অভীক ভট্টাচার্য
ক্ষমতায় আসার পরে গত সাড়ে চার বছরে একের পর এক কেন্দ্রীয় সংস্থার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে সেগুলিকে সরকারের— বা আরও স্পষ্ট করে বললে শাসকদলের— আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার যে চিত্রনাট্য বিজেপি সরকার অনুসরণ করে চলেছে, তাতে সিবিআই-প্রধানের পদ থেকে অলোক বর্মার অপসারণ, পুনর্বহাল, পুনরপসারণ ও পদত্যাগের ঘটনাপরম্পরায় নাটকীয় উপাদান প্রচুর থাকলেও অপ্রত্যাশিত কিছু ছিল না। সাম্প্রতিক সিবিআই কুনাট্যরঙ্গ যাঁদের চোখে আদ্যন্ত অভিনব ও অভূতপূর্ব ঠেকেছে তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে, কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের পরপরই যোজনা কমিশনের বিলোপ ঘটিয়ে নীতি আয়োগের প্রবর্তন ও তার মাথায় বিজেপি-র তল্পিবাহক কিছু নীতিপ্রণেতাকে বসিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে যে উদ্যোগের ‘শুভসূচনা’ হয়েছিল, সেই পরিকল্পিত কর্মসূচি রূপায়ণের একেবারে সাম্প্রতিক উদাহরণ— সিবিআই-এর ঘটনাটি বাদ দিলে— রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর উর্জিত পটেলের পদত্যাগ। এই দুটি ঘটনার মধ্যবর্তী সময়ে একের পর এক স্বশাসিত কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা খর্ব করে, সেগুলির মাথায় ‘নিজেদের লোক’ বসিয়ে তাদের কাজকর্ম সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ও সেগুলিকে সরকারের স্বার্থবাহী করে তোলার নির্লজ্জ অপচেষ্টা দেশের মানুষ এতবার দেখেছেন যে, এতদিনে তা গা-সওয়া হয়ে যাওয়ার কথা; ফলে অলোক বর্মার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর প্রকাশ্য দ্বৈরথে যাঁরা চমকে উঠেছেন তাঁদের বিস্ময়বোধকে সত্যিই তারিফ করতে হয়, বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধা না-জানিয়েও পারা যায় না।
এমন অবশ্যই নয় যে, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নের মুখে পড়ল। বরং তার উলটোটাই সত্যি— কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন প্রায় সব রাজনৈতিক দলই বিরোধী নেতাদের চাপে রাখতে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মিথ্যে মামলার ভয় দেখিয়ে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সিবিআই-কে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করেছে। ‘খাঁচাবন্দি তোতাপাখি’-র শিরোপা যে সিবিআই-এর অকারণে জোটেনি, তার ভুরি-ভুরি উদাহরণ হাতের কাছেই মজুত। সেসব দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা এই প্রতিবেদনের পরিসরে বাহুল্য হবে, কিন্তু উল্লেখ থাকা দরকার যে, সিবিআই-জুজু দেখিয়ে বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাদের বাগে আনতে তাঁদের বিরুদ্ধে এ যাবৎ যত মামলা দেওয়া হয়েছে তার অধিকাংশই অকারণে (বস্তুত, সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কারণে) প্রলম্বিত হয়েছে, প্রয়োজন অনুসারে কখনও তা হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, আবার সময়মতো দেরাজ থেকে বের করে আনা হয়েছে, এবং সর্বোপরি তার অধিকাংশই আদালতে দাঁড়ায়নি— প্রচুর সময় পেয়েও মামলা দাঁড় করাতে না-পারার জন্য সিবিআই-এর তদন্তকারীদের অফিসারদের অসংখ্যবার আদালতে হাস্যাস্পদ, এমনকী ভর্ৎসিতও হতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষস্থানীয় অফিসারদের মধ্যে কাজিয়াও এবারই প্রথম নয়, এর আগেও বহুবার বহু ঘটনায় তা প্রকাশ্যে এসেছে। ফলে সাম্প্রতিক ঘটনাপরম্পরায় সিবিআইয়ের ভাবমূর্তি নতুন করে প্রশ্নের মুখে পড়েছে, এমনটা নয়। এতৎসত্ত্বেও, এবারের ঘটনাক্রম নিয়ে যে আলাদা করে আলোচনা হচ্ছে, সপ্তাহভর নাটকীয় পটপরিবর্তনই তার একমাত্র কারণ নয়। প্রশ্ন উঠছে, তার কারণ, প্রশ্ন ওঠার মতো অনেকগুলো বিষয় হাতের কাছে দস্তুরমতো মজুত।
এক-এক করে দেখা যাক। সপ্তাহের শুরুতে সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগইয়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের নির্দেশে যখন অলোক বর্মা সিবিআই প্রধানের পদে পুনর্বহাল হলেন, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেক সংবাদমাধ্যমই বলতে শুরু করেছিল, অলোক বর্মাকে তাঁর পদ ফিরিয়ে দিয়ে ঢেঁকি গিলতে বাধ্য হল কেন্দ্র। খানিকক্ষণের মধ্যেই কিন্তু স্পষ্ট হয়ে যায়, সুপ্রিম কোর্ট অলোক বর্মাকে অধিকর্তার পদ ফিরিয়ে দিতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে বটে, কিন্তু তা নিতান্তই শর্তসাপেক্ষ। রায়ের কপিটি একটু মন দিয়ে পড়লেই বোঝা যায়, বর্মার পদ কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ার পদ্ধতিগত ত্রুটিটুকুই কেবল মেরামত করে নেওয়ার কথা বলেছিল সুপ্রিম কোর্ট। বলা হয়, আপাতত বর্মাকে তাঁর পদ ফিরিয়ে দিতে হবে, এক সপ্তাহের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের নিয়োগকারী কমিটি বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে, এবং ততদিন পর্যন্ত কেবল রুটিন কাজ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া বস্তুত আর কিছুই করতে পারবেন না বর্মা। পারবেন না নতুন করে কোনও তদন্ত শুরু করতে, এমনকী কোনও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতেও। অর্থাৎ রীতিমত ডানা ছেঁটেই বর্মাকে তাঁর পদ ফিরিয়ে দিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালত। একে আদৌ পদ ফিরিয়ে দেওয়া বলা যায় কি না, সেটাই প্রশ্ন; কিন্তু দেশের অধিকাংশ মিডিয়া এই রায়কে মোদির বিরুদ্ধে বর্মার চূড়ান্ত জয় বলে ব্যাখ্যা করা শুরু করে দেয়। অথচ একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যেত, এখানেই নাটকের শেষ নয়, আসলে সবে শুরু। কারণ, কেন্দ্রীয় সরকারের অভিযোগ অনুযায়ী, বর্মা সত্যিই দুর্নীতিগ্রস্ত কি না সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট কোনও মন্তব্য করেনি, কেবল এটুকুই জানিয়েছিল যে, এ বিষয়ে আরও তদন্ত প্রয়োজন। অর্থাৎ, বলা যায়, সরকারের মধ্যরাতের অভিযানে পদ-খোয়ানো বর্মা কেবল তাঁর গদিটুকুই সাময়িকভাবে ফিরে পেয়েছিলেন; কিন্তু নাটক কোনওমতেই শেষ হয়নি।
শেষ যে হয়নি, তা আরও বোঝা গেল পরের দিনই প্রধানমন্ত্রীর দফতর নিয়োগকারী প্যানেলের জরুরি বৈঠক ডাকায়। সর্বোচ্চ আদালত এক সপ্তাহের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া সত্ত্বেও ২৪ ঘন্টার মধ্যে বৈঠক ডাকার এই ঘোষণা থেকেই সরকারের অভিপ্রায় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। বোঝা গিয়েছিল, সম্মুখসমরের রাস্তা থেকে সরে আসতে রাজি নয় সরকার। একই কথা বলা যায় বর্মার সম্পর্কেও— ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার পরের দিনই নিজের দফতরে এসে যেভাবে তিনি সরকার-নিয়োজিত অন্তর্বর্তীকালীন অধিকর্তা নাগেশ্বর রাওয়ের নিয়োগ-সহ তাঁর আমলের বেশ কয়েকজন অফিসারের বদলির নির্দেশ রদ করে দেন, তাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়— পালটা দেওয়ার পথ থেকে সরে আসছেন না তিনিও। নিয়োগকারী প্যানেলের প্রথম বৈঠকে কোনও সিদ্ধান্ত না-হওয়ায় পরের দিনই আবার বৈঠক ডাকা হয়। এবং সে বৈঠকেই ২-১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বর্মার পুনরপসারণের সিদ্ধান্তে শিলমোহর পড়ে। লোকসভার বিরোধী দলনেতা, কংগ্রেসের মল্লিকার্জুন খড়্গে বর্মার পক্ষে রায় দিলেও সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য বিচারপতি একে সিক্রির ভোট যায় বর্মার বিরুদ্ধে। সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন উঠে পড়ে, পরপর দু’দিন বৈঠক ডেকে ফের বর্মাকে সরিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে কি নিজেদের মরিয়া অবস্থানই কার্যত সামনে এনে ফেলল না কেন্দ্রীয় সরকার? মধ্যরাতে বর্মাকে নাটকীয়ভাবে সরিয়ে দেওয়া নিয়ে রাহুল গান্ধী-সহ বিরোধী শিবির এতদিন ধরে যে বলে আসছিল রাফালে-মামলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নথি বর্মার হাতে রয়েছে এবং তা নিয়ে যে কোনও দিন তিনি তদন্ত শুরু করতে পারেন এই আতঙ্ক থেকেই সরকার বর্মাকে সরিয়ে দিতে এতটা মরিয়া— সেই জল্পনাই কি এতে আরও জোরালো হল না?
দ্বিতীয়, এবং আরও গুরুতর প্রশ্ন, অলোক বর্মার অপসারণের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা জানিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট, দ্বিতীয় দফার অপসারণেও কি সেই পদ্ধতিগত ত্রুটিই রয়ে গেল না? কেন উঠছে এই প্রশ্ন? ভেবে দেখুন, অলোক বর্মার মূল অভিযোগটা ঠিক কী ছিল? মূল অভিযোগটা রাকেশ আস্থানার দুর্নীতির বিরুদ্ধে আনা হলেও, পরোক্ষে তা ছিল সিবিআইয়ের স্বাধীন তদন্তে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেই। তা-ই যদি হয়, তা হলে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য যে প্যানেলের বৈঠক বসে, নীতিগত ও পদ্ধতিগত কারণে সেই বৈঠক থেকে প্রধানমন্ত্রীর অবশ্যই উচিত ছিল নিজেকে দূরে রাখা। কিন্তু তা না-হওয়ায় ব্যাপারটা দাঁড়াল এরকম যে, অভিযুক্ত নিজেই বসলেন অভিযোগকারীর বিচার করতে এবং সে বিচারের ফলাফল যা দাঁড়ানোর, তা-ই দাঁড়াল। নিয়োগকারী প্যানেলের দু’দফার বৈঠকের পর মল্লিকার্জুন খড়্গের বিবৃতি থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেল, বর্মার অপসারণের ক্ষেত্রে অতি-সক্রিয়তা দেখিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর। কী বললেন মল্লিকার্জুন? একেবারে খোলাখুলি জানালেন, বর্মার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশনার-এর (সিভিসি) যে রিপোর্টকে হাতিয়ার করে বর্মা-বিদায়ের পথ পরিষ্কার করেছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর, সেই রিপোর্টে কার্যত এমন কিছুই মেলেনি যার ভিত্তিতে বর্মাকে পত্রপাঠ সরিয়ে দেওয়া যায়। মল্লিকার্জুনের এই বয়ানের ঠিক পাশেই যদি রাখা যায় দ্বিতীয় দফার অপসারণের পরে বর্মার বিবৃতি, কেন্দ্রের অস্বস্তি তাতে কমে না, বরং বাড়ে। বর্মা বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে যেভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাতে স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের মৌলিক শর্তই রক্ষিত হয়নি, এবং তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না-দেওয়ায় ব্যক্তির গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। লক্ষ্যণীয়, মল্লিকার্জুনের কথাতেও কিন্তু প্রায় একই সুর। বলা বাহুল্য, কালবিলম্ব না-করে রাহুল গান্ধী বর্মার মন্তব্য লুফে নিয়ে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। যাঁরা বলছেন স্রেফ চালে ভুল করে রাহুলের হাতে এ-হেন অস্ত্র তুলে দেওয়ার দায় নরেন্দ্র মোদি কোনওমতেই এড়াতে পারেন না, তাঁরাও পুরোটা ঠিক বলছেন না। এটা খুব পরিষ্কার ভাষায় জানানো দরদার যে, এটি কেবল ভুল রাজনৈতিক চালের বিষয় নয়, যদি সত্যিই সিবিআই-কে ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়, তা হলে নৈতিকতার প্রশ্নেই প্রধানমন্ত্রীর দফতরের উচিত তার দায় স্বীকার করা।
প্রশ্নের এখানেই শেষ নয়। কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশনার কোসারাজু ভিরাইয়া চৌধরির রিপোর্ট— যার ভিত্তিতে নিয়োগকারী প্যানেল বর্মাকে পদ থেকে সরিয়েছে— সেই রিপোর্টটি নিয়েও নতুন করে জলঘোলা শুরু হয়েছে, মূলত দুটো প্রশ্নকে ঘিরে। প্রথমটি ওই রিপোর্ট নিয়ে প্রাক্তন বিচারপতি একে পট্টনায়কের একটি পর্যবেক্ষণ, যেখানে তিনি দাবি করেছেন, দুর্নীতির বিষয়ে বর্মার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ মেলেনি, পুরো তদন্তটাই হয়েছে বর্মার বিরুদ্ধে রাকেশ আস্থানার অভিযোগের ভিত্তিতে। এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বিচারপতি পট্টনায়কের নজরদারিতেই সিভিসি-কে বর্মার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। অথচ বিচারপতি পট্টনায়ক সাফ জানিয়েছেন, সিভিসি-র রিপোর্টের দায় সিভিসি-রই, তাঁর নয়। নিজের রিপোর্টে খুব স্পষ্টভাবে সে কথা তিনি উল্লেখও করেছেন। বিচারপতি পট্টনায়কের এই বিবৃতি সামনে আসার পরেই বিতর্ক শুরু হয়েছে, যে রিপোর্টের সারবত্তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট নিজেই নিশ্চিত নয়, তা কী করে নিয়োগকারী প্যানেলের সিদ্ধান্তগ্রহণের ভিত্তি হতে পারে? এই নয়া বিতর্ক আরও উস্কে দিয়ে কংগ্রেস-সূত্রে খবর, রিপোর্ট নিয়ে প্রাক্তন বিচারপতির বিবৃতির প্রেক্ষিতে নতুন করে নিয়োগকারী প্যানেলের বৈঠক ডাকার দাবি তুলতে পারেন মল্লিকার্জুন। সে ক্ষেত্রে সিভিসি-র দেওয়া রিপোর্ট নিয়ে কাটাছেঁড়া শুরু হবে, এবং তাতে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের মুখ আরও একদফা পোড়ার সমূহ আশঙ্কা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু সিভিসি-র রিপোর্টে অসঙ্গতি প্রমাণিত হলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ পুড়বে কেন? তার কারণ, কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশনারের ভূমিকা আতস কাচের তলায় পড়লে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সঙ্গে তাঁর ‘পুরনো সম্পর্ক’ সামনে চলে আসবে, যা নরেন্দ্র মোদির পক্ষে বড়সড় অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ২০১৫ সালে মোদি সরকার যখন চৌধারিকে কমিশনার পদে নিয়োগ করে, তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে এমন একজনকে ওই পদে নিয়োগ কতটা যুক্তিযুক্ত। প্রশ্ন তুলেছিলেন আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ স্বয়ং। তাঁর দাবি ছিল, কেন্দ্রীয় প্রত্যক্ষ কর পর্ষদের (সিবিডিটি) প্রধান হিসেবে সহারা-বিড়লা ডায়েরি মামলায় ঘুষ নেওয়া ব্যক্তিদের তালিকা থেকে মোদির নাম বাদ দিয়েছিলেন এই চৌধারি। সেই বাবদে কৃতজ্ঞতাবশতই নাকি চৌধারিকে ওই পদ পাইয়ে দেওয়া হয়। পদপ্রাপ্তির মূল্য চোকাতেই তিনবছর পর প্রধানমন্ত্রীর ইঙ্গিতে চৌধারি তাঁর রিপোর্টে বর্মাকে দোষী সাব্যস্ত করলেন কি না, এ প্রশ্ন তাই উঠবেই। প্রশ্ন যে উঠবেই তার আরও বড় কারণ, সিবিআই-এ বর্মার ঘনিষ্ঠ অফিসারমহলের অভিযোগ, বর্মার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর মুখেই চৌধারি তাঁর বাড়ি বয়ে গিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজন রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নিলে বর্মার চিন্তার কিছু থাকবে না। অভিযোগ, বর্মা সেই প্রস্তাব পত্রপাঠ খারিজ করে দেন বলেই তাঁর বিরুদ্ধে বিরূপ রিপোর্ট পেশ করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের হাতে তুলে দেন চৌধারি।
এই প্রতিবেদন লেখার সময়ও খবর পাওয়া যাচ্ছে, বর্মার পুনরপসারণ বিতর্কটি এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী নন রাহুল গান্ধী। যেহেতু এ সত্য মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত যে, রাফাল চুক্তি নিয়ে বর্মার হাতে এমন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি এসেছিল যার তদন্ত শুরু হলে প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সমূহ চাপে পড়ার আশঙ্কা, ফলে বর্মা-বিতর্ককে হাতিয়ার করেই কংগ্রেস বিজেপি-কে আক্রমণের রাস্তা নিতে চাইবে। পুনরপসারণকে বেআইনি ও অগণতান্ত্রিক বলে দাবি করে বর্মা নিজেও যে আদালতে যেতে পারেন, সে সম্ভাবনার কথাও দিল্লির বাতাসে ঘুরছে। নিয়োগকারী প্যানেলের ভূমিকা খতিয়ে দেখার প্রশ্ন ওঠারও সম্ভাবনা রয়েছে বিলক্ষণ। সুপ্রিম কোর্টের প্রতিনিধি হিসেবে যেহেতু বিচারপতি সিক্রিকে নিয়োগকারী প্যানেলে মনোনীত করেছিলেন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগই স্বয়ং, তাই নিয়োগকারী প্যানেলের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা খতিয়ে দেখতে চাইতেও পারে সুপ্রিম কোর্ট। যা-ই ঘটুক, প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীর দফতরকে নানা অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। বলা বাহুল্য, দেশের স্বঘোষিত চৌকিদারের সম্মান তাতে বাড়বে না।
ভোটের মুখে খাঁচার তোতা যে এভাবে গলার কাঁটা হয়ে উঠবে, প্রধানমন্ত্রী ভেবেছিলেন?