দুর্ভিক্ষের পুনর্সংজ্ঞায়ন – ভারতের আসন্ন দুর্ভিক্ষ

ভাত নেই, পাথর রয়েছে | প্রথম বর্ষ, অষ্টম যাত্রা | ডিসেম্বর, ২০১৭

বিনায়ক সেন

 

 

বিনায়ক সেন পেশায় শিশুচিকিৎসক। নেশায় জনস্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞ এবং গণ-আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ  (PUCL)-এর সর্বভারতীয় উপ-সভাধিপতি। বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, যার মধ্যে জোনাথন মান পুরস্কার, গোয়াংজু প্রাইজ ফর হিউম্যান রাইটস এবং গান্ধি ইন্টারন্যাশনাল পিস অ্যাওয়ার্ড বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে।

 

বাংলার ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে মারা যান ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষ। ১৯৪৩-এ খাদ্যশস্যের কোনওরকমের কমতি বাংলায় ছিল না, যেমন আজকের ভারতেও নেই। বস্তুতঃ, খাদ্যশস্য এতটাই উদ্বৃত্ত যে তাকে পচন থেকে বাঁচাতে সরকারের তরফে তার রক্ষণাবেক্ষণের যে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, অপ্রতুল ঠেকছে তা-ও।

বাংলার দুর্ভিক্ষ নিয়ে তাঁর বিখ্যাত অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে অমর্ত্য সেন মন্তব্য করেছিলেন, সে-দুর্ঘটনা ছিল “the failure of exchange entitlements”। অন্যভাবে বলতে গেলে, মানুষ যে সমস্ত সামাজিক আয়োজন বা ব্যবস্থার থেকে প্রয়োজনের খাবারটুকু সংগ্রহ করে – তা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছিল।

সম্প্রতি এক তরুণ ইতিহাসবিদ, মধুশ্রী মুখার্জি, এই বিশ্লেষণকে আরও কিছুটা বিস্তৃত করেছেন। “Churchill’s Secret War” নামে একটি বইতে তথ্যপ্রমাণ সহযোগে মধুশ্রী দেখিয়েছেন – বর্ণবাদী উইনস্টন চার্চিল কীভাবে তাঁর সরাসরি হস্তক্ষেপে বাংলায় উৎপন্ন চালকে ব্রিটেনের যুদ্ধক্ষুধা মেটাতে ব্যবহার করেছিলেন, এবং বাংলায় বাড়ন্ত চালের অভাব মেটাতে আসা অস্ট্রেলিয়ার গমকেও একইভাবে পথ দেখিয়েছিলেন। শেষে বার্মা থেকে আসা জাপানিদের বঙ্গোপসাগর পার করে মেদিনীপুর পৌঁছে যাবার রাস্তা বন্ধ করতে চার্চিল সাহেব নিলেন যাকে বলে scorched earth policy। সমস্ত শস্য জ্বালিয়ে দেওয়া হল। নদীবক্ষে শস্য পরিবহণ বন্ধ করতে পুড়িয়ে দেওয়া হল সমস্ত নৌকো। ডুবিয়ে দেওয়া হল নদীতে।

এ সবই ঘটে গেল ১৯৪৩-এ, চার্চিল সাহেবের হুকুমে। ত্রিশ লক্ষ বাঙালি চাষার প্রয়োজনকে ছাপিয়ে গেল তাঁর সৈন্যদলের প্রয়োজন। বলার কথাটি হল – আমাদের দেশে, আর অন্যান্য দেশেও, দুর্ভিক্ষ বা অন্য সব বড়সড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে-সব ঘটনা ঘটে চলেছে, তারা কেউই স্বয়ম্ভু নয়। এই সমস্ত অপরাধের মূলে থাকে এমন কিছু নীতি বা পলিসি, যা ধনী ও প্রতিপত্তিশালীদের সুবিধা করে দেবার জন্য তৈরি হয়। ফলে দরিদ্র আর অধিকারহীন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সাধারণভাবে ঘটনাচক্র এমন হলেও, গত বিশ বছরে আমাদের দেশের শাসন যে চেহারাটা নিয়েছে, তা অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার-সম্বন্ধীয় সংসদীয় বিধি-বিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলেছে, আর আমাদের বুঝিয়ে চলেছে — ধনীর ধনীতর হওয়া, অতএব দরিদ্রের দরিদ্রতর হওয়াতেই দেশের মঙ্গল এবং অগ্রগতি। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৪ই ডিসেম্বর, ২০১১-র খাদ্য সুরক্ষা বিল সংক্রান্ত একটি ক্যাবিনেট মিটিং-এ শ্রী শরদ পওয়ার না কি বলেছেন – “দেশের প্রতিটা মুখে খাবার যোগানো কীভাবে সম্ভব? দেশে যদি দুর্ভিক্ষ লাগে, সকলকে খাদ্য দেওয়া এক অসম্ভব ব্যাপার।” ভাঁড়ামোর কী উৎকৃষ্ট ব্যবহার!

দুর্ভিক্ষের সংজ্ঞা নিয়ে আরও একটা সাধারণ কথা। শ্রী অমর্ত্য সেনের exchange entitlements, বা বিনিময়ের অধিকার-সংক্রান্ত সন্দর্ভ নিয়ে অক্টোবর ১৯৮৫-র ইকোনমিক অ্যান্ড পোলিটিক্যাল উইকলি-তে আলোচনা করেন অমৃতা রঙ্গসামী। তিনি বলেন, “দুর্ভিক্ষজনিত অনাহার এবং তজ্জনিত মৃত্যু আসে দুর্ভিক্ষের চরম স্তরে, যখন দুর্ভিক্ষের কলঙ্করেখা স্পষ্ট ও গোচর হয়ে ওঠে, এবং আক্রান্তের মৃত্যু হয়। তথাপি দুর্ভিক্ষ মানেই আক্রান্তের মৃত্যু না-ও হতে পারে। দুর্ভিক্ষকে সম্যক বুঝতে না-পারার কারণ সেইসব রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নির্ধারকদের চিহ্নিত করতে না-পারা – যারা দুর্ভিক্ষের সূচনা করে। তাই আমাদের কর্তব্য – দুর্ভিক্ষের পুনর্সংজ্ঞায়ন করা, এবং বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিরন্তর পিষতে-থাকা রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উপাদানগুলোকে চিনে নেওয়া।”

দুর্ভিক্ষের বিষয়ে অনেকের ধারণা – যাকে বলা চলে ‘অ্যাপোক্যালিপটিক’। সন্দেহ নেই, অনাহারের ছাপটি চোখে ধরা দিলেই তা জয়নুল আবেদিনের চিত্রের মতো, বা বিয়াফ্রার ছবিগুলোর মতন সারাজীবনের জন্য মনে দাগ কেটে যায়। কিন্তু এই ছবিগুলো তৈরি হয় প্রতিদিন, একটু-একটু করে, আর দুর্ভিক্ষের এই ‘গড়ে-ওঠা’-র খোঁজ রাখতে গেলে প্রয়োজন হয় বিশেষ অন্তর্দৃষ্টির।

নির্ভরযোগ্য আর প্রতিনিধিত্বমূলক অ্যানথ্রপোমেট্রিক সার্ভে করা খুব সহজ কাজ নয়। ফলে এই পথে তথ্য পাওয়াও কঠিন। সম্প্রতি শিশুদের পৌষ্টিক হালের মূল্যায়ন করেছেন নন্দী ফাউন্ডেশন। তাঁদের মূল্যায়নে দেখা গেছে পাঁচ-অনূর্ধ্ব শিশুদের মধ্যে শতকরা চুয়াল্লিশ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার। এই রিপোর্ট প্রকাশ করার সময় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছেন – এ আমাদের “জাতীয় লজ্জা”। লজ্জা, এ-নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এই “লজ্জা” আমাদের এমন কিছু অপরিচিতও নয়। রাষ্ট্রীয় পোষণ সংস্থানের অধীন জাতীয় পুষ্টি পর্যবেক্ষণ দপ্তর বহু বছর ধরেই এই ধরণের তথ্য প্রকাশ করে থাকে। সে-তথ্য ২০০৫-২০০৬-এর জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য জরিপ (NFHS-III)-দ্বারা অনুমোদিতও বটে। NFHS-III-এর কথায়, পাঁচ-অনূর্ধ্ব শিশুমৃত্যুর মোট সংখ্যার মোটামুটি অর্ধেকের ক্ষেত্রে কারণ হিসাবে তাদের অপ্রতুল পুষ্টির ব্যবস্থাকে দায়ী করা যায়। CIA World Factbook বলছে, ভারতে শিশুমৃত্যুর হার বা IMR ছেচল্লিশ। সারা বিশ্বে সবথেকে বেশি শিশুমৃত্যুর হার যেসব দেশের, ভারত তাদের মধ্যে চতুর্দশতম স্থানে। ভারতের শিশুমৃত্যুর হার বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার আর সমস্ত দেশের থেকে বেশি। বাংলাদেশের শিশুমৃত্যুর হার ঊনপঞ্চাশ। CIA বললে মানতেই হয়। সারা বিশ্বের হিসেবটা এরকম – প্রতি তিন সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও অপুষ্টিজনিত কারণে একটি শিশুর মৃত্যু হয়। এই তিন সেকেন্ডে বিশ্বের অস্ত্র কারবারিরা খরচ করে এক লক্ষ কুড়ি হাজার ডলার – যে ব্যবস্থা এই শিশুর মৃত্যুর জন্য দায়ী তাকে সুরক্ষিত রাখতে।

