দুমড়ানো ফুল বা তেতো চকোলেট — আরও কিছু কথা

শতাব্দী দাশ

 

শিশু যৌন নির্যাতন নিয়ে অনেক কথাই শোনা যাচ্ছে,  সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে অনেক ঘটনা জানাও যাচ্ছে। আমরা আতঙ্কিত হচ্ছি, ক্ষেপে উঠছি। সংক্ষেপে, ‘শিশু যৌন নির্যাতন’ (Child Sexual Abuse) এমন এক অপরাধমূলক ঘটনা যেখানে নির্যাতক প্রাপ্তবয়স্ক, পরিণত মানুষ ও নির্যাতিত শিশুমাত্র। ফলে, নির্যাতক বয়সের ব্যবধান, নির্যাতিতর অজ্ঞতা, পারিবারিক সম্পর্ক বা শ্রদ্ধার সম্পর্ক, নিজের সামাজিক সম্মান ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে যৌন নির্যাতন চালাতে পারে।

কখনও কখনও এই নির্যাতন হয় দীর্ঘমেয়াদী।

এরকমই বেশ কিছু ঘটনা এবং তথ্য দিয়েছিলাম ‘চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম’-এ প্রকাশিত কিছুদিন আগের একটি লেখায়পুনরুক্তিতে যাচ্ছি না, বরং আলোচনা করি তার পরবর্তী ধাপটি নিয়ে। শিরোনামের ‘আরও’ শব্দটির তাৎপর্য এটাই।

সমস্যার গুরুত্ব বোধগম্য হলে, পরবর্তী ধাপটি অবশ্যই প্রতিকার, প্রয়োজনে প্রতিরোধ। তার উপায়গুলি জেনে নেওয়া দরকার।

শিশু যৌন নির্যাতন থেকে কীভাবে সুরক্ষিত রাখবেন আপনার সন্তানকে?

অভিভাবক বা শুভাকাঙ্খী হিসেবে, দায়িত্ববান প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে এই ধরণের যৌন নির্যাতন থেকে শিশুকে বাঁচাতে কী কী করবেন? আসুন জেনে নিই। বিষয়গুলি নিয়ে আমরা পয়েন্টভিত্তিক আলোচনা করব, ফলে লেখাটিকে সামগ্রিকভাবে একটি নির্দেশিকা মনে হতে পারে। সেটাই উদ্দেশ্য।

ক) নিরাময়ের চেয়ে সতর্কতা শ্রেয়/ Prevention is Better than Cure:

