দেশভাগ ও ‘সীমান্ত আখ্যান’ : এক চলচ্চিত্র নির্মাতার জবানবন্দি

সৌমিত্র দস্তিদার

 

বলা কওয়া নেই, আচমকা ছোটবেলাটা ঘরে ঢুকে পড়ল। এন্টালিতে আমার মামার বাড়িতে মা, মাসিরা, দিদিমা খেতে বসলেই টুকরো টুকরো নানা কথা কানে আসত। তখন মন দিতাম না। এখন কেমন সেই প্রায় না শোনা কথা, শব্দ, বিলাপ, বিষাদ হাহাকার এক হয়ে জোরে, বেশ জোরে ঘরময় গমগম করছে। মা-দের ফেলে আসা খুলনা, এপারে এসে স্বজনদের খারাপ ব্যবহার — এসবই উঠে আসত খাওয়ার সময়। এখন এতদিন বাদে যখন মায়েরা কেউই আর বেঁচে নেই, তখন মনে হচ্ছে ওসবই ছিল দেশভাগের যন্ত্রণা, যা আসলে উদ্বাস্তু বিলাপ। শরণার্থী উদ্বাস্তুর আভিধানিক অর্থ নিয়ে তর্ক আছে। সাধারণত ধরে নেওয়া হয়, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কারণে যারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তারাই শরণার্থী। আরএসএস যেমন বলে যে ‘ওপার থেকে আসা হিন্দুরা শরণার্থী, মুসলমানেরা হাজার প্রয়োজনে এলেও অনুপ্রবেশকারী’। দিদিমা এপারে এসেছিলেন অবশ্যই কিছুটা আতঙ্কে। ছোট ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তা চিন্তায়। কিন্তু একজন মুসলমানের কোনও অত্যাচারের গল্প মা দিদিমার মুখে কোনওদিন শুনিনি। বরং তারা ঠকেছিলেন নিজের ঘনিষ্ঠদের অসততায়। এখন এতদিন বাদে আচমকা মনে এল ধর্মীয় অত্যাচারে দেশ আমার মায়েরা ছাড়েনি, তবে কি তারা উদ্বাস্তু নন! আসলে রাজনীতিই তাদের প্রয়োজনে, পছন্দমতন পরিভাষা নির্মাণ করে। সভ্যতার আদি থেকে এই মাইগ্রেশন চলছে। আর্থিক কারণে, বাণিজ্যবিস্তার, প্রভুত্ব কায়েম করতে মানুষ সবসময় একদেশ থেকে অন্যদেশে এসেছে। আজও আসছে। কোনও পাঁচিল, কাঁটাতার তাকে আটকাতে পারে না। আসামে বিদেশি অনুপ্রবেশ যত না বাস্তব, তার চেয়ে অনেক বেশি মিথ, কাল্পনিক এবং অবশ্যই রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক। হালফিলের এনআরসি রিপোর্টেও তা কিছুটা সামনে এসেছে। মূলত বিদেশি বিদেশি বলে যাদের দিকে অভিযোগের বর্শামুখ তাক করা ছিল, ঘটনাচক্রে সেই মুসলমানদের চেয়ে বেশি নাম বাদ গেছে হিন্দু, আদিবাসী ও উপজাতিদেরও। হিন্দুর মধ্যে অসমিয়া, বাঙালি দুই-ই আছে। বাঙালির ভেতরে সংখ্যায় বেশি নিম্নবর্গের মানুষ।

উদ্বাস্তু বলতেই আমরা প্রথমেই যে চিত্ররূপ পাই তা হচ্ছে দেশভাগের পরে ওপার থেকে আসা জনতার মিছিল। আমাদের সিনেমা, থিয়েটার, সাহিত্যেও ওই বিষণ্ণ মুখের ভিড়। দেশভাগ ও উদ্বাস্তু নিয়ে আমার ভাবনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার ছবি ‘সীমান্ত আখ্যান’, যেখানে আমি এইসব নিম্নবর্গের মানুষের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এ ছবির নির্মাণেরও একটা অন্য আখ্যান আছে, যা আমাকে এই দেশভাগ, সীমান্ত, কাঁটাতার, অনুপ্রবেশ নিয়ে ভাবতে সাহায্য করে। ২০১১ সালে রাজেন্দ্র সাচারের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তিনি তখন নিজেই কিংবদন্তী, ওঁর পেশ করা রিপোর্টের দৌলতে। সারা দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের আর্থিক, রাজনৈতিক অবস্থা বে-আব্রু হয়ে সামনে আসায় রাজনীতিবিদদের বড় অংশকেই তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। এ রাজ্যের বামপন্থীরাও জনগণের ক্ষোভের মুখে পড়েন। সাচার সাহেব আমাকে উৎসাহ দেন যেন গ্রামে গ্রামে ঘুরে ছবিটা বানাই। সাচার সাহেবের পরামর্শেই আমি গ্রামে শহরে বাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে মিশতে গিয়ে বুঝলাম — ৪৭ সালের দেশভাগ এ রাজ্যের মুসলমানদের দুর্দশার বড় কারণ। ভাগাভাগির পরে ৪৭-৫০ মধ্যবিত্ত ও সচ্ছল মুসলিমদের বড় অংশ ইচ্ছেয় বা বাধ্য হয়ে তখনকার পূর্ববাংলায় চলে গেলেন। এপারে যারা থাকলেন তাদের অধিকাংশই হতদরিদ্র। গরীব কৃষক, ক্ষেতমজুর, বিড়ি-জরি শ্রমিক, সামান্য পুঁজির ব্যবসায়ী। আমার সেই ছবি ‘মুসলমানের কথা’ করতে করতেই আমি দেশভাগ নিয়ে ছবি করার কথা প্রথম ভাবলাম। ভাবলাম ঠিকই, কিন্তু গ্রামে শহরে সীমান্তে ঘুরে ঘুরে কাজ করতে গিয়ে যা দেখলাম তা আমাকে খানিকটা স্তম্ভিতই করল। কারণ আমাদের চেনাপাঠে মুসলিম লিগ, জিন্নাকে যেভাবে খলনায়ক করা হয়েছে, বাস্তবে তা পুরোপুরি সত্যি নয়।

আমার কাজ ছবি নির্মাণ। কিন্তু এই ধরনের বহুস্তরীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে যেমন পড়াশুনো দরকার হয়, ‘সীমান্ত আখ্যান’ করতে গিয়ে আমি দেশভাগ নিয়েও তেমন প্রবল হোমওয়ার্ক শুরু করি। করতে করতে বুঝতে পারি, এটা একটা জটিল বিষয়। নানা বিষয় জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে, ফলে আমার কাজটা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে। আমি যেন এক অন্ধকার সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়েছি, বের হতে পারছি না সেখান থেকে। সিলেটের কথা ধরা যাক, আগে আমার পরিকল্পনায় সিলেটের কোনও জায়গা ছিল না। গণভোট নিয়েও তেমন কিছু জানতাম না। এবার এনআরসি নিয়ে ছবি করতে অসমে গিয়ে অনেক বিষয় সামনে এল। আপাতভাবে গণভোট হয়েছিল দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে। হিন্দু বাঙালি চেয়েছিলেন অসমে থাকতে, মুসলিমরা চেয়েছিলেন প্রস্তাবিত পাকিস্তানে যেতে। কিন্তু আমি যদি বলি একটা বড় অংশের মুসলমান জনতা, যাদের অধিকাংশই কৃষক তারা বাংলাতে থাকতে চেয়ে গণভোট দিয়েছিলেন, তখন ছবিটা নিশ্চয়ই অনেকের কাছে একটু অন্যরকম ঠেকবে।

