তুমিই এ প্রসারিত দেশ…

শঙ্খ ঘোষ, বিশেষ স্মরণ সংখ্যা

 

নৌকোর গলুই ভেঙে উঠে আসে কৃষ্ণা প্রতিপদ
জলজ গুল্মের ভারে ভরে আছে সমস্ত শরীর
আমার অতীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই কোনওখানে…

লিখেছিলেন তিনি। সেখানে এক ঘোর অন্ধকার রাত্রির অনুষঙ্গ ছিল, আর ছিল এক তীব্র আশ্রয়হীনতার বোধ— কবিতার ‘আমি’-টিকে প্রত্যাখ্যান করেছে তার অতীত, এমনকী ভবিষ্যৎও অগ্রহণ করেছে তাকে। বেশ অনেকই বছর আগে লেখা এই পংক্তিগুলি, অথচ এই অতীত-ভবিষ্যৎরহিত মানুষটির মধ্যে আমরা আজকের ভারতবর্ষকে বেশ চিনে নিতে পারি যেন। চিনে নিতে পারি দেশকালহীন এক প্রসারিত দেশকেই যেন— যেখানে ঘন তমিস্রাময় স্তব্ধ জল আর জলজ গুল্মের পিছুটান ভেঙে তবুও কোনও এক অনির্দেশ্যের দিকে পথ খোঁজার বার্তা নিহিত থাকে— পাঁজরে দাঁড়ের আপাত-অশ্রুত শব্দের মধ্যে সেই এগোনোর প্রত্যয়, শান্ত অথচ অবিকল্প, অলক্ষ্যে বেজে উঠতে শোনা যায়।

শান্ত, অথচ তাঁর লেখায় এর পর উঠে আসবে স্বর উঁচু করে কথা বলার কথাও…

কতদিন তোমাকে বলেছি স্বর উঁচু করে কথা বলো আবেগে ভাসিয়ে দাও দেশ
ভিখারি মনের এই দেশ
পাহাড়ের চুড়ো থেকে সাগরের কিনারা অবধি
ফেটে যাওয়া খেত যত অগম জঙ্গল আর মজে যাওয়া নদী
ভেসে যাক সেই স্বরে…

ওঁর সম্পর্কে গুণমুগ্ধদের প্রায়শই এই এক অনুযোগ ছিল বরাবর— কেন তিনি চারপাশে ঘটে যাওয়া যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আরও বেশি প্রকাশ্য, আরও বেশি উচ্চকিত নন— কেন এত সময় নিয়ে, এত ভেবেচিন্তে মুখ খোলা? সে অনুযোগ অনেকটাই যেমন ছিল কোনও বিশেষ পরিস্থিতিতে অভিভাবকপ্রতিম প্রিয় কবির চড়া সুরের প্রতিক্রিয়া আশা করেও না-পাওয়ার খেদজনিত হতাশা, তেমনই, আমাদের মনে আছে, কোনও-কোনও প্রসঙ্গে সেই অনুযোগে ঈষৎ রূঢ়তারও সুর লাগতে দেখেছি আমরা। অথচ, ইতিহাস সাক্ষী— গত পাঁচ-ছয় দশক ধরে তিনিই ছিলেন আমাদের প্রতিবাদী চেতনার বিবেক। স্বর উঁচু করেননি কখনও, অথচ নিচু গলাতেও কত স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া যায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কত ঋজু, বলিষ্ঠ দাঁড়াতে পারে সেই একক স্বর— তাঁর সারাজীবনের কবিতা তার চলমান স্বাক্ষর। স্বৈরাচার, সে যারই হোক, তিনি একেবারে নিজস্ব স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন— তাঁর কবিতায় তার ছাপ ধরা আছে।

কণ্ঠ যখন স্ববশে নেই, শরীর যখন অশক্ত হয়ে আসছে ক্রমেই, এমনকী নিজের লেখাও যখন আর নিজের হাতে কপি করে দিতে পারছেন না; যখন চারপাশে আরও একবার “নষ্ট হয়ে আছে সবুজেরা”; তখনও তাঁর সঙ্গে থেকেছে সেই নিহিত প্রত্যয়, যা একদা তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে পেরেছিল…

এসো এই মুমূর্ষুর বুকে রাখো হাত
এর ক্ষীণ রক্ত থেকে তোমার রক্তের দিকে বয়ে যাক দাহ
ঘটুক সংঘাত
দেখো তার মধ্য থেকে ভিন্ন কিছু জেগে ওঠে কি না

গত কয়েকদিন ধরে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর এই প্রণাম-সংখ্যার পরিকল্পনা করতে-করতে, লেখকসূচি নির্মাণ করতে-করতে, লেখার প্রুফ দেখতে-দেখতে, সম্পাদকীয় কপি প্রস্তুত করতে-করতে, আমরা বারবারই ফিরে-ফিরে যাচ্ছি তাঁর অসংখ্য লেখার কাছে, তাঁর অজস্র স্মৃতির কাছে, আর বুঝে উঠতে চেষ্টা করছি তাঁকে যিনি আক্ষরিক অর্থেই গত অর্ধ-শতাব্দী ধরে হয়ে উঠেছিলেন আমাদের দেশ— আমাদের “প্রসারিত দেশ”।

প্রণাম…

 

সূচি:

স্তব্ধ তোপধ্বনি— এক কবির অন্তিম যাত্রায় — অনিতা অগ্নিহোত্রী

শঙ্খ-বেলায় — প্রবুদ্ধ বাগচী

রাত্রির কলস ভেঙে, প্রভাত গড়ায় দিকে দিকে — পিয়াস মজিদ

শঙ্খ ঘোষ: মেঘের মতো মানুষ — প্রয়াগ শুক্ল

শঙ্খ ঘোষ (১৯৩২-২০২১) — পবিত্র সরকার

ধুম লেগেছে হৃৎকমলে… — পার্থজিৎ চন্দ

অঞ্জলিভাষা — সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়

কথা হয়নি, কেবল ভেবেছিলাম… — অভিজিৎ মুখার্জি

জলজ গুল্মের আলিঙ্গন থেকে শস্যখেতের বিশাল মুক্তির দিকে এক অভিযাত্রা — প্রতিভা সরকার

শঙ্খ ঘোষ: বিবেকের প্রদীপ — তৌফিক জহুর

শ্রী শঙ্খ ঘোষ: আমার মাস্টারমশাই, আমাদের সিজি স্যার — দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শঙ্খ ঘোষ: সঙ্গ-অনুষঙ্গ — সমীর ঘোষ

 

 

Terms and Conditions Privacy Policy Contact Us Cancellation and refund Shipping and delivery
%d bloggers like this: