রোমেল রহমান
…চান্দটা ছিল চোখের সামনে ঝুলে, কয়েকবার মনে হয় যেন; গুলতি দিয়ে ঠিকঠাক লাগাতে পারলেই একবারেই চান্দটা মাটিতে ফেলে দেয়া সম্ভব, আর তারপর চান্দটাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া; সবাই মিলে চান্দ ছুঁয়ে দেখা; ব্যাপারটা চমৎকার, তারপর সেই চান্দ সকলের দেখা হয়ে গেলে, ছোঁয়া হয়ে গেলে একসময় চুপিচুপি গাপ করে দেয়া, কদিন পর প্রিয়তমার হাতে তুলে দিতে দিতে ভেজা কণ্ঠে বলা, ‘এটাই একমাত্র দুর্লভ সম্পদ যা আমার আছে যেটা আমি তোমার হাতে তুলে দিলাম!’
আর ঠিক এইরকম একটা মুহূর্তে কানে এসে বুটের শব্দ লাগে একেরপর এক, ছড়ার বোলের মতো মনের মধ্যে বেজে ওঠে, ‘লেফট্ রাইট্ লেফট্…’, ভীষণ বিশ্রী একটা গন্ধ এসে ভরে ওঠে চিন্তার জগত, যেন এক দঙ্গল শিকারি নির্মম এসে তার চারপাশে ওৎ পেতেছে, যেকোনো মুহূর্তে তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে, আর ঠিক তখন ‘লেফট্ রাইট্ লেফট্…’ শব্দ তুলে দলটা এসে তার মুখোমুখি নাজেল হয়, তাদের সবার সামনে যিনি আঁটোসাঁটো জলপাই রঙের পোশাক পরা তিনি এক চমৎকার তরুণী তাকে দেখলে মনে হবে, তার আসলে এই মুহূর্তে প্রেমিকের সঙ্গে ডেট করে বেড়ানোর কথা কিন্তু উল্টো সে এক দঙ্গল শিকারির দলপ্রধান হয়ে এসে দাড়ায় তার সামনে, আচমকা তাদের এই অনুপ্রবেশে সে ভীত বা বিব্রত হয় না মোটেও, এটাই স্বাভাবিক এইসময়ে, ফলে সে জিজ্ঞেস করে না কিছুই শুধু জলপাই রঙের পোশাকি মেয়েটির চোখে চোখ রাখে, মেয়েটি তার দুর্দান্ত ঠোঁটে একটা মিষ্টি বা কামুক হাসির বদলে বারুদগন্ধি হাসি এনে বলে, ‘তোমাকে নিয়ে খেলতে এসেছি আমরা!!’ পাল্টা উত্তরে সে বলে, ‘সবাই না তুমি একা?’ তখন সৈনিকদের কারোর অস্ত্রে সামান্য নড়েচড়ে ওঠার শব্দ হয়, যা থেকে বোঝা যায় চর দখল হয়ে গেছে, ফলে খাকি পোশাক পরা মেয়টা বলে, ‘দেরি করে লাভ নেই! আপনাকে ঠিক দুই মিনিট সময় দেয় হল!’ সে আচমকা তার ত্যাড়া ঘাড় ঘুরিয়ে জলপাই রঙের পোশাক পরা লোকদের দিকে তাকিয়ে বলে; ‘আমাকে সময় দেয়ার তোমরা কারা?’ ফলে আচমকা এমন উত্তরে দল প্রধান মেয়েটা একটা সূক্ষ্ম ধাক্কা খায় আর অন্যদের কেউ কেউ মচমচ করে ওঠে বুটে কিংবা অস্ত্রে, ফলে তাকে বলা হয়; ‘আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে!’ উত্তরে সে বলে, ‘ যাবো কেন তুলে নিয়ে যাও, যেটা তোমরা ক’রে থাকো!’ ফলে তারা আবার প্রেশার খায় আর জলপাই রঙের মেয়েটার ঠোঁটের কোনায় একটু হাসির রেখা ফুটে ওঠে এবং মেয়েটা বলে, ‘আপনার যা ইচ্ছে বলে ফেলুন, যতো গালাগাল দেয়ার দিয়ে ফেলুন, সময় হাতে কম এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?’ উত্তরে সে বলে, ‘আমাকে যে আপনি বলে সম্বধন করছেন এটাই তো ভয়ানক ব্যাপারা, আর গালাগাল আপনাদের করে লাভ নেই, আপনারা তো বেতনভুক্ত রোবট; এর বেশি কিছু না!’ মেয়েটা হেসে ফেলে বলে, ‘ হতে পারে আমরাই সিস্টেম!’ উত্তরে সে বলে, ‘ উঁহু অতোটা বেশি ভেবে রোমাঞ্চিত হবেন না, আপনারা সিস্টেমের সামান্য লেজের পশম!!!’ মেয়েটা বলে, ‘কথা পেঁচিয়ে লাভ নেই’ সে বলে, ‘ এক কাজ করুণ টানাহেঁচড়া না করে আমাকে এখানেই মেরে ফেলুন’, সৈনিকদের কারো কারো অস্ত্রে আবার নড়াচড়ার শব্দ ওঠে, একজন ফিসফিস করে বলে ফেলে, ‘ম্যাডাম প্রস্তাবটা খারাপ না, তাছাড়া এই লোক ঝামেলার আছে শুধু কথা প্যাঁচায়, এইখানেই খায়া দেই!’ জলপাই পোশাকের মেয়েটা বলে, ‘ এমন একটা কিক্ দেবো তোমার বিচি খুলে পড়বে!’ ফলে অন্য সৈনিকেরা মজা পায়, জলপাই রঙের মেয়েটা বলে, ‘দেখছ না আমরা খেলছি!’
২
… তাকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে রাখা হয়েছে, গতকাল তাকে তুলে আনা হয়, তারপর তাকে এমন সাইজ করা হয়েছে বা খেলা হয়েছে যে, তার শরীরের চল্লিশ শতাংশ অবশ হয়ে আছে, হয়তো আগামী কয়েকদিনও সেগুলো সতেজ হতে পারবে না, ফলে সে অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা ক’রে যখন চিৎ হয় এবং দৃষ্টি স্থির করতে সক্ষম হয় তখন টের পায় একটা চোখের উপর রক্ত শুকিয়ে টানটান হয়ে আছে, চোখের পাতা খুলতে গিয়ে বোধহয় কয়েকটা পাপড়ি ছিঁড়ে লেগে থাকে, ফলে সে যখন আরেকটু সময় নিয়ে ধাতস্থ হয় তখন নজরে আসে একটা চেয়ারে সেই জলপাই রঙয়ের পোশাক পরা মেয়েটা বসে আছে, তাকে দুর্দান্ত লাগছে, পায়ের পর পা তুলে সে বসে আছে, আর একটু পেছেনে দাঁড়িয়ে আছে তার অধস্থন কোন অফিসার; দৃশ্যটা যথেষ্ট সুন্দর, মেয়েটা বিজয়ের গৌরব মুখে বলে, ‘ আছো কেমন?’ সে বলে, ‘ মানুষের শরীর মৃত্যুকে অপছন্দ করে তাই সর্বচ্চ চেষ্টা করে বেঁচে থাকার!’ মেয়েটা বলে, ‘ এমন বাটা দেয়ার পরও তুমি গুছিয়ে কথা বলছ!! ব্যাপারটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ! তোমাদের যারা ট্রেনিং দিয়েছেন তাদেরকে পেলে স্যালুট করা উচিৎ!!’ সে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলে, ‘ ট্রেনিঙয়ের বাইরে তোমরা কিছুই বোঝো না, কল্পনা শক্তিও তোমাদের মরে গেছে; মানুষের ট্রেনিঙটা কি জানো, যেকোনো মূল্যে স্বাধীনতা; বেরিগেট আর বন্দুক সেখানে তুচ্ছ!!’ মেয়েটা চোয়াল শক্ত করে বলে, ‘ তুমি সাধারণ কেউ না!’ সে হেসে ফেলে বলে, ‘ তুমি বোধহয় এর আগে মানুষ খুন করো নি, এটা বোধহয় তোমার প্রথম!’ মেয়েটা বিব্রত হয় কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে, ‘ তোমাকে তুলে এনে বিরাট বিপদ হয়েছে!’ সে বলে, ‘ গুম করে ফেলো, যেটা করতে তোমরা অভ্যস্ত! তাহলে কোন ঝামেলাই থাকবে না!’ জলপাই রঙের মেয়েটা শক্ত চোয়ালে বলে, ‘ সেটা করা হবে, কিন্তু তুমি যে এতোটা পপুলার এটা বুঝতে পারি নি!!’ সে বলে, ‘ তোমরা কিছুই বুঝতে পারো না, সিলেবাসের বাইরে তোমাদের বিশেষ কিচ্ছু নেই!!’ আচমকা এই প্রথম মেয়েটা এসে একটা কিক দেয় তার পেটে! সে হেসে ফেলে! মেয়েটা আবার একটা লাথি মারে তার মুখে, সে আবার হেসে ফেলে, মুখ দিয়ে এক দলা থুতু বের করে সে বলে, ‘ তোমার পায়ের বুটজোড়া কিন্তু আমাদের পয়সায় কেনা!’ মেয়েটা থুতু দেয় তার গালে! একজন সৈনিক এসে বলে, ‘ ম্যাডাম আপনি সরে যান আমি দেখছি!!’ জলপাই রঙয়েযর মেয়েটা ক্ষিপ্র নজরে সৈনিকের দিকে তাকায়, সৈনিক ভয়ে ব্যস্ত সরে যায়, জলপাই রঙয়ের মেয়েটা বলে, ‘ তোকে একবারে মেরে ফেলবো না, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারবো!’ সে বলে, ‘অতো সময় পাবে না, আমাকে নিয়ে ঝামেলা বাড়বে, হই চই হবে; তারচে আজ রাতে হাওয়া করে দাও!’ মেয়েটা বলে, ‘সব কথা বের করে তারপর মারা হবে!’ সে বলে, ‘ কি কথা বের করবে!’ মেয়েটা বলে, ‘ যে জন্য তোকে তুলে আনা হয়েছে!’ সে শ্লেষ্মা জড়ানো স্বরে হেসে ফেলে বলে, ‘ আমাকে কেন তুলে আনা হয়েছে!’ মেয়েটা থতমত খেয়ে যায়, কিছুক্ষণ দম মেরে থাকে, সে ফিসফিস স্বরে বলে, ‘ খুন হবার পর আমি আগুন হয়ে তোমাকে পোড়াবো!’
৩
… তাকে গুম করে দেয়া হয়েছে, কেউ কেউ বলছে তার লাশ গেড়ে ফেলা হয়েছে; কেউ কেউ বলছে তার লাশ, পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, কেউ কেউ বলছে; টুকরো টুকরো করে মাছদের খায়িয়ে দেয়া হয়েছে, কেউ কেউ বলছে; তার লাশ ইট বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে, ফলে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ঝড় হয়ে ওঠে সেই হত্যার পর; চারদিকে বিভিন্ন সংগঠন হই চই শুরু করে, আন্দোলনের সূচনা ঘটে, মিডিয়া সেই ফুটেজ বিক্রি করে, আর আমরা জানতে পাই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধ অভিযোগ আমরা কেউ জানি না, শুধু আমরা জানতে পাই সে নিহত হয়েছে জলপাই রঙের হাতে, ফলে আমরা শিখে ফেলি, যেকোনো মুহূর্তে অকারণে আমরাও এভাবে মারা যেতে পারি; ফলে সেদিন বিকেলে, সেই জলপাই রঙয়ের মেয়েটি তার ঊর্ধ্বতন জলপাই রঙয়ের কাছে জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার তাকে আমরা কেন হত্যা করলাম?’ উত্তরে ঊর্ধ্বতন জলপাই রঙ বলে, ‘ সব সময় হত্যার জন্য কারনের দরকার নেই আমাদের!’ মেয়েটা বলল, ‘ তার বিরুদ্ধে কোন সাধারণ অভিযোগও নেই থানায়’ ঊর্ধ্বতন জলপাই রঙ বলে, ‘ তুমি বোধহয় বেশিই মাথা ঘামাচ্ছ, এটা নিয়ে ঘাটাঘাটির কিচ্ছু নেই, দুদিন গেলে সব আন্দোলন থেমে যাবে, আমরা আগেও এমন ঘটনা ঘটিয়েছি, আগামিতেও ঘটাবো, এক্ষেত্রে পনেরো দিন থেকে একমাসের বেশি হই চই দাড়ায় না, তুমি ভয় পেও না, বরং দুদিনের ছুটি কাটিয়ে আসো, তোমার জন্য প্র্যাকটিসটা নতুন!’ জলপাই রঙের পোশাক পরা মেয়েটা বলে, ‘ শেষ প্রশ্ন স্যার; হত্যাটা কি দরকার ছিল?’ ঊর্ধ্বতন জলপাই রঙয়ের পোশাক পরা লোকটা শক্ত চোয়ালে বলে, ‘ কি দরকার আর কি দরকার না সেটার নির্ধারক তুমি কিংবা আমি নই, আমাদের উপরেও অনেকে বসে আছে, তুমি শুধু তোমার এসাইমেন্টটা শেষ করেছ; যাও আর কোন কথা না এনাফ!’ জলপাই রঙের মেয়েটা বেরিয়ে আসে, সেদিন রাত্রে স্নান করার সময় জলপাই রঙয়ের পোশাক পরা মেয়েটা স্থির নগ্ন দাঁড়িয়ে থাকে শাওয়ারের নিচে, জল পড়ে… জল পড়ে… অবিরাম জল পড়ে তার মাথার উপরে আর বন্ধ চোখের মধ্যে জেগে থাকে তার নিহত হবার আগের মুহূর্তের মুখটা আর শ্রুতিতে বাজে ঊর্ধ্বতন জলপাই রঙদের কয়েকটা বিক্ষিপ্ত সংলাপ, ‘… সকল বিষয় জানা আমাদের অধিকার নেই, … মানুষকে ব্যস্ত রাখার জন্যও হত্যা ঘটাতে হয়, … হত্যার মধ্যে দিয়ে আমরা জানান দিলাম আমরা আছি, … অন্য বাহিনীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমাদেরও তো একটু এগিয়ে থাকা দরকার কি বল, … একজনকে খুন করে হাজারজনকে ভয় দিয়ে দেয়া তারা যেন সঙ্ঘবদ্ধ না হয়, … আমরা তাদের টাকাতেই খেয়ে বাঁচি আবার তাদেরকেই হত্যা করি কিচ্ছু করার নেই, সিস্টেম…; পুরো জিনিসটাই একটা মাদারচোদ সিস্টেম!’ স্নান শেষে আয়নার সামনে যখন দাড়ায় জলপাই রঙয়ের পোশাক পরা মেয়েটা, বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে তার আয়নাতে রক্ত রঙয়ের লিপিস্টিক দিয়ে লেখা হত্যার পূর্বে তার কণ্ঠ থেকে বের হওয়া শেষ বাক্য –
‘ আমার হারিয়ে যাওয়াটাই ভয়ানকভাবে আমাকে ফিরিয়ে আনবে!!’
১ মে ২০১৭
romelabc@gmail.com
Are you looking for expert writing services? We’ve got you covered! Our skilled team can handle a wide range of assignments, from essays and case studies to editing and formatting. Need a compelling book review or a captivating creative writing piece? We’re here for you. Whether it’s a research paper, coursework, or a critical analysis, we deliver good quality. Your personal statement, presentation, or problem-solving task is in good hands.
b.link/ThesisGuru