‘ল্যাক অফ স্পিরিচুয়ালিটি’ এবং একটি খোলা চিঠি

আর্ট অফ লিভিং

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

লক্ষ্মণ ডুকরে। একটা নাম মাত্র। মহারাষ্ট্রের আমেদগড়ের ওয়াদার পরিবারের কয়েকজনের একজন। এলাকার আখ চাষ নামমাত্র জল কেড়ে নিয়েছিল বাকি কম খরচের চাষের থেকে। বাধ্য হয়ে পালঘরের বাসাই দুর্গে এলেন রেস্টোরেশনের কাজে। ‘পাথর ভাঙা খুব কঠিন বাবু, পাথর গরম, মাটি গরম, মাথার ওপর সূর্যও গরম’। ডুকরে জানালেন। সূর্য ডুবলে সারা গাহাতপা যন্ত্রণা। কী করেন তখন? ‘খুব ব্যথা হলে ওষুধ খাই, আরও বাড়লে লোকাল হাতুড়ের কাছে, আর রোজকার ব্যথায় একটা হাফ-কোয়ার্টার হলেই চলে…।’ গরমে ঘামতে ঘামতে একমুখ হাসি মেখে বললেন ষাটোর্ধ্ব মানুষটি। মদ তখন চিয়ার্স নয়। ওষুধ। নির্বাণ। গৌতমের কাছে পায়েসান্ন যেমন ছিল।

হাসান আলি। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা। অস্থায়ী বালুচরের খড়ের ঘর বানিয়ে থাকেন। পরিবার। একটু জল বাড়লেই আবার অন্য কোথাও। আসামের ওই দ্বীপটার তিনটে নাম। পানিখাইটি, লক্ষ্মীচর, মরিসাখান্ডি। মানে ৮০০ জন ঘরহারা কৃষকদের যে যে গ্রাম থেকে এসেছেন সেই নামে। গেল বছরের বন্যায় সরকারি রিলিফ বলতে খাবার না, ২ কিলো গো খাদ্য– বিচুলি, খড় এসব। একমাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ছাদ নেই, দেয়ালে আগাছা। চর থেকে মূল নদীচরে পৌঁছতে নৌকো ভাড়ার জন্য স্কুলড্রপআউট অনেকে, অনেকে চিকিৎসাও করান না।

আয়ুব আমীন। আর তাঁর কচ্ছের ফকিরানি জাট পরিবার। মালধারী। মানে, উটের পিঠে ওইসব মানুষেরা। প্রোসোপিস জুলিফ্লোরা নামের এক ইনভেসিভ গাছের আক্রমণে উটেদের খাবার গাছ শেষ হয়ে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছও নেই বললেই চলে। তাই কড়া রোদে গ্রেজিং গ্রাউন্ড খুঁজতে মাইলের পর মাইল চষে বেড়ানো। রোদ। তবু খুশী। ‘দিনের শেষে পোড়া রুটি আর উটের দুধ পেলেই রাতে একটু ঘুমোতে পারি।’ আয়ুব রবার্ট ফ্রস্ট পড়েননি। জানেন না ঘুমোনোর আগে কত মাইল যেতে হবে তাকে। তবে হালকা কিছু গাছগাছালি দূর থেকে দেখতে পেলেই দাঁড়িয়ে পড়েন। ‘স্টপিং বাই উডস…’।

আয়নার ওপার। বিদর্ভের আত্মঘাতী অশোক সাতপয়সার স্ত্রী সঙ্গীতা। নিজের জমির মুসুর ছাড়া শেষ কবে অন্য সবজি খেয়েছেন মনে নেই। কিংবা নিহত জীতেন্দ্রর স্ত্রী সবিতা। ঘরে ৯৩ পেরোনো শ্বশুর। ছেলে চলে যাওয়ার খবর পেয়েই চলে এসেছেন। তবে সারাক্ষণ বিছানায়। তিন ছেলেমেয়ে। মেয়েটা সারাদিন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বাবার ছবি ধরেও হাসিমুখ। আর একটা সেলাইমেশিন। এরাই ভরসা। ‘স্পিরিচুয়ালিটি’ নয়। সঙ্গীতা, সবিতারা লড়াই করছেন।