অপুষ্টির কথা উঠলেই ধরে নেওয়া হয় শৈশবের অপুষ্টির কথা। এর একটা কারণ – প্রাপ্তবয়স্কদের পুষ্টিমাপক শক্তপোক্ত আর সংবেদী অ্যানথ্রপোমেট্রিক ব্যবস্থার বয়স বিশ বছরেরও কম। বডি মাস ইন্ডেক্স বা BMI, আজকাল যা খুব চালু, ব্যষ্টিক বা সমষ্টিক স্তরেও গ্রাহ্য। এই ইন্ডেক্স কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, শিশুদের ক্ষেত্রে নয়। কিলোগ্রামে ওজনকে মিটারে উচ্চতার বর্গফল দিয়ে ভাগ করলে BMI  পাওয়া যায়। সুস্থ মানুষের BMI-এর ন্যূনতম মান ১৮.৫। BMI এর কম হলে বুঝতে হবে মানুষটি দীর্ঘকাল প্রয়োজনীয় এনার্জি বা কর্মশক্তির অভাবে ভুগছে। বা, সে ক্ষুধাপীড়িত। ১৮.৫ থেকে ২২ পর্যন্ত মান থাকলে ধরে নেওয়া হয় অবস্থা স্বাভাবিক। মান ২২-এর ওপরে যেতে থাকে, মানুষটি তত স্থূলত্বের দিকে এগোয়। এপিডেমিওলজিকাল স্টাডির সাহায্যে পুণের পেডনেকর দেখিয়েছেন – BMI যত ১৮.৫-এর নীচে নামে, তত বৃদ্ধি পেতে থাকে মৃত্যুর হার। ১৮.৫-এর ওপরে মৃত্যুহারকে যদি একক ধরা হয়, তবে দেখা যাবে – ১৮.৫ থেকে ১৭-র মধ্যে মৃত্যুহার ১.৩৩, ১৭ থেকে ১৬-র মধ্যে মৃত্যুহার ১.৫, এবং ১৬-র নীচে মৃত্যুহার ১৮.৫-এর উপরের স্বাভাবিক মৃত্যুহারের দ্বিগুণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ – কোনও সম্প্রদায়ের চল্লিশ শতাংশ মানুষের BMI যদি ১৮.৫-এর নীচে হয়, সেই সম্প্রদায়কে দুর্ভিক্ষগ্রস্ত বলে ধরে নিতে হবে।

আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের অপুষ্টি নিয়ে তথ্যসূত্র কী? রাষ্ট্রীয় পোষণ সংস্থান (NIN)-এর অধীন, হায়দরাবাদের ন্যাশনাল নিউট্রিশন মনিটরিং ব্যুরো (NNMB)। ITDA বা ইন্টিগ্রেটেড ট্রাইবাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির জন্য ২০০৯ সালে করা NNMB-র সার্ভের ফলাফল জানাচ্ছে – শতকরা চল্লিশ শতাংশ পুরুষ ও ঊনপঞ্চাশ শতাংশ মহিলার BMI ১৮.৫-এর নীচে। অর্থাৎ, এঁরা ক্ষুধাপীড়িত। অর্থাৎ, এই সার্ভের অঞ্চলটি দুর্ভিক্ষগ্রস্ত। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে, বা মোটের ওপর সারা দেশে – পুরুষদের ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যান শতকরা তেত্রিশ শতাংশ ও নারীদের ক্ষেত্রে ছত্রিশ শতাংশ। সব মিলিয়ে পঁয়ত্রিশ শতাংশ। ওই একই সার্ভে থেকে জানা যাচ্ছে – তপশীলী উপজাতিদের ৪১.৯ শতাংশের BMI ১৮.৫-এর নীচে। তপশীলী জাতিদের ক্ষেত্রে শতকরার হিসেবটা ৩৮.৪। সংখ্যালঘুদের উন্নতিসাধনে গঠিত সাচার কমিটির রিপোর্টে আছে – আমাদের দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশের BMI ১৮.৫-এর নীচে। এক কথায় বলতে গেলে, আমাদের দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মশক্তির অভাবে ভুগছেন। এঁরা হয় দুর্ভিক্ষপীড়িত, নয় তো এঁদের নিশ্চিত গতি দুর্ভিক্ষের দিকে। এই দুর্ভিক্ষের অবস্থা কোনও সময়সীমায় আবদ্ধ নয়। সুতরাং, আমাদের দেশের জনসংখ্যার বিপুল অংশ দুর্ভিক্ষের কবলে – এই কথা বলা যায়।

NNMB-র সার্ভে আরও জানাচ্ছে – সার্ভেকৃত ভারতবাসীর মধ্যে শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ পুরুষ ও ঊনআশি ভাগ মহিলা রক্তাল্পতার শিকার। শুধু এই-ই নয়, সুপারিশকৃত খাদ্যতালিকায় যা যা পরিপোষক থাকে – যেমন ভিটামিন এ, ডি, বি, সি, প্রোটিন ইত্যাদি – সেসব সম্বলিত কোনও খাদ্যই এঁরা যথেষ্ট পরিমাণে পান না।

এতেই শেষ নয়। জে.এন.ইউ-এর বরিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ উৎসা পট্টনায়েক দেখিয়েছেন, ১৯৯৪ থেকে ২০০৪ – এই দশ বছরে আহার্যের মধ্যে কীভাবে কমে আসছে খাদ্যশস্যের পরিমাণ। সুতরাং, কর্মশক্তি বা এনার্জির অভাবটাই শেষ কথা নয়। এই অভাবের ফাঁকটা ক্রমবর্ধমান। ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে ২০০৯-২০১০-এর তথ্যের উপর ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো।

টিউবারকিউলোসিস, বা টিবি-র এপিডেমিওলজি-সংক্রান্ত তথ্যে চোখ রাখলে হাড় হিম হয়ে আসে। এই নিবন্ধের লেখকের এক সহকর্মী কাজ করেন বিলাসপুরের জন স্বাস্থ্য সহযোগ-এ। তিনি প্রায় এক হাজার নিশ্চিত টিবি-র কেস বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, পালমোনারি টিবি-র সঙ্গে ১৮.৫-এর নীচে BMI-এর নিবিড় সম্পর্ক। জে.এন.ইউয়ের ড. রাজীব দাশগুপ্ত ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ কম্যুনিটি মেডিসিন পত্রিকায় দেখিয়েছেন – গত দশ বছরে পালমোনারি টিবি-তে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে পাঁচ গুণ।

সুতরাং, দুর্ভিক্ষের এই স্তর হল আপাতদৃষ্টিতে তাকে দেখতে না-পাওয়ার স্তর। লক্ষ করার বিষয় এ-ও, যে এই অবস্থার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে ক্ষমতাধরের গুদামে। এই দুর্ভিক্ষের পীড়ন সইছে যারা, তারা বেঁচে আছে স্রেফ জল, জমি, জঙ্গল, ও জীববৈচিত্র্যের মতন সাধারণ সম্পত্তিগুলোর নিত্য প্রসাদ পেয়ে।

এমিনেন্ট ডোমেইন তত্ত্বে ভর করে ভারতরাষ্ট্র চাইছে এইসব সাধারণ প্রাকৃতিক সম্পত্তিগুলোকেও দেশী বিদেশী বহুজাতিক পুঁজির হাতে তুলে দিতে। এই কাজ সুসম্পন্ন করতে রাষ্ট্র নিয়োগ করছে তার ক্ষমতা – সম্ভব হলে বলপ্রয়োগ না করে, আর প্রয়োজন হলে বলপ্রয়োগে পিছপা না হয়ে। নন্দিনী সুন্দরের কেসে সুপ্রিম কোর্ট যেমন বলেছিলেন – ধনীর জন্য ঋণে ছাড় আর দরিদ্রের জন্য বন্দুকের ব্যবহার – এই আমাদের ভবিষ্যতের দর্শন।

এসবের মধ্যে একটাই সান্ত্বনা – PUCL, বা পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়ার “খাদ্যের অধিকার” কেস, যা গত দশ বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টে “নন-অ্যাডভারসারিয়াল” রীতিতে চলছে। দেশের বর্তমান গণবন্টনব্যবস্থার সবটাই এই কেসে সুপ্রিম কোর্ট-কর্তৃক দেওয়া নির্দেশের ভিত্তিতে তৈরি। প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো এরকম —

গণবন্টনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ :

১) দারিদ্রসীমার নীচে প্রতিটি পরিবারকে প্রতি মাসে ৩৫ কিলো খাদ্যশস্য প্রদান।

২) স্কুলের বাচ্চাদের জন্য মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা।

৩) পাঁচ বছর বয়সের নীচের শিশুদের জন্য সম্পূরক আহার।

৪) গর্ভবতী ও স্তন্যদায়িনী মহিলাদের জন্য সম্পূরক আহার।

গণবন্টনব্যবস্থার চেহারায় খাদ্যের অধিকারের দিকে কিছুটা এগিয়ে যাওয়া যদিও আমাদের কিছুটা স্বস্তি দেয়, অতিব্যাপক ক্ষুধা আর তার বহুরূপে প্রকাশ – যে কথা আগে বলছিলাম – আমাদের এ-কথাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে এই ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল, এবং অবশ্যই অসম। আমাদের দেশের “উন্নত” কিছু অঞ্চলে – যেমন গুজরাট বা মহারাষ্ট্রে – ক্ষুধা আর অপুষ্টির সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

এর ওপর খাদ্যসুরক্ষা বিল নিয়ে শ্রী শরদ পওয়ারের চেতাবনি। এই বিল আইনের চেহারা পেলে ভারতের মানুষকে খাদ্যসুরক্ষা দেওয়া তো দূর, তার থেকে অনেক অনেক ধাপ পিছনে নিয়ে যাবে। শ্রেণিবিন্যাসের প্রক্রিয়া, যা বর্তমান গণবন্টনব্যবস্থার একটা মস্ত বড় সমস্যার জায়গা, এই আইন প্রণয়ন হলে হবে আরও অনেক জটিল, ও অপব্যবহারপ্রবণ। খাদ্যশস্যের লভ্যতা হবে অনেক কম। খাদ্যশস্যের বিলিব্যবস্থা হয় তো বদলে যাবে নগদ হস্তান্তরে।

অপুষ্টিজনিত বিকলতা, দুর্ভিক্ষের তথাকথিত কলঙ্করেখার ছাপ স্পষ্ট হচ্ছে এমন একটা সময়ে বা শাসনে – যখন দেশে খাদ্যশস্যের কমতি নেই। দেশে সবুজ বিপ্লব বরকরার। এই তথাকথিত বিপ্লবটি অবশ্য ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া মূলত চাল ও গম চাষের জন্য কৃত্রিম সার, কীটনাশক, জল ও কৃষিযন্ত্রের একটা সম্মিলিত ভর্তুকিঋদ্ধ ডামাডোল যা জায়গায়-জায়গায় জমাট বেঁধে গেছে।

