প্রমীলার প্রতিশোধ

কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

আকাশ আবার কালো করে এসেছে। বারান্দায় মেলা কাপড় তিনদিন ধরে শুকোনোর চেষ্টা চলছে। কারও হুঁশ নেই। অথচ বাড়ি গিজগিজ করছে লোক। নাতির ছেলের মুখেভাতে কোথা কোথা থেকে আত্মীয়স্বজন এসে জড়ো হয়েছে, আশ্চর্যের ব্যাপার, তারা সকলেই প্রমীলার থেকে ছোট। বছরতিনেক আগে এই নাতিরই বিয়েতে দু’জন মাসি এসেছিলেন, একজন হালিশহরের, অন্যজন কসবার, যাঁদেরকে ঝুঁকে প্রণাম করতে গিয়ে কোমরে খিঁচ লেগে গিয়েছিল প্রমীলার। এই তিন বছরে দুটো শ্রাদ্ধের কার্ড এসে গেছে। নাতিপুতি, ছেলে ছেলের বউরা দেখামাত্র লুকিয়ে ফেলেছে। ওদের ফিসফিসানি, চোখটিপুনি দেখে হেসেছেন প্রমীলা। মৃত্যুকে ওদের বয়স থেকে দেখলে যত ভয়ানক মনে হয়, তাঁর বয়স থেকে দেখলে তত ভয়ানক লাগে না। মৃত্যু আর মুক্তি শব্দ দুটোর এত কাছাকাছি হওয়ার কারণটা আন্দাজ করা যায়।

এখন প্রমীলা খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে থাকেন, সবাই এসে ঢিপঢিপ প্রণাম করে। সবাইকে চিনতেও পারেন না। নাতিনাতনির বাচ্চাকাচ্চা পর্যন্ত মনে করে রেখেছিলেন, তাদের শ্বশুরবাড়ির খবর রাখার আর প্রয়োজন মনে করেননি। প্রণাম করে মাথা তুলে পরিচয় দিলে মিষ্টি হেসে চিবুক ধরে চুমু খেয়ে “কেমন আছ?” জানতে চেয়ে কাজ সারেন।

ইস, কী অন্ধকার। চশমার সঙ্গে প্রায় ঠেকিয়ে ফেলা কাগজ নামিয়ে রাখতে বাধ্য হলেন প্রমীলা। বরং কাপড়গুলোর ব্যবস্থা দেখা যাক। বৃষ্টিটাও তেমনি। একেবারে হয়ে গেলে পারে, তা না। একে বলে বউ নাচানো বৃষ্টি। মুশকিল হচ্ছে এখনকার বউরা নাচে না। প্রমীলা রাগতে গিয়েও সংযত হলেন। তিনিও এ বাড়ির বউ। চুল পাকা, ছানি কাটা, পঞ্চাশ বছরের পুরনো বউ, কিন্তু বউ। তিনি নাচলেও অন্যায্য হবে না।

তা ছাড়া এই সুযোগে একটু হাঁটা হবে। সকাল থেকে গোলমালে হয়ে ওঠেনি। এই বয়সে তো প্যান্ট পরে পার্কে দৌড়তে যাওয়া যায় না। ডালে কী ফোড়ন পড়ল জানার ছুতোয় বারদুয়েক রান্নাঘর আর জামাকাপড় তোলার অছিলায় বারদুয়েক বারান্দা ঘুরে আসা। ‘মা, আমি তো জামাকাপড় তুলতাম এক্ষুণি, আপনার আবার সর্দ্…” জিভের ডগা থেকে ফেরৎ পাঠিয়ে দেওয়া শব্দটা চিনতে অসুবিধে হয় না প্রমীলার। জামাকাপড়ের বোঝা হস্তান্তরিত করে খুরখুরিয়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটেন। তোমাদের জামা ভেজা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই বাছা, আমার কাপড় আমি সামলে রেখেছি। আমি হাঁটছি আমার হাঁটুর স্বার্থে।