  • প্রথমত শিশুকে খোলাখুলি কথা বলতে শেখান। মেলামেশার এমন পরিসর তৈরি করুন যেখানে যেকোনও জটিল প্রশ্ন নির্দ্বিধায় করা যায়। দৈনন্দিন জীবনে কোনও প্রশ্ন করা থেকে তাকে বিরত করবেন না। তাকে বোঝান, যেকোনও প্রাপ্তবয়স্ককে সে প্রশ্ন করতে পারে, বিশেষত যদি তাঁর কাজকর্ম শিশুর পক্ষে অস্বস্তিকর ঠেকে। ‘কী করছ?’, ‘কেন করছ?’, ‘মা/বাবাকে কি জিজ্ঞেস করব যে এটা করব কিনা?’ — এই সাধারণ প্রশ্নগুলি যে সে যেকোনও মানুষকেই করতে পারে, বড়দের সাথে সম্পর্ক মানেই যে নিঃশর্ত বাধ্যতার সম্পর্ক নয় — তা তাকে শেখানো জরুরি।
  • স্পষ্ট কিন্তু সরল ভাষায় তার সাথে কথা বলুন। শিশুদের আদর করার সময় অনেক ক্ষেত্রে যেমন বড়রা আধো আধো স্বরে কথা বলেন, তেমনভাবে নয়। বিষয়ের গুরুত্ব তাকে বুঝতে দিন। তার নিজের গুরুত্বও তাকে বুঝতে দিন।
  • বাড়িতে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করুন যাতে সবরকম আলোচনা শিশু আপনার সঙ্গে এবং আপনারই সঙ্গে করতে পারে। তার ছোট ছোট খারাপ লাগাগুলোও যেন সে ছোটবেলা থেকেই আপনার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে। তাহলেই বড়সড় অপমান বা নিগ্রহের কথাও বলতে পারবে প্রয়োজনে।
  • এবার, প্রয়োজন তার যৌন অঙ্গগুলি, বা যৌনভাবে বেশি ‘ভালনারেবল’ অঙ্গগুলি তাকে চেনানো। যেমন যোনি, পুরুষাঙ্গ, নিতম্ব (পায়ুদ্বার সহ), বুক, মুখ। বাংলা ভাষায় সংশ্লিষ্ট শব্দগুলি বেশিরভাগই তৎসম ও কঠিন। ইংরেজিও ব্যবহার করতে পারেন — ভ্যাজাইনা, পেনিস, বাট (এবং অ্যানাস), ব্রেস্ট/চেস্ট, মাউথ ইত্যাদি। হাত-পা-মাথা ইত্যাদি অঙ্গ যখন চেনাচ্ছেন, তখন সেভাবেই এগুলিও চিনিয়ে রাখতে পারেন। কিন্তু তাদের আলাদা গুরুত্ব পরে আবার চিহ্নিত করুন যৌন নির্যাতন সম্পর্কে সতর্ক করার প্রসঙ্গে। অঙ্গগুলি চিহ্নিত করতে অস্বচ্ছ, মনগড়া টার্ম ব্যবহার করবেন না।
  • পরের কাজ হল ‘গুড টাচ’ আর ‘ব্যাড টাচ’ বোঝানো। শিশুকে বলুন, উল্লিখিত যৌন বা ব্যক্তিগত অঙ্গগুলি শুধুমাত্র অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোকজন স্পর্শ করতে পারে (যেমন মা)। অন্য কেউ সেখানে কোনওরকমভাবে স্পর্শ করলে বাধা দিতে শেখান। ‘না’ বলতে শেখান। বোঝান যে অপরিচিত, অল্পপরিচিত ব্যক্তির দ্বারা এইসব স্থানে স্পর্শ হল ‘ব্যাড টাচ’। এমনকি পরিচিত ব্যক্তি/আত্মীয়ও কখনও কোনও অস্বস্তির কারণ হতে পারে — সেই ব্যাপারেও সতর্ক করুন।
  • বলা বাহুল্য, আসলে পিঠেও খারাপভাবে হাত রাখা সম্ভব। গুড/ব্যাডের ধারণা খানিক অ্যাবস্ট্রাক্টও বটে। কিন্তু শিশু যেহেতু বিমূর্তকে খুব ভালো বোঝে না, তাই তাকে মোটামুটি অঞ্চলভিত্তিক বা এরিয়া স্পেসিফিকভাবেই গুড/ব্যাড টাচ বোঝাতে হবে। অর্থাৎ কিছু কিছু অঙ্গে অনভিপ্রেত স্পর্শ যে ব্যাড টাচ — তা বোঝাতে হবে।
  • অন্য কারও উল্লিখিত অঙ্গগুলিতে সে নিজেও যেন স্পর্শ না করে — তাও শেখান।
  • কেউ যদি তার সামনে নিজের গোপন অঙ্গ নিয়ে কিছু করে (অর্থাৎ স্বমেহন), তাহলে সেটাও গ্রহণযোগ্য নয় — তাও বোঝান।
  • গুড টাচ/ব্যাড টাচ সংক্রান্ত শিক্ষা ও যৌনাঙ্গ নিয়ে সচেতন করার শিক্ষা দিতে গিয়ে আপনি নিজে দ্বিধা, সংকোচ ইত্যাদির সম্মুখীন হতে পারেন। সেক্ষেত্রে এই সংক্রান্ত ভিডিও দেখুন। ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করুন। প্রয়োজনে দায়িত্বশীল মনোবিদের সাহায্য নিন এটা বুঝে নিতে যে, কীভাবে এই বিষয়গুলি বাচ্চাদের বোঝাবেন।
  • শিশুকে আরও বলুন, এরকম পরিস্থিতিতে পড়লে তাকে চেঁচাতে হবে, পালাতে হবে।
  • বলুন, অবশ্যই বাড়িতে/বাড়ি ফিরে সবচেয়ে কাছের মানুষকে ঘটনাটি জানাতে হবে (যেমন মা/বাবাকে)। স্কুলে এরকম ঘটলে প্রথমে পছন্দের কোনও দায়িত্বশীল শিক্ষক/শিক্ষিকাকে জানাতে বলুন।
  • এইসব প্রশিক্ষণ মাসে অন্তত একবার পুনরাবৃত্তি করুন।
  • শিশুকে আরও শেখান যে এরকম অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটলে তার দায় কিন্তু তার নিজের নয়। এ তার লজ্জা নয় বা সে নিজে কোনওমতেই দোষী নয়।
  • শিশুকে কখনও কাউকে জড়িয়ে ধরতে, চুমু খেতে বা কারও কোলে বসতে বাধ্য করবেন না। বরং যাকে তাকে জড়িয়ে ধরতে, চুমু খেতে, যার তার কোলে বসতে বারণই করুন।
  • তাকে তার নিজের শরীরের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করুন। শেখান যে, অপছন্দের কাজে ‘না’ বলা তার অধিকার।
  • শিশু কখন কোথায় আছে, তার বন্ধু কারা, তার নিত্যদিনের কাজকর্ম কীরকম, সেসব সম্পর্কে অবহিত থাকুন।
  • সম্ভব হলে, পাড়ার, কমপ্লেক্সের, এলাকার শিশুদের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলুন। তাদের বোঝান যে একে অপরকে চোখে চোখে রাখা তাদের দায়িত্ব।
  • শিশুকে বিশ্বাস করুন, নিঃশর্তভাবেই বিশ্বাস করুন। তার মনে এই ধারণা গেঁথে দিন যে সে তার যৌন নির্যাতনের কাহিনী বলতে এলে অবিশ্বাসের সম্মুখীন হবে না।
  • কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ শিশুর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে দেখলে, খানিক সন্দেহ নিয়েই পর্যবেক্ষণ করুন। হতে পারে, সেই সন্দেহ অমূলক। কিন্তু তাদের একসঙ্গে দেখলে সতর্ক হোন, দৃষ্টি সজাগ রাখুন, অন্তত প্রথম কিছুদিন বা যতদিন না আপনি নিশ্চিত হচ্ছেন যে সেই ব্যক্তির অসদুদ্দেশ্য নেই। দেখুন, আপনার অজ্ঞাতে উপহার বা চকোলেট জাতীয় কিছু দেওয়া হচ্ছে কিনা। শিশুকে অচেনা, অল্প-চেনা মানুষের থেকে উপহার বা চকোলেট গ্রহণ করতে বারণ করুন।
  • এমার্জেন্সি টেলিফোন নম্বর ১০৯৮ শিশুকেও জানিয়ে রাখুন।
  • স্কুলে ভর্তি করার সময় যদি দেখে নেন, স্কুল প্রফেশনাল ও পারদর্শী শিক্ষক/কাউন্সিলরকে দিয়ে সেক্স-এডুকেশনের ক্লাস নেয় কিনা, তবে ভালো হয়। তেমন ব্যবস্থা না থাকলে অভিভাবকরা একত্রিত হয়ে তেমন ক্লাস নেওয়ার আর্জি জানান।
  • এইসব আবশ্যিক শিক্ষা শুরু করুন অন্তত শিশু স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই, অর্থাৎ বহির্জগতে প্রবেশ করার আগে। মোটামুটি তিন বছর বয়সের মধ্যে অবশ্যই তা করুন।
  • তবে এমনকি কয়েকমাসের শিশুর সাথেও যৌন নির্যাতন ঘটে। সুতরাং যৌনশিক্ষা দেওয়ার আগে পর্যন্ত (এবং পরেও) শিশুকে অত্যন্ত সতর্কভাবে চোখে চোখে রাখুন।
  • যদিও বলা হল যে বহির্জগতে প্রবেশ করার আগেই এসব শেখাতে হবে, তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে শিশুর যৌন নির্যাতন শুধু বহির্জগতে নয়,  ঘটতে পারে বাড়িতেও। অত্যন্ত নিকটজন, আত্মীয়-পরিজনও তা করতে পারে। আত্মীয়র দ্বারা নিগৃহীত হলে তা আত্মীয়তার সুযোগেই হতে পারে লাগাতার, দীর্ঘমেয়াদী। সুতরাং তার অভিঘাত অপরিচিত ব্যক্তির দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার থেকেও বেশি ভয়ংকর হতে পারে। সুতরাং আত্মীয়স্বজন সকলের ক্ষেত্রেই একইভাবে সতর্ক হওয়া অভ্যাস করুন।
  • শিশুপুত্রের বাবা-মা হলে নিশ্চিন্ত বোধ করার কোনও কারণ নেই। প্রতি ছ’জনে একজন ছেলে শৈশবে যৌন নির্যাতনের শিকার। তাদের প্রশিক্ষণও একইরকমভাবে হতে হবে।

