মহম্মদ আমিন — বৈচিত্র্যময় এক জীবন

দেবব্রত বিন্দু

 

সরল সাদাসিধে এক বৈচিত্র্যময় সংগ্রামী জীবনের অবসান ঘটল বারোই ফেব্রুয়ারি — শেষ হল মহম্মদ আমিনের কর্মময় জীবন। কারখানার এক অতি সাধারণ শ্রমিক থেকে তিনি পৌঁছতে পেরেছিলেন শ্রমিক আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে। শ্রমজীবী মানুষের প্রতি অপার ভালোবাসা, শ্রেণি সংগ্রামের প্রতি গভীর নিষ্ঠা ও আদর্শনির্ভরতা তাঁর কর্মময় জীবনের নির্দিষ্ট অভিমুখ তৈরি করতে সাহায্য করেছিল।

উত্তর প্রদেশের বারাণসী জেলায় তাঁদের বাসস্থান। তাঁর জন্মও সেখানে, ১৯২৮ সালে। নিদারুণ দারিদ্র্যের তাড়নায় তাঁর পিতা কাজের সন্ধানে অল্প বয়সে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। অর্থের অভাবে প্রথাগত শিক্ষা জোটেনি মহম্মদ আমিনের। ঠাকুরদার কাছ থেকে উর্দু শিক্ষা কিছু পেয়েছিলেন। তারপর সারাজীবন নিজের চেষ্টায় অপ্রথাগত শিক্ষায় নিজেকে উপযুক্ত করে তুলেছিলেন তিনি। উর্দু ভাষায় পরে তিনি যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। উর্দু কবিতা, শায়েরি রচনায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। মুখে মুখে তৈরি করে ফেলতে পারতেন শায়েরি। উর্দু অনুবাদ সাহিত্যেও অবদান রেখে গেছেন তিনি। তাঁর লেখা উর্দু কবিতার বই সদা-এ-বেদারি যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। বিভিন্ন মার্ক্সীয় পুস্তিকা উর্দুতে অনুবাদ করেছেন তিনি। কমিউনিস্ট ইস্তাহার তার অন্যতম। জীবনের নানান উত্থান-পতন নিয়ে রচিত জীবনের ধূপছাঁও তিনি বাংলা ও হিন্দিতে প্রকাশ করে গেছেন। বেশ কয়েকটি উপন্যাসের অনুবাদও তিনি করেছিলেন যা জনপ্রিয় হয়েছিল।

সংসারের অনটন দূর করতে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সেই তাঁকে চটকলে ঢুকিয়ে দেন তাঁর বাবা। এই চটকলেই তাঁর শ্রমিক আন্দোলনে হাতেখড়ি।

এই সময় তাঁর সঙ্গে হাফিজ জালালউদ্দিন নামে এক প্রাক্তন সেনার পরিচয় হয়, যিনি ছিলেন মার্ক্সীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত। তাঁর কাছ থেকেই মহম্মদ আমিন মার্ক্সবাদে দীক্ষিত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে শ্রমিক আন্দোলন-রাজনৈতিক আন্দোলনে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিযুক্ত করেন। এই শুরু। পরে সি.আই.টি.ইউ-র প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ধীরে ধীরে মহম্মদ আমিন শ্রমিক সংগঠনের শীর্ষপদে উন্নীত হন, এবং সি.আই.টি.ইউ-র বারোতম সম্মেলন থেকে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন।

১৯৪৬ সালে মাত্র আঠেরো বছর বয়সে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন। ১৯৫১ সালে পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রংপুরে সভা করতে গিয়ে তিনি গ্রেফতার হন। দু’বছর বন্দি থাকার পর ছাড়া পান ১৯৫৩ সালে। ১৯৫৫ সালে সদস্য হন চব্বিশ পরগণা জেলা কমিটির। ১৯৭১ সালে রাজ্য কমিটির সদস্য, ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ২০০৮ সালে নির্বাচিত হন পার্টির পলিটব্যুরোতে।

বেশ কয়েকবার তিনি বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছেন। আবার ১৯৮৮ সালে রাজ্যসভার সদস্যও নির্বাচিত হন। যুক্তফ্রন্ট সরকার ও বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীসভায় তিনি কখনও পরিবহণ দফতর, কখনও সংখ্যালঘু দফতর আবার কখনও বা শ্রম দফতরের দায়িত্ব যথেষ্ট নৈপুণ্যের সঙ্গে পরিচালনা করেছেন। তাঁর সুমিষ্ট ব্যবহার, সততা ও শিক্ষা তাঁকে শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে যেমন জনপ্রিয় করেছে তেমনি প্রশাসনেও তিনি প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। মন্ত্রী হয়েও তাঁর সরল জীবনযাত্রা থেকে তিনি এক বিন্দুও সরে দাঁড়াননি। প্রতিদিন যোগব্যায়াম ছিল তাঁর অভ্যাস। প্রয়োজন ছিল যৎসামান্য। অনায়াসে সকলের সঙ্গে মিশতে পারতেন তিনি। কথা বলা, গল্প করা, মজার মজার ছড়ায় তিনি জমিয়ে রাখতেন আড্ডা।

এমন একজন কমিউনিস্ট ব্যক্তিত্ব চলে গেলেন। রেখে গেলেন এমন এক অনুসরণযোগ্য জীবনযাপন যা মানুষের সঙ্গে মিশতে, মানুষকে বুঝতে ও মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে চলতে প্রতি মুহূর্তে আমাদের সঙ্গী হবে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4647 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...