রাতে বাড়ি নিস্তেজ হলে অন্ধকার ঘরে বসে নির্ঘুম প্রমীলা ঘাড় এদিকওদিক ঘোরান, দুই হাত মাথার ওপর তোলেন-নামান, নাকের ডান ফুটো চেপে ধরে বাঁ ফুটো দিয়ে দম ছাড়েন। টিভিতে সাধুবাবা দেখিয়েছেন। সাধুবাবা আরও অনেক কিছু দেখিয়েছেন যেমন মাথার ওপর দাঁড়িয়ে সিলিংপানে পা বা মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে এই হাতের তেলো পিঠের পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে এনে ওই পায়ের গোড়ালি ছোঁয়া। কিন্তু এ সব কঠিন ব্যায়াম প্রমীলা করেন না। তিনি তো পাড়ার স্পোর্টসে নামতে যাচ্ছেন না, শুধু শুয়ে না পড়েন সেটা দেখা। তাঁর শাশুড়ি জীবনের শেষ দশ বছর বিছানায় শুয়ে ছিলেন। প্রমীলা থাকবেন না। চলতেফিরতে, কথা বলতে বলতে, পুতিপুতিনের সঙ্গে খেলতে খেলতে টুপ করে মরে যাবেন।

স্যাঁতসেঁতে কাপড়ের বোঝা দুই হাতে নিয়ে লাল বর্ডার দেওয়া কালো বারান্দার মোড় ঘুরেই থমকালেন প্রমীলা। কোণার ঘরের আধভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে একটা পা চোখে পড়ল মনে হল? হাওয়াই চটির স্ট্র্যাপের নীল ঝলক? দু’পা পিছিয়ে এসে আবার তাকালেন। ঠিকই। দুটো পা। একটার ওপর আরেকটা তোলা।

প্রমীলা অপেক্ষা করলেন। এদিকওদিক দেখলেন, রেলিং-এর কাছে গিয়ে উঁকি মারলেন। ভাপাইলিশের ভাতঘুমের নৈঃশব্দ্য চারদিকে। ঘরের ভেতর থেকেও কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

এই দরজাটা ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ করে কি? ‘দুর্গা’ বলে দরজা ঠেললেন প্রমীলা। না, করে না। জানালার পাশে ইজিচেয়ারে পা মেলে চেয়ারে বসে আছে লোকটা। বাঁ দিকে ঘাড় ঘোরালেই দেখতে পাবে।

কিন্তু লোকটা ঘাড় ঘোরাচ্ছে না। লোকটার ঘাড় ইজিচেয়ারের হেলানো, টাকের এপাশে ওপাশে ধূপের ধোঁয়ার মতো ক’গাছি চুল। হাতলে এলানো শিরা বার করা হাত। গাল কোটরে। চশমাটা নাক আর কপালের সংযোগস্থলে বেঁকে রয়েছে। মাথা আর ইজিচেয়ারের ফাঁক গলে চ্যাপ্টা বালিশ গড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে।

লোকটার মুখটা অল্প খোলা।

বালিশটা তোলার জন্য নিচু হতে যাবেন, লোকটা চোখ খুলল। প্রমীলার হৃদপিণ্ড লাফ মারল জোরসে। লোকটা এখন প্রমীলার দিকে তাকিয়ে, দৃষ্টি স্পষ্ট, ঠোঁটে একটা চ্যাটচেটে হাসি আকার নিচ্ছে। চোখ সরিয়ে নিতে সেকেন্ড খানেক দেরি করে ফেললেন প্রমীলা আর ঘটনাটা ঘটে গেল।

লোকটা চোখ মারল তাঁকে।

*****

ব্যাপারটা অত সোজা নয়। ওপরের আঁশটুকু দেখেই কনক্লুশনে পৌঁছনো ভুল।

টিভিতে শহরের সাম্প্রতিকতম ধর্ষণের খবর দেখতে দেখতে বলল প্রমীলার বড় খোকা। এখন আর খোকা নয়, মধ্যবয়স্ক লোক। প্রৌঢ়ও বলতে পারে কেউ কেউ। ভালো ছাত্র বলে খ্যাতি ছিল, কিন্তু প্রমীলা চিরদিন জানতেন তাঁর ছেলে ভালো ছাত্রের থেকে বেশি ভালো মাস্টার। বোঝে যত, বোঝায় তার থেকে অনেক বেশি ভালো।

‘এই বাজারে মাঝরাতে অচেনা লোকের লিফট নিয়ে কেউ যাতায়াত করে? তাও কিনা যে আবার পরিষ্কার মদ খেয়ে রয়েছে? আগে থেকে চেনা না থাকলে? সিসিটিভিতে তো স্পষ্ট দেখিয়েছে। ওই তো…’

