সুশ্রুত চক্রবর্তী
চোখ বুজলে মনে মনে টাইম মেশিনে পিছিয়ে যাওয়াই যায়। হাজারপনেরো বছর বই তো নয়!
গুহার সামনের আগুনে আর-একটা কাঠ গুঁজে দিতে গিয়ে সামনের দিকে তাকাল মানুষটা। আগুনের পেছনের নিকষ আঁধারের ভেতর জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ। কোনও শ্বাপদের।
হাতিয়ারটা হাতে তুলে তাক করতে গিয়েও করল না সে। ওই চোখের দৃষ্টি ও চেনে। গুহার ভেতরে শিকার মেরে এনে খাওয়ার পর যে-সব হাড়গোড় ছিবড়ে পড়ে থাকে, তা ছুঁড়ে ফেলা হলে ওই জন্তুটিই সাঙ্গপাঙ্গ সহ এসে তা উদরস্থ করে নিয়মিত। নিতান্তই নেকড়ে একটা।
অন্ধকারে আগুনের পাশেই ওর বসে থাকা দেখে কেমন যেন মায়া হল মানুষটার। সেদিন যখন আচমকা একটা বিশাল বাঘ এসে ঘুরঘুর করছিল গুহার পাশে, ওই জন্তুটার চ্যাঁচানিতেই তারা সতর্ক হওয়ার সময় পেয়েছিল না?
হাতিয়ার নামিয়ে রেখে রাতের খাবারের থেকে বের হওয়া বড় হাড়টা তুলে নিল মানুষ। ছুঁড়ে দিল জন্তুটার দিকে। প্রথমে চমকে গিয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলেও, শুঁকে শুঁকে এসে যখন জন্তুটা ওই হাড় চিবোচ্ছে, তখন মানুষটা খেয়াল করল নেকড়ের লেজ নড়ছে— খুশি হলে যেমন নড়ে।
Canis lupus থেকে Canis familiaris হওয়ার সেই শুরু।
সেদিন থেকে এই একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত কাজে-অকাজে সর্বদা মানুষের পাশে থেকেছে জংলি নেকড়ে থেকে ঘরোয়া হয়ে ওঠা এই কুকুর নামক জন্তুটি। আলাস্কা থেকে আফগানিস্তান— যেখানে যেখানে মানুষের পদচিহ্ন পড়েছে, সেখানেই পাশে পাশে মিশে গ্যাছে চারথাবার ছাপ। তবে সময়ের নিয়মেই সমাজে তার ভূমিকা বদলেছে পরিস্থিতি আর ভূগোল মেনে। শিকারের সঙ্গী আর আত্মরক্ষার অ্যালার্মের কাজেই যে কুকুরকে পোষা শুরু করেছিল মানুষ, তারা শুধু স্লেজ টেনে, পুলিশের গোয়েন্দা সেজে বা অন্ধকে পথ দেখিয়েই নয়, নিছক আনন্দসঙ্গী হিসেবেও জায়গা করে নিয়েছে দেশে দেশে। নেকড়ের সঙ্গে আজ তার বিভিন্ন ব্রিড-এর মিল নয়, অমিলই অনেক বেশি।
আর এইখানেই শুরু হয়েছে লোকালয়ের সাথে কুকুরদের অবিচ্ছেদ্য জড়িয়ে যাওয়া। যাকে আমরা কুকুর বলে জানি— তা এখন আর কোনও জংলি প্রাণী নয়, বরং মানুষেরই হাতে তৈরি একটি প্রজাতি— আর সে কারণেই মানুষের সাহচর্যে থাকতেই এরা অভ্যস্ত।
সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের মনে কুকুর-মানুষের সম্পর্ক আর সহাবস্থান নিয়ে যে প্রশ্নচিহ্ন উঠেছে— তার ভালো-খারাপ নিয়ে যে তুল্যমূল্য করে চলেছি আমরা— সেটা নিয়ে দু-চার কথা বলার জন্যই ভূমিকাটুকুর অবতারণা। হয়তো এটা বলতেই যে, কুকুর আর মানুষ কিন্তু সহাবস্থানেই অভ্যস্ত— প্রায় পনেরো হাজার বছর ধরে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের ইতিহাসের পাশাপাশি লোককথা-উপকথা-ধর্মেও জায়গা করে নিয়েছে তারা— সে সুমেরিয়ান দেবী বাউ-ই হন বা ভারতের ধর্মরাজ। কিন্তু এইমুহূর্তে সেই সম্পর্ক বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে কয়েক জায়গায়।
উত্তরপ্রদেশের সীতাপুর জেলায় প্রায় দুশো কুকুর মেরে ফেলা হোক বা এনআরএস-এর নার্সিং কলেজের ষোলোটি কুকুরছানার বীভৎস হত্যা— এসব আমরা খবরের দৌলতে জানি। এ ছাড়া খবর না হওয়া প্রচুর কুকুরের মৃত্যুর, বলা ভালো, খুনের আমরা অনেকেই সাক্ষী হয়েছি কখনও না কখনও। সে বিষ দিয়ে মারা হোক বা জলে ডুবিয়ে, কিম্বা নিছকই গাড়িতে থেঁতলে।
সমস্যাটা আসলে কোথায়? আমার তো মনে হয় একটাই শব্দে এর উত্তর দেওয়া যায়। পপুলেশন। হ্যাঁ, দু পক্ষেরই।
