রামনবমীর মাসখানেক…

অতনুপ্রজ্ঞান বন্দ্যোপাধ্যায়

 

রামনবমীর মিছিলের পর থেকে, প্রায় গত মাস দেড়েক কেটে গেল। প্রথমদিকে রাজ্যের রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ, অফিস কাছারির মতো ফেসবুকের দেওয়ালও বেশ উত্তপ্ত ছিল। সে আঁচ বেশ কম এখন। তবে এই তালে দেখলাম কী সহজে মানুষ নিজেদের ‘বিশেষ কোনও একটি পক্ষে’ দলভুক্ত করে নিয়েছে। কিংবা লুকোনো ‘গোষ্ঠীবদ্ধতার’ মানসিকতাগুলো এই বেলা বেড়িয়ে পড়েছে ঝুলির আড়াল সরিয়ে।

রামনবমীর আগে ও পরে আমার আশপাশের বহু মানুষের সঙ্গে (যারা মোটামুটি আমার সহকর্মী বেশিরভাগ) কথা বলেছিলাম। হিন্দু ধর্মে জন্মানো শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত তরুণ তরুণীদের সমর্থন ও তার যুক্তিগুলোকে অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম। ক্রমাগত সংখ্যালঘুদের প্রতি নানা রাজনৈতিক আফিমসদৃশ তোষণ, তিন তালাকের মতো পাকিস্তান-বাংলাদেশের মতো মুসলিম রাষ্ট্র বিবর্জিত নীতিকে এ রাজ্যে সমর্থন, সীমান্ত দিয়ে অবাধে বাংলাদেশ থেকে দুষ্কৃতী ঢুকে শহরে নানা চুরি ডাকাতি সত্ত্বেও অবাধে সীমান্ত অনুপ্রবেশ, বিভিন্ন মাদ্রাসার নাম খবরের কাগজে উঠে আসা নাশকতার আখড়া হিসেবে, এই বাংলার স্কুলে সরস্বতী পুজো বন্ধ করে দেওয়া, ধর্মগ্রন্থের দিক মেনে সরকারি স্কুলের বাথরুম ভেঙে আবার গড়া… আর দেখেশুনে এসব যখন সরকারের ধৃতরাষ্ট্রসুলভ ‘ও কিছু নয়, সামান্য ব্যাপার’ বলে পাশ কাটানোটা ‘হ্যাবিট’ হয়ে যায়, তখন যে মনে মনে বিশাল সংখ্যার একটা মানুষ ফুঁসে উঠবে এটাই হয়তো স্বাভাবিক ছিল। রামনবমীকে সমর্থন করার পেছনে আরও অনেক কারণের সঙ্গে এই কারণগুলোও দায়ী, আমার আশপাশের ও সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে, ভেবে বুঝতে পারছিলাম। সেসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে লিখতে শুরু করতেই দেখলাম লেখাগুলো ‘স্ট্যাম্পড’ হয়ে যাচ্ছে। যারা রামনবমীর সাফল্য নিয়ে উল্লসিত, তারা নিজেদের মতো করে ভেবে নিচ্ছে, যারা মুসলিম ধর্মাবলম্বী তারা তীব্র ‘বিদ্বেষ’ উগড়ে দিচ্ছে, যারা বামপন্থী বা স্বঘোষিত সেকুলার, তারা দ্বেষমূলক বিরোধিতায় মশগুল হয়ে উঠেছে। অথচ, রামনবমীর মতো প্রায় নতুন একটি ইভেন্ট ঘিরে এই ২০১৭-তে হিন্দু বাঙালিদের বৃহৎ অংশ ‘কেন এমন ভাবছে’ সে নিয়ে বিন্দুমাত্র এমপ্যাথিও দেখতে পেলাম না সেই বিরোধিতায়! বরং নানা স্বঘোষিত ‘সেকুলার’ কথাবার্তায়, লেখালেখিতে এই ভাবনাই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল, “এই বিশাল সংখ্যক মানুষগুলো নিতান্ত গোমূর্খ, অশিক্ষিত, ইতিহাস না পড়া, সাম্প্রদায়িক ধিক্‌ জনগণ”!

