রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
'পথের পাঁচালী-কে যাঁরা শুধু প্রকৃতিমুগ্ধ একটি সরল নিষ্পাপ শিশুর কাহিনী বলে মনে করেন, এই দিকটি তাঁরা একেবারেই নজর করেন না। অথচ স্বপ্নর পাশাপাশি রূঢ় বাস্তবকেও বিভূতিভূষণ ধরে রেখেছেন অকরুণভাবে। আর সেই রূঢ়তার একটি দিক হলো: খাবার।' অন্তঃসার পত্রিকার চতুর্থ বর্ষ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সংখ্যা থেকে এবারের স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে পুনঃমুদ্রিত হল রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য-এর লেখা ভিন্ন স্বাদের এই প্রবন্ধটি।
খাবার ব্যাপারটা এখন আর শুধু জীবনধারণের উপায় নয়, সংস্কৃতিচর্চা (কালচারাল স্টাডিজ)-র উপকরণ।[[১]] কাঁচা খাবার থেকে রাঁধা খাবার — এই হলো প্রকৃতি আর সংস্কৃতির এক বড় তফাত। এরই খেই ধরে আরও অনেক তত্ত্বকথা এসেছে।
একটা কথা সকলেই জানেন কিন্তু খেয়াল করেন না। সেটি এই : অন্তত বাঙালির ক্ষেত্রে খাবার দিয়েই বড়লোক আর গরিবের তফাত করা যায়। পথের পাঁচালী-তে বিভূতিভূষণ বার বার এই বিষয়টি এনেছেন। খুঁটিনাটির দিক দিয়ে তাঁর বিবরণ নিখুঁত। তার ভেতর দিয়েই অপু বোঝে তারা কত গরিব। একে একে সেই পরিস্থিতিগুলো দেখা যাক।
শিষ্যবাড়ি যাওয়ার সময় হরিহর ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে চলল : “বাড়ী থেকে কিছু খেতে পায় না, তবুও বাইরে বেরুলে দুধটা, ঘিটা – ওর শরীরটা সারবে এখন।” (পরিচ্ছেদ ১৬)। লক্ষ্মণ মহাজন নামে বেশ বড় চাষি ও অবস্থাপন্ন গৃহস্থর বাইরের আটচালা ঘরে তাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। লক্ষ্মণের ভাই-এর বৌ অপুকে খেতে দিল মোহনভোগ। অপুর চোখ দিয়ে বিভূতিভূষণ লিখেছেন:
একটা বাটিতে অনেকখানি মোহনভোগ, এত ঘি দেওয়া যে আঙুলে ঘিয়ে মাখামাখি হইয়া যায়। অপু একটুখানি মুখে তুলিয়া খাইয়া অবাক হইয়া যায় – এমন অপূর্ব জিনিস আর সে কখনো খায় নাই তো! – মোহনভোগে কিসমিস দেওয়া কেন? কই তাহার মায়ের তৈরি মোহনভোগে তো কিসমিস থাকে না? বাড়ীতে সে মা’র কাছে আবদার ধরে – মা, আজ আমাকে মোহনভোগ করে দিতে হবে। তাহার মা হাসিমুখে বলে- আচ্ছা ওবেলা তোকে করে দেব – পরে সে শুধু সুজি জলে সিদ্ধ করিয়া একটু গুড় মিশাইয়া পুলটিসের মত একটা দ্রব্য তৈয়ারী করিয়া কাঁসার সরপুরিয়া থালাতে আদর করিয়া ছেলেকে খাইতে দেয়। অপু তাহাই খুশির সহিত এতদিন খাইয়া আসিয়াছে, মোহনভোগ যে এরূপ হয় তাহা সে জানিত না। আজ কিন্তু তাহার মনে হইল এ মোহনভোগে আর মায়ের তৈয়ারী মোহনভোগে আকাশ-পাতাল তফাৎ! … সঙ্গে সঙ্গে মায়ের উপর করুণায় ও সহানুভূতিতে তাহার মন ভরিয়া উঠিল। হয়তো তাহার মাও জানে না যে, এরকমের মোহনভোগ হয়! – সে যেন আবছায়া ভাবে বুঝিল, তাহার মা গরিব, তাহারা গরীব – তাই তাহাদের বাড়ী ভাল খাওয়া-দাওয়া হয় না।
