তানিয়া লস্কর
আমাদের বরাক-উপত্যকায় একধরনের লতাঝোপ গজে। যার স্থানীয় নাম রিফুজিলতা। স্বর্ণলতা ধরনের একপ্রকার লতানো ঝোপ। ছোটবেলা দেখতাম লতাটি নজরে পড়লেই বাবা-কাকারা উপড়ে ফেলে দিতেন। একদিন শুনলাম আমাদের বাড়ির পাশের গ্রাম যেখান থেকে আমাদের চুলকাটার কাকুরা আসেন, সেই গ্রামটির নাম ‘রিফুজিগ্রাম’। বুকে কেমন যেন কষ্ট হয়েছিল। যে লতাটি উপড়ে ফেলে দেওয়া হয় তার নামে কাকুদের গ্রামের নাম কেন হবে। পরে জানতে পারলাম ওই গ্রামটি ষাট এবং সত্তরের দশকে ওপার থেকে চলে আসা লোকদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল, তাই এমন নাম। এরপর বরাক-ব্রহ্মপুত্র দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে। ‘বিদেশি’, ‘বহিরাগত’, ‘বাংলাদেশি’, সর্বশেষ সংযোজন ‘উইপোকা’। নানা শব্দকল্পদ্রুমের আঘাতে আহত হয়েছি বারবার। সে যাহোক শব্দতত্ত্ব নিয়ে লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। শুধু এটুকু বুঝাতে চাইছি যে অসমের সমাজ জীবন এবং রাজনীতিতে এই রিফিউজি এবং এর বিপরীতে নাগরিকত্ব বিষয়টি কতটা অঙ্গা-অঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। এহেন একটি বিষয় নিয়ে রাজনীতি হবে না তা কি হয়? সুতরাং আন্দোলন, কোর্টকেস, আইন-কানুনের একটি লম্বা লিস্টি তথা হিস্ট্রি আছে। এরই একটি বিজেপীয় প্রয়োগ ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধেয়ক-২০১৬’।
নূতন কী বলছে বিল
এই আইনের ধারাগুলির সারকথা হ’ল—
১) হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসি এবং খ্রিস্টধর্মের মানুষেরা যেহেতু আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান এসব দেশে সংখ্যালঘু তাই তারা কেন্দ্রীয় সরকারের পাসপোর্ট আইন এবং বিদেশি সনাক্তকরণ আইনের অধিনে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বলে গণ্য হবেন না।
২) উপরোক্ত তিনটি দেশের উপরোক্ত ছয়টি সম্প্রদায়ের লোকদের দেশীয়করণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব হাসিল করতে হলে আগে যেমন ১১ বছর ধরে ভারতে বসবাস করতে হত, সেখানে এই আইনের অধীনে মাত্র ছয় বছর বাস করতে হবে।
৩) ওভারসীজ পরিচয়পত্র থাকা বিদেশি নাগরিকরা কোনও ভারতীয় আইন ভঙ্গ করলে তাদের পঞ্জিকরণ সঙ্গে সঙ্গে রদ করা যেতে পারে।
সর্ষেতে বিদ্যমান ভূতের আভাস
আপাতদৃষ্টিতে দেখলে নাগরিকত্বের অধিকার এবং বিধিবহির্ভূতভাবে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত না হওয়ার অধিকার মানুষের প্রাথমিক মানব-অধিকার। প্রত্যকেরই পৃথিবীর যেকোনও দেশের নাগরিকত্ব অর্জন, বর্জন এবং ধারণ (acquire, change and retain) করার জন্মগত অধিকার রয়েছে। সুতরাং বিলের মাধ্যমে কিছুলোক যদি নাগরিকত্ব পান তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সেটা বিধিবদ্ধভাবে এবং নিরপেক্ষভাবে হওয়া উচিত। এখানেই আলোচ্য বিলটি “গাড্ডু মারিলেন”। কারণ বিলটি সংবিধানের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে। এই বিল মতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান, পার্সি এবং শিখ সম্প্রদায়ের লোকদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। কোনও ব্যাখ্যা ছাড়াই এধরনের ধর্মের ভিত্তিতে শ্রেণিকরণ ভারতীয় সংবিধানের ১৪নং অনুচ্ছেদ উল্লেখ করা ন্যায্য বা যুক্তিযুক্ত শ্রেণিকরণের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। সুতরাং ‘কেশবানন্দ ভারতী ভার্সাস ভারত গণরাজ্য মামলা’য় উচ্চতম ন্যায়ালয়ের দ্বারা নির্ধারিত “প্রাথমিক পরিকাঠামো” বা basic structure নীতিরও বিরুদ্ধে। অথচ এই ধারাটি এতই গুরুত্বপুর্ণ যে নাগরিক এবং অ-নাগরিক সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