সবার মাথা টিভির দিকে ঘুরল। যেমনতেমন আঁকা একটা লাল রঙের গোল্লা থেকে তীর চিহ্ন বেরিয়ে অন্ধকার স্ক্রিনের একটা জায়গা নির্দেশ না করলে কিছু ঠাহর করা মুশকিল হত। বাকিদের সঙ্গে প্রমীলাও চোখ সরু করলেন। আঁকাবাঁকা লাল গোলের মধ্যে কয়েকটা ছায়া দলা পাকিয়ে নাচছে। জামার চুমকি ঝলসে ঝলসে উঠছে।

উত্তেজিত কণ্ঠে ঘোষিকা বলছেন, ‘এখন কিন্তু দেখা যাচ্ছে অমুক আর তমুক ঘনিষ্ঠ হয়ে নাচছেন। আর পনেরো মিনিট পরেই দুজনকে কিন্তু একসঙ্গে বেরোতে দেখা যাবে, আর তার পরই কিন্তু…’

‘প্রশ্নটা চেনাঅচেনার নয়।’ গলা ঝেড়ে বলল প্রমীলার নাতি বুল্টু। বুল্টু বেশিরভাগ সময়েই শোনে, বলার দরকার হলে দুয়েকটা সুচিন্তিত বাক্যে মতামত প্রকাশ করে। এই বয়সেই বিচক্ষণ বলে অফিসে, আত্মীয়মহলে নাম কিনেছে।

‘অ্যাবিউজ অ্যাবিউজই, চেনা না অচেনা কে করল সেটা ইমমেটেরিয়াল। স্ট্যাটস তো বলছে বেশিরভাগ অ্যাবিউজই আজকাল চেনাশুনোর মধ্যে হয়। যেটা হয়েছে, অন্যায় হয়েছে। ব্যস।’

‘ন্যায়অন্যায়ের প্রশ্ন আমিও তুলছি না।’ খোকার গলায় আঁচ। ‘কথাটা হচ্ছে বাস্তব পরিস্থিতির। কোনও সুস্থ মহিলা, আচ্ছা মহিলাপুরুষ ছেড়ে দে, কোনও সুস্থ লোক এটা করবে? তুই করবি? মাঝরাতে মাতালের থেকে লিফট নিবি? আর মেয়েদের তুলনায় সিচুয়েশনটা যে ডিফারেন্ট সেটা তুই স্বীকার করতে না চাইতে পারিস, কিন্তু তাতে সত্যিটা বদলায় না।’

‘প্রশ্নটা স্বীকারঅস্বীকারের নয়।’ গলা নরম করল বুল্টু। ‘হ্যাঁ, মহিলার মাঝরাতে অচেনা লোকের থেকে লিফট নেওয়ার অ্যাকশনটা রিজনেবল নয়।’

‘চরম ইরেসপনসিবল।’ হাঁটুতে চাপড় মারল খোকা। ‘মহিলা তো সমাজের বাইরে তো বাস করেন না। কী থেকে কী হয়, কোথাকার জল কোনদিকে গড়াতে পারে সে সম্পর্কে মহিলার ধারণা নেই এ তো হতে পারে না। সাজপোশাক চলনবলন থেকে উনি যে দুধভাত টাইপ নন সেটা ক্লিয়ার। আমি আগুন নিয়ে শখ করে খেলব তারপর হাত পুড়লে কেন পুড়ল বলে কাঁদব, এটা তোদের জেনারেশনের স্টাইল বুল্টু। আমাদের সময়ের লোকরা এত দায়িত্বজ্ঞানহীন ছিল না।’

‘প্রশ্নটা দায়িত্ব-অদায়িত্বের নয়। আই এগ্রি যে আমরা একটা ফল্টি সমাজে বাস করি এবং সেখানে অ্যাডাল্ট লোকজন নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেরা করবে সেটাই এক্সপেক্টেড। নিরাপত্তার প্রয়োজনটা আনফরচুনেটলি মহিলাপুরুষের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা।’

‘যতদিন না সে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে তোমাকে সেটা অ্যাকসেপ্ট করতে হবে এবং ইউ হ্যাভ টু অ্যাক্ট অ্যাকর্ডিংলি। তোর দাবিমতো মহিলা যদি প্যারাগন অফ ভার্চুও হয়ে থাকেন, শি ওয়াজ নো ডাউট স্টুপিড।’

‘হুম্‌ম্‌।’ গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল বিচক্ষণ বুল্টু।

এই একটা ব্যাপারে মতবিরোধের অবকাশ নেই। ঘরের হাওয়ায় আবার সহাবস্থানের শান্তি।

স্ক্রিনে হেল্পলাইন নম্বর দেখাচ্ছে। ফোন করে কাউন্সেলরের সাহায্য নিন। ট্রমা পুষে রাখবেন না।

*****

পিঁ পিঁ – প্যাঁ পোঁ প্যাঁ পোঁ – প্যাঁ পোঁ প্যাঁ পোঁ।

হেল্পলাইন ডায়াল করলেন প্রমীলা। চোখের সামনে একটা কাচের দেওয়াল ভেসে উঠল। দেওয়ালটা অল্প অল্প কাঁপছে। ওপারে লম্বা টেবিল, টেবিলের ওধারে বাবা জ্যাঠা কাকা দাদা, দু’ পাশে সারি দিয়ে মা জেঠিমা কাকিমা দিদি, দিদির শ্বশুরবাড়ির লোকজন, ভজহরি উকিল, শ্যামাপদ ডাক্তার, বিধুর ঠাকুমা, ললিতার পিসি। সবাই অস্পষ্ট, কাঁপছে। টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক নেই লক্ষ করলেন প্রমীলা, কিন্তু লাল বৃত্তটা আছে। বৃত্ত থেকে বেরোনো তীরচিহ্ন প্রমীলার মাথা তাক করে।

উল্টোরথের বিকেলে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
মেলায়।
তোমাকে গুরুজনেরা কী শিক্ষাদীক্ষা দিয়েছিলেন?
সদা সত্যি কথা বলিবে।
ওটা না।
না বলিয়া পরের দ্রব্য…
আঃ, ওটাও না। প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষা।
মেয়েদের একা একা রাস্তায় বেরোতে নেই।
তোমার সঙ্গে কে ছিল?
বিধু, ললিতা…
ফেরার সময় ওরা তোমার সঙ্গে ছিল?
না।
কেন?
বৃষ্টি আসবে বলে ওরা বাড়ি ফিরে গিয়েছিল।
তোমাকে সঙ্গে ফিরতে বলেনি?
বলেছিল।
তবে?
আমার পাঁপড়ভাজা খেতে ইচ্ছে করছিল, দোকানে খুব ভিড় ছিল…
তাই তুমি ঝেঁপে বৃষ্টি আসছে দেখেও, চারদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে বুঝেও দাঁড়িয়ে রইলে। বাঃ। কী রঙের শাড়ি পরেছিলে?
লাল।
বাড়িতে সাদা শাড়ি ছিল না? ঘিয়ে? ফ্যাকাসে আকাশী কিংবা জন্ডিস রঙের?
ছিল।
হুম্‌। চুল খোলা ছিল না বাঁধা?
ললিতা বেঁধে দিয়েছিল, পাতা কেটে।
চমৎকার। তারপর?
বৃষ্টি নামল খুব জোরে। আমি বাড়ির দিকে দৌড়লাম।
কোন পথ ধরে?
বাঁশবাগানের মাঝের পুকুরের পাশের পথ।
ও পথে লোকজন কম চলে তুমি জানতে না? ক্লাবঘরে ছেলেরা বসে আড্ডা মারে জানতে না?
ওই পথ দিয়ে তাড়াতাড়ি হয়।
তবে আর কী। ক্লাবঘরে ছিল কেউ?

একটা সাইকেল ছিল। ক্লাবঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ভিজছিল। সাইকেলের মালিককে প্রমীলা দেখার আগেই লোকটা তাঁকে দেখেছিল। ক্লাবঘরের কাছাকাছি পৌঁছতে টালির ছাদে ঠ্যাকনা দেওয়া বাঁশের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে হেসেছিল প্রমীলার দিকে তাকিয়ে। ঝকঝকে, সাজানো দাঁত।

আর তুমি? তুমি কী করেছিলে?

প্রমীলার গলা খটখট, মাথা ঝিমঝিম।

আ-আমিও হেসেছিলাম।

তিন সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে থাকার পর কাঁচের দেওয়াল, টেবিল মিলিয়ে গেল। পাঁচ সেকেন্ড অপেক্ষা করে প্রমীলা ক্ষীণ গলায় বললেন, ‘হ্যালো?’

উত্তর এল না। হেল্পলাইন কেটে গেছে।

*****

“এত বেলেল্লা হয়েছ যে অন্ধকার হওয়ার আগে বাড়ি ঢুকতে পারছ না?” দরজা খুলে বাবার চড় এসে পড়েছিল গালে। একদিক থেকে বাবা বাড়িতে থাকায় ভালোই হয়েছিল। প্রমীলার ক্রমগত ঠকঠক কাঁপুনির কারণ ওটাই ধরে নিয়েছিল সকলে। তলপেটে অসম্ভব ব্যথায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারাটাকে বাবার ভয়ে কুঁকড়ে থাকা বলে চালিয়ে দেওয়া গিয়েছিল। দুই পায়ের মাঝখান, ঊরুর চামড়া ফেটে বেরোনো রক্ত, বুকে দাঁতের দাগ কেউ দেখতে পাবে না জানা ছিল। ঘাড় গলার আঁচড়কামড় শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে নেওয়া গিয়েছিল। বৃষ্টির বাজারে স্বাভাবিক।

হাঁটতে পারছিলেন না প্রমীলা। পা ঘষটে ঘষটে ঘরে এসে ঢুকেছিলেন। দরজা বন্ধ করার নিয়ম ছিল না। খিদে নেই বলে না খেয়ে শুয়ে পড়ার সাহস ছিল না। ভাত নেড়েচেড়ে উঠে এসেছিলেন। রান্নাঘর বন্ধ করে শুতে এসে মা পিঠে হাত রেখেছিলেন। ঠিক যেখানে ক্লাবঘরের নোংরা মেঝেতে ছড়ানো পাথরকুচির কোণা ক্রমাগত বিঁধে মাংস থেঁতলে দিয়েছিল। ব্যথায় চোখে জল এসেছিল প্রমীলার। ব্যথার জায়গায় আরও ব্যথা দিতে দিতে মা বলেছিলেন, “তোর ভালোর জন্যই তো শাসন করে। যদি কিছু হয়ে যেত?”

*****

তলপেটের ওই ব্যথাটাকেই কি ট্রমা বলে? গোটা সপ্তাহ জুড়ে বাবু হয়ে বসতে না পারাটাকে? নাকি যখন পেটব্যথা চলে গেছে, পিঠের দপদপানি ঢিমেতালা, কিন্তু প্রমীলা মনে করতে পারছেন না আগের মাসে কত তারিখে তাঁর মাসিক হয়েছিল, রোজ ফ্যানের দিকে তাকাচ্ছেন, বিধুদের গোয়ালঘরে মোটা দড়ি দেখে রাখছেন, বাথরুম পরিষ্কারের জন্য রাখা বোতলে কতখানি অ্যাসিড বাকি আছে পরীক্ষা করছেন সকালবিকেল, সেই অপেক্ষাটাকে?

দীর্ঘ সতেরোদিন পর রক্ত এল। প্রমীলা বেঁচে গেলেন।

রাতে ঘুম অল্প অল্প করে ফিরে এল। নতুন ক্লাসে ওঠার পরীক্ষা এল। পুজোয় নতুন শাড়ি এল। মেজদির জন্য ভালো সম্বন্ধ নিয়ে ঘটক এল। রবিবার দেখে বিকেলে লোকলস্কর নিয়ে পাত্রপক্ষ এল। মাসিপিসি বোনেদের সঙ্গে প্রমীলাও মেজদিকে জাপটে ধরে বসার ঘরে নিয়ে এলেন। যেন ছেড়ে দিলেই মেজদি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে বা ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে দৌড়বে দিকবিদিক ভুলে। মেজদি সে সব কিছুই করল না। পুঁটলির মতো গিয়ে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে পড়ল। মেজদির পাশের টুলে প্রমীলা বসলেন আর মুখ তুলে দেখলেন পাত্রের চেয়ারে লোকটা বসে আছে।

রাশি রাশি সন্দেশ রসগোল্লার সামনে হাসিহাসি মুখে বসে রইল সবাই, মেজদি গান গাইল, বাবামা, ঘটক মেজদির প্রশংসা করলেন, পাত্রপক্ষ পাত্রের গুণকীর্তন করল। কুরুশের টেবিলঢাকার কলকার ফুটো থেকে একটিবারও চোখ না সরিয়েও প্রমীলা টের পাচ্ছিলেন লোকটার দৃষ্টি কখন তাঁর ওপর এসে থামছে। সেই মুহূর্তগুলোতে ঘরের বাতাসের উত্তাপ পাঁচ ডিগ্রি কমে যাচ্ছিল। অবশেষে ‘আচ্ছা তবে আসি’ বলে সম্মিলিত হাঁফ ছেড়ে সবাই উঠে পড়ল, প্রমীলার ওপর হুকুম হল কারও জুতো পরতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না বারান্দায় গিয়ে তদারক করার। প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও আর এড়ানো গেল না, লোকটার চোখে চোখ পড়ে গেল।

আর তখনই প্রমীলাকে চোখ মারল লোকটা। প্রথমবার।

*****

কয়েকবছর পর আলমারি থেকে আবার কুরুশের টেবিলক্লথ বেরোল। থালায় সন্দেশ রসগোল্লা পান্তুয়া সাজল। যাতে কিছুতেই দৌড়ে পালাতে না পারেন, সবাই মিলে চেপে ধরে প্রমীলাকে বসার ঘরে এনে বসাল। টেবিলক্লথের কলকার ফুটোর দিকে তাকিয়ে প্রমীলা নট নড়নচড়ন বসে রইলেন। এবার আর তাঁকে বারান্দায় যেতে হল না। ক’দিন পর ঘটক খবর আনলেন পাত্রের বাড়ির প্রমীলাকে পছন্দ হয়েছে। পাত্রকে জিজ্ঞাসা করায় সে লজ্জা পেয়ে, ‘তোমরা যা ভালো বোঝো করো,’ বলেছে। প্রমীলার বাবা মৃদু হাসলেন, মা দশ আঙুলে আঙুল জড়িয়ে মাথায় ঠেকিয়ে বিড়বিড় করলেন। পাত্র তাঁদেরও পছন্দ।

ঘটক বলল, ‘তবে আর কি, ডাকুন পুরুত, বসান নহবৎ। আমার বিদায়টা এবার একটু বাড়িয়ে দেবেন। বাজারের যা অবস্থা।’

*****

ঘোরানোর সময় পিঁড়ির ডানদিকের পেছনের কোণাটা ধরেছিল লোকটা। লোকটার গরম নিঃশ্বাস লাগছিল এসে ঘাড়ে। প্রমীলার ভয়ে ঠকঠক শরীর, রক্তশূন্য মুখ, টিপে বন্ধ করে রাখা চোখ দেখে সবাই খুশি হয়ে বলেছিল, ‘একেবারে বাচ্চা মেয়ে।’

*****

ন’মাসের মাথায় বড় খোকা হল। দু’বছরের মাথায় বড় খুকি, তার এক বছর পরে একটক্কায় আরও দুজন। কান্না, চিড়িয়াখানা, স্কুলের টিফিন আর অযুতনিযুত ন্যাকড়া পাল্টানো ছাড়া ওই সময়টার আর কিছু মনে নেই প্রমীলার। ওই সময়টায় সবকিছু ভুলে গেলেও যেতে পারতেন কিন্তু আত্মীয়স্বজনদের বিয়ে, বাচ্চা, অন্নপ্রাশন, পৈতে, শ্রাদ্ধ, লক্ষ্মীপুজোয়, সর্বত্র ওই লোকটা। সিঁড়ির কোণায়, ছাদের ধারে, কলতলায়, ঠাকুর প্রণাম করে মুখ তুলে চোখে চোখ। যতবার চোখ পড়ছে, ঝিকিয়ে উঠছে দাঁত, মটকে উঠছে চোখ। আর ততবার সিগারেটের গন্ধওয়ালা আঙুলের চাপে বন্ধ নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস, ততবার তলপেটে অসহ্য ব্যথা, ততবার পিঠের নিচে ধারালো কাঁকর।

*****

ও মা গো…

কী হল? ও মাই গড…কখন হল? কী করে হল?… ওরে গবেষণা পরে করবি আগে ডাক্তারকে ফোন কর… আমারটায় চার্জ নেই তোমার ফোনটা দাও বাবা… কিছু খেয়েছিল নাকি?… সকালে তো সবাই লুচি খেল… দুপুরে ইলিশ, হোয়াট? চার পিস? চাইল মানে কী? বিষ চাইলে বিষ দেবে?… এই বয়সে… অতিথি মানুষ, কিছু একটা হয়ে গেলে বিশ্রী ব্যাপার হবে…… আসুন ডাক্তারবাবু, এই যে এদিকে, দোতলায়… আরে কমপ্লিটলি সুস্থ, দুপুরে ইলিশ খেয়েছে… না না বাড়িতে রেখে রিস্ক নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না…… প্যাঁ প্যাঁ পোঁ পোঁ…… অ্যাম্বুলেন্সে ভিড় বাড়ানোর কোনও দরকার নেই… একটা ইয়ং ছেলে দরকার… বুল্টু যা… হ্যাঁ হ্যাঁ আমার ফোনটা নিয়ে যা… মাসিমণি কেঁদো না… সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো…

