সাংবাদিকতা যদি রাজনীতিকের ব্যবসা নষ্ট করে, রাগ হওয়াই স্বাভাবিক নয়?

সাংবাদিকতা

অভীক ভট্টাচার্য

 

কাঠুয়া গণধর্ষণ মামলায় প্রকাশ্যেই অপরাধীদের পাশে দাঁড়িয়ে খবরের শিরোনামে এসেছিলেন জম্মুর বিজেপি বিধায়ক লাল সিংহ চৌধরি। সে ঘটনা নিয়ে মিডিয়ায় তুমুল হইচই শুরু হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বিজেপি-পিডিপি জোট সরকারের মন্ত্রিত্বের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন তিনি ও তাঁর আর এক সহযোগী চন্দ্রপ্রকাশ গঙ্গা। কাঠুয়া মামলাটি যাঁরা নিয়মিত অনুসরণ করেছেন তাঁরা সকলেই জানেন, গণধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ্যে আসা থেকে শুরু করে তদন্তপ্রক্রিয়ায় বরাবর বাধা দিয়ে এসেছেন এই ভদ্রলোক – তদন্তের ভার সিবিআই-এর হাতে তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করে জম্মুতে মস্ত মিছিল বের করা, মামলাটি পাঠানকোট আদালতে পাঠানোর ব্যাপারে আপত্তি জানানো থেকে শুরু করে নির্যাতিতা কিশোরী ও তার পরিবারের কৌঁশুলি দীপিকা রাজাওয়াতকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিতেও কসুর করেননি। এবং প্রতিটি খবরই মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়ে যাওয়ায় তাঁর সমস্ত রাগ শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়েছিল সাংবাদিকদের ওপর। কাঠুয়ার ঘটনা নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যে খবর লিখে এবং ছেপে উপত্যকায় এবং সারা দেশে পত্রকারেরা বিজেপি-র বদনাম করছে, এই ছিল তাঁর অন্তিম ও চূড়ান্ত প্রতিপাদ্য।

তাই রাইজিং কাশ্মিরের সম্পাদক শুজাত বুখারির হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পরপরই লাল সিংহর বক্তব্য নিয়ে যখন নতুন করে জলঘোলা শুরু হল, ভদ্রলোকের ট্র্যাক রেকর্ড সম্পর্কে মোটামুটি অবহিত সাংবাদিকেরা কেউই এতে খুব একটা অবাক হননি। আলাদা-আলাদা ভাবে পিডিপি, ন্যাশনাল কনফারেন্স ও কংগ্রেস লাল সিংহের বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করলেও, কলমচিরা লাল সিংহের অমৃতবাণীকে বিশেষ গুরুত্বও দেননি। জম্মু ও শ্রীনগর উপত্যকায় বিভিন্ন খবরের কাগজ ও নিউজ এজেন্সিতে কাজ করেন, এমন একাধিক মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, ওঁরা বিষয়টা নিয়ে খুব বিচলিত এমনটা নয়। অবশ্য উপত্যকায় সংবাদকর্মীদের এতরকম বিপদ ঘাড়ে নিয়ে কাজ করতে হয় যে, এইটুকুতে বিচলিত হলে তাঁদের চলে না – বস্তুত সেখানকার যে কোনও ঘটনাতেই সরকার ও সেনাবাহিনি একযোগে যেভাবে তাঁদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করে, তাতে এ ধরনের খুচরো বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু করলে কবেই তাঁদের কলম-ক্যামেরা গুটিয়ে বাড়ি চলে যেতে হত!

কিন্তু প্রসঙ্গ সেটা নয়। কাশ্মির উপত্যকায়, এমনকী গোটা দেশেই স্বাধীন সাংবাদিকতা ক্রমে বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশার তালিকায় ওপরের দিকে জায়গা করে নিচ্ছে, খবর হিসেবে এ যতই উদ্বেগজনক হোক, নতুন কিছুতেই নয়। কিন্তু সে আলোচনায় যাওয়ার আগে, চট করে একবার স্মরণ করে নেওয়া দরকার, শুজাতের মৃত্যুর পর সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে কী চেতাবনি দিয়েছিলেন লাল সিংহ। ইদের ঠিক আগের সন্ধ্যায় শুজাত অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীদের হাতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার আটচল্লিশ ঘণ্টা কাটতে না-কাটতেই লাল সিংহ বিবৃতি দিয়ে জানান, “পত্রকারেরা যদি লক্ষণরেখা মানতে রাজি না-থাকেন, তাঁদের জন্যও শুজাতেরই পরিণতি অপেক্ষা করে আছে।“ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাঁর পুরো বক্তব্যটি ছিল এইরকম – কাশ্মিরি সাংবাদিকরা ভুল পথে চলেছেন, আমি তাঁদের বলব সীমারেখা মেনে চলুন… শুজাতের যে পরিণতি হয়েছে আপনারা যদি তা থেকে দূরে থাকতে চান, সতর্ক থাকুন যাতে (আপনাদের খবরের জেরে) উপত্যকার সৌভ্রাতৃত্ব যাতে লঙ্ঘিত না হয়, এবং উন্নয়ন ও প্রগতির পথ যাতে খোলা থাকে।“ এখানেই না-থেমে নিজের বক্তব্য টুইটও করেন তিনি। সে টুইট-বার্তার বয়ানও ছিল প্রায় একই – “There is a need to draw a line between reporting facts and supporting terrorists and their sympathizers. Misinterpretation has become a norm and reporting facts a rarity. Journalistic freedom is absolute but not at the cost of nation and nationalism.”

খুবই সুসঙ্গত পরামর্শ সন্দেহ নেই, কিন্তু শাসক দলের (তখনও উপত্যকায় পিডিপি-বিজেপি জোট সরকার ভাঙেনি) কোনও বাহুবলী যখন মিডিয়াকে তাদের কাজ শেখাতে বিশেষ যত্নবান হয়ে পড়েন, তখন তার তো বিশেষ একটি তাৎপর্য থেকেই যায়। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ে যেতে পারে কীভাবে কোনও রাজ্যের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক প্রধান ও তাঁর পেটোয়া নেতৃকূল নির্ধারণ করে দিতে থাকেন কোন কোন খবরের কাগজ পড়া যাবে আর কোন কোন খবরের কাগজ পড়া যাবে না, এবং সেই নির্দেশ মেনে সরকারি সাহায্যপুষ্ট লাইব্রেরিতে বিশেষ বিশেষ কাগজ কেনা রাতারাতি বন্ধও হয়ে যায়। মনে পড়বে, অর্থাভাবে ধুঁকতে থাকা কাগজ বা টিভি-চ্যানেলকে ‘বেল-আউট’ করার শর্ত হিসেবে কীভাবে সংবাদ-পরিবেশনে প্রশ্নাতীত আনুগত্য দাবি করা হয়, বা কোনও সংবাদমাধ্যমকে সামনে রেখে রাজনৈতিক নেতৃবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় কীভাবে কোটি টাকার দুর্নীতি চলে, এই আমাদের দেশেই। কিন্তু সেসব তো ভিন্ন প্রসঙ্গ।

বরং লাল সিংহের ঘটনায় ফেরা যাক। এ-ক্ষেত্রেও ন্যাশনাল কনফারেন্স সঙ্গে-সঙ্গেই, এবং তার ঠিক পরপরই পিডিপি ও কংগ্রেস এই বিবৃতির ঘোরতর নিন্দা করে। উপত্যকার সাংবাদিকমহল থেকে শুরু করে কাশ্মির এডিটর্‌স গিল্ড – সব মহল থেকেই লাল সিংহের ধৃষ্টতার সমালোচনা হয়, এমনকী অবিলম্বে বিজেপি বিধায়কের গ্রেফতারের দাবিও ওঠে। বিজেপি দৃশ্যত অস্বস্তিতে পড়লেও বিশ্বের সমস্ত বিষয়ে অবিরত টুইট করে-চলা প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা উপত্যকার দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনাথ সিংহ পর্যন্ত সকলেই এ-বিষয়ে প্রত্যাশিত মৌন অবলম্বন করেন।  

