মৌমিতা সেন
গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে লোকসভায় তৎকালীন মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী, স্মৃতি ইরানি, জে-এন-ইউর প্রসঙ্গে তাঁর অতিনাটকীয় বক্তৃতাটি দেওয়ার পর থেকে মহিষাসুর ও দুর্গাকে নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। খবরের কাগজের পাতায়, টিভির পর্দায়, এমনকি সল্টলেকের এফ-ই ব্লকের দুর্গা পুজোতেও বলা হয়েছিল মহিষাসুর পুজোর কথা! এখন মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালি ঘরে ঘরে জানেন এবং অনায়াসে মেনেও নেন যে মহিষাসুর আদিবাসীদের দেবতা, ঠিক যেমন দুর্গা তাদের দেবী। দেবীপক্ষের সময় নাকি আদিবাসীরা মহিষাসুরকে পুজো করেন! এই প্রথা নিয়ে কিছু বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার।
মহিষাসুর পুজো কি আদৌ পুজো?
দিল্লী, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী ও সংস্থারা এখন গবেষণা করে দেখাচ্ছেন যে প্রাচীন ভারতে মহিষাসুরের মন্দির ছিল এবং তাঁর পুজোও হত। কিন্তু বর্তমান আদিবাসী সমাজে এই প্রথাগুলি লুপ্ত বললেই চলে। লোকসংস্কৃতিতে যা চালু আছে, সাধারণ মানুষ তার সাথে মহিষাসুরের সরাসরি সম্পর্ক খুঁজে পান না। নবরাত্রির সময়ে আদিবাসীদের ঘরে-ঘরে মহিষাসুরের পুজো হয় না। বরং গ্রামে গ্রামে যা হচ্ছে সেটা শুধু ধর্মের ব্যাপার নয় — সেটা রাজনীতির ব্যাপার।
আর্য-অনার্যদের যুদ্ধে অন্যায়ভাবে হেরে যাওয়া অনার্যদের বীর রাজা মহিষাসুরের কথা বিচ্ছিন্ন কিছু বুদ্ধিজীবী কয়েক দশক আগে থেকেই লিখছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পুরুলিয়ার চারিয়ান মাহাতো আর বিহারের প্রেমকুমার মণি। ২০১১ থেকে যারা বিচ্ছিন্নভাবে মহিষাসুরকে রাজনীতির প্রেক্ষাপটে টেনে এনেছেন, তারা এখন সংগঠিত হতে আরম্ভ করেছেন। এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসেই দুর্গাপুজোর সময়ে পুরুলিয়া, মালদা, মেদিনীপুরের অনেক গ্রামে পালন করা হল হুদূড় দুর্গা বা খেড়োয়াল ভাষায় মহিষাসুরের স্মরণ দিবস। কিছুদিন আগেই ঘটে যাওয়া এক রাজনৈতিক হত্যার কথা মাথায় রেখে মঞ্চগুলির নাম দেওয়া হল “অসুরকন্যা গৌরী লঙ্কেশ মঞ্চ”। অনুষ্ঠানে দেখা গেল কাঠি নাচ, দাঁসাই ও রাজনৈতিক বক্তৃতা, পাশে বীররূপে বা রাজারূপে মহিষাসুরের মূর্তি। কলকাতায় অসুর দিবস উপলক্ষে কবি গান, কাঠি নাচ, দাঁসাই, রাজনৈতিক বক্তৃতা ছাড়াও হল ছোটোদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতা। পশ্চিমবঙ্গের কোথাও ৫০, কোথাও ৫০০, কোথাও বা ৫০০০ মানুষ একত্রিত হলেন এই উপলক্ষে!
আমাদের বুঝতে হবে যে আজকের মহিষাসুর স্মরণ দিবস আমাদের চেনা অর্থে পুজো নয়: এটা দলিত-আদিবাসী-বহুজনদের পরিচয়ের লড়াই, বর্তমান সরকারের আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে। দিল্লীর কিছু রাজনৈতিক কর্মীর ভাষায় এটা পুজো একেবারেই নয় — ওঁরা এটাকে বলছেন মহিষাসুর মুভমেন্ট! সংঘ পরিবার ও বিজেপি তো শুধু রাজনৈতিক দল নয়, এটা একটা সামাজিক, ধর্মীয়, ও সাংস্কৃতিক শক্তি। একে হারাতে গেলে, এনাদের মতে, শুধু বাম-ঘেঁষা, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করলে চলবে না; ধর্ম, জাতি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রটা বুঝতে এবং বদলাতে হবে।
কোথায়, কিভাবে আরম্ভ হল মহিষাসুর দিবস?
