মিসড কল

বুবুন চট্টোপাধ্যায়

 

“বৌদি, নিচে দাঁড়িয়ে আছি। নামুন।” “দাঁড়িয়েই থাকো।” বলে মুগ্ধা ঠকাস করে মোবাইলটা টেবিলের উপর রাখল। আর একটু হলে টেবিলের কাচের টপটা চৌচির হত। শুভ্র বলল, “কী হল? নিশ্চয়ই চন্দন!” মুগ্ধা গজগজ করতে করতে বলল, “আবার কে? লাটসাহেব নিচে দাঁড়িয়ে হুকুম করছে, নিচে নেমে আসুন। ডিসগাস্টিং।” শুভ্র বলল, “তুমি আজ ওকে বলে দেবে, এবার থেকে ওপরে এসে চাবি নিয়ে যেতে। রোজ, রোজ এই অশান্তি ভালো লাগে না।” মুগ্ধা শুভ্রর কথা শুনে চিড়বিড়িয়ে উঠল। টেবিল থেকে মোবাইলটা তুলে বলল, “তুমি কী ভাবছ? বলিনি? আমি এও বলেছি লিফটে তো উঠবে। শুধু শুধু একটা কল নষ্ট করো কেন? দরকারের সময় সেই তো বৌদি, দাদা, ১০০ টাকা দেবেন রি-চার্জ করব।”

শুভ্র বলল, “ওরা একে কুঁড়ে তার উপর বুদ্ধি কম। ভালো বুদ্ধি ওদের কানে ঢোকে না।” বলেই বলল, “নাও, নাও আমাকে কিছু একটা সিরিয়াল-টিরিয়াল দিয়ে দাও। বেরোব।” “আজ চন্দন আসুক!” বলে মুগ্ধা গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকল।

শুভ্র বাথরুমে বসে আরাম করে একটা সিগারেট ধরাল। মুগ্ধা ঠিকই বলে, সত্যিই চন্দনটা বড্ড কুঁড়ে। লিফটে করে উপরে এসে গাড়ির চাবিটা নিয়ে যেতেও কুঁড়েমি। তা না বাবু গ্যাঁট হয়ে নিচে দাঁড়িয়ে থাকবে আর আমরা গিয়ে চাবি দেব, উনি দয়া করে গাড়ি স্টার্ট দেবেন। ওর বোধহয় নিজেকে নিছক ড্রাইভার ভাবতে আপত্তি। তা হতেই পারে, সেটায় শুভ্র কোনও দোষ দেখে না, কিন্তু তাহলে অন্য আত্মসম্মানগুলোর দিকেও নজর দেওয়া উচিত। প্রতিমাসে মাইনে ছাড়াও মোবাইল রিচার্জ করার পয়সা নিতেও তাহলে সম্মানে লাগা উচিত। কাজ করব না অথচ ফাট করব… আমি কী হনু রে!

শুভ্র দেখেছে বিহারী বা পাঞ্জাবী ডাইভারগুলো এইসব বাজে ভ্যানিটিতে ভোগে না।

শুভ্র রেডি হয়ে নিচে গিয়ে দেখে চন্দন অন্য ড্রাইভারদের সঙ্গে খিল্লি করছে। মনে মনে ভাবল, আজ ফিরে এসে মুগ্ধার কাছে উত্তমমধ্যম খাবে। ভাবতে ভাবতে শুভ্র গাড়িতে উঠল। কবজি ঘুরিয়ে শুভ্র দেখল, সাড়ে ন-টা। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। কটায় ক্লিনিক শেষ করতে পারবে কে জানে। তারপর আবার ওটি। গাড়িতে উঠতে উঠতে শুভ্র  ভাবল, না চন্দনের সঙ্গে আর এই নিয়ে খ্যাচ খ্যাচ করতে ভালো লাগছে না।

অন্যদিনের তুলনায় শুভ্র ইচ্ছে করেই চন্দনের সঙ্গে বেশি কথা বলছে না। বুঝতে পারছে চন্দন উশখুশ করছে। এক্কেবারে বখতিয়ার খিলজি। একবার শুরু করলে আর থামতে জানে না।

যথারীতি একটু পরে চন্দনই শুরু করল। “দাদা, আজ অনেক পেশেন্ট নাকি?” শুভ্র সংক্ষেপে বলল, “হ্যাঁ।” তারপর বলল, “শোনো আমাকে ছেড়ে দিয়ে বৌদিকে নেবে। বেরোবে। আর কাল মনে আছে তো বৌদির কিন্তু সকালে পুপেকে নিয়ে এয়ারপোর্টে যাওয়া। সময় মতো এসো।” চন্দনকে নিয়ে একটাই ভয়, কখন যে খেয়ে টান্টু হয়ে যাবে কে জানে।