দেশভাগের পরে সীমান্তের দু’দিকে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিনিময়ের একটা কথা উঠেছিল। কিছু কিছু পরিবারের মধ্যে তা হয়েওছিল। সরকারি চাকুরেরা অপশন দিয়ে সুবিধেমত জায়গায় বদলি নিয়েছিলেন। নেহরু বোধহয় আশা করেছিলেন বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের মধ্যে অন্তত মারামারি, বিদ্বেষ চিরকাল থাকবে না। এই আশাতেই তিনি লিয়াকত আলির সঙ্গে পুনর্বাসন চুক্তি করেছিলেন। দাঙ্গায় বাধ্য হয়ে যারা দেশ ছেড়ে চলে গেছিলেন তাদের ফিরে আসতে অনুরোধ করেছিলেন। বাংলা, অসমে কিছু পরিবার ফিরেও এসেছিলেন। তবু সব স্বাভাবিক হয়নি। হয়নি যে তার বড় উদাহরণ পরবর্তীকালে নেলী হত্যাকাণ্ড।

গণভোটের সময় মুসলিম লিগের একটা ছড়া লোকের মুখে মুখে ফিরত। ‘আসামের জুলুমের কথা জীবন থাকতে ভুলব না, আমরা তো ভাই আসামে থাকব না……. হাতিদিয়া মসজিদ ভাঙ্গল গম্বুজের চিন রাখল না, আমরা তো ভাই আসামে থাকব না….’। এখানে কিন্তু কোনও ধর্মীয় বিদ্বেষ নেই, যা আছে তা তীব্র ক্ষোভ, ব্যথা। এটা তো ঘটনা যে ১৮৭৪ অবধি অসম বাংলার মধ্যেই ছিল। রাজস্ব বৃদ্ধির প্রয়োজনে বৃটিশ দলে দলে কৃষকদের অসমে নিয়ে এসেছিল। তারা তাদের প্রতিভা, শ্রম, নিষ্ঠা দিয়ে অসমের বিস্তীর্ণ এলাকাকে শস্যভাণ্ডার করে তুলেছিল। রাজস্ব বাড়িয়েছিল এক এক জায়গায় দ্বিগুণ, তিনগুণ। প্রয়োজন ফুরিয়ে যেতে বর্ণহিন্দুদের একাংশ তাদের ওপর নানা ধরনের অমানুষিক অত্যাচার শুরু করে। বস্তুত ক্ষুব্ধ কৃষকদের নেতা হিসেবেই রাজনীতির সামনের সারিতে আসেন মৌলানা ভাসানী। অহমিয়া জাত্যাভিমান ও বর্ণহিন্দুদের একাংশের অবহেলাই মুসলিম জনগণের বড় অংশকে ঠেলে দিয়েছিল সিলেট ভাগের দিকে। আপনি যদি নিছক বিষয়টিকে হিন্দু মুসলমানে ভাগ করেন তাহলে ভুল করবেন। ওই ভোটে হিন্দুদের পাশে কে কতটা ছিলেন, নতুন নতুন গবেষণায় তা ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। প্যাটেল তো বলেইছিলেন — অসম থেকে একটা ক্যান্সারকে কেটে বাদ দেওয়া গেল। এখন যারা বাংলায় এসে ফাগুয়া ঝাণ্ডার বাণী দিচ্ছেন আর অস্ত্র হাতে রাস্তায় নেমে মুসলিমদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে বিক্রম দেখাচ্ছেন, তখন সিলেটের গণভোটে তাদের ভাইবেরাদরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলুন। আমার দেশভাগের ছবিতে নেহরুর প্রবল সমালোচনা আছে। তবু বলব অসমের হিন্দু বাঙালির যদি কেউ ক্ষতি করে থাকেন তাহলে তা করেছেন দুজনে — বল্লভভাই প্যাটেল ও গোপীনাথ বরদলুই। বাংলাতে ইদানীং শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে খুব চর্চা হচ্ছে। তাকে আইকন করে সঙ্ঘীরা রাস্তায় নামছে। অথচ বাংলাভাগ নিয়ে সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। তিনি চেয়েছিলেন যে ভারত না হলেও বাংলাভাগ করতেই হবে। বাংলা বলতে তিনি পশ্চিমবঙ্গটুকুই বুঝেছিলেন। ভবানীপুরের সাবেক এদেশি মুখুজ্যে পরিবারের সন্তানের কাছে ওপারের ‘বাঙাল’দের নিয়ে কোনও মাথাব্যাথাই ছিল না। অথচ ওপার বাংলাই ছিল হিন্দুমহাসভার বড় ঘাঁটি। দেশভাগের পরে পরেই হিন্দুমহাসভার নেতারা যখন এপারে এলেন, তারা তখনও বোঝেননি যে এপারের ‘ঘটি’দের কাছে ওপারের ‘বাঙাল’রা মোটেও স্বাগত নন।

