বিষাণ বসু
For the painters, paintings are, wet or dry, just paintings. They are not arguments. They are not signs on the way to that supposed Nirvana : Culture.
……Paintings must be looked at and looked at and looked at – they, I think, the good ones, like it. They must be understood, and that’s not the word either, through the eyes. No writing, no talking, no singing, no dancing will explain them. …….”Look at that!” is all that can be said before a great painting, at least, by those who really see it.
“And cannot words, written or spoken, help those who have partial or little sight for painting?”
My answer to this question is : No. Only prayer, and looking, and looking, and looking at painting…..
Charles Demuth
Look at that. দেখুন, প্লিজ দেখে আসুন। সাদা বাংলায়, এইটুকুই বলার। থিয়েটার রোডের পাশে, হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটে, আকৃতি আর্ট গ্যালারিতে লালুপ্রসাদ সাউয়ের বিমূর্ত ছবির যে প্রদর্শনী চলছে, সেইটা নিয়ে এর বেশি কিছুই বলার নেই।
লালুপ্রসাদ সাউ-এর ছবির কথা উঠলে, আর যাই হোক, অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের কথা মাথায় আসে না। সমকালীন ভারতীয় চিত্রকলার এই অন্যতম প্রধান শিল্পীর নাম উঠলেই পরিচিত যে সব ছবির কথা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তার মধ্যে বিমূর্ত ছবি বিশেষ নেই। বাজার-সাফল্য তাঁর এসেছে বাবু-বিবি সিরিজের ছবির হাত ধরেই।
টেম্পেরার দক্ষ ব্যবহারে, আপাতজটিলতাহীন এক আশ্চর্য জগতের নির্মাণ করেন তিনি এই বাবু-বিবি সিরিজের ছবির মাধ্যমে, যাতে মিশে থাকে এক ফেলে আসা কল্পনার সময়, কিছু নস্ট্যালজিয়া, স্মিত হাসি। হয়তো কিছু ফিল-গুডও।
বাংলার পটচিত্র আর তার সঙ্গে রাজপুত-মুঘল মিনিয়াচারের ধারাকে মিলিয়ে নিজস্ব টেম্পেরার জগত নির্মাণ করেন লালুপ্রসাদ। এ ছবি অতীতচারী, কিন্তু সম্পূর্ণ বাস্তবানুগ নয়।
আর, কে-ই বা না জানে, হুবহু বাস্তবকে বা ভাবনাকে বাস্তবানুগ করে ক্যানভাসে আনার দিন গিয়েছে সেইদিনই, যেদিন ক্যামেরা নামক যন্ত্রটি এক লহমায়, অনেক বেশি নিপুণতার সঙ্গে, বাস্তবকে ধরতে সক্ষম হল।
আজ নয়, পাক্কা আটটি দশক আগেই, আর্শিল গোর্কি বলে গিয়েছিলেন,
My dearest ones, the camera has rendered impotent any attempt to compete with it. This has to be accepted as a necessary and a scientific advance. What reason, therefore, remains to sit in realism’s stagnation? Art is more than mere chronicle. It must mirror the intellect and the emotion, for anyone, even a commercial artist or illustrator, can portray realism…….the stuff of thought is the seed of the artist. Dreams form the bristles of the artist’s brush. And the eye functions as the brain’s sentry. I communicate my innermost perceptions through art, my worldview.