নাম এক হলেও গরিবের আর বড়লোকের ঘরের মোহনভোগ যে এক হয় না – অপুর এই উপলব্ধি এখান থেকেই শুরু। ঐ একই বাড়িতে অপু সন্ধেবেলা নেমন্তন্ন খেতে গেল। সেখানেও আবার নতুন অভিজ্ঞতা:
খাইতে বসিয়া খাবার জিনিষপত্র ও আয়োজনের ঘটা দেখিয়া সে অবাক হইয়া গেল। ছোট একখানা ফুলকাটা রেকাবীতে আলাদা করিয়া নুন ও নেবু কেন? নুন, নেবু তো মা পাতেই দেয়। প্রত্যেক তরকারীর জন্যে আবার আলাদা আলাদা বাটি? তরকারীই বা কত! অত বড় গলদা চিংড়ির মাথাটা কি তাহার একার জন্য?
খাবার পাতে প্রথমেই পড়ে লুচি। অপুর জীবনে এটি দুর্লভ সামগ্রী। বছরে একদিন, রামনবমী দোলের দিনটিতে ও পাড়ার গাঙ্গুলি বাড়িতে তার লুচি খাওয়ার সুযোগ হয়। অপুর তাই মনে হয়:
লুচি! লুচি! তাহার ও তাহার দিদির স্বপ্নকামনার পারে এক রূপকথার দেশের নীল বেলা আবছায়া দেখা যায় … কত রাতে, দিনে, ওলের ডাঁটা-চচ্চড়ী ও লাউ ছেঁচকী দিয়া ভাত খাইতে খাইতে, কত জল-খাবার-খাওয়া শূন্য সকাল বিকালে, অন্যমনস্ক মন হঠাৎ লুব্ধ, উদাস গতিতে ছুটিয়া চলে সেখানে … একদিন মাত্র বছরে সে দেশের ঠিকানা খুঁজিয়া মেলে …। কিন্তু আজ সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে সে সুদিনের উদয় হইল কি করিয়া! খাইতে বসিয়া বার বার তাহার মনে হইতেছিল, আহা, তাহার দিদি এ রকম খাইতে পাই নাই কখনো!
শিষ্যবাড়ি ঘোরা শেষ; অপুকে বাড়িতে রেখে হরিহর আবার বেরিয়েছেন। সন্ধের পর ভাত চড়িয়েছেন সর্বজয়া। দুর্গা বঁটি পেতে তরকারি কুটছে। তরকারি মানে পাতালকোঁড়ের তরকারি। গোঁসাইদের বড় বাগান থেকে বনের ভেতরে ঢুকে দুর্গাই পাতালকোঁড় জোগাড় করে এনেছে।
দুর্গার মন আজ খুশি আছে। রাত্রিতে রান্না প্রায়ই হয় না। ওবেলার বাসী ভাত তরকারি থাকে। আজ ভাত চড়িয়াছে, তরকারী রান্না হইবে, ইহাতে তাহার মহা আনন্দ। আজ যেন একটা উৎসবের দিন। (পরি. ২৬)
উৎসবই বটে। খেতে বসে দুর্গা বলে, “পাতালকোঁড়ের তরকারীটা কি সুন্দর খেতে হয়েছে মা!” বিভূতিভূষণ মন্তব্য করেন: “তাহার মুখ স্বর্গীয় তৃপ্তিতে ভরিয়া উঠিল”। এখানে ‘স্বর্গীয়’ শব্দটি খেয়াল করার মত। শুধু দুর্গা নয়, অপুও বলে, “বাঃ! খেতে ঠিক মাংসের মত, না দিদি?”