শুভ্রকে ছেড়ে দিয়ে গাড়ি রেখে চন্দন মুগ্ধাকে ফোন করল, বলল, “বৌদি, এসে গেছি, নেমে আসুন।” মুগ্ধা হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। ভাবল যা বলার সামনাসামনিই বলবে। দরজায় চাবি দিয়ে মুগ্ধা নিচে এল। দেখল চন্দন গাড়িতে বসে জোরসে রেডিও শুনছে। মুগ্ধাকে দেখে থতমত খেয়ে বন্ধ করল। মুগ্ধা গাড়িতে ব্যাগপত্তর রেখে সোজাসুজি চন্দনকে বলল, “তোমাকে অনেকদিন বলেছি নিচ থেকে ফোন করবে না। অনেকদিন অনেক ব্যাগ থাকে, একটু না ধরলে অসুবিধা হয়। তাছাড়া লিফটে উঠবে তাও এত আলসেমি কেন? শুধু শুধু কল নষ্ট করো। তারপর তো ফুরিয়ে গেলে আমাদের থেকেই…।” এইটুকু বলে মুগ্ধা গাড়িতে উঠল। সারা রাস্তা আর একটি কথাও বলেনি চন্দনের সঙ্গে। বিরক্ত লাগছে।

চন্দনও গুম মেরে আছে। বুঝতে পেরেছে বৌদি ক্ষেপে গেছে। কিন্তু চন্দন একটা ব্যাপার বুঝতে পারে না এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত কিচাইন করার কী আছে। আসলে ওরা চাকরবাকরকে মোটে মানতে পারে না। মুখে যত সিপিএম মার্কা বুলি। আসলে সব শালা আমাদের জুতোর নিচে রাখতে চায়। চন্দন মনে মনে ভাবল, বেশি কিচাইন করলে বলে দেব, “রাখুন, আপনার গাড়ি। আমাদের কাজের অভাব হবে না।”

মুগ্ধার মেজাজটা সত্যিই খিঁচড়ে গেছে। যত এদের উপর নির্ভরতা, তত খিটিমিটি। মুগ্ধা মাঝেমাঝে ভাবে এর থেকে তার বিদেশবাস ভালো ছিল। যে যার কাজ নিজে করো, কাজের লোকের বালাই নেই, নিত্য খিটিমিটিও নেই। ভাবতে ভাবতে মুগ্ধার গ্রেগের কথা মনে পড়ল। ইংল্যান্ডে গিয়ে ও আর শুভ্র প্রথম গ্রেগের কাছেই গাড়ি চালানোর লেসন্ নিয়েছিল। কারণ ও দেশে  বাস করলে বাসিন্দা হিসেবে ইন্ডিয়ার ড্রাইভিং লাইসেন্সকে ওরা ধর্তব্যের মধ্যে ধরে না। গ্রেগ বেশ ফ্রেন্ডলি ছিল, ড্রাইভারের পাশের সিটে ব্রেকে পা দিয়ে নানারকম গল্প করত। একদিন গ্রেগ কথায় কথায় জানতে চাইল, “তুমি ইন্ডিয়ায় গাড়ি চালাতে তো?” আমি বললাম, “না।” উত্তরে গ্রেগ বেশ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “হাও ডিড ইউ ম্যানেজ দেন…?” উত্তরে আমি হেসে বলেছিলাম, “আমাদের ড্রাইভার ছিল।” শুনে বিস্ফারিত নেত্রে গ্রেগ বলেছিল, “ইউ মিন শফার ড্রিভেন কার? দেন, ইউ মাস্ট বি ভেরি রিচ!”

শুনে এত লজ্জা হয়েছিল সেদিন, গ্রেগকে কী করে বোঝাই বড়লোক হলে কি আর বাপু এদেশে আসতাম!