খ) কী কী লক্ষণ দেখে সন্দেহ করবেন যে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকতে পারে?

এইসব করা সত্ত্বেও কোনও কারণে যদি শিশু সব কথা বলতে না পারে, তাহলেও তার সমস্যা বুঝতে পারা জরুরি। তাই চোখ কান খোলা রাখতে হবে আর সংবেদনশীল হতে হবে। বাচ্চার মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট আচরণগত পরিবর্তন বা শারীরিক লক্ষণ দেখা দিলে বোঝার চেষ্টা করুন, তা নির্যাতনের ফলে নয় তো?

  1. সে কি হঠাৎই আতঙ্কিত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, বেশি চঞ্চল বা খুব বেশি চুপচাপ, মনমরা, বন্ধুবিচ্ছিন্ন বা রাগী, আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে?
  2. আবার নতুন করে বিছানায় প্রস্রাব বা আঙুল চোষা শুরু করেছে? কথা কম বলছে বা আধো আধো কথা বলছে, তোতলাচ্ছে? অচেনা লোক দেখলে ভয় পাচ্ছে? অথবা অন্য কোনও শিশুসুলভ আচরণ করছে, যা করার বয়স সে পেরিয়ে এসেছে?
  3. কোনও পরিচিত জায়গা বা মানুষ সম্বন্ধে অকারণ ভয় পাচ্ছে? স্কুলে যেতে চাইছে না বা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে চাইছে না? অথবা কোনও গান, নাচ, আঁকার ক্লাস বা প্লে হাউজে যেতে ভয় পাচ্ছে? কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে কোথাও যেতে বললে কি নানা অজুহাতে এড়িয়ে যাচ্ছে?
  4. পড়াশুনা কি হঠাৎ খারাপ হতে আরম্ভ করেছে? স্কুল কামাই বেড়েছে?
  5. খাওয়া বেড়ে বা কমে গেছে? ওজন দ্রুত বাড়ছে বা কমছে? ঘুম আসছে না, দুঃস্বপ্ন দেখে কাঁদছে, তাড়াতাড়ি জেগে যাচ্ছে বা খুব বেশি ঘুমোচ্ছে?
  6. পোশাক ঠিকমতো পরছে না? দাঁত মাজা, স্নান করা, পরিচ্ছন্ন থাকা, ইত্যাদির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অনাগ্রহ চোখে পড়ছে?
  7. নেশা করতে শুরু করেছে বা অন্য কোনও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে?
  8. আচার ব্যবহারে অপ্রত্যাশিত যৌনতার ছাপ ফুটে উঠছে কি, যা শিশুর বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন?
  9. যৌনাঙ্গ, পায়ু বা স্তন জাতীয় অংশে কোনও ব্যথা, জ্বালা, ঘা হচ্ছে কি, অথবা সেসব জায়গায় বারবার হাত দিচ্ছে? পেচ্ছাপে জ্বালা বা ইনফেকশন হচ্ছে?

এগুলো অন্য রোগের লক্ষণও হতে পারে, কিন্তু নির্যাতনের ফলেও হতে পারে। এসব যদি হয়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে অন্য শারীরিক বা মানসিক রোগ যে নেই, সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নিন। যদি অন্য কারণ না খুঁজে পান, তাহলে শিশু বা কিশোর/কিশোরীর উপর যৌন নির্যাতন হয়েছে কিনা বোঝার চেষ্টা করুন। এমনভাবে প্রশ্ন করবেন, যাতে ভয় না পেয়ে যায়। ভালোবেসে সাহচর্য দিয়ে তাকে সহজ করার পরেও যদি সে নিজে থেকে না বলে, তবে সরাসরি প্রশ্ন করতে পারেন, কিন্তু প্রশ্ন করার সময় ক্রমাগত বাচ্চাকে অভয় দিন যে তেমন কিছু ঘটে থাকলে সে নির্ভয়ে বলতে পারে এবং তা বলার ফলে তার বা তার ঘনিষ্ঠ কারও কোনও ক্ষতি হবে না। এসব ক্ষেত্রে অভয় দেওয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে কারণ নির্যাতিতকে সম্ভবত ভয় দেখানো হয়েছে, যার ফলে সে কষ্ট গোপন করছে। 

