বালুরঘাট-এ বিভ্রাট

বালুরঘাট কাণ্ড

ব্রতীন সরকার

গত বছর পুজোর ঠিক আগে আমাদের বালুরঘাট শহরে পুলিশ প্রশাসন একটা অদ্ভুত নির্দেশ জারি করল। পুজোর চতুর্থীর দিন থেকে একাদশীর দিন পর্যন্ত শহরে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার এই নির্দেশনামা ছিল অভূতপূর্ব। অতিব্যস্ত রাজধানী কলকাতা শহরেও এমনভাবে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। বলা হল, সকাল চারটে থেকে বিকেল চারটের অবধি শহরে দু’চাকা ও চারচাকা গাড়ি চলবে, তারপর গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে। চারটের পর কোন গাড়ি শহরে ঢুকতে পারবে না। যেসব চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী ও কর্মীরা শহরের বাইরের কাজ সেরে শহরে ফিরবেন, ফেরার সময় বিকেল চারটের পর হলেই যান তাদের আটকে দেওয়া হল। গলিঘুঁজিতে যারা বাইক নিয়ে চলাফেরা করছিলেন তাদের লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হল, মোটা অঙ্কের জরিমানা করা হল। চারটের পর যাতায়াতের জন্য লক্ষাধিক নাগরিকের ভরসা রইল সামান্য কিছু রিকশা ও শ’দুয়েক ব্যাটারিচালিত টোটো। মানুষের অসুবিধার সুযোগ নিয়ে কিছু অসৎ টোটো চালক সামান্য তিন-চার কিলোমিটার পথ যাওয়ার জন্য ভাড়া চাইতে শুরু করলেন তিনশো-চারশো টাকা। পুজোর দিনে শিশু ও বয়স্করা কার্যত গৃহবন্দি হলে। প্রশাসনের বদান্যতায় উৎসবের সন্ধ্যায় হতাশা নেমে এল আমাদের আপাত-শান্ত বালুরঘাট শহরে।
গল্প এখানে শেষ নয়। সবে শুরু। সপ্তমীর দিন যানবাহন নিয়ে এই প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে ফেসবুকে আমার বন্ধু ‘উত্তর ভাষা’ পত্রিকার সম্পাদক কৌশিক রঞ্জন খানের একটি পোস্ট শেয়ার করি, নিজেও এই বিষয়ে কিছু লিখি। আমি অর্থাৎ ব্রতীন সরকার একজন চিত্রশিল্পী, বালুরঘাট শহরের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা এবং উল্লিখিত ‘উত্তর ভাষা’ পত্রিকার প্রকাশকও বটে। ফেসুবক কৌশিকের পোস্ট নিয়ে শেয়ার করেন আরও কয়েকজন। রাজ্য সরকারের স্মার্ট পুলিশ সম্ভবত আজকাল স্মার্ট ফোনেই বেশি সময় কাটায়। তাই লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন নোটিশ আসে আমার বাড়িতে। আমাকে ও কৌশিককে লোকাল থানায় দেখা করতে বলা হয়। পরদিন থেকে টানা তিন-চারদিন থানায় গিয়ে দুপুর একটা থেকে রাত দশটা অবধি হাজিরা দিয়ে বসে থাকতে হয় আমাদের। শারীরিক নিগ্রহ না করা হলেও চলে মানসিক অত্যাচার। টানা তিন-চারদিনের এই লাঞ্ছনায় আমাদের ও আমাদের পরিবারের মানসিক জোর তলানিতে এসে ঠেকে। এর মাঝে থানাতেই দেখা হয় আমাদের পূর্বপরিচিত ব্যবসায়ী দেবজিৎ রায় ও ব্যাঙ্ককর্মী অনুপম তরফদারের সঙ্গে। এঁদের একই কারণে ডাকা হয়েছে। দাঙ্গায় ইন্ধন যোগানোর অভিযোগে জামিন-অযোগ্য ধারায় এফ আই আর করা হয় আমাদের চারজন নাগরিকের বিরুদ্ধে। এরপরের ঘটনাক্রম আরও নাটকীয়। গ্রেপ্তার এড়াতে দিশেহারা হয়ে আমি আত্মগোপন করি। ৮ মাসের অন্তঃসত্তা স্ত্রীকে পাশে নিয়ে প্রতিদিন লাঞ্ছিত হওয়া দেবজিৎবাবু পরিবার নিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর আবেদন জানান জেলাশাসকের কাছে। ঠিক পরেরদিন, ১৯শে অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হয় দেবজিৎ ও অনুপমবাবুকে। নড়ে ওঠে বালুরঘাট শহরে। ২০ তারিখ বালুরঘাটের রাস্তায় নাগরিক সমাজ এক অরাজনৈতিক মিছিলের আয়োজন করেন, অনুমতি দেওয়ার পরও পুলিশ সে মিছিল আটকে দেয়। ততক্ষণে খবর ছড়িয়ে পড়েছে মিডিয়ায়। কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্রে উঠে এসেছে এই ন্যক্কারজনক পুলিশি দৌরাত্ম্যের খবর। বুনিয়াদপুর মহকুমা আদালত থেকে কয়েকদিন পরে ২০০০ টাকার বণ্ডে জামিন পাই আমি ও অন্যান্যরা।
প্রতিবাদের নাম বালুরঘাটবালুরঘাট কাণ্ড
ঘটনাটি এইখানেই শেষ হতে পারত। ফাইলবন্দি হয়ে মরে যেতে পারত আর পাঁচটা অন্য কেসের মতো। তা হয়নি।  ৭ই নভেম্বর অভিযুক্তদের অর্থাৎ আমাদের সমর্থনে বালুরঘাটের সুপ্রাচীন নাট্যমন্দিরে এক নাগরিক সভায় এসেছিলেন কবি মন্দাক্রান্তা সেন, কলকাতার প্রাক্তন মেয়র ও এক্ষেত্রে অভিযুক্তদের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, অম্বিকেশ মহাপাত্র ও দিলীপ দে সরকার। প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন মদতে ল কলেজের ছাত্ররা ও অসংখ্য টোটোচালক এসে সকাল এগারোটা থেকে রাস্তা অবরোধ করে সভা ভণ্ডুল করে দেয়। শেষে বিকাশবাবুর ফোনে ও রাজ্যের বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের হস্তক্ষেপে স্বরাষ্ট্রসচিবের নির্দেশে এতক্ষণ ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকা বালুরঘাটের পুলিশ প্রশাসন বক্তাদের নিরাপত্তা দিতে আসে। শেষ পর্যন্ত নিজেদের লজের সামনে পথসভা করে বক্তব্য রাখতে হয় অম্বিকেশ-মন্দাক্রান্তাকে।
বর্তমানে কেসটি হাইকোর্টের বিচারাধীন। আমরা এখনও জামিনে আছি। পূর্ববর্তী শুনানির দিন বিচারপতি পুলিশ প্রশাসনকে প্রবল ভর্ৎসনা করে জানিয়ে দিয়েছেন যে পুলিশের এই কাজ অসাংবিধানিক ও আমাদের বিরুদ্ধে কোনও চার্জশিট দেওয়া যাবে না। তিন সপ্তাহ সময় দিয়ে নিজেদের কাজের সাফাই দিয়ে পুলিশকে হলফনামা জমা দিতে বলেছে কোর্ট। আগামী শুনানির দিন আসন্ন।
শেষমেশ আদালতের হস্তক্ষেপে ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই রাজ্যে বারবার আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার গুরুদায়িত্ব ছেড়ে পুলিশ খুঁজে নিচ্ছে ‘সফট টার্গেট’। বাস্তবের অপরাধীদের দিকে নজর না দিয়ে সোশাল মিডিয়ায় ভিন্নমত ও অসন্তোষের কণ্ঠস্বরকে গলা টিপে মারতে চাইছে প্রশাসন।
বালুরঘাট কাণ্ড
অম্বিকেশ মহাপাত্রকে জেলে পুরে যে সন্ত্রাসের সংস্কৃতির সূচনা হয়েছিল, তার সমাপ্তির কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সত্তর বছরে যে গণতন্ত্রের সাবালকত্বে পৌঁছবার কথা, তার এই পেছনের দিকে হাঁটার চেষ্টা কীসের সংকেত? আমরা ভীত, আমার সন্তান কখন আবার ঘুমের মধ্যে কেঁপে উঠে জিজ্ঞেস করবে, বাবা, কাল সকালে বাড়িতে পুলিশ আসবে না তো?
[ছবিগুলি লেখকের আঁকা]
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...