২০১১ সালে, কিছুটা কাকতালীয়ভাবেই, দিল্লীর জে-এন-ইউতে আর পুরুলিয়ার ভালাগোড়া গ্রামে প্রায় একই সাথে পালিত হয় মহিষাসুর স্মরণ দিবস। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুজন রাজনীতির সাথে জড়িত পড়ুয়ারা মহিষাসুর সহদৎ দিবসের জন্য বেছে নিয়েছিলেন বহু-বিতর্কিত মেকলে জয়ন্তীর দিনটি; এদিকে পুরুলিয়ার গ্রামে নবমীর রাতটি বেছে নেওয়া হয়েছিল দুর্গা-মহিষাসুরের গল্প/ইতিহাস মাথায় রেখে। ২০১৪ সালে জে-এন-ইউতে মহিষাসুর সহদৎ দিবস উপলক্ষে এসেছিলেন উদিত রাজ, বিজেপির এমপি! আজকের লেখায় পুরুলিয়ার বিষয়টাই খুলে বলি — ২০০৯ সালে টিভিতে ‘বাবা’ রামদেবের একটি অনুষ্ঠান দেখে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন ভালাগোড়ার অজিত হেমব্রম। তখনও ক্ষমতায় ইউপিএ, নরেন্দ্র মোদী তখনও গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। মোদী সরকার আসার অত আগেও হেমব্রম বুঝতে পেরেছিলেন যে সংখ্যালঘুদের খাদ্যাভ্যাস, ধর্মীয় আচার ইত্যাদির ওপর হতে চলেছে বৈদিক, ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির আগ্রাসী আক্রমণ। নিজের সাঁওতাল তথা খেড়োয়াল সমাজের সংস্কৃতি নিয়ে নানা মানুষের সাথে আলোচনা করে, নানান গবেষণামূলক বই পড়ে, হেমব্রম ভাবতে আরম্ভ করেন দুর্গা ও মহিষাসুরের মিথ নিয়ে। সত্যি হয়তো আর্য আর অনার্যদের যুদ্ধ হয়েছিল! দেবতাদের ছলে-কৌশলে অনার্যরা হেরে যায় সেই যুদ্ধে… পিছিয়ে পড়ে তারা নানানভাবে! এই ভেবে হেমব্রম মহিষাসুরের মূর্তি খাড়া করে তার প্রথম স্মরণ দিবস উদযাপন করেন। মহিষাসুর হয়ে ওঠে নিপীড়িত খেড়োয়াল সমাজের প্রতীক! চারিয়ান মাহাতোর উদ্যোগে শুরু হয় ‘ছত্র উত্তলন’ পর্ব, যা এখন পশ্চিমবঙ্গের অন্য অনেক গ্রামে চালু হয়েছে। বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন মূলনিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়গুলিকে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে একই ছাতার নীচে সংঘবদ্ধ করার চেষ্টার প্রতীক এই অনুষ্ঠানটি।
সাঁওতালদের দাঁসাই নাচে দেখা যায় ছেলেরা মেয়েদের পোশাক পরে সামরিক ভঙ্গিতে নাচছেন এবং মাঝেমাঝে “হায় হায়” বলে উঠছেন। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই নাচ; সব সবল সাঁওতাল পুরুষই দাঁসাই নাচতে পারে, বললেন হেমব্রম। মহিষাসুরের মৃত্যুর পর, অনার্য পুরুষরা নাকি ঠিক এইভাবেই ছদ্মবেশে পালিয়েছিলেন তাদের রাজ্য ছেড়ে। ইতিহাসের এই ভুলে যাওয়া ঘটনা এই নাচের মধ্যে আজও বর্তমান।
মহিষাসুরের গলায় মালা দিচ্ছেন অজিত হেমব্রোম। পিছনে দেখা যাচ্ছে গৌরী লঙ্কেশের ছবি। ভালাগোড়া গ্রাম, পুরুলিয়া।
সাঁওতাল ছেলেরা শাড়ি পরে দাঁসাই নাচছেন। ভালাগোড়া গ্রাম, পুরুলিয়া।
সাত বছর হুদূড় দুর্গা দিবস দেখতে দেখতে গ্রামের সাঁওতাল তো বটেই, বাউরি, কাপালি ও ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ও এই বিষয়টা খুব ভালো বুঝতে শিখেছে। এ বছর দাঁসাই নাচের ঠিক পরেই দুজন সাঁওতাল শিল্পীর ভর হল; মহিষাসুরের মূর্তির দিকে আঙ্গুল তুলে পাড়ার মেয়েরা আমায় বলল, “ওই তো… ওই বোঙ্গারই ভর হয়েছে!” অথচ, এই অনুষ্ঠানের গোড়ায় যিনি, সেই অজিত হেমব্রম কিন্তু একেবারে নাস্তিক, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। যে বছর তিনি হুদূড় দুর্গা স্মরণ দিবস আরম্ভ করেন, ঠিক তার পরের বছরই ভালাগোড়া গ্রামে বিজ্ঞান দিবস পালন করতে শুরু করেন। তিনি বোঝেন যে ঠিক যেই রাজনৈতিক চিন্তার জায়গা থেকে তিনি শুরু করেছিলেন, যারা এই উৎসবটিকে আপন করে নিচ্ছেন, তারা কিন্তু সকলে একইভাবে ভাবছেন না!
তা সত্ত্বেও এই উৎসব দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়ছে! শুনছি ২০১৭-তেই ১০০০টার বেশি স্মরণ দিবস হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নানান গ্রামে।
অসাম্য বা হায়ারার্কি এবং একটি শেষ প্রশ্ন
অন্য রাজনীতির মতো, মহিষাসুর মুভমেন্টের মধ্যেও কিছু ভেদাভেদ বা হায়ারার্কি আছে। দিল্লীর বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক রাজনীতি করে উঠে আসা বহুজনেরা লিখছেন তারাই এই মুভমেন্ট শুরু করেন; পুরুলিয়ার আদিবাসীরা এ কথা মানতে নারাজ। আবার পুরুলিয়ায় দেখেছি রাশভারী মন্ত্রী উচ্চস্বরে ধমকে দিচ্ছেন অল্পবয়সী কর্মীকে। শহরের বুদ্ধিজীবী গ্রামের সংগঠকের হাত থেকে মাইক কেড়ে নিচ্ছেন মঞ্চে। বা একটু বেশি শিক্ষিত মানুষ মিডিয়ার লোক ও ক্যামেরার সামনে নিজের কথাটা বলছেন অন্যদের চুপ করিয়ে।
আমার কাছে সবচেয়ে লক্ষণীয় হায়ারার্কি ধরা পরেছে এই আন্দোলনে মেয়েদের অভাব দেখে। দু-তিনজন মহিলা উঠে আসছেন ঠিকই, কিন্তু আন্দোলনের গণ্য-মান্য সবাই পুরুষ। তাদের কয়েকজন বক্তৃতা দিতে গিয়ে যখন হিন্দু দেবী দুর্গাকে “বেশ্যা”, “বেশ্যা-কন্যা”, “মেয়েছেলে” ইত্যাদি বলে ভর্ৎসনা করেন, তখন বোঝা যায় এই মুভমেন্ট কতটা পুরুষতান্ত্রিক!
ভালাগোড়া গ্রামে এরম কথা শুনিনি। কিন্তু ওখানেও মেয়েরা রাজনীতি নিয়ে বিশেষ কথা বললেন না। দুপুরবেলা কয়েকঘর বাউরি মেয়ে-বউ উঠোনে বসে গল্প করছিলেন, আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে তারা শুধু কাঠি নাচ দেখেই চলে আসেন কেন, বক্তৃতাগুলো শোনেন না কেন? তাঁরা একগাল হেসে বললেন, “ও মা, আমাদের অত সময় কোথায়! ও ছেলেগুলো যায়… শোনে… আমরা সারাদিন ওখানে পরে থাকলে বাড়িতে রান্না করবে কে? বাচ্চাগুলোকে কে দেখবে? আমার গরুটা তুমি চড়াবে?”
…..!
খুবই সুন্দর লেখা।
অত্যন্ত ফালতু প্রোপাগান্ডা