পাঞ্জাবের মনসা জেলায় একটা সার্ভেতে ধরা পড়ল গত দু’বছরে ৫৩০টি কেস, যার মধ্যে ক্ষতিপূরণ পেল ৭৪টি পরিবার, ৩১৪টি রিজেক্টেড, ১৪২টি পেন্ডিং। কোথায় দেখাবে ওরা ঠিকঠাক এফআইআর, ঋণের পরিমাণের হিসেব বা নিহতের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট? লাঙল চালানো ছাড়া আর কিছুই যে জানে না! অন্ধ্রে ৩২ লাখ কৃষিভিত্তিক পরিবারের ৯২.৯ শতাংশই বিরাট ঋণের কবলে পড়ে আছেন, তেলেঙ্গানায় সেটা ৮৯.১ শতাংশ। ক্রপ লস হলে যারা ভূমিহীন চাষি, তাঁরা পাচ্ছেন মাত্র সাড়ে সাতশো, তাও গোটা বছর জুড়ে ধাপে ধাপে। একজন তুলো চাষি ১ একর জমিতে চাষ করে খরচ করছেন ২৮০০০-৩০০০০ টাকা, অলৌকিক ভাবে মারাত্মক প্রোডাকশন হলেও লাভ পাবেন তাঁর থেকে দু’হাজার কম। অন্ধ্রের প্রশাসনিক সরকারি বাসের সিকিউরিটি রিপেয়ারে খরচ হয় সাড়ে পাঁচ কোটি আর কৃষক আত্মহত্যায় এক্সগ্র্যাসিয়া সাড়ে তিন লাখ। বিদর্ভের পড়শি মারাঠাওয়ারার হিসেবে সেখানকার ঋণ পরিবার পিছু ১০০০০ টাকা হলেই আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা ঘটছে আকছার। গোটা দেশে ২০১২-র পর থেকে বছরে গড়ে ১২০০০-১৬০০০ চাষি আত্মঘাতী। যার বেশীরভাগটাই ১৮ থেকে ৩০ বছরের রেঞ্জে। অধিকাংশ বিমা বা অন্যান্য গালভরা প্রকল্প পৌঁছচ্ছে না ২০ শতাংশ চাষিদের কাছেও।

নয়ডা। রবিশঙ্কর। ওয়ার্ল্ড কালচার ফেস্টিভাল। আর্ট অফ লিভিং। যমুনা-র জল। ট্রেন থেকে একটা বিরাট মরাকাঠের মতো লাগে। যেন একটা বীভৎস কালো জলের অনিচ্ছাকৃত দাঁড়িয়ে পড়া একটা রাজধানী শহরের কাছে। সেই ওয়ার্ল্ড কালচার। উৎসবের জন্য যমুনা ফ্লাডপ্লেইনকে যেভাবে খুশি সেভাবে ব্যবহার। কৃষিজমি, আরও প্রচুর প্ল্যান্ট বায়োডাইভারসিটি ছেঁটে ফেলা হল। আর যাবতীয় জঞ্জাল জড়ো করে জমানো হল যমুনা তীরে। ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইবুনালে ৫ কোটির বিনিময়ে প্রোজেক্ট পাশ। যেমন হয় আর কি! যাই হোক, যে কথা বলছিলাম। ওয়ার্ল্ড কালচারের জন্য বুলডোজার চালানো হল ময়ূর বিহার মেট্রো স্টেশনের উল্টোদিকে যমুনা ফ্লাডপ্লেইনের প্রায় ২০০ জন চাষির জমিতে। স্পাইনাচ কিংবা সর্ষের ক্ষেত। ধূধূ মাঠ। কম্পেনসেশন? হু, একদিন নিশ্চয়ই আসবে…। একটু ডিটেইলে বলি? ‘এভাবেই দুষ্কৃতীর জন্ম হয়। যখন গরিবকে পিষে ফেলা হয়, সে হয় মারে না হয় মরে।’ বলছিলেন পান সিংহ। চাষের জন্য প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচা করা পান সিংহের পকেটে আর্ট অফ লিভিং সংক্রান্ত উচ্ছেদের জন্য জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ২৬০০০ টাকা। কিংবা মহম্মদ ইব্রাম। বাপ-মায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড়। ভাইদের পড়াশুনো আর গরিবি তাঁকে ক্লাস ফাইভের ওপরে পড়তে দেয়নি। ভাই সলমন পড়ত। একদিন পুলিশ এসে বাড়ি ঘর উঠিয়ে দিতে বলল। সলমন বন্ধু শিবকুমার এবং ইয়ামিনকে নিয়ে ফেটে পড়ল রাগে। দেব না জমি। ঠিক তার পরেই থানায় জামিন-অযোগ্য ধারায় ঢুকল তিন বন্ধুর নাম। এক মেন্টেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারের ক্যাসিও এবং ৩০০ টাকা চুরির দায়। কারণ অনুমেয়…। ইতিমধ্যে সলমনকে ছাড়ানোর জন্য ইব্রামের বাড়ির বাইরে থাকার সুযোগে তাঁদের পুরো কৃষিজমিটাই কয়েকজন সিনিয়র পুলিশের তত্ত্বাবধানে চলে গেল বুলডোজারদের কবলে। ফুলকপি, সর্ষে, স্পাইনাচ, মুলো এবং পেঁয়াজ নিয়ে লালন করা দু’বিঘে এবং বাকি দু’বিঘে শুধুই গম। শেষ। ‘গুটিকয়েক পেঁয়াজ শুধু তুলতে পেরেছিলাম জমি থেকে।’ বলছিলেন ক্রুদ্ধ, হতাশ হালীমা, ইব্রাম-সলমনের মা। বীজ, সার আর জলের জন্য খরচা করা সলমনের ২০০০০ টাকা এক লহমায় শেষ। জমির মালিককে বিঘে প্রতি বার্ষিক ৬০০০ টাকা কোথা থেকে দেবে ইব্রাম, সলমন? ৫০০ মিটার দূরেই রাজ সিং সহ অগুনতি দলিত চাষির জমি ধূলিসাৎ একবেলার মধ্যেই। জমি উচ্ছেদের অনুমতি দেখাতে বলা হলে পুলিশি তৎপরতায় দেখানো হল আর্ট অফ লিভিং ফাউন্ডেশনের সংগঠকদের নির্দেশ। জায়গাটির মালিকানা কিন্তু উত্তরপ্রদেশ সরকারের সেচ দপ্তরের অধীনে। অথচ কোনও সরকারি নির্দেশ ছাড়াই বেসরকারি ভুঁইফোড়দের সুপারিশে কৃষিজমি, ঘরবাড়ি উচ্ছেদ। প্রায় ২০০ একর জমি কোনও অনুমতি ছাড়াই জবরদখল করা হল। এবং আয়রনি হল, কয়েকদিন পরেই রবিশঙ্করের সারপ্রাইজ ভিজিটে বলা হল, তিনি নাকি জানতেনই না এমন একটা বিপদ ঘনিয়ে আসছে তাঁর কৃষকবন্ধুদের সংসারে। তাঁর কথায়-– ‘আপ লোগো কে সাথ আন্যিয়ায় নেই হোনা চাহিয়ে, মেহনত বেকার নেহি হোনা চাহিয়ে।’ সত্যি, সারপ্রাইজই বটে। তার পরে তাঁকে আর দেখা যায়নি সে চত্বরে।