সত্যিই ওদেশে আচ্ছা আচ্ছা বড়লোকও ভাবতে পারে না ড্রাইভার নিয়ে গাড়ি চালাবে। টনি ব্লেয়ারও নিজের গাড়ি নিজে চালাতেন। গাড়ি খারাপ হলে ট্রেনে-বাসে যাতায়াত করতেন। এদেশে ভিআইপিদের মতো সর, সর, ডাকাত এল গোছের ইচ্ছেমতো হুটার বাজানো নেই।

মুগ্ধা নামার সময় চন্দনকে বলল, “কাল আটটা কুড়িতে ফ্লাইট। সাড়ে পাঁচটার মধ্যে চলে আসবে।”

পৌনে ছটা বাজে। চন্দন ফোন ধরছে না। মুগ্ধা শুভ্রকে বলল, “ট্যাক্সি ডাকো। এবার রিস্ক হয়ে যাবে। নিশ্চয় খেয়ে আছে।” উফ!! শুভ্ররও রাগ হচ্ছে, কাল বলে দেওয়া সত্ত্বেও এমন করে ঝোলাল। “ধুস! চন্দনটার আর জ্ঞানগম্যি হবে না কোনওদিনও।” বলে শুভ্র ট্যাক্সি ডাকার তোড়জোড় শুরু করল।

মুগ্ধার মাথাটা দপদপ করছে। সক্কালবেলা এত চাপ নেওয়া যায়? মাস গেলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নেবে, অথচ দরকারের সময় ঠিক নিয়ম করে ঝোলাবে। এদের চরিত্রই তাই। ভাগ্যিস ট্যাক্সিটা পেল। যদি না পেত! উফ! মুগ্ধা ভাবতেই পারছে না। ভাইয়ের বিয়ে। কবে থেকে টিকিট কাটা। কোনও মানে হয় এমন করার! এমন নয় চন্দন জানে না। ওকে পই পই করে বলা ছিল যাই হোক ওইদিন কিন্তু মিস কোরো না। শুভ্রও বারবার বলেছিল। যেহেতু ও পরে যাবে, পুপে আর মুগ্ধা একা যাবে… কী আর করা। নিশ্চয় কোথাও খেয়ে পড়ে আছে। ও তো সক্কাল সক্কাল মুখ ধুয়েই খেয়ে নিতে পারে। শুভ্র মুগ্ধাদের ব্যাগপত্র ডিকিতে তুলতে তুলতে ভাবল, বেলায় চন্দন দাঁত কেলিয়ে এলে এককথায় বিদায় করে দেবে। এনাফ ইজ এনাফ!

না, চন্দন আসেনি। দু দিন হয়ে গেল। পুরো ডুব। কোথায় ঘাপটি মেরে পড়ে আছে কে জানে। এই না বলে কয়ে কামাই করলে শুভ্রর সত্যিই খুব অসুবিধা হয়। হাসপাতাল, চেম্বার, ওটি… কত আর ট্যাক্সি করে ম্যানেজ করা যায়। আরে বাবা! আসবি না আসবি না একটা খবর তো দিবি! শুভ্র ভাবে এই এত কাণ্ডজ্ঞানের অভাবের জন্যই এদের দুর্গতির কোনও শেষ হয় না। যে কোনও কাজের জায়গায় বিশ্বাস অর্জন করতে হলে একটু রেসপন্সিবলও হতে হয়। শুভ্র ভাবল, চন্দনের সব কিছু নিয়ে ওদের একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। অনেক জায়গায় প্রয়োজনে একা ছেড়ে দেওয়া যেত। এখন আবার একটা ড্রাইভার খোঁজো, তাকে ধরে ধরে এর বাড়ি, ওর বাড়ি, পুপের স্কুল চেনাও। সত্যি মাঝেমধ্যে শুভ্র ভাবে কী মরতে যে ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এল। বেশ তো ছিল। যত ডিপেন্ডেন্স, তত ঝামেলা। এই ফিরে আসা নিয়ে মনকেমন করলেই শুভ্রর ইংল্যান্ডে তার কলিগ আব্দুর কথা মনে পড়ে। বহুদিন আগে আব্দু প্যালেস্টাইন থেকে ইংল্যান্ডে চলে এসেছিল। ওদেশে দশ বছর থেকে হঠাৎ শুভ্রদের ফিরে আসার সিদ্ধান্তে আব্দু খুব মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিল। বারবার শুভ্রকে বলছিল, ইংল্যান্ডের মতো ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিতে এমন স্থায়ী চাকরি ছেড়ে কেউ যায়? শেষমেশ কিছুতেই যখন শুভ্রকে টলানো গেল না, ঈষৎ রেগে গিয়েই বলেছিল, “তোমাদের সমস্যাটা কী জানো, তোমরা সবাইকে ছেড়েও থাকতেও পারো না, আবার দেশে গিয়ে সবাইকে নিয়েও থাকতে পারোনি। তাই চলে এসেছিলে!” শুভ্রর আব্দুর এই কথাটা প্রায়ই মনে পড়ে। কী অনায়াসে চরম সত্যি কথাটা বলেছিল। ও দেশে দশ বছর থাকার দরুণ অনেক অভ্যাস, এক্সপেকটেশন পালটে গেছে শুভ্র আর মুগ্ধার। এখানে প্রতিদিন সেই অভ্যাস, সেই প্রত্যাশায় হোঁচট। তাই প্রতিদিনই ঝামেলা, ঝঞ্ঝাট, মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকে। প্রতিদিনের সহযোগী মানুষগুলো যদি চন্দনের মতো এমন প্রতি পদে অসহযোগিতা করে কাঁহাতক সহ্য করা যায়। অথচ, ওদেশে এমন কথার খেলাপ মানুষ ভাবতেই পারে না। শুধু মুখের কথাতেই কত বড় বড় কাজ হয় ও দেশে। শুভ্রর সবসময় মনে হয়, ওরা যতই ধুরন্ধর হোক, সকলের একটা বেসিক ক্যারেক্টার আছে।