অতএব, লালুপ্রসাদের টেম্পেরার জগত, তাঁর নিজস্ব নির্মাণ। আপাতদৃষ্টিতে, পুরনো কলকাতার বাবু-কালচারের সঙ্গে মিলমিশ থাকলেও, তাঁর বাবু-বিবির দুনিয়া একান্তভাবেই তাঁর মনোরাজ্য, তাঁর ওয়ার্ডভিউ। শিল্পীর সাফল্য সেই মনোজগতকে প্রকাশ্যে আনার মধ্যেই।
শুধু জনপ্রিয়তা দিয়ে ছবির বিচার হয় না। অন্তত সমকালে শিল্পীর ছবি কতখানি দর্শকের মনোযোগ পাচ্ছে বা বাজারে কেমন দামে বিকোচ্ছে, এইটা তো শিল্পের বিচারের ক্ষেত্রে কোনওভাবেই বিবেচ্য হওয়া উচিৎ নয়।
কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে, এই বাজার অর্থনীতি শাসিত দুনিয়ায়, যে দুনিয়ায় এমনকি আমাদের মনোজগতটিও নিয়ন্ত্রণ করতে থাকছে সেই সর্বশক্তিমান বাজারই, এমন সময়ে দাঁড়িয়ে, ছবির ক্ষেত্রে বাজারকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা দর্শক কিম্বা শিল্পী, দুই পক্ষের ক্ষেত্রেই কঠিন।
শিল্পজগত এবং শিল্পবাজার এমনভাবে একাকার হয়ে যাওয়ার বিষয়টি অন্তত চিত্রসমালোচকেরা সযত্নে এড়িয়ে যান। কেননা, কেউই মানতে চান না, যে, তাঁদের চর্চার জগতটি বাজারি হয়ে দাঁড়িয়েছে বা হেমন্তের অরণ্যে তিনি সেলসম্যান মাত্র। কিন্তু, বিগত কয়েকদশক জুড়েই, আর্ট এবং তার উপর বাজারের নিয়ন্ত্রণ, এই বিষয়টি পশ্চিমদেশে সিরিয়াস আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।
কথাটা তুললাম এই কারণেই, যে, লালুপ্রসাদ সাউ-এর বাবু-বিবি সিরিজ বাজারের আশীর্বাদলাভে সক্ষম হয়েছে। বঙ্গদেশের সমকালীন জীবিত শিল্পী যারা রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজন বিশেষ শিল্পীর এমন একটি বিশেষ ধরনের কাজের শিল্পবাজারে এমন বিপুল জনপ্রিয়তা প্রায় নজিরবিহীন (একমাত্র তুলনায় আসতে পারে যোগেন চৌধুরীর ক্রস-হ্যাচে করা শিল্পসম্ভার)। আবার, পাশাপাশি, ছবি যাঁরা নিয়মিত দেখেন না এবং যাঁরা ছবি ভালোবাসেন, সব ধরনের দর্শকের মধ্যেই এই বাবু-বিবি সিরিজের কদর রয়েছে। চিত্রসমালোচকরাও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকেন এইসব ছবি নিয়ে, কিন্তু, সেইকথা আলাদা করে না ভাবলেও চলবে, কেননা, অন্তত এদেশে, যার ছবির বাজার রয়েছে, সেই শিল্পীর ছবির নিন্দা করার দুঃসাহস প্রায় কোনও তথাকথিত বিদগ্ধ সমালোচকই দেখান না।
মোদ্দা কথা, সব ধরনের দর্শক এবং বাজারের ক্রেতা, সব পক্ষেই লালুপ্রসাদ সাউ-এর টেম্পেরা জনপ্রিয়। সেই হিসেবে, তিনি, অনিবার্যভাবেই, সফল শিল্পী।
কিন্তু, এই নিরাপত্তার জগত ছেড়ে, তিনি, আকস্মিক, অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের আলোআধারির জগতে পা বাড়ালেন কেন?
আর কিছু না হোক, অশীতিপর এক শিল্পী কেমন করে নিশ্চয়তার বেড়া ছিঁড়ে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারে প্রয়াসী হতে পারেন, অন্তত সেই বিস্ময়ের সাক্ষী হওয়ার জন্যেই, এই প্রদর্শনী অবশ্য দ্রষ্টব্য।
***
শিল্পী যখন ছবি আঁকেন, তখন কি দর্শকের কথা মাথায় রাখেন? রাখলে, সেই রাখা কোন অর্থে?