অন্য একদিনের কথা। জরিপের কাজে নিজের ভাগের জমি দেখভাল করার জন্যে বাবার হুকুমে নীরেন এসেছে নিশ্চিন্দিপুরে। সময় কাটানোর জন্যে গ্রামের ছেলেদের নিয়ে সে একটা পাঠশালা খুলেছে। অপু আর পটু সেখানে পড়তে যায়। তার পরের ঘটনা এইরকম:
মধুসংক্রান্তির ব্রতের পূর্ব্বদিন সর্বজয়া ছেলেকে বলিল – কাল তোদের মাষ্টার মশাইকে নেমন্তন্ন ক’রে আসিস – বলিস দুপুর বেলা এখানে খেতে।
মোটা চালের ভাত, পেঁপের ডালনা, ডুমুরের সুক্তানি, থোড়ের ঘন্ট, চিংড়ি মাছের ঝোল, কলার বড়া ও পায়েস।
দুর্গাকে তাহার মা পরিবেশন কার্যে নিযুক্ত করিয়াছে। নিতান্ত আনাড়ি – ভয়ে ভয়ে এমন সন্তর্পণে সে ডালের বাটি নিমন্ত্রিতের সম্মুখে রাখিয়া দিল – যেন তাহার ভয় হইতেছে এখনই বকিয়া উঠিবে। অত মোটা চালের ভাত নীরেনের খাওয়া অভ্যেস নাইঃ এত কম তৈলঘৃতের রান্না তরকারী কি করিয়া লোকে খায়, তাহা সে জানে না। পায়েস পানসে – জল মিশানো দুধের তৈরী, একবার মুখে দিয়াই পায়েস ভোজনের উৎসাহ তাহার অর্ধেক কমিয়া গেল। অপু মহা খুশি ও উৎসাহ সহকারে খাইতেছিল, এত সুখাদ্য তাহাদের বাড়ীতে দু’একদিন মাত্র হইয়াছে – আজ তাহার স্মরণীয় উৎসবের দিন! – আপনি আর একটু পায়েস নিন মাষ্টার মশায়। … নিজে সে এটা ওটা বার বার দিদির কাছে চাহিয়া লইতেছিল। (পরি. ১৮)
এই বিবরণে একটিও বাড়তি কথা নেই। নেমন্তন্ন কথাটা বলার পরেই এসে যায় খাবারের ফর্দ, বিনা ভূমিকায়। সর্বজয়া যে নীরেনের সামনে বার হচ্ছেন না – সেটা বোঝানো হয় ইঙ্গিতে: দুর্গা একাই পরিবেশন করে। খাবারের গুণাগুণ জানানো হয় নীরেন আর অপুর দৃষ্টিকোণ থেকে। নীরেনের কাছে যা অখাদ্য, ওল আর পাতালকোঁড়োর তরকারী খাওয়া অপুর কাছে সেটাই মহাভোজ। অপুর সংলাপটি বিবরণের মধ্যেই আচমকা এসে পড়ে;”অপু বলিল” গোছের কিছু থাকে না। সমস্ত বিবরণের মধ্যেই একটা নির্লিপ্ত ভাব আছে। নীরেন আর অপুর স্বাদের ধারণা যে এক নয় তা বলা হয় সংক্ষেপে কিন্তু অমোঘভাবে।
হরিহরের জ্ঞাতিভাই, নীলমণি রায়ের বিধবা স্ত্রী তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে নিশ্চিন্দিপুর এসেছেন। বড়মানুষ জা-এর সঙ্গে মিশতে গিয়ে সর্বজয়া বুঝতে পারল তাকে কোনো আমলই দেওয়া হবে না।
