শতাব্দী দাশ
মাম্মাম,
যখন এই চিঠি লিখছি তখন তুমি ছয় বছরের। আমরা একসঙ্গে বেড়েছি এই ছয়টা বছর, জানো? যখন এই চিঠি পাচ্ছ, তখন হয়ত তুমি চোদ্দ-পনের। তখন তুমি আরও দামাল কি? নাকি শান্ত হয়েছ খানিক? তোমার জিভের ডগায় অসংখ্য প্রশ্ন বুজকুড়ি কাটছে কি আজকের মতো? নাকি উত্তর হাতড়াচ্ছ নিজের মতো করে? জানি না তখনও মায়ের সঙ্গে বকবক করা জীবনের মোক্ষ কিনা। আমার কিন্তু অনেক কথা বলার থাকবে তখনও।
ছয় বছরের ‘আমি’ তোমার মতো বাঁধনছেঁড়া ছিলাম না, জানো? ছিলাম শান্ত এবং বাধ্য৷ আসলে ছয় বছরের ‘আমি’’ যে কী হতে পারতাম, নিজেও জানি না। মেয়েলি হওয়ার ডিসিপ্লিনিং শুরু হয়েছিল শুরু থেকেই৷ তোমাকে যে বেঁধে ফেলতে চাইনি, ছাঁচে ফেলতে চাইনি, তার কারণ, তুমি যেমনটা, তেমনটাই চোখ ভরে দেখতে চেয়েছিলাম। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল অবশ্য। অভিভাবক হিসেবে নিজেকে সন্দেহ করতাম, বুঝলে? প্যারেন্টিং-মডেল ছিল না যে অনুকরণ করব। বেঁধে ফেলতে চাইনি, আবার উচ্ছন্নে পাঠাতেও তো চাইনি। দায়িত্ববোধ আর স্বাধীনতার সঠিক ব্যালেন্স শেখাতে পারলাম কি? আশঙ্কায় থাকতাম। তোমাকে শেখাতে গিয়েই আসলে সেই ব্যালেন্স নিজে শিখেছি একটু একটু করে, পালন করেছি। ওই যে বললাম, আক্ষরিক অর্থেই একসঙ্গে বেড়ে উঠছিলাম আমরা!
এই চিঠি তোমায় মনে করিয়ে দিক, ছয় বছর বয়সে তুমি স্কুলগাড়িতে ঝগড়া করেছিলে। কারণ কেউ তোমাকে চেঁচাতে বারণ করার কালে বলেছিল, ‘মেয়েদের অত চিৎকার করতে নেই!’ এই চিঠি নোট রাখুক, সেবার মুদি-দোকানের ক্যালেন্ডার ছিঁড়ে ফেলেছিলে, ছবিতে লক্ষ্মীদেবী নারায়ণের পদসেবা করছিলেন বলে। এই চিঠি মনে রাখুক, কোনও ছেলে-বন্ধুকে ম্যাম বলেছিলেন, ‘মেয়েদের মতো কেঁদো না’ আর তোমার ভারি মন খারাপ হয়েছিল৷ না, তথাকথিত বিপ্লবী-ছাঁচে ফেলতে চাইনি তোমাকে৷ তুমি পুতুল খেলতে ভালোবাসতে, রান্নাবাটিও। কিন্তু এ’সব ঘটনা ঘটেছিল। হয়ত আমাদের কথোপকথনের যেটুকু রেশ চারিয়ে গেছিল, তার ফল। আরও একটা ঘটনা ঘটছিল। তুমি নিজেকে ‘নারী’ হিসেবে চিনতে শুরু করছিলে৷
হাসি পেল বাক্যটি লিখে। পুরুষমানুষের লেখাজোকা যত, পুরুষালি যত সাহিত্য, সে বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্র হোক বা মিলস এন্ড বুনসের রেডিমেড রোম্যান্স, সেখানে পড়বে, পুরুষের মুগ্ধ দৃষ্টির আবেশে বালিকা নাকি নারী হয়ে ওঠে।
অথচ দেখলাম… নিজের ছোটবেলায় তো নিজেকেই ‘দেখার’ চোখ থাকে না… তাই তোমাকে দেখলাম— তুমি নিজেকে নারী হিসেবে চিনতে শিখলে সেই পাঁচ-ছয় থেকেই৷ সে চেনার পিছনে আবেশ-টাবেশ কিছু ছিল না। তুমি জানলে, তোমাকে হীনতর ভাবা হয়, তুমি নাকি দুর্বল, ছিঁচকাঁদুনে৷ তোমার পরিবেশ, তোমার স্কুল, তোমার খেলাধূলার প্রান্তর— একটু একটু করে সেই বার্তা দিল। এই বৈষম্য থেকে আমি তোমায় কীভাবে বাঁচাতাম? বাড়ির চারপাশে বিশ ফুট দেওয়াল তুলে? সে তো ভারি বিদঘুটে হত। তাই চাইলাম, বৈষম্য চেনার মন, মগজ ও চোখটুকু তৈরি হোক৷ নারী হিসেবে বাঁচার খানতিনেক উপায় ছিল তোমার সামনে। আমার সামনে, আমাদের সবার সামনেই যেমন থাকে। এক, সমাজ যেমনটা চাইছে, তেমনটাই হয়ে ওঠা৷ জেন্ডার-রোল বা লিঙ্গ-ভূমিকা মেনে চলা। দুই, নির্দিষ্ট ঘেরাটোপে ঢুকে যাওয়া এবং সমমনস্ক কিছু হাতে-গোনা মানুষের সাথে সখ্য বজায় রেখে, জীবনটা বাকি পৃথিবীর প্রতি বিদ্রুপে কাটিয়ে দেওয়া৷ আর তিন, অচলায়তন ভেঙে ফেলা। তৃতীয় পথটিই প্রকৃত পথ, জানবে৷ তুমি নিজের প্রতি দায়বদ্ধ। কিন্তু দায়বদ্ধ সমলিঙ্গের প্রতিটি মানুষের প্রতিও। এমন কি বিষম-লিঙ্গের মানুষের প্রতিও তোমার দায় বর্তায়৷
এইভাবে বৈষম্যের পৃথিবীতে বড় হতে হতে একসময় দেখবে, সোমক বা সান্নিধ্যর পৃথিবীটা তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে গেছে। দেখবে তাদের নিজস্ব এক জগৎ, নিজস্ব কথাবার্তা হয়েছে। ‘গাই-টক’। শোনো… এ’সব অনেক দিন আগের কথা… নয় কিংবা দশের ক্লাসে টিউশনের পর আমরা মেয়েরা গল্পগাছা করতে করতে বাড়ি ফিরতাম৷ ছেলেদের বাড়ি ফেরার অত তাড়া ছিল না, তারা পুকুরপাড়ে আড্ডা দিত কিছুক্ষণ। আমাদের চুল-ছাঁটা, হাট্টাকাট্টা চেহারার কেয়া ছিল ফুটবল-প্লেয়ার। তার দুদিকেই যাতায়াত ছিল৷ সে একবার খবর দিল, ‘তোদের নিয়ে খারাপ খারাপ আলোচনা হয়।’ কেয়াকে ওরা ‘মেয়ে’ জ্ঞান করত না৷ মেয়ে হওয়ার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা, নির্দিষ্ট মাপঝোক ছিল কিনা! তাই তার সামনেই ওরা সে’সব বলে ফেলতে পেরেছিল। ‘বন্ধু’ শব্দটার গায়ে ফাটল ধরেছিল, জানো? আবেশ ছিল না৷ আঘাতই ছিল৷ নিশ্চিত৷
আমাদের ছেলেরা যা করছিল, পুকুরপাড়ে, তাকে সাম্প্রতিক ক’বছরে আমরা ‘লকার-রুম টক’ বলে ডাকি, যে ভাষায় লকার রুমে খেলোয়াড়রা নিজেদের মধ্যে কথা-টথা বলে। স্পোর্টস, বুঝলে, দুই রকম হয়। যেমন, ক্রিকেট এবং মহিলা-ক্রিকেট। ফুটবল এবং মহিলা-ফুটবল। হকি এবং মহিলা হকি। মেয়েদের টেনিস-কোর্টে ক্ষিপ্র বাঘিনীদের নিম্নবাসের দৈর্ঘ্য বাঁধা থাকে। যতটা দীর্ঘ হলে পুরুষের চোখে তাঁদের আবেদনময় লাগে, ততটাই হয় জামার ঝুল। মোদ্দা কথা, খেলাধূলা বিষয়টাই মূলত পুরুষালি। মহিলা-খেলাধূলা উপগ্রহের মতো সেই সাম্রাজ্যের চারপাশে ঘোরাফেরা করে। সুতরাং চলতি ভাষায় ‘লকার-রুম’ পুরুষের একান্ত চারণভূমিরই দ্যোতক। খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে লকার-রুম যা, চোদ্দ-পনেরর মফস্বলী ছেলের ক্ষেত্রে পুকুর-পাড়ও তা। শহরের যুবকের কাছে রোয়াকও তা। আঁতেলের কাছে কফি হাউজও তা৷ অথবা ধরো কোনও বয়েজ হস্টেল, মেস। যেকোনও ছেলেলি জমায়েত।
এমন কী বলা-কওয়া হয় সেখানে, যা তোমার সামনে বলা যায় না? আসলে সেখানে তুমি তোমার সযত্নলালিত সব বৈশিষ্ট্য হারাও, যে বৈশিষ্ট্যগুলো চোখ ভরে দেখবে বলেই তোমার মাম্মাম তোমায় বাঁধেনি। তুমি প্রাণের আনন্দে গান গেয়ে ওঠো কিনা, কবিতা লেখো নাকি গল্প, ফুটবল ভালোবাসো নাকি ক্রিকেট, সেসব নিরর্থক হয়ে পড়ে। তোমাকে বুক-কোমর-পাছা-কটাক্ষ-চুলের দৈর্ঘ্য-লাস্যতে মাপা হয়। সমবেতভাবে৷ নিশ্চিত জেনো, তাতে তোমার অপমান হয়। ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের দিব্যি, ভালোবাসলে মানুষকে খেলো করা যায় না। জেনো, এর চেয়ে উন্নততর ভালোবাসার যোগ্য তুমি।
‘লকার-রুম টক’-এর কথা এল কেন, বলি। আজ তো দুহাজার উনিশের জানুয়ারি। এ বছরের শুরু থেকেই একটার পর একটা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রকৃতপক্ষে, ঘটনা রোজই ঘটে। সম্প্রতি কিছু ঘটনা প্রচারের আলো পেয়েছে। আর ঘটনায় জড়িত মানুষদের মনের অন্ধকার বড় বিচ্ছিরি প্রকট হয়েছে। একটা নন-ক্রিকেট টিভি শোয়ে আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দলের অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ড্য ‘লকার-রুম’-এর সীমানা ভুলে গেছিলেন৷ সারা দেশ তাই জেনে ফেলেছে, মহিলাদের তিনি কী চোখে দেখেন। যেমন, তিনি বললেন, কোনও পার্টিতে তাঁর বাবামা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘তেরা-ওয়ালা কৌনসা হ্যায়?’ উত্তরে তিনি বলেছেন, পার্টিতে উপস্থিত মেয়েদের সকলের সঙ্গেই তাঁর কিছু না কিছু যৌনক্রীড়ার অভিজ্ঞতা আছে৷ তাঁর সঙ্গে ছিলেন সতীর্থ কেএল রাহুল। প্রশ্ন করা হল, কোনও মহিলাকে যদি তাঁদের উভয়ের পছন্দ হয়, কী করবেন? রাহুল তাও বলার চেষ্টা করলেন একবার, তখন মেয়েটির মর্জি, মেয়েটির ইচ্ছা। হার্দিক আবারও বললেন, উঁহু, অন্যের হাত থেকে মেয়ে ছিনিয়ে নেওয়া একটা ট্যালেন্ট, সে প্রতিভা তাঁর আছে।
শো-টি আমি দেখিনি, মাম্মাম। শুনেছি, সেখানে নামী চলচ্চিত্রাভিনেতারা আসেন। আসেন আরও নানা ক্ষেত্রের মান্যগণ্যরা। তাঁরা অনেকেই আগেও এ’ভাষায় কথা বলেছেন নাকি, হয়ত আরেকটু শালীনতার চাদর জড়িয়ে। হার্দিকের বক্তব্য ছিল এতই সপাট ও রাখঢাকহীন, যে কানে বেজেছে এইবেলা৷ তারপর তো সে অনেক ডামাডোল! বিসিসিআই সাসাপেন্ড করল তাদের, কমিটি, তদন্ত, সুপ্রিম কোর্ট… ভালো লাগল। কিন্তু সমস্যা তো হার্দিককে নিয়ে নয়। সমস্যা নারীকে যৌনবস্তু ভাবার সংস্কৃতিতে৷ যখন এ চিঠি পড়ছ, তখনও মেয়েদের ‘চিজ’ বা ‘মাল’ বলে গান বাঁধা হয়? শুনতে পাও?
হার্দিক বললেন, তিনি নাকি তাঁর বাবামার সঙ্গে খোলাখুলি সঙ্গম নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর বাবামা তাঁর প্রথমবারের সঙ্গমের পর নাকি বলেছিলেন, ‘প্রাউড অফ ইউ’। খোলাখুলি তো আমিও কথা বলতে চাই, মাম্মাম, তোমার সঙ্গে। তবে চাই, তোমার যৌনতার সঙ্গীকে তুমি যেন সম্মানও করো। যৌনতা সন্তানধারণের আবশ্যিক ধাপ হয়ে নয়, আনন্দ হয়েই আসুক তোমার জীবনে, নির্দিষ্ট বয়সের পর। কিন্তু মাথায় রেখো— তোমারও আনন্দ, তোমারও আরাম, তোমারও প্রাণ-জুড়োনো যেন থাকে। যে তোমাকে যৌনবস্তু মাত্র মনে করে— কারণ তুমি মেয়ে— তোমার আদরের যোগ্য নয়, আনন্দের সঙ্গী নয়৷
হার্দিকদের ঘৃণা কোরো না তা বলে। তাদের পুরুষ হয়ে ওঠার শিক্ষাটি ভুল৷ দেখলে না, টক্সিক ম্যাস্কুল্যানিটি না শিখলে তারা কেমন তাদের নিজেদের বাবামা-র কাছেও যথেষ্ট ‘পুরুষ’ নয়? পারলে চ্যালেঞ্জ কোরো ‘পুরুষ’ হওয়ার এই পদ্ধতিকে। জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করতে গেলে সুসভ্য আচরণ করতে হয়, বলছেন অনেকে। তাই কি? হার্দিক টক-শো-কে ‘লকার রুম’ ভাবার ভুল করেছিলেন৷ আবার এক উন্নততর, ধনী দেশের দেশাধিনায়ক সারা পৃথিবীকেই তার ‘লকার-রুম’ ভাবেন। তাঁর নাম ডনাল্ড ট্রাম্প। জানবে তাঁকে বড় হলে। চ্যালেঞ্জ করতে হলে চ্যালেঞ্জ কোরো এদের পৌরুষের ধারণাকে, যে ধারণার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল নারীর সার্বিক যৌনায়ন।
*******
পিতৃতন্ত্রের নিদান হল, ছেলেরা গর্ব করবে বহুগামিতা নিয়ে। আর মেয়েদের সম্পদ হবে সতীত্ব। এই প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক আরও একটি ঘটনা লিখে রাখি। অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক, শ্রী কনক সরকারের কথা। তিনি লকার-রুমের সঙ্গে বহির্বিশ্বকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন বলা যায় না। বরং তিনি নারীবিদ্বেষী প্রোপাগ্যান্ডা ছড়ানোকেই সুমহান কর্তব্য ভেবেছেন। ফেসবুকের দেওয়ালে ‘ইয়ং বয়েজ’ বা ‘ইয়ং মেন’-দের সম্বোধন করে তিনি নানা বার্তা নিয়মিত দিতেন। ছাত্রীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের জন্যও তিনি সুবিদিত। সম্প্রতি তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় বললেন, কুমারী নারী ‘সিল্ড বটল’ বা ‘সিল্ড প্যাকেটের’ মতো। কেউ তবে কেন খামোখা ফাটা প্যাকেট বা খোলা বোতল কিনতে যাবে?