“হ্যালো, ঠিকঠাক পৌঁছেছছ তো?” মুগ্ধা, বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, কোনও অসুবিধা হয়নি।” বলেই শুভ্রকে জিজ্ঞাসা করল, “চন্দনের কোনও খবর পেলে?” শুভ্র বলল, “না! নেওয়ার চেষ্টা ও করিনি। এলে স্রেফ বিদায় করে দেব।” মুগ্ধা বলল, “তা তো করবই, এর পরে আর কোনও প্রশ্নই নেই। এই প্রথমবার নয়। এর আগেও এমন করে হ্যারাস করেছে চন্দন। আর নয়।”

“ঠিক আছে, আমি রাখছি এখন, বেরোতে হবে” মুগ্ধা শুভ্রর ছেড়ে দেওয়া ফোনের রিসিভারটা রাখতে রাখতে ভাবল, এক-একজন মানুষ জীবনে যতই অসুবিধা করুক, কীরকম যেন অভ্যাস হয়ে যায়। চন্দন যতই ড্রাইভার হোক, হাজারটা বায়নাক্কা, বিরক্তি সত্ত্বেও চন্দন তাদের সংসারে সেই পুরাতন ভৃত্যের মতো। দেখে পিত্তি চলে গেলেও সেই কোনকাল থেকে তাদের গাড়ি চালাচ্ছে। ধ্যুস! এখানে, মায়ের কাছে এসে কদিন আর ওই উজবুকটাকে নিয়ে মুগ্ধা ভাববে না।

পরেরদিন চন্দনের মিসড কল। ব্যাঙ্গালোরে বসে ওকে কল ব্যাক করতে মুগ্ধার বয়েই গেছে। চন্দনের এমন ঝোলানো প্রথমবার নয়। এবার আর নয়। শুভ্রই বলে দিয়েছে এলে পরিষ্কার মাইনে দিয়ে বিদায় করে দেবে। আবার চন্দনের মিসড কল। করুক। এবার বোঝ। আবার…..উফ!!!

দিন দশেক বাদে চন্দন এল। দরজা খুলে মুগ্ধা হতবাক। একি মাথা ন্যাড়া কেন? মুগ্ধা জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে?” চন্দন মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “বাবা মারা গেছে বৌদি। সেদিন আপনাকে আর দাদাকে কত মিসড কল দিলাম, কেউ ধরলেন না। সেদিন সত্যিই আমার ফোনে কোনও ব্যালেন্স ছিল না। দাদা যদি গিয়ে একটু দেখত হয়তো বাবা…” বলতে বলতে চন্দনের গলা বুজে এল। মুগ্ধা বলল, “তা ফোন করে তো সেটা বলতে হয়!” চন্দন মুগ্ধার দিকে কীরকম ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলল, “আপনিই তো বলেছিলেন মিসড কল দিতে।”

মুগ্ধার জীবনে এই প্রথমবার নিজের উপর ঘেন্না হল।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. মিস্ ড কল দেওয়া তো আমাদের দেশে যোগাযোগের মাধ্যম। কাজের দিদি কখনোই ফোন করে বলে না ‘আজ আসব না’। ও মিস কল দেয়। আমরা কল করলে বলে ‘আসব না’। এখন আর ওকে ফিরে ফোন করি না। ও মিস কল করলেই বুঝেযাই আজ আসবে না।

আপনার মতামত...