স্টেট অফ মাদ্রাজ ভার্সাস ভি জি রাও (State of Madras Vs. V.G. Row) মামলায় উচ্চতম ন্যায়ালায় যুক্তিযুক্ত শ্রেণিকরণের জন্য দুটি শর্ত উল্লেখ করেছিলেন সেগুলি হল যুক্তিগ্রাহ্য শ্রেণিকরণ (reasonable classification) এবং আইনের উদ্দেশ্য এবং আইনে আরোপিত শর্তের মধ্যে সম্পর্ক (nexus between the object sought to achieve and the legislation)। ধর্মের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে পার্থক্য করা কখনওই যুক্তিযুক্ত নয়। এবং ধর্মীয় বিভাজনকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে নাগরিকত্ব প্রদানের মাধ্যমে শুধু একটি উদ্দেশ্য সাধিত হয় সেটি হল ‘পার্টি উইথ এ ডিফেরেন্স’-এর ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ৩৯ নম্বর পৃষ্ঠায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনের অভিনয়। অবশ্যই অভিনয়। কারণ বিলে বলা হয়েছে যে উল্লেখিত ছয়টি সম্প্রদায়ের লোকেরা উল্লেখিত তিনটি দেশ থেকে এলে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বলে গণ্য হবেন না। তারা তাহলে কী বলে গণ্য হবেন এবং নাগরিকত্ব অর্জন করার প্রক্রিয়া কী হবে সেটা কোথাও বলা নেই। সুতরাং সর্ষের ভিতরেই ভূত। বাকিটা বুঝতে হলে একবার রাজস্থানে আশ্রয় নেওয়া পাকিস্তানি হিন্দুদের খবর নিতে পারেন। অধ্যাদেশ জারি করে দীর্ঘমেয়াদি ভিসা দেওয়ার নাম করে যাদের ১৫/২০ বছর থেকে ঠকিয়ে যাচ্ছে মহামহিমদের সরকার। এখনও প্রায় ১৭০০০ দীর্ঘমেয়াদি ভিসা এবং ৫০০০ নাগরিকত্বের আবেদন বিচারাধীন পড়ে আছে। অবশ্য তাদের মধ্যে বেশিরভাগ লোকই আর ধৈর্য রাখতে না পেরে আবার পাকিস্তানে ফিরে গেছেন।
নাগরিকত্বের ভিত্তি জন্মস্থানভিত্তিক হবে (jus soli) নাকি রক্তসম্পর্কের মানে মা-বাবার নাগরিকত্বের ভিত্তিতে (Jus sanguine) হবে, এ নিয়ে ভারতীয় সংবিধান খসড়া কমিটিতেও কম বিতর্ক হয়নি। কিন্তু বহু আলোচনার পর জন্মস্থানভিত্তিক নাগরিকত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, এটি বেশি “অগ্রগামী, আধুনিক এবং সুসভ্য” এ যুক্তিতে। এবং দ্বিতীয়টিকে অগণতান্ত্রিক এবং জাতিবিদ্বেষমূলক এই যুক্তিতে নাকচ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫-র মাধ্যমে এই দুই নীতিকেই যুক্তিযুক্তভাবে মিলিত করে নাগরিকত্ব অর্জনের নিয়ম স্থির করা হয়। অথচ বর্তমান বিলটির মাধ্যমে সেই আপাত নিরপেক্ষ আইনটিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে এটির প্রকৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তাছাড়া ভারতীয় সংবিধানে ইজরায়েলের মতো হোমল্যান্ড জাতীয় কোনও ধারণা নেই। সুতরাং ইজরায়েলে যেমন পৃথিবীর যে কোনও দেশে বসবাস করা ইহুদিদের প্রত্যাবর্তনের সুযোগ রয়েছে, ভারতে তেমন কোনও নীতি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এইটি প্রশ্নাতীতভাবে শুদ্ধ সঙ্ঘীয় আমদানি। ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভার ১৯তম অধিবেশনে ভীর দামোদর সাভারকার যে দ্বি-জাতি তত্ত্বের উল্লেখ করেছিলেন সেই তত্ত্বের পুনঃপ্রয়োগ হল এই আইন।