প্রসঙ্গক্রমে বলি, ‘লকার-রুম’-এর অন্তরালে কুমারী মেয়ের সঙ্গে সঙ্গমকে ‘সিল ফাটানো’ নামে ডাকা হয়। বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের গাছে চড়তে, সাঁতার কাটতে বা সাইকেল চালাতে বারণ করা হয়, কারণ ‘হাইমেন’ বা তথাকথিত ‘সতীচ্ছদ’ শুধু প্রথম শারীরিক মিলনে নয়, এসব শারীরিক কসরতেও ফেটে যেতে পারে। শুনেছি উনিশ বা বিশের শতকে দম্পতির ফুলশয্যার পরদিন মা-মাসিরা বিছানায় রক্ত খুঁজতেন। একবিংশ শতকে, বাল্যবিবাহ রদ হওয়ার অনেক বছর পরে, কুড়ি বা ত্রিশের কোঠায় বিয়ে করেও বিমর্ষ পুরুষ মনোবিদের কাছে যায়, কারণ স্ত্রীর রক্তদর্শন না করতে পেরে সে হতাশ ও হতচকিত। পূর্ণবয়স্ক নারীর বিবাহ-পূর্ব যৌন অভিজ্ঞতাকে বড় সহজে মেনে নেওয়া যায় না আজও। বস্তুত, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর, নারী যৌন অভিজ্ঞতা চায় নাকি চায় না, তা স্থির করার হক শুধুমাত্র সেই নারীরই আছে, সমাজের নয়৷
এই অধ্যাপকও ক্ষোভের মুখে পড়েছেন৷ দেশের মহিলা কমিশন অভিযোগ এনেছে তাঁর বিরুদ্ধে। চূড়ান্ত ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত তিনি কাজে যোগ দিতে পারবেন না। শিক্ষক নিজের ছাত্রের মনন ও চিন্তন গঠনে বিশেষ ভূমিকা নেন। এই সামাজিক ও পেশাগত অবস্থানের জন্যই তিনি ছিলেন বেশি ক্ষতিকর। কিন্তু আবারও, তিনি উদ্ভট, কিন্তু একমাত্র নন। কুমারীত্বকে নারীর সম্পদ ভাবার ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতিতেই আছে যে! যত সহজে মহিলা কমিশন অধ্যাপকের প্রতি খড়্গহস্ত হতে পারে, তত সহজে কুমারীপূজা তুলে দিতে পারে কি?