নীলমণি রায়ের ছেলেমেয়ে সর্বদা ফিটফাট সাজিয়া আছে, কোথাও এতটুকু ময়লা হইতে পায় না, চুল সর্বদা আঁচড়ানো, অতসীর গলায়, হাতে সোনার চুড়ি, কানে সোনার দুল, একপ্রস্থ চা ও খাবার না পাইলে সকালে কেহ কোথাও বাহির হয় না … (পরি. ২৭)
অপুদের বাড়িতে কোনোদিনই চা-এর চল ছিল না। সকালে মা-র কাছে চিড়ে, মুড়ি, নাড়ু বা বাসি ভাত (পরি. ২৮)। গঙ্গানন্দপুরে পিসির বাড়ি যাওয়ার সময়ে পুঁটলির ভেতর সে নিয়েছিল নারকোল নাড়ু। পিসির বাড়িতে আদর-যত্নর অভাব হয় নি। রাত্তিরে ভাত খাওয়ার সময়ে দুধের সঙ্গে তাঁর সন্দেশ কিনে এনে দিয়েছিলেন। সকালে পাড়ার পথে এদিক ওদিক ঘুরে সে আর পিসির বাড়ি ফিরতে ভরসা পায় না। মনে হয়: “আজ যদি সে এখনই ফিরে, তবে হয়তো উহারা ভাবিবে ছেলেটা ভারী পেটুক; খাবার খাইবার লোভে-লোভে এত সকালে বাড়ী ফিরিল। রোজ রোজ খাবার খাওয়া কি ভাল? … এখন সে কি করে?” অপুর সিদ্ধান্ত: “না, বাড়ী ফিরিবে না। আরও খানিক পথে পথে একেবারে সেই ভাত খাইবার সময়ের একটু আগে বাড়ী যাইবে”। (পরি. ২৮)
ঐ একই পরিচ্ছেদে আছে গুলকী নামে অনাথা মেয়েটির খাওয়ার বর্ণনা:
অনেকগুলি ভাত চাহিয়া লহিয়া ডাল দিয়া সেগুলি মাখিল, পড়ে অনেকক্ষণ বসিয়া বসিয়া অত ভাত না খাইতে পারিয়া পাটের পাশে রাশীকৃত ঠেলিয়া রাখিল। তবুও উঠিবার নাম করে না।
শেষ বাক্যটি বিশেষ করে নজর করা দরকার, খেতে পারুক আর না-পারুক, ডাল ভাতের সামনে বসে থেকেও সুখ।
গুলকীর ব্যাপারে অপুর পিসিমা বলে দেন: মেয়েটি অনাথা, তার দূর সম্পর্কের জ্যেঠির বাড়ীতে থাকে; “জ্যেঠী তো নয় রণচণ্ডী, কতদিন খেতেও দেয় না, এর ওর বাড়ী খেয়ে বেড়ায়”। কিন্তু তার পরেই তিনি যোগ করেনঃ “ নিজের পুষ্যিই সাতগণ্ডা – তাদেরই জোটে না, তার আবার পর!” (পরি. ২৮)
অবস্থা যে কত খারাপ তার অন্য একটি বিবরণ আছে নিশ্চিন্দিপুরের পাশের গ্রামের আদ্যশ্রাদ্ধর বিবরণে। হরিহর বাড়িতে নেই, অপুই তাই গ্রামের সকলে সঙ্গে নেমন্তন্ন খেতে গেল। নীলমণি রায়ের ছেলে সুনীলও গেল তাদের সঙ্গে। “নানা গ্রামের ফলারে বামুনের দল পাঁচ-ছয় ক্রোশ দূর হতে হাঁটিয়া আসিয়াছে। এক-এক ব্যক্তি পাঁচ-ছয়টি করিয়া ছেলেমেয়ে সঙ্গে করিয়া আসিয়াছে; সকলকে সুবিধামত স্থানে বসাইতে গিয়া একটা দাঙ্গা বাঁধিবার উপক্রম”। (পরি. ২৭)