গ) অঘটন ঘটে যাওয়ার পর:

এবার ধরুন, আপনার শিশু ইতোমধ্যেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সেক্ষেত্রে কী করবেন?

  • তার পাশে সর্বতোভাবে দাঁড়ান প্রথমে, তাকে সব কিছু খুলে বলার প্রত্যয় ও পরিসর দিন।
  • নিজে অস্থির বা আতঙ্কিত হয়ে পড়বেন না। পড়লেও তা যেন বিন্দুমাত্র ধরা না পড়ে আপনার মুখের বা শরীরের ভাষায়।
  • তাকে মন খুলে কথা বলার সময় শারীরিক সান্নিধ্য দিন। খুব উঁচুতে বা খুব দূরে বসে থাকবেন না।
  • প্রতি মুহূর্তে তাকে নিজের আচরণ ও শারীরিক ভাষা দিয়ে বোঝান যে, সবকিছু আপনাকে বলে সে ঠিক কাজই করছে এবং আপনি তার পাশে আছেন।
  • অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনুন। প্রশ্নও করুন। কিন্তু মূলত শুনুন, শুনে নিয়ে তবে প্রশ্ন করুন। তবে মাথায় রাখুন, খুব অস্বস্তিকর জেরা করবেন না। যেমন — ‘কাকু কি এইখানে ছুঁয়েছে?’ ‘কেমন করে ছুঁয়েছে?’ এরকম গ্রাফিক ডিটেল সে নিজে বললে ভালো, আপনি বলার জন্য চাপ সৃষ্টি করবেন না কৌতূহল বা আশঙ্কাবশত।
  • শিশু যা বলল, তাকেই সত্য বলে মানুন।
  • তাকে আবার মনে করান, এসব তার দোষ, দায়, লজ্জা নয়।
  • ‘কাউকে বোলো না’ — এই ধরণের অনুরোধে সম্মতি জানানোর দরকার নেই। বরং অন্য অভিভাবককে, পুলিশকে, চাইল্ড লাইনকে জানানো সমীচীন। অর্থাৎ, কোনও মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার দরকার নেই।
  • আবার এমন কাউকেও এই ঘটনার কথা বলার দরকার নেই, যিনি শিশুকে জেরা করতে পারেন, বিব্রত করতে পারেন খামোখা। সহমর্মিতার সাথে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারবেন, এমন লোকজনকেই জানানো উচিত। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, মিডিয়ার ভূমিকা সম্পর্কেও সচেতন হোন। কেউই যেন ইতোমধ্যে শারীরিক-মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিশুকে আরও বিব্রত না করে।
  • কোনওভাবে শিশুর বিচারসভা বসাবেন না সেই মুহূর্তে। ‘বারণ করেছিলাম, তাও কেন গেছিলে?’ — ইত্যাদি বলার আগে নিজেকে সংযত করুন।
  • তারপর নিজেরা স্থির করুন, আপনারা এই ঘটনা নিয়ে ঠিক কী করতে চান। ব্যক্তিটিকে মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ করবেন না পুলিশে রিপোর্ট করবেন না চাইল্ডলাইনের সাহায্য নেবেন, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিন। এসব আলোচনা শিশুর সামনে না করে নিজেরা করুন।
  • তবে, অপরাধী কোনওভাবেই কোনও শাস্তি না পেলে, এমনকি তাকে সামনাসামনি নিন্দাও না করা হলে, স্রেফ ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেওয়া হলে, শিশুটি বাবামার উপর থেকে আস্থা হারাতে পারে। মন্দ কাজ করলে শাস্তি পেতে হয় — এরকম রিট্রিবিউটিভ জাস্টিসের ধারণা দিয়ে আমরাই শিশুদের বড় করি। তার সঙ্গে অন্যায় করে কেউ সম্পূর্ণ পার পেয়ে গেল দেখলে শিশুর ভালো লাগবে না। উল্টোটা দেখলে তার মানসিক নিরাময় সহজ হবে। বাবামাকে বিশ্বাস করতে পারবে।
