দিদিমার ভাবনা

কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

‘বাঁচতে ইচ্ছা করে না বললে হবে?’ দিদিমার হাঁটুদুটো দলাইমলাই করতে করতে বলল গোপাল। পাহাড়ের মতো শরীর, হাঁড়ির মতো মুখ, টি শার্টের হাতা ঠেলে ওঠা মাসল, মাসল ঘিরে মাদুলি। মালিশের তালে তালে মাদুলি থেকে ঝুলন্ত লাল সুতো দুলছে। ‘পগতি সংঘের পুজোয় এবার বারো হাত পতিমা, নতুন শাড়ি পরে দেখতে যেতে হবে না?’ গোপালের কুচকুচে কালো ঠোঁটের কষ থেকে থুতু ছিটকে এল।

চট করে চোখ বন্ধ করে ফেললেন দিদিমা। থুতু চোখের ভেতরে না গিয়ে চোখের পাতার ওপর এসে পড়ল। গা জ্বলে যায় রাগে। তাঁর জীবন, তাঁর বাঁচতে ইচ্ছে করা না-করা তাঁর ব্যাপার। লাই দিলেই সবাই মাথায় চড়ে বসে। এটাকেও আগের দুটোর মতো গোড়াতেই তাড়ানো উচিত ছিল। কিন্তু যেই শুনলেন ছোঁড়ার ঠাকুমা বরিশালের লোক, তাও আবার মানপাশার একেবারে পাশের গ্রাম, মন দুর্বল হয়ে গেল। দিদিমা চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করলেন। গোপাল বকে চলল। কোন পাড়ার ক’হাত লম্বা প্রতিমা, কত টাকার প্যান্ডেল, থিম কী, কোন সিনেমা আর্টিস্ট ফিতে কাটতে আসবে। চাকাওয়ালা চেয়ারে বসিয়ে দিদিমাকে নতুন শাড়ি পরিয়ে কেমন সে সব প্যান্ডেলে ঘুরতে যাওয়া হবে। যেন তিনি ঊননব্বইয়ের দিদিমা নন, আড়াই বছরের কাঁদুনে খুকি। এজেন্সির নতুন মেয়েটা, নাম মনে নেই দিদিমার, মনে রাখার চেষ্টাও করেননি, খুশি খুশি গলায় তাল দিচ্ছে গোপালের সঙ্গে। খিলখিল করে হাসছে প্রতি কথায়। রাগে মাথা জ্বলে গেল দিদিমার। ঝটকা দিয়ে হাঁটু ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। গোপালের ষণ্ডা পাঞ্জা আরও শক্ত হয়ে বসল।

গুড়গুড় আওয়াজ কীসের? আওয়াজটা আসলে গোপালের বাইকে স্টার্ট দেওয়ার, কিন্তু দিদিমার মনে হল মেঘ ডাকল। আজকালকার মেঘগুলোর গলার জোর কত কমে গেছে। মেঘের মতো মেঘ ডাকত তাঁদের ছোটবেলায়। গ্রামের বাইরে মাঠ ছিল। প্রায় আকাশের সমান বড়। মাঠের মাঝখানে উঁচু কুলগাছটার টঙে চড়ে সেই অমিতশক্তিশালী মেঘের সঙ্গে একবার চোখাচোখি হয়েছিল দিদিমার। মাঠের প্রান্ত থেকে একটা কালো অসুর যেন মাথা তুলল। বুক কেঁপে উঠেছিল দিদিমার। তাড়াহুড়োয় গাছ থেকে নামতে গিয়ে কাঁটায় ছড়ে গিয়েছিল নরম হাঁটু, কচি কনুই। ফুঁ দিয়ে সে জ্বালা কমানোর সময় নেই। হইহই করে অসুরটা এসে পড়েছে দিদিমার মাথার ওপর। দিদিমা দৌড়োন, মেঘ দৌড়োয়, দিদিমা আরও জোরে দৌড়োন, মেঘ আরও জোরে ধাওয়া করে। কোঁচড়ের কুল সামলে ছুটতে গিয়ে দিদিমা স্পিড তুলতে পারছেন না, মেঘ তাঁকে ছুঁয়ে ফেলেছে প্রায়, ঝাঁকড়া চুলের ছায়ায় চারদিক অন্ধকার, শোঁ শোঁ নিঃশ্বাসে মাঠের শুকনো খসখসে ধুলো উড়ছে ঘুরে ঘুরে, চোখেমুখে ঢুকে যাচ্ছে, হৃদপিণ্ডটা বড় হতে হতে বুক ফাটিয়ে ফুটিয়ে এই বুঝি বেরিয়ে পড়ে। একটা শুকনো শিকড় না কীসে হোঁচট খেলেন দিদিমা, টাল রাখতে পারছেন না, শক্ত মাটি বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে আসছে তাঁর মুখের কাছে, মেঘটা কড়কড় করে হেসে উঠেছে বীভৎস জোরে, চোখ ধাঁধানো দাঁতের পাটি ঝিকিয়ে উঠেছে আকাশের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত, কোঁচড়ের কুলগুলো ছিটকে পড়বে এইবার, আর রক্ষা নেই…