মা কোথায়? মাকে দেখেছে কেউ?

ঠাম্মি ওপরে… খবর পেয়েছে? আচ্ছা থাক, এক্ষুনি কিছু বলার দরকার নেই… হ্যাঁ ভাই হ্যাঁ তাড়া তোমার থেকে আমাদের কিছু কম নেই… বুল্টু ওঠ শিগগিরি, ডাক্তারের সঙ্গে সঙ্গে থাকবি, যা হবে ফোন করে জানাবি, আমরা আসছি একটু পরেই… ওফ অ্যাম্বুলেন্সের সামনে থেকে ষাঁড়টাকে তাড়া কেউ… যত্তসব…

*****

আওয়াজ পেয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে থেকে দ্রুত সরে আসার চেষ্টা করলেন প্রমীলা কিন্তু ততক্ষণে দরজা ঠেলে বুল্টু ঢুকে পড়েছে। প্রমীলার নার্ভাস মুখের দিকে তাকিয়ে অবাকই হল হয়তো, সামলেও নিল।

‘রেডি ঠাম্মি?’

শহরের ট্র্যাফিকের যা ছিরি আগেভাগে না বেরোলে ভিজিটিং আওয়ার্স থাকতে থাকতে নার্সিং হোম পৌঁছনো যাবে না। তাছাড়া প্রমীলা যে স্পিডে নড়েনচড়েন স্বাভাবিকের দেড়গুণ সময় লাগবে। বাড়ির সবাই আগেই দেখে এসেছে। খুচরোখাচরা তথ্য এসেছে প্রমীলার কানে। আই সি ইউ-তে রেখেছে… পরিস্থিতি খারাপ হয়নি, কিন্তু ভালোও হয়নি… বয়সটাও তো দেখতে হবে… হ্যাঁ, জ্ঞান আছে… বলছে তো বাহাত্তর ঘণ্টা ওয়াচে রাখতে হবে, তার আগে কিছু বলা যাবে না…

বাহাত্তর ঘণ্টা।

পঞ্চান্ন বছর দু’মাস সতেরো দিন।

‘আর দেরি করা উচিত হবে না, বুল্টু। একদিন নিয়ে যাস আমাকে।’ পুতির জন্য সেলাই হতে থাকা কাঁথাটা মুখের কাছে তুলে দাঁত দিয়ে সুতো কেটে বলেছিলেন প্রমীলা।

গাড়ির ঝাপসা কাঁচে দুয়েকটা আঁকাবাঁকা রেখার মধ্যে দিয়ে ঘোলাটে আকাশ দেখতে দেখতে প্রমীলা হাসপাতালে পৌঁছলেন। শশব্যস্ত নার্সিং হোম। রোগের শেষ নেই, চিকিৎসারও না। একতলার অপেক্ষা করার জায়গা গমগম করছে। চড়া এসিতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মাথা ঘুরছে। হাত কাঁপছে। নাতিকে শক্ত করে আঁকড়ালেন প্রমীলা। গলা শুকনো। বোতলটা বোধহয় গাড়ি থেকে নামানো হয়নি। গাড়িতে বুল্টু বলেছিল জল খাওয়ার কথা। খেলেই হত।

লিফটের মাথার ওপর রক্তাক্ষরে এক দুই তিন চার। সাততলায় হাত ধরে সাবধানে নামাল বুল্টু।

সাদা আলোর নিচে তকতকে করিডর ছিরকুটে পড়ে আছে। বাড়িতে লাইজল দিয়ে ঘর মোছার সময় প্রমীলা নাকে আঁচল চেপে বসে থাকেন, এখানে চতুর্দিকে জীবাণুনাশকের কড়া গন্ধে পেট মোচড় দিয়ে উঠছে। ইস্তিরি করা টুপি মাথায় একটা মেয়ে ঘড়ঘড়ে ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে পাশ দিয়ে চলে গেল।

‘কতদূর রে বুল্টু?’

‘ওই তো ঠাম্মি, কোণের ঘরটা।’

ঘরের ভেতর সবুজ পর্দা ঘেরা আরেক ঘর। বুল্টুর হাত ধরে পর্দার এপাশে এসে দাঁড়ালেন প্রমীলা। দেওয়ালজোড়া জানালার কাঁচের ওপারে রুদ্ধশ্বাস আকাশ। যন্ত্রপাতি ঠাসাঠাসি, তারে তারে ছয়লাপ ঘরের মাঝে মাথা উঁচু করা খাটের সাদা চাদরে মিশে গিয়ে শুয়ে আছে লোকটা। দুই হাত পেটের ওপর জড়ো করা। হাতে ফোটানো সূচ দিয়ে জীবনদায়ী তরল এসে ঢুকছে শরীরে। ড্রিপ ড্রিপ ড্রিপ।

ফোন বেজে উঠছে আওয়াজ করে। “শিট” বলে পকেট হাতড়াচ্ছে বুল্টু, কানে লাগিয়ে ফিসফিস করে বলছে, ‘হ্যাঁ বাবা, এই সবে পৌঁছলাম, যা জ্যাম। না ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়নি এখনও। শিওর শিওর।’ প্রমীলাকে ঠেলে বেডের পাশে এগিয়ে দিচ্ছে, কাঁধ ছুঁয়ে ইশারায় বলছে, এখানেই থাকো। তর্জনী তুলে বোঝাতে চাইছে, আমি এক মিনিটে ফিরছি।

পর্দা সরিয়ে বুল্টু বেরিয়ে গেল।

লোকটার সঙ্গে প্রমীলাকে একা রেখে।

*****

লোকটা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। প্রতিরোধহীন। নাকে লাগানো ওই প্লাস্টিকের ঢাকনাটাকে যদি ঢাল হিসেবে ধরে কেউ ধরতে পারে। লোকটার এই মুহূর্তে কোনও হেল্পলাইন নেই। এখন ভালোমন্দ কিছু ঘটে গেলে লোকটার ট্রমা হবে কি?

হলেও কি প্রমীলা কেয়ার করবেন?

নাঃ আবোলতাবোল ভেবে দেরি করে লাভ নেই। যে কেউ ঘরে ঢুকে আসতে পারে এক্ষুণি। বুল্টু কিংবা ডাক্তার কিংবা নার্স। প্রমীলা খাটের বেঁটে রেলিং ধরে ঝাঁকুনি দিলেন। অস্ফুট আওয়াজ করে লোকটা চোখ খুলল। চোখের মণি ঘুরছে এদিক ওদিক। প্রমীলা অপেক্ষা করলেন। নিশ্চিত হওয়া দরকার লোকটা তাঁকে চিনতে পেরেছে।

মণিজোড়া অবশেষে প্রমীলার মুখে স্থির হল। চিনেছে।

প্রমীলা শিরদাঁড়া টান করলেন। লোকটার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেলেন।

বাঁ চোখের পলক ঝটিতি বন্ধ হয়েই খুলল আবার। ডান চোখের পলক কাঁপল না। ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে প্র্যাকটিস করা শত শত ব্যর্থ,একটা বন্ধ করতে গিয়ে দুটোই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কিংবা দুটোর কোনওটাই ঠিক করে বন্ধ হচ্ছে না গোছের অস্পষ্ট, অকার্যকরী নয়; অমোঘ, অভ্রান্ত চাবুকের মতো চোখ মারলেন প্রমীলা লোকটার দিকে তাকিয়ে।

লোকটার ফ্যালফেলে দৃষ্টি পেছনে ফেলে হাতে ধরা চশমাটার ভাঁজ খুলে পরে পর্দা সরিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন প্রমীলা। জানালার বাইরে আকাশ চিরে দিল সোনালি বিদ্যুৎ। প্রকাণ্ড গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল শহর ভাসিয়ে।

করিডর ধরে হেঁটে চললেন প্রমীলা।

আগুনলাল শাড়ি পরে, পাতা কেটে চুল বেঁধে, বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরল একটা মেয়ে।

একা একা।

 

(Ruth Rendell-এর The Wink ছোটগল্পের ছায়াবলম্বনে)

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

আপনার মতামত...