এই বিলটি পাশ করার পিছনে সদিচ্ছার অভাবও খুবই স্পষ্ট। কারণ উপরোক্ত দেশগুলো সহ পৃথিবীর নানা দেশে বিভিন্ন সময়ে নাস্তিক তথা যুক্তিবাদীরা অত্যাচারিত হচ্ছেন এমনকি তাদের হত্যাও করা হচ্ছে, তাদের নাগরিকত্ব প্রধানের ক্ষেত্রে তো এনাদের কোনও মাথাব্যথা দেখি না।
ওভারসীজ নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিলকারী ধারাটিও খুব গোলমেলে। কী ধরনের আইন ভঙ্গ করলে নাগরিকত্ব বাতিল করা হবে সেটা বিশদভাবে আলোচনা করা হয়নি। তার মানে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করলেও কি কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে?
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের উলঙ্ঘন
মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ১৫ নং ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে কোনও মানুষকেই বিধিবিরুদ্ধভাবে নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। সুতরাং একটি সম্প্রদায়কে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা এই ধারার সম্পূর্ণ উলঙ্ঘন।
এছাড়াও জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে নিয়মপত্রের ধারা ৫(গ) ধারার সম্পূর্ণ উলঙ্ঘন। যে ধারায় বলা হয়েছে প্রত্যেক রাষ্ট্র রাজনৈতিক অধিকার বা ভোটাধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে জাতি (Race), বর্ণ (Color), রাষ্ট্রীয় উৎপত্তিমূল (nation of origin) কিংবা জাতিগত মূলের (ethnic origin) ভিত্তিতে কোনও ধরনের ভেদাভেদ করবে না।
সমাধান কোথায়
এধরনের জাতিগত বৈষম্যমূলক আইন প্রণয়ন ধীরে ধীরে জাতিগত নির্মূলীকরণ, এবং বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-ভাষিক অন্তরকোন্দলের জন্ম দেয়। শ্রীলঙ্কা, জার্মানি, জিম্বাবোয়ে, মায়ানমার এসব দেশের ইতিহাস তাই বলে। ভারতবর্ষও সেই পথেই হাটছে। এটা সমগ্র দেশকে ধীরে ধীরে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। সুতরাং এমন বিভাজনমূলক আইন পাশ না করে একটি তুলনামূলকভাবে বেশি বাস্তববাদী তথা যুক্তিসম্মত সমাধানের বিষয়ে ভাবতে হবে। এই বিলটি আইনে পরিবর্তিত হলে ২০১৪ সনে যারা ভোট দিয়েছিলেন, তাদের এক বৃহৎ অংশের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। যাচাইয়ের পর যদি এদের নাগরিকত্ব হারাতে হয়, তবে ২০১৪ সালে যারা নির্বাচিত হয়ে এসেছেন তাদের পদের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। তাছাড়া প্রাকৃতিক ন্যায় বা natural justice-এর role of estoppels মতেও যাদের একবার নাগরিক বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে তাদের প্রত্যেকের নাগরিকত্বের আইনি অধিকার বর্তায়। সুতরাং ২০১৪ সালে যারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন তাদের প্রত্যেকেই নাগরিকত্ব প্রদান করা হোক। আর একটি সর্বাঙ্গীন রিফিউজি পলিসির কথা ভাবতে হবে। ধর্মীয় নির্যাতন-পীড়িতদের প্রতি সত্যিকারের দরদ থাকলে নাগপুরীয় সঙ্ঘের নীতিকে মান্যতা না দিয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নীতিকে মান্যতা দিতে হবে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের রিফিউজি কনভেনশন এবং প্রোটোকলগুলো স্বাক্ষর এবং অনুমোদন করতে হবে। তাহলে সমাধানের পথ বের হতে পারে।