  • অপরাধী যদি ক্ষমা চাইতে চায়, যদি শিশুর কাছেও ক্ষমা চাইতে চায়, তাহলেও শিশু ক্ষমা করতে বাধ্য নয়। তাকে বাধ্য করবেন না এ ব্যাপারে। বরং অপরাধীর সঙ্গে তার তক্ষুনি দেখা না হওয়াই ভালো। সে আতঙ্কিত হতে পারে।
  • কোনওভাবেই অপরাধমূলক ঘটনাটিকে লঘু করবেন না।
  • নির্যাতকের অসহায়তা বা যুক্তি বোঝা আপনার কর্তব্য নয়, তা তিনি যতই নিকটজন হোন। তা বুঝতে গেলে শিশুর মনে খারাপ প্রভাবই পড়বে।
  • শিশুর শারীরিক চিকিৎসা প্রয়োজন হলে সঙ্গে সঙ্গে তা শুরু করান।
  • মনোচিকিৎসক বা মনোবিদ খুব ভেবেচিন্তে বাছুন। তাঁকে সহমর্মী হতেই হবে। তিনিও অস্বস্তিকর প্রশ্ন বা আচরণ করে শিশুটিকে আবার তার ভয়ংকর অতীতে ফেরত না পাঠান যেন (রিভিক্টিমাইজেশন যেন না হয়)।
  • শিশু যদি ধর্ষিত হয়ে থাকে, অবশ্যই পুলিশে যান। পুলিশকে এফ আই আর নিতে বাধ্য করুন। চাইল্ড লাইন, চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির সাহায্য নিন। শিশুর ডাক্তারি পরীক্ষা যাতে হয় পুলিশি তত্ত্বাবধানে, তা নিশ্চিত করুন।
  • পক্সোয় (POCSO) অবশ্যই অভিযুক্ত করুন নির্যাতককে, অন্যান্য ধারার সাথে। আইনজ্ঞের পরামর্শ নিন।
  • পক্সোয় কিন্তু ফাস্ট ট্র‍্যাক কোর্টে ইন-ক্যামেরা ট্রায়াল হয়। অর্থাৎ ভরা কোর্ট রুমে ট্রায়াল হয় না। অভিযুক্ত, অভিযোগকারী পক্ষ, উকিল, বিচারক শুধু উপস্থিত থাকেন বিচারের সময়। এরকমই হচ্ছে কিনা নিশ্চিত করুন।
  • দরকার হলে নির্যাতিত আর নির্যাতকের মধ্যে পর্দা টাঙানোর কথা বলুন ট্রায়ালের সময়, যাতে শিশু ভীত না হয়।
  • আপনি কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন — তা শিশুকে জানান। সে আস্থা ফিরে পাবে।
  • ঘটনার পর শিশু আতঙ্ক আর একাকীত্বে ভুগবে। এই সময় তাকে খেলাধুলো বা তার পছন্দের কাজের মধ্যে ফিরিয়ে আনুন (গান, ছড়া, গল্প, ছবি-আঁকা বা যা সে পছন্দ করে)।
  • ঘটনার পরে হঠাৎ অতিসতর্ক হয়ে শিশুর চলাচলের স্বাধীনতা কেড়ে নেবেন না। বরং উষ্ণ অনুভূতি ও কথা বিনিময়, হেসে জড়িয়ে ধরার মাধ্যমে বোঝান যে সে একই রকম মূল্যবান আর গুরুত্বপূর্ণ আছে।

আরও বিশদে বলা হয়ত সম্ভব। কিন্তু আপাতত একটি রূপরেখা দেওয়া গেল। আপনার শিশু ভালো থাকুক। আমাদের সকলের শিশু সুস্থ ও নিরাপদ থাকুক। এ পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব আমাদের সকলের। শুভেচ্ছা!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4651 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. খুব প্রয়োজনীয় লেখা। তথ্যসমৃদ্ধ এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য।

Leave a Reply to Koushik Dutta Cancel reply