কয়েকবছর আগে আত্মহত্যার অধিকার দেওয়া উচিত কিনা এ প্রসঙ্গে লেখক চিকিৎসক ড. অভিজিৎ তরফদারের একটি লেখা পড়েছিলাম। কাঁকড়া আর গুগলি কুড়োনো নুলিয়া বাচ্চাদের গল্প বলেছিলেন অভিজিৎ। পেশা আর অর্থকষ্টে বাধ্য হয়ে প্রায়ই সাপের খোপে হাত বসাত ওরা। মরতও। অভিজিৎ লিখলেন, ওই মরার অধিকারটাই তো আছে এদেশের গরিবদের, সেটায় হাত বসাবে কোন আইন?

প্রিয় রবিশঙ্কর, আপনি ওয়ার্ল্ড কালচার ভাবুন, স্পিরিচুয়ালিটি ভাবুন, জীবন বা মৃত্যু নিয়ে ভাবতে হবে না। ওটা বরং ওই আয়ুব, ইব্রাম, সবিতা, লক্ষ্মণ বা হাসান আলিদের ভাবতে দিন। আর্ট অফ লিভিং আপনি করতে পারেন। তবে, বেঁচে থাকার শিল্পটা ওদেরই জানা। তাই না?

 

ঋণস্বীকার –
• https://ruralindiaonline.org/
 https://psainath.org/
 http://indiatoday.intoday.in/…/sri-sri-ravi-s…/1/613556.html,
• https://thewire.in/…/no-spirituality-here-farmers-strong-a…/,
• http://www.aljazeera.com/…/stories-survival-widows-india-fa…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

5 Comments

  1. এই লেখাটি পড়ে নিজের আত্মার উন্নতি হল, একটু হলেও।

  2. সত্যিকারের আর্ট অফ লিভিং যারা জানেন, তাদের চীটিংবাজীর প্রয়োজন হয় না। রবিশঙ্করের মতো জোচ্চোরেরা আর রাগেরও যোগ্য থাকেন না এই জীবন সংগ্রামের প্রেক্ষিতে – এরা জাস্ট একেকটা পোকামাকড়।

  3. লেখাটা পড়ার পর মনে হল না পড়লেই ভালো হতো। আরেকটু ঘুমিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু ঘুমটা আসলো না আর। লেখককে অনেক ধন্যবাদ তথ্যগুলির জন্য।

  4. মর্মান্তিক এই সত্য কে তুলে ধরার জন্য লেখক কে ধন্যবাদ। কিন্তু প্রশ্ন হল এই দুর্দিনের কি শেষ আছে ?

  5. এটা খালি লেখা নয়। একটি দলিল। সেই হিসেবেই মান্যতা পাক। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মকে ধন্যবাদ…

    আর সাম্যব্রতকে বলি, সবকিছুরই শেষ আছে… 🙂

Leave a Reply to Samyabrata Chakrabarty Cancel reply