তন্দ্রা ছুটে গেল। মাঠ নয়, ঘর। মাটি নয়, তক্তপোশের ওপর ছিরকুটে পড়ে রয়েছেন দিদিমা। মেঘটেঘ কিছু না, জানালাদরজা সব বন্ধ বলে চারদিক অন্ধকার দেখাচ্ছে।

‘আরতিইইইইই,’ শরীরের সবটুকু জোর ফুসফুসে নিয়ে এসে চেঁচালেন দিদিমা। দ্রুত পদক্ষেপের শব্দ হল, কয়েক সেকেন্ড পর দিদিমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল উৎকণ্ঠিত ফর্সা মুখ।

‘কী হয়েছে মা? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?’

‘জানালা খুলিসনি কেন? কতদিন বলেছি আমার দমবন্ধ লাগে।’

কখনও যে এ কথা দিদিমা বলেননি তা-ই নয়, উল্টে দু’ঘণ্টা আগেই চেঁচিয়ে নালিশ করেছেন জানালার আলো চোখে পড়লে তাঁর চোখ জ্বলে যায়। আরতি দিদিমাকে সে কথা মনে করালেন না। এটা মনে করানোর সময় নয়। মনে করানোর জন্য গোটা জীবন পার হয়ে গেছে। এখন শুধু শোনার সময়।

জানালা দিয়ে রোদ এসে পড়ল চোখে। দিদিমা চোখ কুঁচকোলেন। পরক্ষণেই ছায়া। আরতি এসে বসেছে খাটের ওপর। দিদিমার পাতলা চুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছে।

দিদিমার চোখ বুজে এল। দিদিমা ভাবতে লাগলেন, এরা আমাকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা করে কেন? আমাকে নিয়ে পড়ে থাকলেই চলবে? আর কোনও কাজ নেই? কেমন সুন্দর ঝকঝকে রোদ উঠেছে, আবার কখন আসবে মেঘ ঝেঁপে, ভেজা কাপড়জামা এইবেলা শুকিয়ে নিতে হবে। শুয়ে শুয়ে রোদটাকে কতভাবে কাজে লাগানো যায় ভাবতে লাগলেন দিদিমা। তাঁর অল্প খোলা দন্তহীন মুখের ভিতর দিয়ে হাওয়া মৃদু ঘরঘর যাতায়াত করতে লাগল। আধোঘুমে দিদিমা রোদে ভাসা ছাদের স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত জোড়া সুতির ধুতি পাতা হয়েছে, হাতের মোচড়ে তার ওপর বড়ির নকশা পড়ছে। কল্কা, ময়ূরের পেখম। ছোট, বড়, সাদা, কমলা, ঘিয়ে। শীতলপাটির ওপর সারি সারি কাঁচের বয়াম। ভেতর গলা পর্যন্ত তেলে ভাসছে লেবু, লংকা, আমসি, কুল। দিদিমার শুকনো জিভ জলে ভরে এল। ছাদের ওই কোণে বয়ামের ওপর উবু হয়ে ও কে? ফ্রক পরা প্যাংলা শরীর, ঢাকনা সরিয়ে রোগা কবজি ঢুকে গেছে বয়ামের ভেতর। ভারতী! চান না করে এসব ছুঁতে আছে? দিদিমার হাতের পাতা সজোরে আছড়ে পড়ে ভারতীর গালে। ভয়ে মেয়ের শুকনো মুখ আরও শুকিয়ে গেছে, জল থমকে আছে চোখের কোলে এসে।

দিদিমার বুকের ভেতর টনটন করে। কতদিন দেখেননি ভারতীকে। আরতিকে বলবেন একদিন ফোন করে আসতে বলতে। খেতে ভালোবাসে মেয়েটা, নিজে হাতে বসিয়ে খাওয়াবেন। বাজারের কেনা আচার চলবে না। আরতিকে বলবেন আসার আগে আচার তৈরি করে ছাদে শুকোতে দিতে। দুধ ঘন করে সর তুলতে।

‘আরতিইইই…’

‘কী হয়েছে মা? কোথায় কষ্ট?’

‘ভারতীকে ফোন কর। আসতে বল। দুধ জ্বাল দিতে বসা, মোটা করে সর তোল। বাজারে টোপা কুল উঠেছে কিনা খোঁজ নে।’

কানের কাছে স্বরেরা গুনগুন করে। এজেন্সির মেয়ে শুকনো হেসে জিজ্ঞাসা করছে, ‘সর খাবে বলছে? সব গেলেও নোলা যায় না।’

রাগে দিদিমার গা রি রি করে। সাহস পায় কী করে, তাঁর সামনে তাঁকেই নিয়ে কথা বলার? ভেবেছে তাঁর চোখ কান নাক সব খারাপ হয়ে গেছে, কী বলছে শুনতে পাবেন না? মেয়ে জানে না, যারা কালা তারাই শুনতে পায় বেশি। শোনা নির্ভর করে কত জোরে বলা হচ্ছে তার ওপর নয়, কী বলা হছে তার ওপর। দিদিমার শাশুড়ি নিরানব্বই পার করে মারা গিয়েছিলেন, শেষ পনেরো বছর বিছানায় শোয়া, সেবা করতে করতে দিদিমার হাড়মাস এক হয়ে গিয়েছিল। সব যত্ন, মিষ্টি কথা, সাড়াশব্দ না করে চোখ বুজে শুনতেন, যেই অচেতনে বিরক্তি বেরিয়ে পড়ত কখনও মুখ থেকে, ‘আমি কেন মরি না ঠাকুর, সবার জ্বালা জুড়োয়’ বলে পাড়া কাঁপিয়ে কান্না।

আরেকটা সম্ভাবনার কথা ভেবে দিদিমার ভয় হয়। হয়তো মেয়েটা এইসব শোনা না-শোনার নিয়ম হাড়ে হাড়ে জানে। হয়তো কেয়ার করে না। শুনতে পেলেই বা কী?

‘মায়ের কাপড়গুলো কাচা হয়ে গেছে? এখনই কেচে ফেলো, না হলে শুকোবে না।’ কঠিন গলায় আরতি বলে। দিদিমা খুশি হন। মায়ের নামে যে সে যা খুশি বলে যাবে, সইবে না আরতি।

কেনই বা সইবে? কম করেছেন তিনি এই ছেলেমেয়ের জন্য? নাওয়ানো, খাওয়ানো, রোগবালাই, ওষুধপত্র, প্রতিটা দিন বাঁচামরার লড়াই। কতবার মনে হয়েছে, আর বুঝি হল না। অন্ধকার সন্ধেতে তুলসীতলায় প্রদীপ দিতে এসে ভয়ে হাত ঠকঠক করে কেঁপেছে। কাল কী হবে? আমি তো জানি না ঠাকুর, তুমি জানো তো? শীর্ণ, লিকপিকে তুলসীগাছের দিকে তাকিয়ে সংশয় ঘনিয়ে এসেছে, জোর করে ধাক্কা মেরে সরিয়েছেন। তুমি জানো, জানতেই হবে তোমায়। এই আমি আমার সমস্ত ভয়, তোমার হাতে সঁপে দিলাম। এবার তুমি রাখলে রাখবে, মারলে মারবে।

‘মা?’

সন্ধের ছায়ায় তিনটে ছোট ছোট অবয়ব। গুটিগুটি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

‘ভয় করছে মা।’

খাদের কিনারা থেকে কারা যেন টেনে তোলে দিদিমাকে।

‘কীসের ভয়?’ হাত বাড়িয়ে তিনজনকে বুকে টেনে নেন দিদিমা। ‘আমি আছি তো।’

চোখের পাতা পুড়ে যায়। নিঃশ্বাস যেন ভাতের ধোঁয়া। কী তাপ কী তাপ। জলপট্টির ন্যাকড়া মুহূর্তে, শুকিয়ে যাচ্ছে নিমেষে।

‘কষ্ট হচ্ছে ভারতী?’

