আজ থেকে দুহাজার বিশ বছর আগে খ্রিস্টজন্মের সম্ভাব্য দিনটিকে আধুনিক পৃথিবী কালগণনার সূত্রপাত হিসেবে মেনে নিয়েছিল। যদিও দুনিয়াজোড়া নানা সভ্যতা ও সংস্কৃতির পেটের মধ্যে বহুদিন আগে থেকেই রয়ে গিয়েছিল হাজার হাজার দেশীয়, স্থানীয় এমনকি লোক-ক্যালেন্ডার। তা সত্ত্বেও উপনিবেশ ও তার পরবর্তী পৃথিবীকে একসূত্রে বাঁধতে ব্যাবহারিকভাবে একটি সর্বজনীন ও মান্য দিনপঞ্জিকা নির্মাণের প্রয়োজন ছিল। অতঃপর, পৃথিবীর নিরবিচ্ছিন্ন সময়প্রবাহ, খ্রিস্টজন্মের পূর্বে ও পরে, দুটি কালখণ্ডে ভাগ হয়ে গেল।
কিন্তু এই বিভাজন নিতান্ত প্রতীকী, কারণ এই বিভাজনের কথা পৃথিবী জানতেও পারেনি। সেই অর্থে, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক অতিমারি এই পৃথিবীতে মানবসভ্যতার দশ হাজার বছরের ইতিহাসে, সর্বার্থে, প্রথম জলবিভাজিকা৷ ২০১৯-এর সর্বশেষ মাস ও ২০২০ সালের প্রথম কয়েক মাস ধরে সারা পৃথিবীর ভাগ্য যেভাবে নিরন্তর একসূত্রে গ্রথিত ও লিখিত হয়ে চলেছে, তা অভূতপূর্ব। কনৌজ থেকে ক্যালিফোর্নিয়া, তিরুবনন্তপুরম থেকে ত্রিনিদাদ, সারা দুনিয়ার মানুষের সামনে তাদের শ্রেণিজাতিধর্মনির্বিশেষে একটিই সঙ্কট আগে কখনও এত বড় হয়ে দেখা দেয়নি। বিশ্বায়িত আধুনিক বিশ্ব আমাদের হাতের তালুতে ধৃত আমলকির মতো ছোট হয়ে এসেছে, সঙ্কটের চরিত্র ক্রমেই সর্বজনীন হয়েছে, কিন্তু কোভিড-১৯ মাত্রা ও বিস্তারে তার সকল পূর্বসূরির তুলনায় অনেক গুণ ব্যাপ্ত ও মারক হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েই চলেছে।
একইসঙ্গে, একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে কোভিড-পূর্ব পৃথিবীর তুলনায় কোভিড-পরবর্তী পৃথিবী অনেকটাই বদলে যাচ্ছে। প্রথমত, আমরা, সারা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ এই মুহূর্তে যে ছোট জানালার মধ্যে দিয়ে বাইরের দুনিয়ার দিকে ভয় ও আশঙ্কা নিয়ে তাকিয়ে আছি, তার নাম লকডাউন। নানা শ্রেণির মানুষ ঘরে বসে, শ্রেণিভেদে খানিক আলস্যে অথবা অনেকখানি উদ্বেগ নিয়ে বদলে যাওয়া পৃথিবীটাকে দেখছে। দেখছে, কীভাবে প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে প্রথম বিশ্ব নির্ধারিত আধুনিক সমাজ ও মানবউন্নয়নের বুনিয়াদি সংজ্ঞাগুলি। প্রবল শক্তিশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি সম্পদ, প্রযুক্তি, স্বচ্ছলতা ও ব্যক্তিস্বাচ্ছন্দ্যের শীর্ষে থেকেও নিজের স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা দিতে পারছে না, প্রতিদিন তাকে কয়েকশো করে নাগরিকের লাশ গুণতে হচ্ছে। আসন্ন ও দীর্ঘমেয়াদি আর্থসামাজিক হতাশা ঘিরে ধরছে, বিশেষত মধ্যবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির দালালিসুলভ জীবিকাগুলি, যারা পুঁজির নিরবচ্ছিন্ন দৌড়কে রোবটপ্রায় পরিশ্রমে এতদিন সচল রেখেছিল, তাদের হঠাৎই বড় বায়বীয়, বড় বেশি অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হচ্ছে। খ্রিস্ট ক্যালেন্ডারের আধিপত্যের আড়ালে যেমন ঢেকে গিয়েছিল চিরাচরিত দেশজ পঞ্জিকাগুলি, তেমনিভাবে আজ সমস্ত চাকচিক্য ও পালিশের আড়াল থেকে মানুষের আবহমান খিদের রাজত্ব আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এবং এই খিদে, অতিমারির হাত ধরে, এই প্রথমবার সুরক্ষিত শ্রেণি-সীমানাগুলি ভেঙে ফেলার উপক্রম করেছে৷ মুনাফা-কেন্দ্রিক সমাজকাঠামো ও পেশাদারি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিশ্বাসী রাষ্ট্রগুলিও এই সঙ্কটকালে নিজেদের দেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারছে না। এই মহাসঙ্কটের মোকাবিলায় স্পেন গত মাসে একদিনের নোটিশে দেশের সমস্ত বেসরকারি স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানগুলিকে অধিগ্রহণ করেছে। মালিক বা সামন্তপ্রভু, যিনি এতদিন শুধুমাত্র উৎপাদন নিয়ে মাথা ঘামাতেন, তাকে সহসা উৎপাদকের স্বাস্থ্য নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। বাম্পার লটারিতে প্রথম পুরস্কার জেতার মতো সবেতন ছুটি পাচ্ছেন গৃহপরিচারক-পরিচারিকারা, সম্ভবত জীবনে প্রথম ও শেষবারের মতো। বিশ্বাসীর মনের আসন থেকে পিছু হটছেন ঈশ্বর। তাই কি? তবে আমরা জানতে পারছি, ভারতের মহিলা কমিশনের মেলবাক্স উপচে পড়ছে মহিলাদের ই-মেলে। লকডাউনে ঘরে আটক আরেক ঈশ্বর— পুরুষ— অস্থির হয়ে গিয়ে পরিবারের ওপর অত্যাচার করছে, বাড়ছে গৃহনির্যাতনের ঘটনা। মেয়েরা থাকতে না পেরে সাহায্যের জন্য উতলা হয়ে কমিশনকে মেল করছেন। যারা মেল করতে পারেন না বা করার সুযোগ নেই, আর যারা কখনও কাউকে চিঠি লেখেননি, বা লিখতেই শেখেননি, তারা? তাদের সংখ্যাটা ঠিক কত?
এই সময়ে ভালো কি কিছুই ঘটছে না?
ঘটছে। ধীরে হলেও বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। পৃথিবী জানতে পেরেছে এই বদলের কথা। জনপরিসরে মানুষের ভিড় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায়, পণ্য বমি করা কারখানার চুল্লিগুলো আপাতত বন্ধ থাকায়, বাতাসে দূষণের মাত্রা কমেছে। পৃথিবী সামান্য শীতল হয়েছে। গন্ডোলার চলাচল বন্ধ থাকায় ভেনিসের খালে ফিরে এসেছে রাজহাঁস, ডলফিনেরা। রাতের হরিদ্বারে রাজপথ শাসন করছে বারশিঙা হরিণ। এই পরিবর্তনগুলি অবশ্যই সাময়িক, কিন্তু প্রকৃতি মানুষকে আরও একবার বোঝার সুযোগ করে দিচ্ছে, এই পৃথিবী মানুষের একার নয়।
আমাদের এই সমস্ত অভিজ্ঞতা ও অনুভব, ব্যক্তিগত ও নৈব্যক্তিক, লকডাউনের জানালায় দাঁড়িয়ে তা টুকে রাখার চেষ্টা করছে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। আমাদের স্পেশাল ট্রেন ‘লকডাউন ডায়েরিজ’ প্রকাশিত হবে রোজ, আপাতত চোদ্দ এপ্রিল ২০২০ অবধি, যদি না দেশে লকডাউনের সময়সীমা বাড়ানো হয়। প্রিয় পাঠক, আসুন এই বিশেষ যাত্রার সঙ্গী হোন।