হস্তশিল্পী

রৌহিন ব্যানার্জী

 

ব্যাগের দোকানটার সামনে বেশ ভিড়… চটের ওপর রঙিন সুতোর নকশাদার ব্যাগগুলো বেশ বাহারি… দামও এমন কিছু বেশি নয়… ফলে অনেকেই হামলে পড়েছে। গোপুও একটু উঁকি দিয়ে দেখতে গেছিল… এখন আর কিছু নেবে না যদিও। আজকের কোটা শেষ। তা উঁকি মারতে গিয়েই বিপত্তিটা হল। প্যান্টের পকেটে সুড়সুড়িটা খুব হালকা, যেন পিঁপড়ের হেঁটে যাওয়ার মতো সূক্ষ্মভাবে টের পেল গোপু। অন্য কেউ হলে পেত না… কিন্তু সে তো অন্য কেউ নয়… গোপু। ধুতি না পরে প্যান্ট পরে আসার জন্য নিজেকেই খিস্তায় গোপু… একইসঙ্গে প্রায় ততটাই সূক্ষ্মভাবে নিজের বাঁ হাতটা পকেটের কাছে তুলে আনে… আর অনুভূতিটা সরে যাবার ঠিক আগেই খপাৎ করে হাতটা ধরে ফেলে সে। হাতের মালিক একটা সিড়িঙ্গে চেহারার অল্পবয়সী ছেলে — তৈলাক্ত হাতটা হালকা মোচড়ে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলেও ছেলেটা কুম্ভক জানে না — গোপুর বজ্রমুষ্টি ছাড়ানোর সাধ্য তার নেই। কোনও কথা না বলে ছেলেটাকে টেনে ভিড় থেকে বেরিয়ে আসে গোপু। আঙুলের ঈশারায় বলে চুপ করতে। যুঝে লাভ নেই বুঝে ছেলেটা হাল ছেড়ে দিয়ে গোপুর সঙ্গে হাঁটতে থাকে।

পুবদিকের বেরোনোর গেটের পাশে একটা ফাঁকামতো তেলেভাজার দোকান দেখে ছেলেটাকে বসতে বলে গোপু… হাতটা তখনও শক্ত করে ধরা। ছেলেটা একটু ধন্দে পড়ে যায় যেন — “আপনে কি পুলিশ?”

“হতে পারি। বসো… কথা আছে…”

আর কথা না বাড়িয়ে বসে পড়ে ছেলেটা। গোপুও বসে পড়ে তার পাশে… তারপর হাতটা ছেড়ে দেয়। ছেলেটার যেন বিশ্বাস হয় না… সে হাতটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে… তারপর গোপুর দিকে — “লোক ডাকলেন না ক্যান?”

“ডাকলে কি আর কথা বলা যেত? আমার তো তোমার সাথে কথা বলা দরকার বাপু!”

“আমি কারও হয়ে কাজ করি না — একাই। কোনও দল টল কিছু নাই। মাইরি, বিশ্বাস করেন…”

“করলাম। নাম কী তোর?”

“আজ্ঞে কৌশিক…” ছেলেটা কাঁচুমাচু মুখে বলে।

“বাব্বা! এটা তোমার আসল নাম? খুব বাহার তো নামের…”

“এক্কেবারে আসল নাম… বিশ্বাস করেন। আমার আধার কার্ডও আছে এই নামে!”

এটা শুনে হাহাহাহা করে খুব একচোট হেসে নেয় গোপু। পথচলতি কয়েকজন তাকিয়ে দেখে, তারপর চলে যায়। দোকানদারও তাকাচ্ছে দেখে দুটো করে আলুর চপ আর একটা করে বেগুনি দিতে বলে গোপু — দুজনের জন্যই। তারপর জানতে চায়, “তা পদবী কী? শুধু কৌশিক দিয়ে তো আধার কার্ড হবে না!”

“আপনি কেন জানতে চাচ্ছেন কন দিকি? আপনে কি সত্যিই পুলিশ?”

“নাঃ, আমি পুলিশ টুলিশ নই,” পকেট থেকে সিগারেট আর দেশলাই বার করে ধরায় গোপু, “না বলতে চাইলে বলিস না। তবে আধারে যা আছে তা তো এমনিই সারা দেশ জেনে যাচ্ছে, আমার কাছে লুকিয়েই বা কী করবি?”

“ঘোষ। কৌশিক ঘোষ।”

“হুঁ… কুলীন কায়েৎ। ঘোষজা। তা চাকরি বাকরি কিছু জুটল না?”

“জুটছিল বটে… কিন্তু সে পাতে দেবার মতো না, বুঝলেন…” কৌশিক চোখটা মাটির দিক থেকে তুলে সোজা তাকায় এবার, “মাস গেলে পাঁচ হাজারও দেবে না, তাই নাকি চাকরি। আজকের দিনে ওইতে কী হয় বলেন?”

“তা এই লাইনে ভিড়লে কীভাবে?” গোপু হাসে, “ট্রেনিং লাগে তো!”