রোগা শরীর মিশে গেছে বিছানার সঙ্গে, তবু ঠোঁটে হাসি। ঠোঁট নড়ছে। দিদিমা ঝুঁকে পড়েন ভারতীর মুখের ওপর।

‘ভালো হয়ে গেলে একদিন দুধের সর খেতে দেবে মা?’

‘আরতিইইইই… দুধ বসিয়েছিস?’

‘মা, এই তো আমি, কষ্ট হচ্ছে খুব? আর কষ্ট হবে না, এই দেখো কে এসেছে।’

‘ভারতী? এসেছিস? এতদিনে মাকে মনে পড়ল?’

‘কই দেখি কীসের কষ্ট।’

‘দেখো না গো, জ্বর নামছে না রাত থেকে।’

চোখ কুঁচকে ভারতীর মুখখানা দেখার চেষ্টা করেন দিদিমা। দৃষ্টি বার বার কেঁপে যায়, জলে ভরে আসে। ভারতীর রিনরিনে গলা এত গম্ভীর হয়ে গেল কবে? সর্বনাশ, এক জোড়া গোঁফও গজিয়েছে নাকি! ও হরি এ তো ভারতী নয়, এ তো ছোকরা ডাক্তারটা।

ছোকরা ডাক্তার দিদিমার মাথা বালিশ থেকে দুহাতে তুলে নিয়ে ফুটবলের মতো এদিকওদিক নাড়ায়, নাড়ি টেপে, বুকের ওপর স্টেথোস্কোপ চেপে ধরে। দিদিমা যেন মানুষ নন, ন্যাকড়ার পুতুল।

‘এই তো সকালেই দেখে গেল, আবার এখনই দেখার কী আছে?’

‘সকালে কী করে দেখবে মা, সকাল তো এখন। চুপ করো। কথা বোলো না।’ আরতির আঙুল দিদিমার হাতের পাতা চেপে ধরে সান্ত্বনা দেয়। দিদিমা গজগজ করেন। বাড়িতে এসে দেখলে যে বেশি টাকা ভিজিট সেটা তিনি জানেন। টাকার মর্ম এরা জানে না, ফেলেছড়িয়ে নষ্ট করে।

ডাক্তার দিদিমার চোখের পাতা টেনে ধরে গম্ভীর মুখে উঁকি মারে। বলে, ‘আসলে দিদিমা এত সুন্দর যে বার বার দেখতে ইচ্ছে করে।’

ছোকরা ডাক্তার হয়েছে, কিন্তু ফাজলামো যায়নি। হাফপ্যান্ট পরে আমগাছে ঢিল মেরে দৌড়ত ক’বছর আগেও। দিদিমার মনটা সামান্য ফুরফুরে হয়। এখন না হয় এই হয়েছেন, সুন্দর তিনি সত্যিই ছিলেন। খাটের তলার ট্রাংকে পুরনো অ্যালবামে প্রমাণ আছে। ওই ট্রাংকে আরও কত কিছু যে আছে, তাঁর লাল বেনারসি, পিঁজে পিঁজে গেছে, আজকের কথা? আরতিভারতীর ছোটবেলার সোয়েটার, ফ্রক, অরুণের মেডেল সার্টিফিকেট। কিচ্ছু ফেলেননি দিদিমা।

‘মা খুব কষ্ট পাচ্ছে গো?’ আরতির গলা এরকম ধরা কেন? নিশ্চয় সারারাত জানালা খুলে শুয়েছিল, ঠান্ডা লাগিয়েছে।

‘কষ্ট এখন পাচ্ছেন শুধু আপনারা, উনি ও সবের ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। অরুণদাকে আসতে বলে দিন আরতিদি, আর দেরি করা উচিত হবে না।’

দিদিমা চমকে ওঠেন। কী বলছিস তোরা। অরুণকে আসতে বারণ কর। তোরা দেখতে পাস না, এখনও দুপুরবেলা পাড়ার রাস্তায় গাড়ি চেপে ঘোরে ওরা। সাপের মতো ঠাণ্ডা চোখ আমার চোখে রাখে। বলে, ছেলে কুসঙ্গে পড়েছে মাসিমা, এইবেলা সামলান। অরুণকে পেলে তুলে নিয়ে যাবে, মেরে হাঁটু জখম করে দেবে চিরকালের মতো। তারপর ছেড়ে দেবে।