সিরিয়াসলি বলছি, আমার তথাকথিত বন্ধুরা, যাদের ‘উদার’, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’, ‘প্রকৃত শিক্ষিত’ বলে মনে করতাম, তাদের ‘অ্যাটিটিউড’ নিতান্তই অপোজিট দেখে তাদের শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞানগম্যির প্রতি শ্রদ্ধা হারালাম! প্রশ্ন জাগছিল, যে ‘শিক্ষাদীক্ষা’ সমস্যা থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়, ‘সমাধান’ বা ‘রুট কজ্‌’ না ভেবে শুধু তর্ক করতে শেখায়, মতে বিপরীত হলেই ‘তাচ্ছিল্য’ করতে শেখায় তা কি আদৌ ‘প্রকৃত’ শিক্ষা? আমি তো শিখে এসেছি ‘প্রকৃত শিক্ষা’ মানুষের ভেতরে ডুব দিতে শেখায়, মানুষগুলোর মনে কী এবং কেন চলছে তা নিয়ে অনুভব করতে শেখায়, শুধু শুষ্ক পুঁথি পড়ে উগড়ানো তো টিচিং নয়, বড়জোর ‘প্রীচিং’! বুঝে গেলাম, ‘বুদ্ধিজীবী’, ‘সেকুলার’ মানে যদি দিস্তা দিস্তা বিশ্ববিদ্যালয় মার্কা পুঁথিপত্র পড়ে ‘বিতর্কের’ মেজাজে ফেসবুক পাড়ায় বিরোধীদের ‘টিজ্‌’ কাটা হয়, ও আমার পোষাবে না! আরও অবাক হলাম পরিচিত কিছু বন্ধুবান্ধবের অদ্ভুত একটা ‘কথায়’, আমার এই ধরনের পোস্ট নাকি আমি কোনও ‘রাজনৈতিক দলের দ্বারা’ ব্যবহৃত হয়ে লিখছি!! কেউ নাকি টাকা দিয়েছে!!

বুলশিট!

লেখালেখিতে এক পয়সা প্রত্যাশা করে কলম ধরিনি কখনও, আশা করি ধরবোও না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২ ঘণ্টা সম্পূর্ণ বিপরীত একটি পেশায় যথেষ্ট ভালোবেসে ডেডিকেটেড জীবন কাটিয়ে, একবিন্দু ফাঁকি না মেরে মাঝরাতে লিখতে বসি। এই সময়টুকু আমার কাছে ‘পুজো’। লেখালেখি করে সমাজ পালটে ফেলার কথা ভাবি না। পৃথিবীতে ভালো ভালো বহু লেখা হয়ে গিয়েছে। তার জন্য সমাজ যে কতটা পাল্টেছে কে জানে! কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার লিখতে খুব ভালো লাগে, আনন্দ পাই তাই লিখি, লিখবও। পাঠক যদি আমার লেখা না পড়েন, তাও লিখব, যদি অনেক পড়েন, তাও লিখব। তবে এ কথা স্বীকার করে নিচ্ছি, আমার কোনও লেখা পড়ে পাঠকের জীবনে এক চুলও যদি অনুপ্রেরণা, অনুভব, ভালোলাগা, ভালোবাসার অনুভব চুঁইয়ে যায়, তবে তার চেয়ে বেশি আনন্দ আর কোনও কিছুতেই পাব না।

কিন্তু যেসব পরিচিত বা ‘বন্ধু’রা ‘ভাবতেও’ পেরেছিল যে একটি রাজনৈতিক দল আমাকে টাকা দিয়ে লেখাচ্ছে, তারা যে একেবারেই বন্ধু নয়, সেদিনই বুঝেছিলাম। তারা কিন্তু এ নিয়ে কেউ ‘চ্যাটে’ বা ‘ফোন করে’ কথা বলেনি, বরং দেখছিলাম ‘ফেসবুকে’ গোষ্ঠীবদ্ধতায় মেতেছে!