এই যে কুমারীত্বে মহত্ব আরোপ করা, এর ঠিক উলটো পিঠেই থাকে নারীকে খাটো করতে, হেয় করতে, শাস্তি দিতে যৌন-অপমান ছুঁড়ে দেওয়া৷ যেকোনও সীমারেখা লঙ্ঘন করে যদি কখনও জনরোষে পড়ো, দেখবে প্রথমেই তোমার যৌনাঙ্গ আলোচিত হতে পারে। বাচিকভাবেও তো ধর্ষণ করা যায়! ঘাবড়িও না৷ অপমানে আমার কাছে কেঁদো। কিন্তু জেনো, ওরা তোমাকে তীব্রভাবে অপমানের আর কোনও উপায় জানে না। জেনো, ওদের ভাষা ওদেরই সংজ্ঞায়িত করে। তোমাকে নয়। পুরুষ এমনকি সহপুরুষকেও অপমান করার জন্য এমন কোনও খিস্তি আবিষ্কার করতে চায়নি, যেখানে পক্ষান্তরে নারী-ঘৃণা না ঝরে পড়ে। একে আমরা ‘ধর্ষণ-সংস্কৃতি’ বলে ডাকি। এই সংস্কৃতিতে প্রকৃত ধর্ষণকে উজ্জ্বল রাংতায় মুড়ে ‘প্রেম’ বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়৷ আর ধর্ষণের ভাষা ব্যবহৃত হয় যথেচ্ছ। আজ তোমায় বলি, এই যে ছটি বছর আমরা গায়ে-গা ঠেকিয়ে বাঁচলাম, এই যে তোমার দেড় বছর বয়সে প্রথম সমুদ্রে গেছিলাম আমরা, আড়াই-এ মাম্মাম পাহাড়ে নিয়ে গেছিল— তুমি রাতে ঘুমিয়ে পড়লে আমার ঘুম আসত না সেসব বিভুঁই-এ। কারণ পরিসংখ্যান জানত, আমরা নিরাপদ নই। আমরা ধর্ষণ-সংস্কৃতিতে বাস করি নিত্যদিন।
তোমার যৌনতা একান্তভাবেই তোমার স্বাধীন যাপনের অংশ৷ ভার্জিনিটির ধারণাকে উড়িয়ে দিলাম বলে ভেবো না, প্রাপ্তবয়স পেরোনোর পর, কুমারীত্ব হারানোকে একটা রাজনৈতিক কর্তব্য হিসেবে পালন করতে বলছি। এ তোমার ব্যক্তিগত প্রান্তর। শরীর ও মন যার দিকে ধাবিত হবে, তারও যদি সম্মতি থাকে, তা সে পুরুষ হোক বা নারী, সমতলে দাঁড়িয়ে পরস্পরের হাত ধোরো৷ শুধু সে যেন তোমার শরীরের মালিক না হয়৷ তুমি যেন তার শরীরের মালিক না হও। শরীরের হাঁচোড়পাঁচড়ে কিছু সংবেদনাও যেন মিশে থাকে৷ কারও পছন্দের ছাঁচে নিজেকে গোড়ো না। তোমার দায় নেই ‘পছন্দসই’ হওয়ার। বরং সৎ হোয়ো, সমব্যথী হোয়ো তোমার সঙ্গীর প্রতি।
আমরা নাহয় আফ্রা বেন পড়ব একসাথে, কোনও সন্ধ্যার ছায়ায়৷ ‘দ্য উইলিং মিস্ট্রেস’। ‘ডিস্যাপয়েন্টমেন্ট’। দেবারতি মিত্রর ‘যুবকের স্নান’ পড়ে নাহয় তুমি নিজের কামনাকে চিনো। কামনায় গর্হিত কিছু নেই, কিন্তু অযাচিত ও অশালীন হতে পারে তার প্রকাশ। ধীরে ধীরে বুঝবে এসব। কোহেনের গান শুনব আমরা৷ যেখানে কারও ‘পার্ফেক্ট বডি’-কে ছুঁয়ে যায় কারও ‘পার্ফেক্ট সোল’!