পথকুকুরদের সংখ্যাবৃদ্ধি একদিনে হয় না— কিন্তু তা ভীষণ আকার ধারণ করতে সময়ও নেয় না বেশি। কারণ একমাত্র ওদের ক্ষেত্রেই মানুষের সাধারণত কিছু মাথাব্যথা থাকে না। মনে রাখতে হবে, কুকুরেরা যেখানে থাকতে পছন্দ করে, অর্থাৎ শহর-গ্রামে লোকালয়ের আশেপাশে, সেখানে ওদের কোনও ন্যাচারাল প্রিডেটর নেই (এমনিতেই শিকারী প্রাণীরা খাদ্যশৃঙ্খলের ওপরের দিকেই থাকে)। প্রায় প্রতি শীতেই ওদের বংশবৃদ্ধি হয়ে চলে গুণোত্তর প্রগতির নিয়ম মেনে। মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি— শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এরই সহায়ক, কারণ যত মানুষ, তত ফেলে দেওয়া খাবার ও আবর্জনা, এবং তত ঊষ্ণতা। ফলে, শীতের কারণে আগে যে সমস্ত কুকুরছানা জন্মের কিছু পরেই মরে যেত, তার সংখ্যাটা কিছু হলেও কমেছে। চারটে কুকুরছানা জন্মালে তার দুটো-তিনটে বা চারটেই বেঁচে যাচ্ছে সহজে। হ্যাঁ, রাস্তাঘাটে ধাক্কা ইত্যাদির ঘটনা অবশ্যই আছে, তা সত্ত্বেও সেই মৃত্যুর হার খুবই কম।
এই কুকুরগুলোই বড় হয়ে যখন সংখ্যায় অনেকগুলো মিলে খাবারের জন্য নিজেদের মধ্যে মারামারি কাড়াকাড়ি করে, এবং মানুষের বাড়িঘরে রীতিমতো ছোঁকছোঁক করে বেড়ায়, তখন বেশিরভাগ মানুষের কাছে সেটা বিরক্তিকর বইকি! কিছু মানুষ স্বভাবত ভীতু বলে দাগিয়ে দেওয়াটাই এক্ষেত্রে শুধু ঠিক হবে না, বস্তুত কুকুরের থেকে শুধু জলাতঙ্ক না, অনেক ধরনেরই ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়তে পারে, সতর্ক না থাকলে। তার সঙ্গে চলাফেরায় অসুবিধে, দুর্ঘটনার ভয়, রাত্রিবেলা তাড়া খাওয়ার মতো ফ্যাক্টরও যোগ হয়ে যায় প্রায়ই।
কিন্তু সে জন্য সরাসরি মেরে ফেলার ব্যাপারটা বোধহয় অধিকাংশ মানুষই মেনে নিতে পারেন না— যাঁরা কুকুর ভালোবাসেন না, তাঁরাও। আসলে, এই কিলার ইন্সটিংক্ট জিনিসটা প্রতিটা মানুষের মধ্যে থাকলেও হয়তো সবার ক্ষেত্রে তার প্রকাশ সমান নয়। আবার অনেকের কাছেই নিজের চেয়ে অসহায় প্রাণীর ওপর অত্যাচার করা এক ধরনের আমোদ, সুখ। ঘেন্নায় আমরা মুখ বাঁকালেও এটাই সত্যি।
কুকুরহত্যার এই কাণ্ড নিয়ে সোশাল মিডিয়া থেকে চায়ের আড্ডায় যে বাদপ্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, তাতে অনেক মতামত শোনা গেলেও কিন্তু সমস্যার সমাধান নিয়ে উৎসাহিত হচ্ছেন না কেউই। অনেকেই বরং মাত্র দুজন নার্সের কীর্তির কারণে সমগ্র নার্সজাতি এবং সেই সঙ্গে ডাক্তারদেরও বিনা কারণে কাঠগড়ায় তুলে দিচ্ছেন, আবার তার বিপরীতে ‘বেশ করেছে, আমি হলেও মারতাম’ গোছের মন্তব্য করেও নিজেদের জায়গা পরিষ্কার করে দিচ্ছেন কেউ কেউ। তারই সঙ্গে খুন করে দেব, ধর্ষণ করে দেব-ও ভেসে বেড়াচ্ছে একে অন্যের শেয়ারে কমেন্টে— হ্যাঁ, ঠিক ওই কুকুরগুলোরই পারস্পরিক কামড়াকামড়ির মতো!
অথচ এর সবচেয়ে সহজ সমাধান হচ্ছে— কুকুরের জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং শেল্টারিং। হ্যাঁ, সরকারেরই এবিসি অর্থাৎ অ্যানিমাল বার্থ কন্ট্রোলের নির্দিষ্ট রূপরেখা আছে। অথচ কার্যক্ষেত্রে শেল্টার তো বাদই দেওয়া যাক, কুকুরদের নির্বীজকরণের ন্যূনতম ব্যবস্থাটুকু নেই এ রাজ্যে তথা সারা দেশে। অথচ যে-কোনও পুরুষ কুকুরের নির্বীজকরণের ফলেই পরবর্তী প্রজন্মে কুকুরছানার সংখ্যাটা রীতিমতো কমে যায়— শুধু দরকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিছু মানুষ, যাঁরা কাজটা গুরুত্বসহকারে করবেন। অথচ, ঠিক সেই জিনিসটারই কোনও অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
শুধু দুমুঠো ভাতের বিনিময়ে খেলার সঙ্গী নয়, পথকুকুর কিন্তু ভালো স্ক্যাভেঞ্জার এবং পাহারাদারও। শুধু সংখ্যাটা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেই তাদের সাথে মানুষের সংঘাত অনেকটাই কমে যাবে— যেমনটা গিয়েছে বহু সভ্য দেশের কুকুরনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ফলে। সেটুকু আশা তো করাই যায়, তাই না?