অথচ আমার পক্ষে কোনও একটি গোষ্ঠীর পক্ষ নিয়ে লেখা সম্ভবই ছিল না। এমন মানুষ নইই যে! তবে এও সত্যি, ব্যক্তিগতভাবে চাই রাজনৈতিক মুখের বার বার পরিবর্তন, আজ সিপিএম তো কাল তৃণমূল, তো পরশু বিজেপি, তো তরশু আরও অন্য কেউ যদি মাথা তুলতে পারে… এবং র‍্যান্ডম রিসাইক্লিং! অ্যাজেন্ডা নিয়ে মাথার চুল না ছিঁড়ে তারা অবজেক্টিভলি “কি করছে” তাকেই অবজার্ভ করা। এখানে মুখে মারিতং বিশ্ব রাজনীতির আঙিনায় ‘বক্তিমে’ যতটা হয়, “কাজের কাজ” হয় সিকিভাগ। কাজেই বার বার রাজনৈতিক দলের মুখ বদলে “কাজের গতিতে” প্রতিযোগিতা আনায় তীব্রভাবে বিশ্বাস করি।

যাই হোক, রামনবমীর সাপোর্টে থাকা হিন্দুদের নিয়ে কিছু লেখালেখির পরে, যখন রাজনীতির ও ধার্মিক নেতাদের প্যাঁচে পড়া মুসলিম জনজীবনের হাঁসফাঁসের অবস্থা লিখলাম, এবং এই সাধারণ মুসলিমের প্রতি এই বাংলায় হঠাৎ করে জেগে ওঠা তীব্র বিদ্বেষের তীব্র বিরোধিতায় কিছু কথা লিখলাম, দেখলাম না কোনও ‘তথাকথিত সেকুলার’ কলম এসে পাশে দাঁড়িয়েছে, যারা একসময় ‘অনেক অনেক সেকুলারিজম্‌ ভাটিয়ে অপমান করতে এসেছিল’! দেখলাম না কোনও মুসলিম ধর্মের বন্ধুকে এগিয়ে এসে কথা বলতে, যারা রামনবমী সংক্রান্ত পোস্টের পর ইনবক্সে বা দেওয়ালে ঘুরিয়ে ঘারিয়ে বলতে চাইছিল, ‘ইসলামের পেছনে পড়ে গেছ তুমি’!

যখন নিজের মতো করে ‘ধর্ম’ শব্দটি আমার জীবনে জড়িয়ে আছে লিখলাম, আমার ‘আস্তিক’ চেতনাকে বলতে চাইলাম, বলতে চাইলাম ‘ধার্মিক’ মানে যদি ধর্মের গোঁড়া দিকগুলো আঁকড়ে, ধর্মকে যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ না করে জোরজবস্তি ‘বিশ্বাস’-কে বোঝায়, প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিতে গালাগালি আর অশ্রাব্য ভাষা প্রয়োগ করা হয়, ও আমার চলবে না; শাস্ত্রব্যাখ্যার ‘ধার্মিক’ হয়ে গণেশের গলায় হাতির মাথাকে সেই আমলের ‘প্লাস্টিক সার্জারি’ বা রামায়ণের পুষ্পক রথকে ‘দ্রোণ’-এর ‘উদাহরণ’ বলতে পারব না; বরং এই ভেবে গর্বিত হব, এত শতাব্দী আগেও লেখকের ‘কল্পনা’ কী অসম্ভব রকমের শক্তিশালী ছিল যে এসব নানা ‘কনসেপ্ট’ ভাবতে পেরেছিল, যা এই যুগে ‘বিজ্ঞান’ ইমপ্লিমেন্ট করে দিচ্ছে; কিংবা ‘গাভী আমাদের মা’ বাক্যটিকে কোনও ধার্মিকতার চশমায় না দেখে গাভী ‘কেন মা হয়ে উঠল’ তার সোশিওলজি বা ইতিহাস জানব আর সেই মতো ভারতের বিশাল সংখ্যক এক্সিস্টিং গরু যাদের সঠিকভাবে পরিচর্যা ও পরিকাঠামোতে কেয়ার দিয়ে কোয়ালিটি দুধ, মেডিসিনের ‘র’ প্রোডাক্ট বা শেষে গিয়ে চামড়া… ইত্যাদি বাইপ্রোডাক্ট তৈরি স্ট্রাকচারড উদ্যোগে আনা যায়, তার সমর্থন জানাব… তখনও কিন্তু দেখতে পেলাম না আমার পুরনো সব ‘বন্ধুকে’!

এই পর্যন্ত পড়ে আবার ভাববেন না ‘বন্ধু’দের আসা খুব ‘এক্সপেক্ট’ করছিলাম! ব্যাপারটা আদৌ ‘এক্সপেক্টেশনের’ নয়… ‘অবজার্ভেশনের’। কারা কিরকম ‘আসলে’ ভাবে সেটা জেনে বুঝে নেওয়া।

হতে পারে, তারা হয়তো কনফিউজড, কোন ‘গ্রুপে’ ফেলবে আমাকে! অর্থাৎ কোনও একটা গ্রুপে না ফেলতে পারলে ঠিক মতো ‘জাজ’ করা যায় না মানুষকে যে! আশ্চর্য্য!