এর পরের ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়েছে সিরিওকমিক ভঙ্গিতে:
প্রত্যেকের পাতে চারিখানি করিয়া লুচি দিয়া যাইবার পর পরিবেশনকারীরা বেগুনভাজা পরিবেশন করিতে আসিয়া দেখিল কাহারও পাতে লুচি নাই, – সকলেই পার্শ্ববর্তী চাদরে বা গামছায় লুচি তুলিয়া বসিয়া আছে! … একটি ছোট ছেলে অতশত না বুঝিয়া পাতের লুচি ছিঁড়িতে যাইতেছে – তাহার বাপ বিশ্বেশ্বর ভটচায ছোঁ মারিয়া ছেলের পাত হইতে লুচি উঠাইয়া পাশের চাদরে রাখিয়া বলিল – এগুলি রেখে দাওনা! আবার এখনই দেবে, খেও এখন।
তাহার পর খানিকক্ষণ ধরিয়া ভীষণ সোরগোল হইতে লাগিল – “লুচির ধামাটা এ সারিতে,” “কুমড়োটা যে আমার পাতে একেবারেই,” “ওহে গরম দেখে,”… “মশাই কি দিলেন হাত দিয়ে দেখুন দিকি, স্রেফ কাঁচা ময়দা”… ইত্যাদি।
এরপর আসে ছাঁদার প্রসঙ্গ৷ সেই নিয়েও তুমুল বিবাদ।
কে একজন চিৎকার করিয়া বলিতে লাগিল- তা হোলে সেখানে ভদ্দর লোকদের নেমন্তন্ন করতে নেই। স’ পাঁচ গণ্ডা লুচি এ একেবারে ধরা-বাঁধা ছাঁদার রেট- বল্লাল সেনের আমল থেকে বাঁধা রয়েছে। চাইনে তোমার ছাঁদা, কন্দপ্পো মজুমদার এমন জায়গায় কখনও-
কর্মকর্ত্তা হাতে পায়ে ধরিয়া কন্দপ্পো মজুমদারকে প্রসন্ন করিলেন।
অপুও এক পুটুলি ছাঁদা বয়ে এনেছিল। সর্বজয়া দেখে খুব খুশি: “লুচি, পানতুয়া, গজা কত রে…! ঢেকে রেখে দি, সকাল বেলা খেও এখন।” অপু বলে: “তোমায়ও কিন্তু মা খেতে হবে- তোমার জন্য আমি চেয়ে দু’বার ক’রে পানতুয়া নিইচি।”
এরপরেই কিন্তু ব্যাপারটা পুরো উলটোদিকে ঘুরে যায়। খানিকক্ষণ পরে সুনীলদের বাড়ি গিয়ে অপু শুনতে পেল: “ওসব কেন বয়ে আনলি বাড়িতে? কে আনতে বলেছে তোকে?” সকলের দেখাদেখি আট বছরের সুনীলও ছাঁদা বেঁধেছিল। সে বলে: “কেন মা সবাই তো নিলে- অপুও তো এনেছে।”
সুনীলের মা-র উত্তর: “অপু আনবে না কেন -ও ফলারে বামুনের ছেলে! ও এরপর ঠাকুরপুজো ক’রে আর ছাঁদা বেঁধে বেড়াবে, ওই ওদের ধারা। ও-র মা-টাও অমনই হ্যাংলা। ঐজন্যে আমি তখন তোমাদের নিয়ে এ গাঁয়ে আসতে চাইনি। কুসঙ্গে পড়ে যত কুশিক্ষে হচ্ছে! যা, ওসব অপুকে ডেকে দিয়ে আয়- যা; না হয় ফেলে দিগে যা। নেমন্তন্ন করেচে নেমন্তন্ন গেলি- ছোটলোকের মতো ওসব বেঁধে আনবার দরকার কি!”