আরেকটু স্পষ্ট করে বলতে হলে, হ্যাঁ, আর্টের মধ্যে একটা এক্সট্রোভার্ট এলিমেন্ট তো রয়েছেই। একজন শিল্পী, একেবারে নিভৃতে বসে আঁকার মুহূর্তেও, এমন, বোধহয়, ভাবেন না, যে, তাঁর সেই ছবি দেখবেন না কেউ। কাজেই, ছবি আঁকার মুহূর্তে শিল্পী অবশ্যই জানেন, তাঁর এই কাজ থাকবে অনেক দর্শকের সামনে।
কিন্তু, ছবি আঁকার সময়ে কি শিল্পী দর্শকের পছন্দ-অপছন্দের কথা মাথায় রাখেন? অথবা, দর্শক বলতে যদি ছবির ক্রেতার কথা ভাবা হয়, সেক্ষেত্রে, শিল্পী কি ক্রেতার রুচি বা চাহিদার কথা ভেবে ছবি আঁকেন? বাজারের রুচি-চাহিদা কি শিল্প-সৃষ্টির পদ্ধতিকেই প্রভাবিত করে? অথবা, কোনও শিল্পীর একটি বিশেষ কোনও শিল্প-ধাঁচ বাজারে জনপ্রিয় হয়ে গেলে, শিল্পী যদি সেই ধরনের কাজেরই পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন, তাহলে সেই পুনরাবৃত্তি কি সেই ধাঁচের কাজের প্রতি শিল্পীর অপত্য-স্নেহের কারণে, নাকি বাজারের চাহিদায় প্রভাবিত হয়ে?
প্রশ্নগুলো যুক্তিযুক্ত এবং লালুপ্রসাদ সাউ-এর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। বাবু-বিবি সিরিজের বিপুল জনপ্রিয়তা এবং তারপর এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁর একই ধরনের ছবি আঁকার প্রবণতা প্রসঙ্গে এমন প্রশ্ন উঠে আসা তো অযৌক্তিক নয়। কিন্তু, এক কথায় এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সহজ নয়।
***
লালুপ্রসাদ সাউ-এর বিমূর্ত ছবির এই প্রদর্শনী দেখতে হলে, মাথায় রাখা ভালো, তাঁর শুরুটি অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট দিয়েই। সেই অর্থে, এ তাঁর পক্ষে কোনও ভিন্ন শিল্পধারায় হাত পাকানোর প্রয়াস নয়। বরং, বলা যেতে পারে, এ তাঁর ঘরে ফেরা বা শিকড়ের সন্ধান।
বিমূর্ত ছেড়ে ফিগারেটিভ ছবির পথে যাত্রা শুরুর প্রেক্ষিত বিষয়ে তিনি নিজেই বলেছেন—
তখন তো আমি শুধুই বিমূর্ত কাজ করতাম। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, বিমূর্ত কাজ করে খুব বেশিদূর এগোনো যাবে না। এগোনো যাবে না মানে, ছবি হিসেবে অবশ্যই এগোনো যাবে কিন্তু আর্থিক দিক দিয়ে খুব একটা সুবিধাজনক হবে না। শুনতে খারাপ লাগলেও এটা খুব সত্যি কথা। আমি এই সত্যিকে খোলাখুলি বলতেই পছন্দ করি।
(সাক্ষাৎকার— লালুপ্রসাদ সাউ, প্রকাশক— দেবভাষা)
হ্যাঁ, তাঁর ছবির মতোই, লালুপ্রসাদ সাউ এমনই, ভণিতাহীন, সহজসরল।
যিনি স্পষ্ট বলতে পারেন –
আমার ছবি খুব সোজা, সরল। কোনও বড় ভাবনা নেই তাতে। হ্যাঁ, কখনও-সখনও হিউমার এসেছে হয়তো। সেগুলো লোকে যদি এনজয় করতে পারে, তো ভালো।
দেখুন, ছবি এঁকেছি বলে আমি এই দাবি করতে পারি না, যে আমার ছবি সবারই ভালো লাগবে। এটা আমি কখনওই দাবি করতে পারি না। আমি ছবি আঁকি নিজের আনন্দের জন্য। লোকে ছবি দেখে তার আনন্দের জন্য। সেক্ষেত্রে আমার ছবি তার ভালো নাও লাগতে পারে। আমার ছবির সঙ্গে তার ভাবনার কোনও মিল নাও হতে পারে। এর জন্য আমি তাকে দোষ দিতে পারি না। আমারও এক্ষেত্রে কোনও দোষ নেই। এটা একটা শূন্যতা, আমি এভাবেই ভাবি।
তাঁর টেম্পেরার জগত নিয়ে এই জটিলতাহীনতার দাবি সঙ্গত হলেও, তাঁর অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট প্রসঙ্গেও এই একই কথা প্রযোজ্য কি?
এককথায় এর উত্তর দেওয়া মুশকিল। বিমূর্ত চিত্র উপভোগ করার অভিজ্ঞতা একেকজনের কাছে একেকরকম। আর, এইজন্যেই, এই প্রদর্শনী দেখতে পারেন।
পুনরাবৃত্তি শোনাচ্ছে, একথা মেনেও বলি, দেশের একেবারে প্রথমসারির এক প্রবীণ শিল্পীর নিজেকে নতুন করে খুঁড়ে দেখার নিরীক্ষার মুখোমুখি হতে পারার এমন সুযোগ, এই শহরে বসে, সচরাচর আসে না।
***
লালুপ্রসাদ সাউ স্বল্পবাক, প্রচারবিমুখ মানুষ। নিজের ছবি নিয়ে খুব বেশি কথা তিনি বলেছেন বলে জানি না। তাঁর ছবিই যথেষ্ট বাঙ্ময়। কিন্তু, বিমূর্ত এইসব ছবির ক্ষেত্রে তাঁর ভাবনাটি ঠিক কী, সেইটা জানার সরাসরি সুযোগ নেই।
প্রচারবিমুখ এই শিল্পীর অসামান্য শিল্পকর্ম নিয়ে খুব বেশি লেখালিখি হয়েছে, এমন নয়। যেটুকু হয়েছে, তা ওই টেম্পেরার কাজগুলি নিয়েই। তাঁর বিমূর্ত চিত্র বা এচিং বা লিথো নিয়ে সর্বাঙ্গীণ কোনও কাজ হয়েছে বলে শুনিনি।
কাজেই, এই প্রদর্শনী দেখার আগে, কোন পথে এল এইসব কাজ, সেই প্রেক্ষিতটি জানার খুব একটা সুযোগ নেই। অবশ্য, লেখার শুরুতে ব্যবহৃত ডিমুথ-এর উদ্ধৃতিটি আরেকবার পড়ুন। কোনও লেখা, কোনও ব্যাখ্যা-ই আপনাকে ছবির অভ্যন্তরে পৌঁছে দিতে পারে না। এই কথা আরও বেশি করে সত্যি বিমূর্ত ছবি নিয়ে।
এই প্রসঙ্গে বেন নিকলসনের কথাটি গুরুত্বপূর্ণ—
(Abstract art) is felt subconsciously and it is useless to approach it intellectually, as this, so far from helping, only acts as barrier…… I think that so far from being a limited expression, understood by a few, abstract art is a powerful, unlimited and universal language.
কাজেই, মন খুলে, নির্ভয়ে, ছবি বিষয়ে আপনার মনে যা যা সংস্কার রয়েছে সে সব ছেড়ে ছবির সামনে দাঁড়ান। ছবির দরজা আপনাআপনিই খুলে যাবে।
***
কীভাবে, কোন পথে আসে অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট? মূর্ত জগৎ-এর দৃশ্য ঠিক কোন পথে হাঁটা দেয় বিমূর্তের পথে? নাকি শিল্পীর বিমূর্ত অবচেতনই উঠে আসে ক্যানভাসে বিমূর্ত শিল্প হয়ে?
কবিতা-গান-সিনেমার সঙ্গে ছবির এই একখানা বড় ফারাক। এইখানে আমাদের নতুন একটা ভাষা শিখতে হয়। সেইটা দৃশ্যভাষা, যা আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায় ব্যবহৃত ভাষার থেকে আলাদা, এবং, খুব সম্ভবত, যে ভাষা রয়েছে মুখের ভাষার চাইতে আগে থেকেই, এবং নিশ্চিতভাবেই যে ভাষার জন্ম লিখিত ভাষালিপির পূর্বে।
এই দৃশ্যভাষার সঙ্গে একটু জানাচেনা থাকলেই বিমূর্ত ছবির হয়ে ওঠার রহস্যটি আর রহস্য থাকে না।
মূর্ত দৃশ্যাবলী থেকে বিমূর্ত ছবির হয়ে ওঠা নিয়ে এই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী পিয়ের সুলাজস-এর কথাটি শোনা যেতে পারে—
Let’s be done with the trees. What interested me was the drawing of the branches, their movement in space. One may find a point of departure for my abstract painting. But if it offers a handwriting which is related to them it is just a chance. Window bars or the back of a chair would have furnished me the same point of departure.
সুলাজস-এর কথা এ কারণেই তুললাম, কেননা, এই প্রদর্শনীতে থাকা লালুপ্রসাদের বেশ কয়েকটি কাজের সঙ্গে এই ফরাসি শিল্পীর কাজের ধারার মিল লক্ষ্যণীয়। সুলাজস-এর জগদ্বিখ্যাত কিছু ছবির পাশাপাশি এই প্রদর্শনীর কিছু ছবিকে রাখলেই মিলটি স্পষ্ট বোঝা যাবে।
নীচের ছবিটি সুলাজসের—
পরেরটি লালুপ্রসাদের, এই প্রদর্শনীর। আঙ্গিকগত মিল অনুধাবনের জন্যে দূরবীন বা অনুবীক্ষণ লাগবে না আশা করি।
আরও একটা উদাহরণ দিই। দেখে নেওয়া যাক সুলাজস-এর আরেকটি ছবি।
আর পরের ছবিটি আবার লালুপ্রসাদ সাউ-এর। বর্তমান প্রদর্শনী থেকে গৃহীত।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমার এই ছবিগুলি পাশাপাশি রাখার উদ্দেশ্য, কোনওভাবেই, লালুপ্রসাদের কাজগুলিকে অনুকরণ বলে দাগিয়ে দেওয়া নয় (একসময় সুলাজস-এর উপর ফ্রানৎস ক্ল্যিন-এর কাজের প্রভাব নিয়েও বিস্তর কথা হয়েছে, কিন্তু কেউই সুলাজস-এর কাজকে অনুকরণ বলে দাগিয়ে দেননি। সমকালীন এক শিল্পীর সঙ্গে আরেকজনের ভাবনার বা আঙ্গিকের মিল মাত্রেই অনুকরণ নয়)। এইটুকুই জানাতে চেষ্টা করেছি, যে, এই মুহূর্তে বিশ্বে যেসব শিল্পী জীবিত আছেন, তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত পিয়ের সুলাজস-এর (হ্যাঁ, বছর পাঁচেক আগে এই নামেই তাঁকে অভিহিত করেছিলেন ফ্রাসোয়ঁ হল্যান্ড, যদিও শিল্পীর এমন র্যাঙ্কিং হতে পারে কিনা, বা হলেও কেমনকরে তা হওয়া সম্ভব সেটা আমার জানা নেই) ছায়া ঠিক কেমনভাবে পড়েছে এই সময়ের অন্যতম প্রধান ভারতীয় শিল্পীর কাজের উপরে। বা পাশাপাশি রেখে দেখতে চাইছি দুজনের ভাবনার মিলটুকু।
কিন্তু, সুলাজস-এর অনেক কাজই বৃহদায়তন ক্যানভাসে (ছোট সাইজের কাজের সংখ্যাও কিছু কম নয়)। অন্যদিকে, আর কিছু না হোক, স্রেফ বয়সের কারণেই লালুপ্রসাদের পক্ষে খুব বড় ক্যানভাসে কাজ করে ওঠা কঠিন (অবশ্য, ইঞ্চি-সেন্টিমিটারের হিসেবে বড় কাজ করার অভ্যেস তাঁর কখনওই ছিল না)। কাজেই, ছবির ব্যাপ্তির ফারাক রয়েছেই। পাশাপাশি, দেশ-কাল-সময়-সংস্কৃতির দুস্তর ব্যবধানটিও মাথায় রাখতে হবে। কিন্তু, সেই সব কথা বাদ দিলে, লালুপ্রসাদের এই প্রদর্শনী সুলাজস-কৃত আকাশের মাপকাঠি স্পর্শ করতে পারল কি?
কালো রঙ বলতেই আমাদের মাথায় আসে অন্ধকার আর মৃত্যুর অনুষঙ্গ। অবশ্য, সুলাজস বলে থাকেন, কালো রঙ দিয়েই তিনি ছবির মধ্যে আলোর সৃষ্টি করেন। লালুপ্রসাদের এই প্রদর্শনীর প্রায় সব ছবিতেই অনিবার্য উপস্থিতি এই কালো রঙের। মনে রাখতে হবে, সুলাজস এই কাজগুলি করে থাকেন তাঁর যৌবন থেকেই, এবং এর ধারাবাহিকতা ও এমন ধাঁচের ছবির ক্রমবিবর্তন নিয়েই তাঁর শিল্পীজীবন। অবশ্যম্ভাবীভাবেই, সুলাজস-এর কালো আরও অনেক উজ্জ্বল। লালুপ্রসাদের কালো অনেক মলিন, প্রায় ধূসর। মাধ্যমের ফারাকটিও মনে রাখা দরকার। কিন্তু, অশীতিপর লালুপ্রসাদ সাউ, কয়েকদশক যাবত বাবু-বিবির টেনশনহীন স্মিতহাসির দুনিয়া থেকে নেমে এসে, কিছুটা আকস্মিকই, এতখানি ডার্ক হয়ে উঠলেন কেন?
সুলাজসের কাছে ছবি কোনও জানালা নয়, যা দিয়ে আমরা তাকাতে পারি বাইরের দিকে। তাঁর কাছে ছবি এক দেওয়াল, যা আমাদের ভিতরপানে তাকাতে উদ্বুদ্ধ করে। সরাসরি তাঁকেই উদ্ধৃত করি—
I always liked paintings to be walls rather than windows. When we see a painting on a wall, it’s a window, so I often put my paintings in the middle of the space to make a wall. A window looks outside, but a painting should do the opposite— it should look inside of us.
লালুপ্রসাদ সাউ-এর এই বিমূর্ত ছবিও একইভাবে গভীর ও, নিঃসন্দেহে, অন্তর্মুখী। এ ছবি, অনিবার্যভাবেই, আপনাকে বাধ্য করে অবচেতনের মধ্যে উত্তর খুঁজতে।
লালুপ্রসাদ সাউ তাঁর, গত বছরে প্রকাশিত, পূর্বোল্লেখিত সাক্ষাৎকারে বলেন (আবারও মনে করাই, বইটির প্রকাশক, দেবভাষা)—
অ্যাবস্ট্রাক্ট কাজের প্রতিও আমার টান রয়ে গেছে। ইচ্ছে আছে এখন কিছু অ্যাবস্ট্রাক্ট কাজ করার। আসলে এই জাতীয় কাজ করার মধ্যে যে স্বাধীনতা উপভোগ করা যায়, তা অন্য কিছুতে নেই। বাবু-বিবি বা যে-কোনও ফিগারেটিভ কাজের ক্ষেত্রে আগে থেকেই একটা আইডিয়া কাজ করে। কিন্তু আমার যে অ্যাবস্ট্রাক্ট কাজের ধরন তাতে কিছু একটার হঠাৎ করে ইম্প্রেশন নিলাম হয়তো লিথোগ্রাফে বা ক্যানভাসে, তারপর সেই জিনিসটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলাম। একসময় দেখলাম, আসল জিনিসটিরই আর দরকার নেই। তখন তাকে মুছে দিলাম। তবে এই জাতীয় কাজ করা খুব কঠিন। একেবারে অন্ধকার গলি। কতদূর এগোব?