যেমন ওপার বাংলা থেকে হিন্দুরা স্বাগত নন অসমে। ডি-ভোটার থেকে ভোটার লিস্টে, এখন এনআরসি তালিকা থেকে কয়েক লাখ হিন্দুর নাম বাদ গেছে। মিথ্যে বলা হচ্ছে তারা সবাই শরণার্থী। কাউকে এদেশ থেকে চলে যেতে হবে না। নতুন বিল আনা হচ্ছে হিন্দুর ‘সুরক্ষা’য়। বিলে বলা হচ্ছে যে আপনি কয়েক বছর বাদে নাগরিক হওয়ার জন্যে আবেদন করতে পারেন। তার মানে নাগরিক না হওয়া অব্দি আপনি এদেশের কোনও নাগরিক অধিকার পাবেন না। পাশাপাশি আপনি স্বীকার করছেন যে আপনি ‘বিদেশি’। ওপার থেকে ‘নির্যাতিত’ হয়ে এপারে এসেছেন। নির্যাতিত হওয়ার প্রমাণও আপনাকে দাখিল করতে হবে। শিলচর, করিমগঞ্জের নমঃশুদ্র, কৈবর্তদের মহল্লায় যান, তাদের ক্ষোভ, যন্ত্রণা টের পাবেন। গোটা বিষয়টার মধ্যে লুকিয়ে আছে রাজনৈতিক সুবিধেবাদ ও ভোট রাজনীতি।

আমাদের দেশভাগ বহুমাত্রিক। আমি একটু একটু করে রিসার্চ করেছি ও শট নিয়েছি। তিন বছর ধরে আমি একটা স্বপ্নের পিছনে ছুটেছি। এত বড় বিষয়, এত বড় ঘটনা, মনে হয়েছে এটা অন্তত তিন পর্বে শেষ করতে হবে। আমি এখন অবধি একটি পর্ব শেষ করেছি। জীবনে এখন অবধি যত কাজ করেছি এটা সবচেয়ে কঠিন। বলতে পারেন আমি একটা ভিস্যুয়াল প্রবন্ধ লিখেছি, নির্মাণ করেছি। কত কত রাত ঘুম হয়নি। মনে হয়েছে আমি যেন ১৯৩৭-৪৬-এর বাংলায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। গান্ধীজীর বেলেঘাটার ঠিকানায় গেছি, সোওরাবর্দীর বাড়িতে গেছি। রিপন স্ট্রিটে আবুল হাশেম আর এলগিন রোডে শরৎ বসুর বৈঠকখানায় ঢুকে পড়েছি। এখনও আমি এক অচেনা অনির্দিষ্ট পথে হাঁটছি। জানি না এর শেষ কোথায়! আমি কেন দেশভাগ নিয়ে কাজ করতে চাইছি, নিঃসন্দেহে তার আরও একটা কারণ দক্ষিণপন্থী রাজনীতির মুখোশ খুলে দেওয়া। অনেক আগে থেকেই, ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে দক্ষিণপন্থার ভূমিকা আছে। কখনও তারা এগিয়েছে, কখনও বাম, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির দাপটের কাছে তারা পিছু হটেছে। দেশভাগের সময় তারা প্রবল শক্তিশালী ভূমিকা নিয়েছিল। এখন আবার তারা সমস্ত নখদাঁত বের করে এদেশের সংবিধান, সেকুলার নীতি সব ভাঙতে সক্রিয় হয়েছে। তাদের অন্যতম অস্ত্র মিথ্যে প্রচার আর মুসলিম বিদ্বেষ। এই বিদ্বেষ তারা রপ্ত করেছে আন্তর্জাতিক ইসলামফোবিকদের কাছ থেকে।

