সারারাত ফোটাক তারা…

রাতদখলের দ্রোহগাথা

 

১৪ আগস্ট, ২০২৪ গভীর রাতে ভারতের আটাত্তরতম স্বাধীনতা দিবসের মাহেন্দ্রক্ষণে মূলত পশ্চিমবঙ্গ তথা গোটা দেশ জুড়ে এক অভূতপূর্ব পরিবেশ তথা ঐতিহাসিক মুহূর্ত সৃষ্টি হল। গত ৯ আগস্ট কলকাতার রাধাগোবিন্দ কর নামাঙ্কিত সরকারি মেডিকাল কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সংবেদনহীনতা ও তদন্ত পরিচালনায় পুলিশ ও প্রশাসনের অকর্মণ্যতা ও দোষীদের আড়াল করার কুশলী প্রচেষ্টা— একের পর এক অনভিপ্রেত ঘটনার অভিঘাতে রাজ্যের মানুষ একইসঙ্গে আহত ও সন্ত্রস্ত। নির্ভয়াকাণ্ডের ভয়াবহতা যেভাবে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মর্মে প্রবেশ করেছিল, আরজিকর হাসপাতালে ধর্ষিতার মর্মান্তিক পরিণাম সেই একই তীব্রতা নিয়ে আমাদের আপাত-শান্ত গৃহকোণ এক লহমায় বিপর্যস্ত করে দিল। বিগত এক দশক ধরে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত, স্বজনপোষণে সিদ্ধহস্ত, নীতিহীন শাসকের অপশাসনের নানা ঘটনায় তিল তিল করে জনমনে জমে উঠেছিল পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, নানা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার সমীকরণে এবং বিরোধীহীন পরিসরে সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ভোটের বাক্সে সঠিকভাবে হচ্ছিল না, অবশেষে আরজিকর-ধর্ষণ সেই ক্ষোভের স্তূপে অগ্নিসংযোগের কাজ করল। ধর্ষিতার ন্যায়বিচারের দাবিতে আপামর জনসাধারণ সে-রাতে বেরিয়ে এলেন রাস্তায়। আমাদের প্রতিবেশী, প্রাণের দোসর বাংলাদেশে সদ্য ঘটে যাওয়া ছাত্র আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের ঘটনা রাজ্যবাসীর কাছে পথে নামার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে থাকবে।

আমাদের দুর্ভাগ্য, সাধারণত আমাদের দেশে শাসক দলগুলি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জিতে এসে শাসনক্ষমতা হাসিল করে ঠিকই, কিন্তু একবার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরেই চূড়ান্ত অসহিষ্ণুতা ও একনায়কতন্ত্রের দিকে তাদের যাত্রা শুরু হয়। পরপর তিনবার ভোটে জিতে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর বাংলার শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের দলীয় একনায়কতন্ত্র আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। আমরা জানি, শাসকের প্রতি সাধারণ্যে প্রোথিত ভয় ও আনুগত্যই শাসকের প্রধানতম অস্ত্র। তেমনি সেই ভয় একবার ভেঙে গেলে শাসকের পক্ষে পুনরায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা অতি দুষ্কর। ১৪-১৫ আগস্টের মিলনক্ষণে শাসকের প্রতি সাধারণ মানুষের মনে সেই ভয়ের দেওয়াল বরাবরের মতো ভেঙে গেল। এহেন অর্জন মোটেই কম কথা নয়।

১৪ তারিখে সমাজমাধ্যম-কেন্দ্রিক প্রচারাভিযানের মূল লক্ষ্য ছিলেন মূলত মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা, তাদের মুঠোফোনে রাতদখলের আর্জি নিয়ে ডিজিটাল বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল। সময় বেছে নেওয়া হয়েছিল রাত এগারোটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট, স্বাধীনতা দিবসে প্রবেশের প্রাক-মুহূর্তটিকে। মূলত শহর কলকাতার তিনটি সপ্রশস্ত স্থানে জমায়েত করার আহ্বান হয়েছিল প্রাথমিকভাবে, কিন্তু দিন গড়ানোর সঙ্গে তালিকা দীর্ঘতর হতে থাকে, আর তাতে দাবানলের মতো জুড়ে যেতে থাকে রাজ্যের জেলাশহর-মফস্বল-গ্রাম-সভাস্থল-চত্বরের নাম। সমর্থন আসে দেশের অন্যান্য রাজ্য, প্রতিটি মহানগর থেকে, একই কর্মসূচি নেওয়া হয় দেশ এমনকি বিদেশের নানা শহরে। দেওয়াল তুললে ঘর আর দেওয়াল ভাঙলেই পৃথিবী— এই কথাটা আরেকবার মনে করিয়ে রাত বারোটায় দেশজুড়ে পথে নামেন একসমুদ্র মানুষ, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, মূলত মেয়েরা, মায়েরা এমনকি অশীতিপর পিতামহী-মাতামহীরাও। সামাজিক ইস্যুতে এইরকম স্বতঃস্ফূর্ত জনসমাবেশ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা আগে কখনও দেখেছে বলে মনে পড়ে না, নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গে জনআন্দোলনকে মনে রেখেই একথা বলছি।