********
যাইহোক, যা বলছিলাম তা হল— আমাদের লক্ষ্য স্থান-কাল-পাত্র বিচার করে হার্দিক বা কনকদের সংযমী হতে বলা নয়। একজন জাতীয় ক্রিকেটার, একজন অধ্যাপক এসব প্রকাশ্যে বলতে পারেন না— এইটা কোনও স্লোগান হল না! আমাদের লক্ষ্য, এদের ‘লকার-রুমে’ ঢুকে পড়া। পারলে তার চেয়েও ব্যক্তিগত সব জায়গায় ঢুকে পড়া। মনে, মগজে। সর্বত্রই যেন তারা অন্য লিঙ্গের মানুষের উপস্থিতি টের পায়। যেন মাথার মধ্যে অন্য লিঙ্গের মানুষও জানান দেয়, মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে বলে, ‘আছি’। যেন ‘পুরুষালি স্পেস’ বলে কিছু না থাকে। যেন ‘পুরুষালি’-র মধ্যে যা কিছু বিষাক্ত, হিংস্র— তা নিপাত যায়। বদলে ফেলা সহজ নয়, বদলে ফেলার লড়াই দীর্ঘমেয়াদী৷ লড়াই-এ যে কোনও ভূমিকায় থেকো। কিন্তু লড়াই-এই থেকো, মাঠে থেকো।
ভাষা ও চিন্তনের লিঙ্গায়ন প্রসঙ্গে আজ আরও লিপিবদ্ধ থাক, আমাদের দেশের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের রাহুল গান্ধি সেদিন এমন সব ভাষা অবলীলায় প্রয়োগ করেছেন, যা নারীর পক্ষে অবমাননাকর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে রাফাল অভিযোগের মোকাবিলা করতে হত পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে। তা না করে তিনি দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকলেন। ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রীর পৌত্র রাহুল, বিপক্ষদলের মুখ, তাই বললেন, ‘ছাপান্ন ইঞ্চি চওড়া বুকের প্রধানমন্ত্রী এক মহিলার পিছনে লুকিয়ে পড়েছেন।’ তুমি শুনলে অবাক হবে, প্রধানমন্ত্রীর তথাকথিত ‘ছাপান্ন ইঞ্চির বুক’ তাঁর ও তাঁর দলের রাজনৈতিক প্রচারের অংশ। এতদিনে এক প্রকৃত হিন্দু পুরুষের হাতে ভারতমাতার ভার ন্যস্ত হয়েছে— এই হল প্রধানমন্ত্রীর দল বিজেপি-র বার্তা৷ আবার দেখো, তাঁর বিপক্ষও একই রকম লিঙ্গায়িত ভাষায় তাঁর বিরোধিতা করলেন। মহিলাটি এখানে প্রতিরক্ষামন্ত্রী, নির্মলা সীতারমন। একজন মন্ত্রী তার মন্ত্রিত্বের মর্যাদা খুইয়ে ‘সামান্য নারী’-তে পরিণত হন কত সহজে! মোটের উপর ২০১৯ সালে এই হল ভারতীয় রাজনীতির ভাষা।
তারপর যা হল, তা বিকৃত রাজনৈতিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি। রাহুল একবগ্গা থাকলেন৷ আবারও বললেন, নারীকে তিনি সম্মান করেন ঠিকই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যদি ‘প্রকৃত পুরুষ’ হন, তবে তিনি রাফাল প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না কেন? ‘ছাপান্ন ইঞ্চি’ তাঁকে জাতীয় মহিলা কমিশনের মাধ্যমে নোটিস পাঠালেন। এই লোকগুলিকে চিনে রেখো। এদের কোনও পক্ষই তোমার মতবাদকে ভালোবাসে না, জেনো। তোমার বিশ্বাস ও আদর্শকে শিখণ্ডী খাড়া করে যারা রাজনৈতিক বা বাজারনৈতিক ফায়দার তোলে, তাদের থেকে দূরে থেকো। তোমরা এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যেও নারীবাদী প্রতীতীকে, যেন সংসদীয় রাজনীতি তাকে ‘ব্যবহার’ না করতে পারে, বরং যেন সংসদীয় রাজনীতিই ভোটের স্বার্থে নারী ও নারীবাদীর আস্থা অর্জনে সচেষ্ট হয়। তোমাদের সমবেত সৎ চিৎকার মুহুর্মুহু দেশের আনাচে কানাচে শুনতে পাওয়া জরুরি সে কারণে।
অনেকেই বলবেন, ভাষাপ্রয়োগ নিয়ে এত খুঁতখুঁতানি অপ্রয়োজনীয়৷ বলবেন, এসব ‘কথার কথা’ গায়ে না মাখতে। তাঁদের মনে করিয়ে দিও, শব্দই ব্রহ্ম। নিজের বোধে আস্থা রেখো। নিজেকে প্রশ্ন কোরো, ওসব কথায় অস্বস্তি হচ্ছে না কি তোমার? হলে, প্রতিবাদ কোরো। মনে রেখো, ভাষাও বড় একপেশে। ভাষার চলনই এমন যে পুরুষ ছাড়া সব লিঙ্গের মানুষকে নিষ্ক্রিয়, নির্বাক, বাধ্য পুতুলতুল্য মনে হয়। নাহলে ‘সৎ’ এবং ‘সতী’ কেন ভিন্ন দুই ব্যঞ্জনা বয়ে আনে, বলো?