আমি ছবির দ্বিতীয় পর্ব করব আসাম নিয়ে। সিলেট ভাগ অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দেশভাগের ডিসকোর্সে বাংলা যেটুকু আসে, অসম একেবারেই আসে না। অথচ এপার থেকে, বা অসমের বিপুল এলাকা থেকেও যে মুসলিম সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার লোককে উদ্বাস্তু হয়ে কষ্টের জীবন যাপন করতে হয়েছে, ইতিহাসের এই দিকটা আমাদের চেনা পাঠে আসে না। আমাদের সময় এসেছে অন্য সম্প্রদায়কে বলা যে ভাই — আমরাও তো তোমাদের ওপর কম অত্যাচার করিনি। অসমে তো ১৯১০/১২ থেকেই মুসলিমদের ওপর অহমিয়া জাত্যাভিমানের হামলা শুরু হয়েছে। এক রাতে এক এক জায়গা থেকে কয়েক হাজার মুসলিমকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদের বিদেশি তকমা লাগিয়ে। ১৯৫০ সালে কোনও রকম প্ররোচনা ছাড়াই মার্চের প্রথম সপ্তাহে কামরূপ, গোয়ালপাড়া জেলায় একতরফাভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়। ওই সময় প্রায় চার লাখ মুসলিমকে এদেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। অনেককেই ওপারে গিয়ে রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে হয়। এই রিফিউজিদের কোনও আখ্যান কি আমি আপনি কোনওদিন শুনেছি? শুনতে চেয়েছি? নেহরু-লিয়াকত চুক্তি মেনে কেউ কেউ ফিরে আসতে থাকেন তাদের ফেলে আসা বাসায়। ১৯৫১ সালের এনআরসি চলার পরেই অনেকে আসে না। স্বাভাবিকভাবে এনআরসি-তে তাদের নাম ওঠেনি। ফলে আজ যখন চল্লিশ লাখ লোকের নাম বাদ গেছে এনআরসি থেকে, তার মধ্যে ওইসময় বাদ যাওয়া অনেক পরিবারের সদস্যও আছেন। আসলে প্রেক্ষিতকে সংবেদী চোখে না দেখলে এ সমস্যা হবেই। আগে বহুবার বলেছি, আমার ‘সীমান্ত আখ্যান’-এও বলতে চেয়েছি অনুপ্রবেশ বিজেপির একটা বিরাট ধাপ্পা। ইলেকশন এলেই এসব নিয়ে তারা বাজার গরম করে। অসমেই বলুন বা এ রাজ্যে। অসমে তো বহু বছর ধরে তারা জনমনে এ ধারণার জন্ম দিয়েছে অনুপ্রবেশ আসামের আর্থসামাজিক ও জনবিন্যাস বদলে দিয়েছে। এর ফলে দাড়িটুপি পরা মুসলিম দেখলেই ঘৃণার সঙ্গে লোকে আঙুল তোলে ওই ওই বিদেশি, বাংলাদেশি যাচ্ছে। অসমে ইতিমধ্যেই হয়েছে, এ বঙ্গেও প্রায় হচ্ছে — বাংলাদেশি শব্দটাই ঘেন্নার অন্য পরিভাষা। বিজেপির রাজনীতি এভাবে কোনওরকম সৌজন্যের ধার না ধেরে প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে মিথ্যে দোষারোপ করে আসছে। মিথ্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ — ১৯৯৪ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস কে সিনহা, যিনি তখন অসমের রাজ্যপাল ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতিকে এক রিপোর্টে দাবি করেন যে, অসমে রোজ ৬ হাজার বাংলাদেশি সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে। ওই রিপোর্ট যদি সত্যি হয় তাহলে ১৬ বছরে (১৯৯৪-২০১১) ৩ কোটি ৪৫ লাখ বাংলাদেশি আসামে ঢুকেছে। আরও ১ কোটি বাংলাদেশি আগেই অনুপ্রবেশ করেছে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। অথচ ২০১১ সালের সেনসাস রিপোর্টে আসামের জনসংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৪৫ লাখ। তাহলে মেনে নিতে হয় মোট জনসংখ্যার চেয়ে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বেশি। এরকম মনগড়া, আদ্যন্ত মিথ্যে নোট চালাচালি চলছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুই পদাধিকারীর মধ্যে। তখনই যদি ছবিটা এই হয়, তাহলে মোদি সরকারের আমলে গোয়েবলসীয় কৌশল কোন পর্যায়ে গেছে তা একটি শিশুও বুঝতে পারবে।

অনেকে বলছেন প্রথমিক পর্যায়ে যে বিপুলসংখ্যক, চল্লিশ লক্ষ লোকের নাম এনআরসি থেকে বাদ পড়েছে, চূড়ান্ত পর্যায়ে অত হবে না। তর্কের খাতিরে ধরলাম যে মাত্র এক লাখ লোক নাগরিকত্ব হারল। তো সেই এক লাখের কী হবে? তারা যাবে কোথায়? বাংলাদেশ কি তাদের ফিরিয়ে নেবে? না তারা পাকাপাকি শরণার্থী হয়ে দেশের যাবতীয় অধিকার বঞ্চিত পরজীবী হয়ে মুনাফা বৃদ্ধির শস্তা শ্রমিক হয়ে পুৃঁজির সেবাদাস হয়ে বেঁচে থাকবেন? আর তাছাড়া সংখ্যা দিয়ে কি মানবতার পরিমাপ করা যায়?

আসলে দেশের অর্থনীতি এখন গভীর সঙ্কটে। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা প্রত্যেকটা ধাপ্পা তা লোকে বুঝতে পারছে। কোটি কোটি টাকা লুঠ করে বিজয় মাল্য, নীরব মোদিরা কার প্রশ্রয়ে বিদেশে আছেন তাও এখন লোকের কাছে পরিষ্কার। তাই নির্বাচনে জিততে মোদির একমাত্র অস্ত্র ধর্মীয় মেরুকরণ। তাই সঙ্ঘ পরিবার মিথ্যে বলতে বলতে মিথ্যেটাকেই সত্যি করতে চাইছে। অনুপ্রবেশ সেই কৌশলেরই এক গুরুত্বপূর্ণ প্রচার। আমি একজন চিত্রনির্মাতা হিসেবে আসল সত্যিটাকে সামনে আনতে চেয়েছি। আমি শুরুতে বলেছি আজকের অসম কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, যেমন নয় উদ্বাস্তু, অনুপ্রবেশ ইত্যাদি সামাজিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক সমস্যা। এটা দক্ষিণপন্থী মতাদর্শ, সারা দুনিয়ায় যা আজ সামনে আসছে রাইট উইং পলিটিকসের আপাত জনপ্রিয়তার মধ্য দিয়ে। আপনার কাজ প্রয়োজনে স্রোতের বিরুদ্ধে হেঁটে আসল সত্যিকে প্রতিষ্ঠা করা। আমি সেই কাজটুকুই করতে চেয়েছি। রাষ্ট্রের লাল চোখকে বিন্দুমাত্র সমীহ না করে। এমন একটা সময় আমি এসব বলছি যখন আমার দেশে ফ্যাসিবাদের ছায়া গভীর হচ্ছে। দলিত আদিবাসী মুসলমানদের ওপর নির্যাতন বাড়ছে। মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। বুদ্ধিজীবীদেরও জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। খুন হচ্ছেন মুক্তচিন্তাবিদরা। আমি জানি আমার ছবি সেন্সর নামক অগণতান্ত্রিক, সরকারের সেবাদাস সংস্থার অনুমোদন পাবে না। তাই ইউটিউবেই প্রকাশ করে দিলাম সীমান্ত আখ্যান — প্রথম পর্ব। যা তর্ক চলার চলুক। হয়ে উঠুক ইতিহাসের এক অচেনা, নতুন পাঠ। হয়ে উঠুক সময়ের এক ডিজিটাল দলিল।

এইরকম কঠিন বিষয় নিয়ে ছবি করা নিঃসন্দেহে কঠিনতম কাজ। এ এক কম চর্চিত তথ্যচিত্র নির্মাণের ধারা। এখানে আপনার সবচেয়ে বড় সহায় অজস্র সাধারণ, প্রভাবশালী জনতার অনুপ্রেরণা। দেশে বিদেশের কত কত লোক আমার এ কাজে উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন তা বলে বোঝাতে পারব না। একটা সিনেমা কী করে জনতার নিজস্ব কাজ হতে পারে তাও ‘সীমান্ত আখ্যান’ তৈরি করতে গিয়ে বুঝেছি। কত ভালবাসা কত জায়গায় পেয়েছি তা বলবার নয়। এভাবে সরাসরি জনতার মাঝে গিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন এসেছে। আমি এখন ছবির বিপণনেও গ্রামমুখী হয়েছি। সরাসরি নতুন প্রজন্মের কাছে যাচ্ছি ছবি নিয়ে। শহুরে এলিটদের প্রশংসা নিন্দের আর আমি তোয়াক্কা করি না। তারা দেখুন। কথা বলুন। তবে আমার মূল দর্শক তারা নন। ইউটিউবে ছবি আপলোড করছি, যাতে সবাই ছবিটি দেখতে পারেন। ছবির দ্বিতীয় পর্বের বিষয় অসম, মূলত সিলেটভাগ আখ্যান, তাই তা উৎসর্গ করব লাল মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে। শেষ পর্ব নিবেদন করব অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন যারা, আবুল হাশেম, শরৎ চন্দ্র বোস ও সোওরাবর্দী ও অন্যান্যদের। প্রথম পর্বের জায়গাটা ফাঁকা। এখন মনে হয় মস্ত একটা ভুল হয়ে গেছে। যাদের কথা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম, যারা দেশভাগের পরে এপারে চলে এসেছিলেন ‘রিফিউজি’ হয়ে, অথচ কোনওদিন মুসলিমদের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেননি, আমার সেই দিদিমা, মা ও মাসিদের ছবিটা উৎসর্গ করা উচিত ছিল আমার। আসলে অন্ধ বিদ্বেষ কিছু দিতে পারে না। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েই সামনে এগোতে হবে। লেখা শেষ করতে করতে আমার মায়ের দেশ খুলনা থেকে ফোন এল। ওখানকার এই প্রজন্মের তরুণদের কাছ থেকে। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি মায়েদের খুলনা থেকে চলে আসার আখ্যান ওদেরও যন্ত্রণা দেয়। কোনও কাঁটাতার, ভিসা, পাসপোর্ট আমাদের মধ্যে বিভেদের জন্ম দিতে পারে না। সীমান্ত আসলে আমাদের মনে, মনের মধ্যেকার বিদ্বেষে। তার থেকে বের হতে না পারলে, সামনের দিকে তাকাতে না পারলে আধুনিক ভারতের মুক্তি নেই।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...