…অথচ আমার জীবনে এইটাই চরম সত্যি যে, আমি কোনও ‘গ্রুপ’-এ আটকে পড়ার মানুষ কোনওদিনই নই!

আমি পাড়া, স্কুল, কলেজ, রাজনৈতিক দল, পরিচিত মানুষ তো ছেড়েই দিন, চাকরির জগৎ অফিসেও কোনওদিন ‘গ্রুপিজম’-এ নাম লেখাতে পারিনি (যেখানে গ্রুপিজম হল টিকে থাকার একটি মাপকাঠি!), দলবদ্ধ হয়ে মানিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন এলেই হাঁসফাঁস টের পেয়েছি। এই ফেসবুকে বন্ধুবৃত্তে আমার অফিস, স্কুল কলেজ সবাই আছে, এসব অন-রেকর্ড বলছি। তৈলমর্দন কিংবা গোষ্ঠীবদ্ধতার খেলায় কোথাও কোনওদিনই অংশ নিতে পারিনি। পরিবারেও পারি না। রাজনীতির খেলাটা, দলে বলের ক্যালকুলেশনটা আসে না একেবারেই। বন্ধুতা তো ‘ভালোবাসা’, এর মধ্যে যখনই ‘দলবদ্ধতা’র সমীকরণ হাত বাড়াবে তখন ভালোবাসা থোড়াই থাকে? থাকে শুধু ‘ক্ষমতা’ দখল বা জিইয়ে রাখার কমন স্বার্থ! এমন সব ‘বন্ধু’ চাই না যে!

দরকার নেই বুঝলেন, গোষ্ঠীবদ্ধ গলাবাজি কিংবা দলবাজি, বা আপোষের ‘ইগোসেন্ট্রিক’ বন্ধুত্ব। এর চেয়ে একা একা নিভৃত জীবন অনেক আরাম। যদি কেউ বা কারা সত্যিই অনুভব করে, বন্ধু হবে, আর যারা হবার নয়, তারা দূরে সরে যাবে। …

ভালো লাগে, যখন, বাইরের অকারণ নানা কোলাহলে, হা হা হি হি হাসিতে, অনেক অনেক ফাঁপানো ফোলানো তাচ্ছিল্য কিংবা নাটুকে ওপরচালাকি আড্ডার ফাঁকে নিজের মতো করে ‘ভেতরে ভেতরে’ একা হয়ে গিয়ে নিজের মধ্যে হারিয়ে যাই, ঘুরতে বেরোই সেই আগের মতো, অনেক ছোটবেলার মতো; সেই কয়েকটা বই, কাঁধে ব্যাগ, সাইকেল নিয়ে একা একা ঘুরে বেড়ানো; একটু বড় হলে অনেক অনেক মানুষের কথা শোনা, তাদের গল্প জানা, তাদের ভেতরের পৃথিবীটা অনুভব করা; না সেসব জেনে ‘গল্প টোকা’ নয়, বরং অন্য মানুষের অনুভবগুলোকে কিছুটা হলেও ছুঁয়ে যাওয়া; এমন অনুভবে যে কী আনন্দ এ যারা এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়, তারা জানেই! কিন্তু দেখেছি, গোষ্ঠীবদ্ধতা, দলবদ্ধতা এসব জোরজবস্তি ব্যাপারগুলো এই ‘ভেতর ভেতর’ একাকী জীবনের পক্ষে বড্ড ভারী! কদিনই বা বাঁচব আর! নিজের মতো করে বাঁচাই ভালো। তাই না?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. একটা ভালো লেখা হতে পারত। হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে কেন সাম্প্রদায়িক মনোভাব তৈরি হচ্ছে, তার একটা উত্তর খোঁজার চেষ্টা… সে ভুলভাল বা পক্ষপাতদুষ্ট হলেও। তার বদলে লেখক আত্মবিলাপ এবং আত্মপ্রচারে মেতে উঠলেন। ভালো লাগল না….

Leave a Reply to ক.ব. Cancel reply