সমতা বিশ্বাস
১৯৯০ বা ৯১ সাল, ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়ি আমি, মাঝেমাঝেই সকালবেলার সমবেত সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া হত ‘জয়ধ্বনি করো সবে তাঁর’। আমাদের মিশনারি স্কুলে রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে শুরু করে জাতীয়তাবোধক গান ও নানারকম স্বল্পপরিচিত খ্রিস্টান গানের রেওয়াজ ছিল। বোঝাই যাচ্ছে এসব গানের বুলি কাউকে শেখানো হত না। ছোটবেলা থেকে আশেপাশের মানুষের অনুকরণ করতে করতে ক্লাস ফাইভ সিক্সের মধ্যে গোটা পঞ্চাশেক গান সকলেই শিখে যেতেন। টু বা থ্রিতে আমিও অন্যদের শোনাশুনি গাইতাম,
‘জয়ধ্বনি করো সবে তাঁর
সুভাষ ঘিসিং সবাকার’
বছর দশেক বাদে বুঝতে পারি দ্বিতীয় পঙক্তিটি হল: ‘শুভার্থী যিনি সবাকার’। কিন্তু সেই সময়, প্রায় প্রতিদিন সংবাদপত্রে পড়া সুভাষ ঘিসিং-এর নাম স্কুলে কেন গাওয়া হচ্ছে, তা বুঝতে পারতাম না। আশেপাশের অন্যরাই বা কেন এ বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করছেন না, তাও বোধগম্য হত না।
এই কিছুটা লম্বা ও লজ্জাজনক ভূমিকার অবতারণা কেন? ঠিক এই সময়েই No Path in Darjeeling is Straight-এর লেখক পরিমল ভট্টাচার্য যোগ দেন দার্জিলিং সরকারি মহাবিদ্যালয়ের ইংরাজির অধ্যাপক হিসেবে, আপাত স্তিমিত গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন ও সুভাষ ঘিসিঙের লম্বা ছায়ায় অবস্থিত দার্জিলিং শহরের সাথে তাঁর প্রথম প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। প্রত্যক্ষ কারণ, যেমন পরিমল বারবার, অত্যন্ত সাবলীলভাবে দেখান— দক্ষিণবঙ্গের বাঙালির কাছে দার্জিলিং যাত্রাই একমাত্র যোগাযোগের অবকাশ নয়, পরিমলের দাদামশায়ের সরকারি ভ্রমণ থেকে সত্যজিত রায়ের ছবি, দার্জিলিঙে একাধারে নানারকম রোমান্স ও নস্টালজিয়ার অবস্থান (যা একে অপরের ধারক ও বাহক)। এবং ঠিক এইখানেই পরিমলের লেখার ভঙ্গি ও ও বিষয়বস্তু ব্যতিক্রম: যদিও বইয়ের গৌণনাম হল, Memories of a Hill Town, স্মৃতি শব্দটাকে একান্ত ব্যাক্তিগতভাবে ব্যবহার না করে, তাঁর দার্জিলিং বাসের (এ ক্ষেত্রে ইংরিজি sojourn শব্দটা মনে হয় অনেক বেশি যথাযথ হবে) অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণাই শুধু করছেন না, বিশেষ কিছু ঘটনা বা অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে দার্জিলিং এলাকার জনজীবন, ঔপনিবেশিক ইতিহাস, বিগত কিছু দশকের রাজনীতি, শহরের গঠন ও তার পিছনে লুকিয়ে থাকা শ্রমের অভিবাসনের জটিল গতিপথ, সাম্প্রতিক নেপালি সাহিত্য থেকে অতিসাম্প্রতিক যুবসংস্কৃতি— সবেতে তাঁর সুগম ও অনায়াস আসা যাওয়ার স্বাক্ষর রাখছেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের ব্রিটিশ পুরুষদের চিঠি থেকে সেনাবাহিনীর নথি, চওড়া রাস্তা থেকে বেরিয়ে আসা অলি গলি (স্থানীয় ভাষায় যার নাম চোর বাটর), চা শিল্প ও তার সাথে জড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক পরিবর্তন, কাঞ্চনজঙ্ঘা ও আশেপাশের নিসর্গ, কিছুই বাদ পড়েনি।
No Path in Darjeeling is Straight
পরিমল ভট্টাচার্য
প্রকাশক- স্পিকিং টাইগার। ২০১৭। দাম- ৪৫০/-
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, আমি কোনওদিন দার্জিলিং যাইনি। তাই দার্জিলিং সম্বন্ধে যা কিছু স্মৃতিমেদুরতা আমার, তার পুরোটাই ধার করা। অনেকটা লেখকের চাকরি শুরুর মুহূর্তের সাথে তাঁর দাদুর দার্জিলিং বাসের স্মৃতির overlapping-এর মতন। কিন্তু ইংরিজি নস্টালজিয়া শব্দটা, যা প্রায় দার্জিলিঙের কুয়াশার মতো এই শৈল শহর সম্বন্ধিত সবরকমের আখ্যানের মূল উপাদান— আসলে লেখকের স্মৃতিকথার প্রাথমিক উপকরণ নয়। বরঞ্চ, এবং সে কারণেই এই স্মৃতিকথা এত উপাদেয়, লেখক নস্টালজিয়ার মোড়ক পরতে পরতে ছাড়াতে ছাড়াতে পাঠককে মনে করিয়ে দেন (এবং আনকোরা পাঠককে জানান) বিশ্ববিখ্যাত দার্জিলিং চায়ের সাথে চা-শ্রমিকদের কথা, কীভাবে জনবসতি গড়ে ওঠে দার্জিলিঙের আশেপাশে, সিকিম-রাজের সাথে ব্রিটিশদের চুক্তি, রেল লাইন, স্যানাটরিয়াম ও দার্জিলিং শহরের উচ্চ ও নিম্নবিত্তের মধ্যে এলাকার ব্যবধান। এই মোড়ক উন্মোচন করতে গিয়ে পরিমল সাহায্য নেন এক বিশাল চেনা-অচেনা, সহজলভ্য ও দুষ্প্রাপ্য আর্কাইভের: লর্ড লিটনের ভারত শাসনের ইতিহাস (১৮৯৯), ইন্দ্র বাহাদুর রাইয়ের ছোটগল্প (১৯৯৯), বেঙ্গল ডিসট্রিক্ট গেজেট, ফ্রেড পিন সম্পাদিত দার্জিলিং বিষয়ক চিঠিচাপাটি, দ্বিতীয় দফার গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় তৈরি স্থানীয় গান, জীববিশারদ ও কনজারভেশনিস্টের জীবনকাহিনী, লরেটো হাউস কলেজের প্রধানা শিক্ষিকার স্মৃতিচারণা, লেপচা জাতি গোষ্ঠী সম্পর্কে নৃতাত্ত্বিক লেখাপত্তর— লোকগান, গল্প, পুরনো সাদা কালো ছবি, পত্রপত্রিকার খবর ও বিজ্ঞাপন— ঠিক যেমনভাবে পরিমল স্মৃতি, ইতিহাস, লোককথাকে তাঁর অনবদ্য লেখনশৈলীর মাধ্যমে মেশাতে পেরেছেন, আর্কাইভের এই সুচিন্তিত এবং একলেকটিক ব্যবহার তাঁর স্মৃতিকথাকে করে তুলেছে দার্জিলিং বিষয়ক একটি প্রামাণ্য নথি।
ব্রিটিশ গবেষক জুলিয়ার সাথে আলাপচারিতা প্রসঙ্গে ক্রমশ উঠে আসে লেপচা জনজাতির ইতিহাস, তাঁদের ক্রমবিলুপ্তপ্রায় ও জটিল ভাষা— লোকচক্ষুর অন্তরালে অবস্থিত একটি বিশেষ লেপচা গোষ্ঠীর সন্ধানে যাত্রা করেন ঐ গবেষক, এই লেখকও ছাত্রস্থানীয় জীববিশারদ, ব্যর্থ এই যাত্রার বিবরণে মিলেমিশে যায় নতুন মানুষ, একটা ছাতা, হ্যালির ধূমকেতু, গাছপালা ও গল্পকথা— গ্রন্থনার বুনোট কখনও শিথিল হয় না, সমাজবিজ্ঞান থেকে সাহিত্য, নানা ধরনের ভাষ্যে পরিমল সমান দক্ষ।