“তা আজ্ঞে আপনি পুলিশ হন বা না-ই হন, ট্রেনারের নাম বলা বারণ আছে। তবে ট্রেনিং হয়েছে বই কি!”

“হুম। তো কেমন ট্রেনিং দিল যে কাস্টোমার চিনতে পারো না?”

ছেলেটা জিভ কাটে এইবার, “আজ্ঞে এদিকটায় আলো কম — বুঝি নাই। আর এসব মেলায় তো সব ভদ্দরলোকেরাই আসে টাসে…”

খুব একচোট হো হো করে হাসে গোপু, “তাহলে তুমি বুঝে গেছ যে আমি ভদ্রলোক নই, তাই তো?”

“আজ্ঞে ঠিক তা বলি নাই,” কৌশিকও একটু ফিক করে হেসে ফেলে এবার, “মানে এই যে আপনে আমারে ধরে ফেললেন, এটা তো কোনও শহুরে বাবুর কম্ম নয়… অবশ্য আপনে সত্যিই পুলিশ হলে হয়তো…”

“বললাম তো আমি পুলিশ টুলিশ নই,” গোপু তেলেভাজা শেষ করে হাত মোছে রুমালে, “সত্যি পুলিশের বয়ে গেছে তোকে এখানে বসিয়ে তেলেভাজা খাওয়াতে…”

“হুঁ, সে আমি জানি,” কৌশিক এবার একটু শ্লেষের গলায় বলে ওঠে, “তবে কিনা, ইনফর্মেশন বার করার জন্য…”

“ওরে আমার মানিকচাঁদ রে” গোপু ওকে থামিয়ে দেয়, “কত ইনফর্মেশন আছে তোর কাছে? এই তেলেভাজার দাম উঠবে না তো। পুলিশ জানে কার কাছে ইনফর্মেশন থাকে আর কার কাছে থাকে না!”

“তা হবে,” কৌশিকও এবারে খাওয়া শেষ করে হাত মোছে, “তা আমারে নিয়ে এখন কী করবেন আপনে?”

“আমি আবার কী করব?” গোপু চোখ ওল্টায়। “আমি তো কথাবার্তা বলার জন্য ধরে নিয়ে এলাম। সন্ধে থেকে একা একা ঘুরে একদম বোর হচ্ছিলাম। তোমার যদি ইচ্ছা না করে তো চলে যাও…”

“চলে আর কই যাব? প্ল্যান ছিল আরও ঘণ্টাখানেক অপারেশান চালাব, তারপর কাটব… কিন্তু আপনে যা করলেন, আমার কনফিডেন্সটাই মাটি হইয়া গেল গা…” কৌশিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, “আজ আর হবে না কিছু…”

“চোপ শালা অপদার্থ!” গোপু ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “বুড়ো আঙুল ইউজ করতে শেখোনি, তোমার পাবলিক ধোলাই খাওয়াই উচিৎ! প্র্যাকটিস করিস না কেন?”

কৌশিকের চোখগুলো একটু গোল গোল হয়, “আপনে…”

“এখানে কেন এলি হঠাৎ?” ওকে শেষ করতে না দিয়েই বলে ওঠে গোপু, “কলকাতার মেলায় তো ব্যবসাও বেশি, রিস্কও কম…”

“যাব,” কৌশিক হাসে, “তবে এই মেলাটা ছাড়ি কী করে… এ তো আমাদেরই মেলা!”

“মানে?” গোপু এবারে একটু অবাক হয়…

“মানে আমরা তো হস্তশিল্পী — হাতের কাজ করি…” এবারে একগাল হাসে কৌশিক, “হস্তশিল্প মেলাই তো আমাদের মেলা। আজকাল সব মেশিনে কাজ করা কারিগরেরাও ‘হস্তশিল্প’ বলে বসে যায়!”

“এটা ভালো বলেছিস তো!” একগাল হাসে গোপু, “একদম ঠিক। হস্তশিল্পীই তো। এরা আজকাল সরকারি দাক্ষিণ্য পাওয়ার জন্য সবকিছুকেই হস্তশিল্প বলে চালায়… আরে ভাই তাঁত আর হাত কি এক হল?”

“একটা কথা জিগাই?”

“আবার কী কথা?”

“মানে, ইয়ে… আপনেও কি হস্তশিল্পী?”

চোখটা সরু করে ছেলেটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে গোপু। কথাটা বলে ফেলে কৌশিকও একটু অপ্রস্তুত বোধ করে কিন্তু প্রাথমিক ঘাবড়ানো ভাবটা কাটিয়ে উঠে সে-ও এখন কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ ওকে নজর করে হেসে ফেলে গোপু… তারপর উঠে পড়ে… “চল”…

“আবার কই যাবেন?”

“এখানে আর কতক্ষণ বসে থাকব? আমি আমার আস্তানায় ফিরব… তুই কোথায় যাবি?”

“তাহলে আমার প্রশ্নের জবাব দেবেন না… তাই তো?”

“ডেঁপোমি একদম করবি না,” গোপু ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “প্রশ্নের জবাব দেবেন না — ন্যাকাষষ্ঠী। শোন, আমিও হস্তশিল্পীই ছিলাম বটে, কিন্তু তোর মতো না। আমাকে লোকে বাজিকর বলে…”

“তাই বলেন,” কৌশিক এবারে একটু হাসে — “আমার গুরুকেও…”

“হারু। হরেন ঘোষ। তুইও ঘোষ… দাঁড়া দাঁড়া, তুই হারুর ছেলে নাকি?”

এবারে আবার সেই প্রথমের মতোই ঘাবড়ে যায় কৌশিক, এ লোকটা কি আসল জাদুকর নাকি! সে আবার তুতলে যায়, “আ-আপনে কেমন করে…”

“হারু আর আমি একসাথে বিদ্যে শিখেছি রে…” গোপু এবার ওর কাঁধে একটা হাত রাখে, “হারুর এই কারবার আমার জানা। কিন্তু তুই যে ওরই কাছে শিখেছিস তা বুঝিনি। প্র্যাকটিস করো না বাবা?”

“করি…” কৌশিক বিষণ্ণ গলায় বলে, “কিন্তু…।” তারপর হঠাৎ বলে ওঠে, “কিন্তু আপনে এই খারাপ কাজে আপত্তি করেন না ক্যান? বাবাকে মানা করেন না ক্যান?”

“কোনটা খারাপ কাজ?” গোপু অবাক হয়ে বলে, “তোর এই বিদ্যে খারাপ, কে বলেছে?”

“যাব্বাবা, সবাই তো বলে, ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি চুরি চামারি পকেটমারি খারাপ কাজ!”

“তাহলে তোর বাবা এসব শেখায় কেন?”

“বাবা পাগল। বাবা বলে সবাই তো নিজের নিজের কাজের ট্রেনিং নেয়, তারপর সেটার জোরে অন্যের কাছ থেকে টাকা নেয়, তোরাও ট্রেনিং নিয়ে রোজগার করবি, অসুবিধা কী আছে?”

“আমারও তো সেই প্রশ্ন — কী অসুবিধা?”

“মানেটা কী? এই যে আমরা লোকের পকেট মারি, তার ক্ষতি তো। এ কি ঠিক কাজ?”

“কার পকেট মারিস তোরা?”

“এই মেলায় বা ভিড়ের বাসে যাতায়াত করা লোকজনের…”

“বাসটা ছেড়ে দে…”

“হুঁ, দিয়েইছি।” আরও একবার গোপুর এই দৈববাণীর মতো কথায় মনে মনে চমকায় কৌশিক, “বাবা বারণ করে। বলে বাসে পয়সা কম, রিস্ক বেশি।”

“ঠিক কথা। ব্যবসার নিয়মই হল কম রিস্কে বেশি ইনকাম…” গোপু হাসে।

“কিন্তু তাতে কী হল?” কৌশিক ঝাঁঝিয়ে ওঠে একটু, “কাজটা তো আর ভালো হয়ে গেল না…”

“কে বলে?” গোপুও ধমকায় পালটা, “তাতেই তো সব হল। যেই তোর টার্গেট কাস্টোমার পালটে গেল, অমনি পাপও ধুয়ে গেল…”

“সে আবার কী করে?” কৌশিক ভাবে এই লোকটা তার বাবার চেয়েও বেশি খ্যাপাটে নাকি!

“বুঝলি না কেনে? তুই যাদের পকেট এখন মারছিস, তারা ওই টাকাটা ওড়াতেই এসেছে — হস্তশিল্প কিনবে, এদিকে কলে বোনা কাপড় আর হাতে বোনা কাপড়ের তফাৎ বোঝে না। তো তাদের হস্তশিল্প দেখিয়ে তুই যা কামাচ্ছিস, ওই যারা ওদের কলের জিনিসকে হাতে বোনা বলে বিক্রি করছে, তাদের থেকে তোর কামাই বেশি সৎ তো। আর যাদের পকেট থেকে নিচ্ছিস, তারা কে কীভাবে কামায় জানলে আর এসব ভাববি না…” এবার ওকে ঘুরিয়ে দাঁড় করায় গোপু, “এবারে বল তো, প্র্যাকটিস করেও হাতের এই দশা কেন?”

মাটির দিকে চোখ নেমে যায় ছেলেটার, “কারণ বুড়ো আঙুলের ইউজ আমি শিখতে পারিনি…”

“কেন?”

“বাবার হাতটা কেটে দিয়েছে ওরা… তিন বছর হল…” খুব নিরাসক্ত গলায় বলে কৌশিক, “এখন শুধু কনুই অবধি…”

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে গোপু। অনেকক্ষণ। তারপর কৌশিকের পাশে হাঁটতে শুরু করে — “চল, আজ তোদের বাসায় যাব আমি…”

বাসস্ট্যান্ডে এখন কোনও বাস নেই। মেলা ফেরত লোকজন বেশিরভাগই স্থানীয়, বাসে ওঠার লোক খুব কম। বাসটা কখন আসবে, সেই অপেক্ষায় পাশাপাশি বসে থাকে দুই হস্তশিল্পী।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

Leave a Reply to Prativa sarker Cancel reply