টেম্পেরায় মিনিয়েচারের ধাঁচে যিনি এক ফেলে আসা সময়ের নস্ট্যালজিয়াকে এমন করে ছবিতে বাঁধতে পারেন, ঠিক তেমন দক্ষতার সঙ্গেই কি তিনি ছোট কাগজের উপরে গুয়াশে ধরতে পারলেন নিজের মনোজগৎকে, বিমূর্ততায়?
যে শিল্পী বলতে পারেন—
আমি মনে করি, আমার ছবিতে ফিলোজফিক্যাল ব্যাপার-ট্যাপার কিছু নেই। যা আছে, তা আমার চারপাশ, লোকাল মানুষজন, এরাই। যদি কোনও দর্শন খুঁজতে চান, সেটা হল বিউটি— সুন্দর। আসলে কি জানেন তো, জীবনে অনেক দুঃখ পেয়েছি, অনেক কষ্ট পেয়েছি। অনেকদিন কিছু না খেয়ে, সামান্য একটু ছাতু খেয়ে ক্লাস করে গেছি। এসব বলতে আমার কোনও লজ্জা নেই। কিন্তু জীবনের এই কাটাছেড়াকে আমি আর নতুন করে নিজের ছবির মধ্যে দিয়ে লোককে দেখাতে পছন্দ করি না। কেননা, এই দুঃখ-কষ্টের বাইরেও তো একটা জীবন আছে, সৌন্দর্য আছে, সেটা কেন দেখাব না? আমার ফিলোজফি সুন্দরের দিকে যাওয়া। নিজের জীবনেই যখন দেখতে পাচ্ছি এত যন্ত্রণা তখন সেই যন্ত্রণাটাই ছবিতে এঁকে— যিনি দেখছেন, তাকেও যন্ত্রণা দেব কেন?
সেই শিল্পীই আশি পার হয়ে কালোয় ভরিয়ে তুললেন নিজের ছবি। এমনকি, এই সিরিজে, রঙিন ছবিতেও কালো রঙের ব্যবহার প্রবল। কেন?
এইসব কোনও প্রশ্নেরই উত্তর আমি দেব না। বা, বলা ভালো, দিতে পারব না।
অনুরোধ, প্রদর্শনীটি দেখে আসুন।
দেশের চিত্রকলার রাজধানীটি দীর্ঘদিন হল সরে গিয়েছে দিল্লি এবং মুম্বাইয়ে। এই শহরে গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীর সংখ্যা এখন হাতে গোনা। আমার মনে হয়, এই প্রদর্শনী একটি ল্যান্ডমার্ক। এর বেশি কিছুই বলার নেই।
প্রথমেই তো জেনেছি, ছবি নিয়ে “Look at that!!” এর বেশি কিছু বলার থাকে না। থাকতে পারেও না।
কৃতজ্ঞতা — লালুপ্রসাদ সাউ-এর শিল্পকর্মের ছবিগুলি আকৃতি আর্ট গ্যালারির সূত্রে পেয়েছি। প্রথমটি, বাবু-বিবি সিরিজের, বিবি। বাকিগুলো, আলোচ্য প্রদর্শনী থেকে নেওয়া।