কিন্তু এই ঘটনাক্রমের পশ্চাদ্‌বর্তী বাস্তবতাটি অধিকতর প্রণিধানযোগ্য – ইতিহাস যে কী বিচিত্রভাবে ফিরে আসে, তার চমৎকার দৃষ্টান্তও বটে। আপনাদের হয়তো মনে থাকবে, আততায়ীর গুলিতে মারা যাওয়ার কয়েকমাস আগে, ধারোয়াড়ের বিজেপি সাংসদ প্রহ্লাদ যোশির করা এক মানহানির মামলায় কর্ণাটকের এক স্থানীয় আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন গৌরী লঙ্কেশ। পরে সে মামলা উচ্চতর আদালতে যায়, এবং সেখানে জামিন পান গৌরী। কিন্তু খবরটা সেখানে নয়। খবরটা হল, নিম্ন আদালতের রায় বেরনোর পর বিজেপি-র সোশ্যাল মিডিয়া উইং-এর প্রধান অমিত মালব্য একটি টুইট করেছিলেন। সেই টুইট-বার্তার বয়ানের দু’টি অংশ ছিল। প্রথম অংশে ছিল নিখাদ জয়ঘোষণা, এবং পরবর্তী অংশে একটি সংক্ষিপ্ত, অথচ সুস্পষ্ট, চেতাবনি। বার্তাটি ছিল এইরকম – “Prahlad Joshi BJP MP from Dharwar gets Gouri Lankesh convicted in the defamation case. Hope other journos take note.” এই ‘হোপ আদার জার্নোজ টেক নোট’ বাক্যবন্ধটির প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইব। গৌরীর দোষী সাব্যস্ত হওয়ার খবরের উল্লেখ করে অন্যান্য সাংবাদিকদের চোখে আঙুল দিয়ে কী দেখাতে চেয়েছিলেন মালব্য? বুঝতে অসুবিধে হয় না, সেখানে ছিল এইরকম কোনও সংকেত যে, “(আমাদের বিরুদ্ধে খবর লেখার আগে) সাবধানে থাকুন, (নচেৎ) আপনাদেরও এই একই পরিণতি হতে পারে।“ এবার লাল সিংহ আর মালব্যর বার্তাদুটি পাশাপাশি ফেলে দেখুন, ছবিটা ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে আসবে।

একইসঙ্গে পরিষ্কার হয়ে আসবে, কেন গৌরী বা শুজাতের মতো সাংবাদিকদের নিয়ে এত দুশ্চিন্তা শাসক বিজেপি ও তার লেঠেলবাহিনির। কাশ্মিরে, কিংবা ব্যাপক অর্থে সারা দেশ জুড়েই বিজেপি যেভাবে সাম্প্রদায়িক তাস খেলতে চাইছে, শুজাত ও গৌরীর মতো সাংবাদিকেরা ছিলেন আগাগোড়া তার বিপক্ষে। শুজাতের ক্ষেত্রে, বা তাঁর মতো কাশ্মিরের আরও অনেক সাংবাদিকের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা ছিল আরও বেশি বিপজ্জনক, কেন না তাঁরা ছিলেন একদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী উগ্রপন্থী ও অন্যদিকে সরকার-সেনা-বিজেপি অক্ষ – এই উভয়পক্ষেরই চক্ষুশূল। চক্ষুশূল, কেন না তাঁরা মনে করতেন, এখনও করেন যে, কাশ্মির সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে অবিলম্বে কথা শুরু হওয়া দরকার। কথা শুরু হওয়া দরকার কাশ্মিরের সাধারণ মানুষের স্বার্থেই, এবং তার জন্য দরকার একটা গণতান্ত্রিক পরিসর। কিন্তু একদিকে কট্টরপন্থীরা ও উলটোদিকে অজিত দোভালদের মতো অদূরদর্শী নীতিপ্রণেতাগণ – উভয় শিবিরের পক্ষেই তা রীতিমত মাথাব্যথার কারণ। সেই কারণেই আলোচনা শুরু হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলেই সেটাকে ঘেঁটে দেওয়ার চেষ্টা জরুরি, এবং এমন একটা অবিশ্বাস ও হিংসার পরিস্থিতি কায়েম রাখা দরকার যাতে, আলোচনাপন্থীরা কোনওমতেই হালে পানি পেতে না-পারে। বিশেষত, যেখানে দেশ জুড়ে ভোটের দামামা বেজে ওঠার বেশি দেরি নেই, সেখানে কাশ্মিরে গোলমাল জিইয়ে রাখা একাধিক কারণেই ভালো কৌশলগত লগ্নি – যা থেকে অদূর ভবিষ্যতে মোটা রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড মিলতে পারে। পিডিপি-র সঙ্গে জোট ভেঙে দেওয়া এবং তার পরপরই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের ভিডিও প্রকাশ থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়, ভোটের আগে সারা দেশ জুড়ে ফের কাশ্মির তাসই খেলতে চলেছে বিজেপি।  

এমন সুচারু পরিকল্পনা স্রেফ কয়েকটা সাংবাদিকের হাতে ভেস্তে যাবে, তা কি হতে দেওয়া যায়?      

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. প্রখর বিশ্লেষণ! সমৃদ্ধ হলাম। কায়েমি স্বার্থের খেলাগুলো আরও স্পষ্ট হল।

Leave a Reply to অসিত বিশ্বাস Cancel reply