ভাষাকে সন্দেহ কোরো। ভাষাকে রিক্লেইম কোরো৷ মুখর হোয়ো। নিজের জন্য, অন্যদের জন্যও। কিন্তু পুরুষের ভাষাও হয়ত তোমার পথে অন্তরায় হতে পারে। ‘The Master’s tools will never dismantle the Master’s house’। অড্রে লর্ড বলেছিলেন, অন্য প্রসঙ্গে৷ জেনো, প্রচলিত ভাষাও ক্ষমতাতন্ত্রের অস্ত্র। তার নিপীড়নক্ষমতা অসীম। তাকে চ্যালেঞ্জ করাই কর্তব্য। কিন্তু ভাষা অনেকটা নদীর মতোও বটে। তাকে নিজের খাতে, নিজের বাঁকে বইতে দিও।
কেউ যদি তোমায় বলে, ‘মেয়ে হলেও তুমি বুদ্ধিমান’, ‘মেয়ে হলেও শক্তিশালী’, ‘মেয়ে হলেও অঙ্কে ভালো’— তাহলে জেনো তোমার প্রশংসায় তোমারই লিঙ্গশ্রেণির অপমান লুকিয়ে আছে৷ তার প্রতিবাদ কোরো। ভুল ধোরো, কিন্তু তোমার সমালোচনায় যেন সংবেদনাও বাজে৷ চরম পরিস্থিতি ছাড়া, তাদের শত্রু নয়, সহমানুষ ভেবে সমালোচনা কোরো। হয়ত তাদের আত্মিক বদলে কিছু অবদান তোমারও থাকবে।
আর নজর রেখো নিজের উপরেও। পুরুষালি আচরণ, পুরুষালি ভাষা, পুরুষালি হিংসা, পুরুষালি নিয়ন্ত্রণবাদ— যা কিছু থেকে পুরুষকে মুক্ত করতে চাইছ, তা যেন তোমার নিজের মধ্যেও বাসা না বাঁধে। অড্রে লর্ডের কথা শেখালাম না? রোজ একবার একান্তে বোলো নিজের কানে।
The Master’s tools….
will never dismantle…
the Master’s house.
এবার চিঠি ভাঁজ করো বরং, শাট ডাউন করো, নামিয়ে রাখো ল্যাপটপ। বেলা বয়ে গেল। আজ কি বৃষ্টি ঝরছে অঝোর? হয়ত তা সমবেত কান্না। আজ কি ভীষণ দাবদহ? হয়ত তা সমবেত ক্রোধ। আজ কি আকাশ ঝকঝকে নীল? সে নীলে তোমারও অধিকার।
ইতি,
মাম্মাম।
অসাধারণ! ঠিক যেমনটি প্রত্যাশিত, তেমন।
মন ভরে গেছে চিঠিটা পড়ে। এমন চমৎকার শিক্ষায় আগামিতে ছোট্ট মাম্মাম বিরুদ্ধ অন্ধকারে আলো হয়ে ফুটে ওঠবে, এটা নিশ্চিত। শতাব্দী দাশ, আপনাকে সশ্রদ্ধ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
শাণিত ভাষা ও অনুভুতির এমন সরল প্রকাশ প্রসংসনীয়।