দিদিমার সারাশরীর ঘামে ভিজে যায়। তিনি জানেন, ছাড়া মানে কী। ছেড়ে দিলে ছেলে দিকবিদিকশূন্য হয়ে দৌড়বে, তখন পেছন থেকে গুলি চালাবে। দিদিমা চিৎকার করে বলতে চান, ‘দৌড়ো অরুণ, আরও জোরে দৌড়ো, পালা এখান থেকে। পাড়া ছেড়ে, শহর ছেড়ে, দেশ ছেড়ে। আমার কথা ভাবিস না, তোরা বাঁচলে আমিও বাঁচব।’

‘মা মাগো,’ আরতি জাপটে ধরেছে তাঁকে। ‘এত কাঁদছিস কেন আরতি? কীসের ভয়? কে বকেছে?’ ‘আমাদের কী হবে মা?’ দিদিমা হাসেন। ‘সব মঙ্গল হবে। ভগবান আছেন, আমি আছি। দিদিমার কানে ফোন চেপে ধরে আরতি, ‘বলো মা, দাদার সঙ্গে কথা বলো।’ তিনজনের মধ্যে অরুণের গলাই সবথেকে সুরেলা ছিল, খুব শখ ছিল দিদিমার ছেলে গান শিখবে, হেমন্তের মতো গাইবে, এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়… ‘মা, আমরা আসছি মা, আর কয়েকঘণ্টা বাদেই দেখা হবে, মা, মাগো…’ ‘আসিস না অরুণ, দোহাই তোর আসিস না, আরও জোরে দৌড়ো। আরও দূরে পালা।’

‘আরতি, কান্না থামা, এত কাঁদলে গলা ভেঙে যাবে। এত অন্ধকার কেন চারদিক, জানালা খুলিসনি?’ নাকি খোলা জানালা দিয়ে সেই অসুরের মতো মেঘটা ঢুকে পড়েছে ঘরের ভেতর? অবশেষে ধরে ফেলেছে দিদিমাকে? কড়কড় করে হাসছে মেঘটা, শোঁ শোঁ নিঃশ্বাস ফেলছে।

এই দুর্যোগে দরজায় কে কড়া নাড়ে?

ভারতী! ভারতী এসেছে! ওরে দরজা খুলে দে। অরুণের মতো বেপরোয়া নয় ও, আরতির মতো ছিঁচকাঁদুনে নয়, ও ভীতু, শান্ত, মুখচোরা। এই ঝড়ে বাইরে ভয় পাবে।

ভীষণ জোরে বাজ পড়ল একটা। দিদিমা নিজেই ছুটে গিয়ে দরজা খোলেন। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রদীপ জ্বালা।

ওই তো, তুলসীতলায় দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রক পরা, রোগা হাতে লালরঙের চুড়ি। মেলা থেকে কিনে দিয়েছিলেন তিনিই। তাঁকে দেখতে পেয়েছে ভারতীও। দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। দিদিমা দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরেন। আহ, কতদিন পর। ছোট্ট, নরম শরীরটা তাঁর বুকের সঙ্গে লেপটে থাকে।

‘ভয় করছে ভারতী?’ চোখের জলে ভেজা মুখে হাসি ফোটে। দু’দিকে ঘাড় নাড়ছে ভারতী।

‘তুমি আছ তো।’

‘আছি আছি, আমি আছি। মা আছে। ভয় নেই। অরুণ, ভালো থাকিস। খুব ভালো থাকিস। আরতি, ইস গলা ভেঙে গেছে, আর কাঁদিস না মা, গরম জলে নুন দিয়ে কুলকুচি করিস, কুঁড়েমো করিস না। আমার সময় থাকলে করে দিতাম, মা ছাড়া কে-ই বা করে, কিন্তু আমার আর সময় নেই যে।’

ভারতীর হাত ধরে অন্ধকারের দিকে পা বাড়ালেন দিদিমা।

প্রদীপ নিভে গেল।

(Katherine Anne Porter-এর ছোট গল্প ‘The Jilting of Granny Weatherall’-এর ছায়া অবলম্বনে)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...