এই সমগ্র প্রচেষ্টাটা ধ্বংস করেছে স্বল্প উপাদানে পরিবেশ বাঁচিয়ে চাষের দেশজ প্রক্রিয়াকে। নষ্ট করেছে আমাদের বাজরা-অর্থনীতি, বৃষ্টির জল ধরে ফসলের কাজে লাগানোর প্রক্রিয়া। ধ্বস্ত করেছে মাটি। ভূগর্ভের জলকে নিঃশেষ করেই শুধু আনেনি, তার যেটুকু এখনও বেঁচে তাকে দূষিত করেছে ফ্লুওরাইড আর আর্সেনিক দিয়ে। চাষের জমি আর জঙ্গলের অনেকাংশ চলে গেছে শিল্প ও বাণিজ্যের উদরে। তামাক, ইথানল, ইয়োরোপ-আমেরিকার গবাদি পশুর জন্য সোয়া বিন, এবং ডায়াবিটিস রোগকে দেশে ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে আখ – শস্যকে সরিয়ে তার জায়গা নিয়েছে এ-সবেরই চাষ। অথবা, জলবিদ্যুতের জন্য ভূকম্পপ্রবণ ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় তৈরি করেছে বাহান্নটা বিশাল বাঁধ। এবং ওমকারেশ্বর বা ইন্দিরা সাগর বাঁধের ক্ষেত্রে যেমন – ওই অঞ্চলের মানুষের জন্য যথাযথ পুনর্বাসনের কোনও ব্যবস্থা না করেই এইসব কর্মযজ্ঞ এগিয়ে চলেছে।

‘পিক অয়েল’-এর জমানায়, বিশ্ববাজারে তেলের দাম যখন ঊর্ধ্বমুখী, তখন এই ধরণের ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া এবং যন্ত্র ও ভর্তুকিসর্বস্ব কৃষির প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া বেশিদিন সম্ভব হবে না, লাভজনক তো নয়ই। ততদিনে আমাদের দেশের সাধারণ নাগরিক যদি উদ্বিগ্ন না হয়, জমি-জল-বীজব্যবস্থা ও শস্যের ফলন, রক্ষণ ও সমবন্টনের প্রতি নজর না দেয়, দেশে দুর্ভিক্ষ আসতে বাধ্য। আর দেশমাতৃকার মুখে সেই দুর্ভিক্ষের ছাপ হবে অসহ, ভয়াবহ।

কী করতে হবে তাহলে? আপাতত বহুচর্চিত খাদ্যসুরক্ষা বিলে – শ্রী পওয়ারের সমস্ত উদ্বেগ সত্ত্বেও – প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে সকলেরই যথেষ্ট খাদ্য জোটে। শুধুই শস্যদানা নয়, শুধু চাল বা গম নয়, খাদ্য – ডাল এবং তেল, যাতে তাদের মুখের থেকে কেটে যায় অনাহারের কালো ছোপ। আগামী দিনগুলোতে গড়ে তুলতে হবে ক্ষতিকর চাষ (তামাক, আখ, অ্যালকোহল, সোয়া বিন) এবং তার ক্ষতিকর প্রণালী নিয়ে সাধারণের মধ্যে সচেতনতা। চাষের দেশজ পদ্ধতিকেও আশু গুরুত্ব দেওয়া দরকার – যাতে চাষিরা ফলাতে পারেন বাজরা, ডাল, সবুজপত্র সবজি, এবং পশুপ্রোটিন, এবং তাদের সুষম খাদ্যের প্রয়োজন মেটে। গড়ে তুলতে হবে সম্প্রদায়ভিত্তিক খাদ্যসংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থা। আর সব শেষে – সাম্যসুন্দর সমাজ, যেখানে সকলের ভাগেই পর্যাপ্ত জোটে। সকলে সুখে থাকে। শান্তিতে থাকে।

 

নিবন্ধটি ফ্রন্টিয়ার, ভল. ৪৫, নং ১৮, নভে. ১১-১৭, ২০১২-এ প্রকাশিত। লেখকের অনুমতিক্রমে ও আগ্রহে পুনঃপ্রকাশিত হল।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. এক চূড়ান্ত অসম সমাজের দিকে আরেকবার নজর ফেরাতে বলে এই লেখা, উফ, কী এক ভয়াবহতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা!

  2. কিন্তু ভারতের শিশুমৃত্যুর হার কি বাংলাদেশের চেয়ে কম?

Leave a Reply to Hasinul Cancel reply