দাদুর কাছ থেকে ধার নেওয়া, মধ্যবিত্ত বাঙালির সমষ্টিগত স্মৃতিমেদুরতাকে দূরে সরিয়ে, পরিমল দেখান পরিকল্পনামাফিক তৈরি শৈলশহরের মধ্যে আঁকাবাঁকা চোর বাটরের অনিবার্য উপস্থিতি, ক্রমবর্ধমান পর্যটনের সাথে ক্রমসঙ্কুচিত জীবজগৎ, ১০০ কর্মচারী সম্বলিত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকের সাথে অভিবাসী শ্রমিকের সহাবস্থান। দার্জিলিঙের চেনা ছবিটাকে মুছে দিতে দিতে পরিমল তুলে ধরেন আরেক দার্জিলিংকে, কসমোপলিটান এক শহর যেখানে একাধিক জাতি, গোষ্ঠী, উপজাতির সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে অপেক্ষাকৃত উদারচেতা ও অনন্য এক সমাজ।
সেই ভালোবাসার শহরেই লেখক যখন ফিরে যান ২০০৬ সালে, জি জে এমের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে নির্ধারিত দার্জিলিং জনজীবন ও রাজনীতিতে, তা যেন আরেকবার নিজের স্মৃতির প্রতি সন্দিহান হয়ে পড়ারই শামিল। কিন্তু, মার্ক টুলির প্রচ্ছদে উদ্ধৃত বয়ান অনুযায়ী, এই ‘এলেজি’ শুধুমাত্র চেনা শহরের অচেনা হয়ে যাওয়ার উপলক্ষে লেখা নয়; তা পুরনো কথা যেমন মনে করায়, তেমনই ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর সময়, দার্জিলিঙে গোর্খা-নামধারী জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের সম্পর্কে সুচিন্তিত ও প্রয়োজনীয় শঙ্কা প্রকাশের সময়ও লেখার এলেজিয়াক ভাব অটুট থাকে।
২০১৭ সালের প্রায় ৩ মাস ব্যাপী আন্দোলনের আশেপাশেই এই বইয়ের প্রকাশ। যদিও রচনাকাল নিজেকে ২০০৬ সালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে, বইয়ের শেষে পরিমল দার্জিলিঙের সবরকমের মানুষ, পশুপাখি ও পরিবেশের জন্যে যে আশা প্রকাশ করেন, দুঃখের বিষয় রাজনৈতিক ভাষ্যে আজকাল তার বিশেষ অনুপস্থিতি। তাঁর আশা:
পাহাড়ের প্রতিটি বাড়িতে থাকবে পর্যাপ্ত খাদ্য ও জল। স্কুলে শিক্ষকরা থাকবেন, হাসপাতালে ওষুধ। টুইয়ার লতাজড়ানো তারে বিদ্যুৎ আসবে, গ্নুইয়েরা বার্ধক্যভাতা পাবেন, চকবাজারের মহিলাদের নিজস্ব সেলফ হেল্প গ্রুপ তৈরি হবে, চাবাগান আর রুগ্ন শিল্প হিসেবে গণ্য হবে না, মংপুর সিঙ্কোনা খামারগুলো আবার গড়ে উঠবে, যৌনকর্মীরা পুনর্বাসন পাবেন (অনুবাদ আমার)।
গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনকারীরা ও তাঁদের দমনকারী সরকার, কারও কথাতেই এখন আর আমূল পরিবর্তিত সমাজের স্বপ্ন দেখার অবকাশ নেই। পরিমলের উপসংহার সেই স্বপ্নে বিভোর।
তাহলে, এই বই সম্বন্ধে সমস্যাজনক কোনও কথাই কি বলা সম্ভব নয়? আমার মন খুঁতখুঁত করে একটা বিশেষ কারণে: গবেষক জুলিয়া, অশীতিপর মিসেস দত্ত ও নামহীন গোর্খা মহিলা কর্মচারী আর শ্রমিক, যৌনকর্মী ও কিছু বিদেশি পর্যটক ছাড়া লেখকের দার্জিলিং যাপনের স্মৃতিতে মেয়েরা একান্তই প্রান্তিক। আমার প্রশ্ন এই বইটি নিয়ে নয়, ‘এলেজি’ ও ‘নস্টালজিয়া’-র চারিত্রিক গুণাবলি নিয়ে— এগুলি প্রায় সবসময়ই পুরুষকেন্দ্রিক কেন হয়? আমরা কি ভাবতে পারি না, দার্জিলিং যাপনের বর্ণনায় মেয়েরা কেন্দ্রস্থল অধিকার করলে, সে বর্ণনা কেমন হত?
বইটির বাংলা সংস্করণ পড়েছি। আপনার রিভিউ ইংরিজি ভার্সনটি পড়তেও প্রলুব্ধ করছে।