অপুর প্রতিক্রিয়াটা বিভূতিভূষণ তার ভাবনার ভাষাতেই লেখেন। ব্যাপারটা অপুর কাছে স্পষ্ট হয় না। কিন্তু সুনীলের মা-র কথায় সে আঘাত পায়।
অপু ভয় পাইয়া আর সুনীলদের ঘরে ঢুকিল না। বাড়ী ফিরিতে ফিরিতে ভাবিল- যাহা তাহার মা পাইয়া এত খুশি হইল, জ্যেঠাইমা তাহা দেখিয়াই এত রাগিল কেন? খাবারগুলো কি ঢ্যালামাটি যে, সেগুলো ফেলিয়া দিতে হইবে? তাহার মা হ্যাংলা! সে ফলারে বামুনের ছেলে? বা রে! জ্যেঠিমা যেন অনেক পানতুয়া-গজা খাইয়াছে, তাহার মা তো ওসব কিছুই খাইতে পায় না। আর সে-ই বা নিজে এ-সব ক’দিন খাইয়াছে? সুনীলের কাছে যাহা অন্যায় তাহার কাছে সেটা কেমন করিয়া অন্যায় হইতে পারে!
ন্যায়-অন্যায়ের যে কোনো অনন্য মাপকাঠি নেই- অবস্থার তারতম্যে সে মাপকাঠি বদলাতে হয়- অস্পষ্টভাবে হলেও অপু বুঝতে পারে।
এখানেই অপুর জীবনের নিশ্চিন্দিপুর পর্ব শেষ। কাশীতে শুরু হয় এক নতুন পর্ব। সেখানেও নানা প্রসঙ্গে খাবারের কথা উঠেছে। আপাতত সে-আলোচনা মুলতুবি থাক।
রেললাইন থেকে বহুদূরের একটি গ্রামে এক গরিব ঘরের ছেলে- বামুন হলেও যে গরিব গরিবই থাকে- সে তার অবস্থা বুঝতে শেখে অন্য রকমের মোহনভোগ খেয়ে। বারে বারে সেই বোধ তার জীবনকে ধাক্কা দেয়। এর ভেতর দিয়ে শুরু হয় তার পথ চলা। সর্বজয়া যা চেয়েছিল, অপু তা হয় নি। হরিহরের মতো শিষ্যবাড়ি ঘুরে, সেরেস্তায় খাতা লিখে জীবন কাটাতে হয় নি তাকে। এইদিক দিয়ে অপু বেঁচে গিয়েছিল, কারণ তার ছিল পড়ার ও শেখার আগ্রহ। তার সঙ্গে এ-ও দেখার: নিতান্ত বাচ্চা বয়স থেকে সে দেখেছে, অনুভব করেছে গরিব বলেই তার বাবা-মা এমনকি তাঁদের আত্মীয়দের কাছেও কতখানি অবজ্ঞার পাত্র৷ পথের পাঁচালী-কে যাঁরা শুধু প্রকৃতিমুগ্ধ একটি সরল নিষ্পাপ শিশুর কাহিনী বলে মনে করেন, এই দিকটি তাঁরা একেবারেই নজর করেন না। অথচ স্বপ্নর পাশাপাশি রূঢ় বাস্তবকেও বিভূতিভূষণ ধরে রেখেছেন অকরুণভাবে। আর সেই রূঢ়তার একটি দিক হলো: খাবার। যে-খাবার না-পেলে কোনো মানুষই বাঁচে না, আবার যে-খাবারের রকমফের দিয়ে মানুষে মানুষে ফারাকও ধরা যায়।
টীকা
[[১]] বছর কয়েক আগে স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ, লন্ডন-এ “দক্ষিণ-এশিয়ার খাবার” নিয়ে একটা সম্মেলন পর্যন্ত হয়ে গেছে। ভাস্কর মুখোপাধ্যায়, ৪৮ দ্র.। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরিজি বিভাগ খাবার নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করেছে (১৬-১৮.১১.২০০৬)
রচনাপঞ্জি
১. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পথের পাঁচালী (সপ্তম সংস্করণ)। পি. মিত্র, ১৩৫৯।
২. Mukhopadhyay, Bhaskar, “Between Elite Hysteria and Subaltern Carnivalesque: The Politics of Street-food in the City of Calcutta“, South Asia Research, 24 (I): May 2004, 37-50.