জগন্নাথদেব মণ্ডল

তিনটি কবিতা

 


আমার ছোটদাদু রাধাভাবে ভাবিত ছিলেন।
বিয়ে করেননি আজীবন।

চিলের ছাতে একলা ঘরে একটা রাধাহীন কৃষ্ণ মূর্তি ছিল।
কৃষ্ণের মাথার পাখনাটি ছিল সত্যি- ময়ূরের।

দাদু ঘাড়ে নেমে আসা চুল আলগোছে বেঁধে নিতেন। মনসাপাতায় প্রদীপশিখা জমিয়ে কাজল পরতেন চোখে।

আমি কাছে গেলে শোনাতেন চণ্ডীদাসের পদাবলি। প্রসাদ দিতেন- মুচকুন্দ ফুলের শরবত আর গুড় সন্দেশ।

দাদুকে বলতাম- রাত্রিকে একা থাকেন কী করে? আপনার ভয় করে না?
দাদু বলতেন- রাত্রিতে আমি ময়ূরী হয়ে যাই; নাচ দেখাই নাগরকে। তাই ভয় করে না।

আমি চুপ করে থাকতাম। আমার মনে পড়ত গান- ” হতাম যদি বনময়ূরী তোমায় নাচ দেখাতাম….”
আমি বলতাম -আচ্ছা, মানুষ মারা গেলে কোথায় যায়? কী হয়?

তিনি বলতেন- প্রথমে কাকজন্ম হয়। সেই কাকের গলার কাছে থাকে নীল ময়ূরী রঙ।

তারপর এক দোলজোছনার রাতে দাদু মারা গেলেন। চোখে লেপ্টে যাওয়া কাজল। ঠোঁটে ছিল মধুর হাসি।

আজ নবান্নক্ষণ। গতকাল মা নেমতন্ন করেছে সমস্ত পাখিদের। মৃত পূর্বপুরুষদের।

আজ ভোরে কলার পাতায় রাখা নবান্ন খেতে এসেছে গলার কাছে ময়ূরীরঙ কাক। আমি চিৎকার করে ডেকে উঠলাম – ছোটদাদু।

মা শুনতে পেল না এই ডাক। শুধু শুনতে পেল উন্মাদ ঠাকুমা। ঠাকুমা শিউলিগাছের সাথে কথা বলছিলেন। এই ডাক শুনে শোলোক বললেন-
‘কা- কা- কা তিতে বাড়ি থেকে মিঠে বাড়ি যা।
গোয়াল বাথানে যা, দই দুধ খা। ‘

ছোটদাদু গোলাবাড়ির পাশ দিয়ে উড়ে গেল রাধাবিনোদ মন্দিরের দিকে।


আমার ইচ্ছে করে একপায়ে নূপুর বেঁধে বেজে উঠি রিনরিন।
আলপনা হয়ে শুয়ে থাকি উপাসনা গৃহের মেঝেয়।
তুমি তখন সেতার বাদনরত দৈবপুরুষ।
রুদ্রবীণায় বৈশাখ নামাবে শাল মহুয়ার মাথায়।

নবীন আষাঢ় মাসে কুর্চি গাছের নরম তালুতে এনে দেবে তুমি।
আমি মহুল রঙের আলো গালে মাখাব তোমার।

দুজনে মুখে চিনিদানা নেব।
গুটি গুটি নেমে যাব দূর্বা ঘাসের অতল সুগন্ধি শিকড়ে।

এইসব ভাবতে ভাবতে তুমি কিশোর অমলতাস হয়ে গেছ।
আমি তোমার গায়ে ঠেস দিয়েছি কিশোরী সোনাঝুরি গাছ।


ছুঁয়ে দাও,
তিরতির কেঁপে উঠুক তিতির পাখির বুক।

কমায় এসে সঘন নিশ্বাস দীঘিতে ফেলুক রাঙা বৌঠান।

কোথায় দিঘি?

এতো নবীন পুরুষের কালো বুকরোমে লেগে থাকা পৌষশিশির।

বৌঠান আর বৌঠান নেই,
এখন চিতল হরিণী।

হরিণীও নয় রোহিত মৎস্যের ঘরণী হয়ে গেছে।

নতুন জলে ঘাই মারতেই ধীবর পুরুষের বুক টাটায়।

এই কুশল রোদে এইসব অপরূপ দেখতে দেখতে কবির মায়াজন্ম নরম আলপনার মতো ফুরিয়ে আসে…

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4647 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

Leave a Reply to Rahul Ray Cancel reply