন তাঁকে তাঁর উৎপাদনের ২৫ শতাংশ সেই রাজ্যের সরকারকে বিক্রি করতে হয়— ‘আদানি পাওয়ার’ তাদের উৎপাদনের ওই পরিমাণ আদৌ ঝাড়খণ্ডকে দিচ্ছে না। তাদের পক্ষে ঝাড়খণ্ডের সরকারকে জানানো হয়েছে ওই ‘প্রাপ্য’ তারা ‘বিকল্প’ কোনও পথে পুষিয়ে দেবে— চালু আইনকে কলা দেখানো আর কি! শুধু তাই নয়। গোড্ডা স্পেশ্যাল ইকোনমিক জোনে চালু রীতি লঙ্ঘন করে শুধুমাত্র আদানি পাওয়ারকেই কারখানা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সচরাচর আরও অনেক কোম্পানি একই হাবে কাজ করার অনুমতি পায়। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আসছে অস্ট্রেলিয়া থেকে আর ‘আদানি পাওয়ার’ পাচ্ছে বিপুল ‘কার্বন সেস’[1] ছাড়। অথচ যে-মাশুল নিয়ে তারা ওপারে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে তার মূল্য বাজারমূল্যের থেকে দেড়গুণ, এমনকি ভিন্ন কোনও কোম্পানির থেকে বিদ্যুৎ কিনলে বাংলাদেশ বর্তমান মূল্যের তিনভাগের একভাগ দামেই তা কিনতে পারত। দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বাংলাদেশের এই দামাদামির ক্ষমতাটাই আত্মসাৎ করে নিয়েছে। এই চুক্তি নিয়ে ও-দেশে জনরোষ আছে।
আর হাসিনার দুর্নীতি? সে তো এক আলাদা অধ্যায়। গত পনেরো বছরে তার সীমা যে দিগন্তস্পর্শী সে তো আজ সাধারণ সত্য। তার সহকারী পিওন নাকি হেলিকপ্টার ছাড়া চাপেন না এবং আওয়ামি লিগের মাতব্বর হিসেবে চারশো কোটি টাকা তছরুপের সঙ্গে যুক্ত। তার বাড়ির গেট তৈরিতে ব্যয় হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। এমনকি শেখ মুজিবরের মূর্তি তৈরির জন্য যেভাবে দরিদ্র মানুষকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেছে হাসিনার সরকার তাও প্রায় নজিরবিহীন। তাঁর আমলে যা সরকারি ব্যয়বরাদ্দ তার চল্লিশ শতাংশ লুটে খেয়েছে তাঁর আমলাবাহিনি। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে প্রস্তাবিত খরচ চড়া হারে বাড়িয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে অর্থ, বাইরে পাচার হয়েছে আনুমানিক সাতশো কোটি টাকা। মনে পড়তে পারে, রাফায়েল বিমান কেনার ব্যয় ঠিক একইভাবে ২০১৪ সালের পর দ্বিগুণ করে দেওয়া হয়েছিল এবং খাতায়কলমে দেউলিয়া ‘রিলায়েন্স পাওয়ার’ কোম্পানিকে তার বরাত দেওয়া হয়েছিল যা সাফল্যের সঙ্গে করার যোগ্যতা ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত হিন্দুস্থান এরোনটিক্স (হ্যাল)-এর। কী আশ্চর্য, রাফায়েল দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত অজিত ডোভাল ‘স্যারই’ শেখ হাসিনাকে সসম্মানে ভারতে আশ্রয় দেওয়ার ‘অপারেশন’-এর নেতৃত্ব দিলেন!
এমন মনে করার কোনও কারণ নেই অন্তর্বর্তী সরকার জাদুদণ্ডে সব অনাচার সাফ করে দেবেন। তার উপায় ও সদিচ্ছা কোনওটাই তাঁদের নেই। একশো দিনের সীমায় ইতিমধ্যেই তারা লাভজনক চট্টগ্রাম বন্দর বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন— বন্দর কিনে নেওয়ায় ইদানিং এক ভারতীয় নক্ষত্রের খুব নামডাক। তিনি সম্ভবত আশায় দিন গুনছেন। সংখ্যালঘুর স্বার্থে এ-দেশ যে বাণিজ্য-সম্পর্কের কোনও বদল করবেন এটা দুরাশা, এর সঙ্গে বিপুল বিনিয়োগ-বাণিজ্য-পুঁজির যোগ আছে। পুঁজির কোনও দেশ নেই, ধর্ম নেই, সীমান্তও নেই।
হ্যাঁ, এই কথা জোর দিয়ে বলা দরকার দেশের পতাকা দেশের সব মানুষের আবেগের প্রতীক। কোনও দেশের কোনও দলের পতাকা অন্য কারও পুড়িয়ে দেওয়ার বা পদদলিত করার নৈতিক অধিকার থাকে না। এক্ষেত্রে যে উদাহরণ তৈরি হল এবং তার ‘পাল্টা’ দেওয়া হল তা সরব ধিক্কারের বিষয়। একটু বিনীতভাবে স্মরণ করাই ওপারের মানুষরা যখন নিজেদের কপালে বাংলাদেশের পতাকা জড়িয়ে রাজপথে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন বাংলাদেশের পুলিশ সেই পতাকাঘেরা কপালেই গুলি চালায়— ওই পতাকা তো পুলিশবাহিনিরও আরাধ্য ছিল! কিন্তু পতাকা-ঢাকা প্রতিবাদীদের দেহকে বুলেট গ্রাহ্য করেনি। আর আমার দেশের পতাকা? মনে পড়ছে এনআরসি নিয়ে সারা দেশে যে ব্যাপ্ত প্রতিবাদ তার কেন্দ্রে ছিল আমাদের ত্রিবর্ণ, আমার দেশের কৃষকরা যেদিন প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লির রাজপথে সরকারি সন্ত্রাসের মুখোমুখি হচ্ছেন সেদিনও তাঁদের হাতে উড্ডীন ছিল ওই একই স্মারক। ওটা দেশের টাকা মেরে পালিয়ে যাওয়া নীরব মোদি বা মেহুল চোকসিদের একচেটিয়া পতাকা নয়— ওটা আদানি-আম্বানিদের পতাকা নয় যারা সম্প্রতি ‘হর ঘর তিরঙ্গা’ মেনে নিজেরা পলিয়েস্টার কাপড়ের পতাকা বেচে বেশ কিছু কামিয়ে নিয়েছেন। ওটা সেই দলিত মানুষটির বয়ে চলা পতাকা যিনি ‘দেশ জোড়ো যাত্রা’য় গাড়ি বাস টেম্পো কোথাও না উঠে শুধু ওই পতাকা কাঁধে নিয়ে হেঁটে যেতেন। সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসায় বলেছিলেন, গাড়িতে চাপব কেন? আমার দেশের বেশিরভাগ মানুষ তো হেঁটেই নিজেদের সব কাজ করে নেন। ওই পতাকা আর তার বাহক এদেশের সাধারণ মানুষ। তাঁদের কারও সঙ্গে আপনাদের বৈরিতা নেই। তারা এদেশেও সংখ্যালঘুকে পাহারা দেন, ওপারে আপনারাও মন্দির-স্তুপ-গির্জা ভাঙতে এলে বুক চিতিয়ে দাঁড়ান।
এই জেগে থাকাই তো আসলে আমাদের ধর্ম, তাই না?
[1] বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা পোড়ালে যে পরিবেশগত ক্ষতি হয় তার জন্য উৎপাদককে সরকারিভাবে কিছু কর দিতে হয়। তাকে বলা হয় কার্বন সেস।
*মতামত ব্যক্তিগত