সাবধানীরা প্রশ্ন তুলছেন, একদিনের রাতদখল কী-ই বা বদলাতে পারে? প্রকৃত দোষীকে শাস্তি দিতে বা দুরাচারী শাসককে সুপথে আনতে একরাতে পথদখলের গুরুত্ব ঠিক কতটা? আপাতদৃষ্টিতে, এই প্রতীকী প্রতিবাদের গুরুত্ব কিছুই নয়, আবার অনেকটাই। নিন্দুকেরা যা-ই বলুন, রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে মোমবাতির আলোয় যথার্থই রাতদখল করে নিয়েছিল আমাদের ঘরের মেয়েরা। এর প্রতীকী তাৎপর্য অপরিসীম। বাংলার রাজনৈতিক পরিসরে শাসক দল ভেবে নিয়েছিল যে শুধুমাত্র লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ও কন্যাশ্রীর ভাতা (যে ধরনের সুরক্ষা ভাতা কোনও দয়া নয়, মানুষের ন্যায্য অধিকার) বিতরণ করে বাংলার মহিলাদের অটুট ও নির্ভরযোগ্য ভোটব্যাঙ্কে পরিণত করে ফেলা গেছে, ১৪ তারিখ তাঁদেরই এক বিপুল অংশের প্রতিবাদ বুঝিয়ে দিল তা পুরোপুরি ঠিক নয়। দীর্ঘ সময় ধরে দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই, কৃষক বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, নকশালবাড়ি— সংগ্রামের চেতনাকে ধারাবাহিকভাবে ধারণ করে আসা বাংলার মেয়েদের হাজার-বারোশো টাকার বিনিময়ে বংশবদ দাসে পরিণত করা যাবে না তা বুঝিয়ে দিল এই সমবেত প্রতিরোধ। ক-দিন আগে সন্দেশখালিতেও একই ছবি দেখেছি আমরা। এই প্রতিবাদ, এই ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ শাসকের অপশাসনের বিরুদ্ধে, এবং আদ্যন্ত রাজনৈতিক। যে-সকল শুচিবায়ুগ্রস্ত মধ্যবিত্ত ১৪ আগস্টের রাতদখলকে ‘অরাজনৈতিক’ মনে করে এক ব্যানারহীন পদযাত্রায় হাঁটলেন, তাঁরা এখনও বুঝতে পারেননি তাঁরা নিজেদের অজান্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিবাদে সামিল হলেন। যে প্রতিবাদ সরাসরি শাসককে আঘাত করে, শাসকের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, সেই প্রতিবাদ কখনও অরাজনৈতিক হতে পারে না। একটি ধর্ষণের প্রতিবাদ কোনওদিন অরাজনৈতিক হতে পারে না, কারণ তা সরাসরি নারী ও পুরুষের লিঙ্গসাম্যের রাজনীতি থেকে জারিত। আর এক্ষেত্রে আরজিকর-কাণ্ড শুধুমাত্র ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তার প্রশাসনের অনৈতিক কার্যকলাপ এবং অপশাসনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ১৪ তারিখের রাত তাই বাংলার নাগরিক সমাজের তরফ থেকে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে একটি চরম রাজনৈতিক পদক্ষেপ, যা শাসকের মনে ভয়টুকু ধরাতে পেরেছে। আমরা জানি না এই নাগরিক ক্ষোভকে প্রগতিশীল বিরোধী শক্তি আগামী বিধানসভা নির্বাচনে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগাতে পারবেন কিনা, বাংলার মানুষকে একটি গ্রহণীয় বিকল্প উপহার দিতে পারবেন কিনা। সময় এই প্রশ্নের উত্তর দেবে। কিন্তু আজকের এই রাতদখল নিস্ফলা নয়, বরং তা বহুবিধ সম্ভাবনায় গর্ভবতী। আমরা নিশ্চিত, গত ১৪ আগস্ট রাতের প্রতিবাদ এক বৃহত্তর গণআন্দোলনের সূচনা মাত্র। অবশ্য এমন অনেক রাত এবং দিন আমাদের, আমাদের সহনাগরিকদের সঙ্গে এখনও হাঁটতে হবে, যতদিন না নারীর মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার, এ-রাজ্যের প্রতিটি মানুষের নায্য অধিকারগুলিকে সুনিশ্চিত করা যায়।

প্রতিবাদের এই চেতনাকে পাথেয় করে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত হতে চলেছে এক স্পেশাল ট্রেন, ১৪ আগস্টের মোমবাতির আলো আঁধারকে ফিকে করে দিতে সক্ষম, এই বিশ্বাস নিয়ে আমাদের এই সিরিজের শিরোনাম— সারারাত ফোটাক তারা— রাতদখলের দ্রোহগাথা। এই প্রতিবাদ চলবে আর তার সহযাত্রী হিসেবে প্রকাশিত হবে আমাদের লেখা, রোজ একটি বা একাধিক। প্রিয় পাঠিকা ও পাঠক, আপনিও সামিল হোন এই অগস্ত্যযাত্রায়।

 

সূচি:

Terms and Conditions Privacy Policy Contact Us Cancellation and refund Shipping and delivery
%d bloggers like this: