অভিজিৎ মুখার্জি
ঔপন্যাসিক অমিতাভ ঘোষের লেখা পড়তে ভালবাসি খুব। যাঁরা তখনও পড়েননি, তাঁদের কাছে ওঁর লেখা নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে বলতেও আমার ক্লান্তি হয় না। সম্ভবত সেই কারণেই ওঁর জ্ঞানপীঠ সম্মান পাওয়া উপলক্ষ্যে আমাকে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে ওঁকে নিয়ে কিছু লেখার। লেখকদের স্বীকৃতির প্রয়োজন থাকে না এমন তো নয়, পুরস্কারের বা সম্মাননার সেদিক থেকে উপযোগিতা আছে বৈকি, কিন্তু পুরস্কার বা সম্মাননা নিয়ে খুব বেশি হইচই ভালোর চেয়ে খারাপ করে বেশি। নবীন লেখকরা পুরস্কারলোভী হয়ে ওঠেন, এবং অনুপযুক্ত প্রাপকের উদাহরণ তাঁদের বিপথগামী করে। বাংলা সাহিত্যও এহেন বিপত্তির দ্বারা নানাদিক দিয়ে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জ্ঞানপীঠ সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন বলে নয়, নিজের ইতিহাসজ্ঞানকে অবলম্বন করে মানবসভ্যতাকে পথনির্দেশ করার সাহিত্যাশ্রয়ী যে প্রকল্প উনি ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, সেটির সঙ্গে পরিচিত হতেই আমরা তাঁকে নিয়ে আলোচনা করব, তাঁর সবক’টি লেখা পড়ব। ওঁর লেখা ধারাবাহিকভাবে পড়তে থাকলে যে তিনটি ব্যাপার পাঠক থেকে থেকেই খেয়াল করবেন, ওঁর উপন্যাসের কাহিনী যেগুলোকে নিয়ম করে সামনে নিয়ে আসে, সেগুলো হল:
- আধুনিকতার ধারণাকে বাহন করে পশ্চিমী সভ্যতার যে নৈতিক উচ্চতার অহঙ্কার সেটিকে সার্বিকভাবে অস্বীকার করা;
- ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ছেদ আনার প্রয়োজনীয়তাকে প্রতিষ্ঠা করা; এবং
- আজকের পৃথিবীতে পরিবেশ নিয়ে সংকট ও তার উৎস নির্দেশ করা।
যে কারণে ওঁর লেখা পাঠকের আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জন করে, সেটি হল, এই তিনটে দিক বিচ্ছিন্নভাবে কখনও আসে না, সবসময়ই একটা আর একটার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে থাকে।
১৬২৬ সালে প্রয়াত হন ফ্রান্সিস বেকন। তাঁর প্রবন্ধ ‘Of the True Greatness of Kingdoms and Estates’-এর এক জায়গায় লিখে রেখে গেছেন,
To be master of the sea is an abridgement of a monarchy… thus much is certain, that he that commands the sea is at great liberty, and may take as much and as little of the war as he will. Whereas those that be strongest by land are many times nevertheless in great straits. Surely, at this day, with us of Europe, the vantage of strength at sea (which is one of the principal dowries of this kingdom of Great Britain) is great: both because most of the kingdoms of Europe are not merely inland, but girt with the sea most part of their compass; and because the wealth of both Indies seems in great part but an accessary to the command of the seas.
রাজ্যবিস্তার করার ও লুণ্ঠন করার লোভ পশ্চিমের মজ্জাগত। ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটেনের নৌশক্তির শ্রেষ্ঠত্ব নেহাৎই তার প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটা দিক নয়, বরং এই সিদ্ধান্তে আসা মোটেই অযৌক্তিক হবে না যে, প্রযুক্তি উদ্ভাবনের একটি মুখ্য লক্ষ্যই ছিল নৌশক্তির শক্তি বাড়িয়ে অন্য দেশকে যুদ্ধে পরাজিত করা।
পশ্চিমেরই আর একটি দেশ, পর্তুগাল থেকে ভাস্কো-দা-গামা ভারতে প্রথম এসেছিলেন ১৪৯৮ সালের ১৭ মে, নৌপথে। ‘ইন অ্যান অ্যান্টিক ল্যান্ড’ উপন্যাসে অমিতাভ ঘোষ লিখলেন,
সেই দিনটির কয়েক বছরের মধ্যেই মৃত্যুঘণ্টা বেজে গিয়েছিল সেই জগতের যা বোম্মা, বেন ঈজু আর আশুকে মিলিত করেছিল। শুরু হয়েছিল অন্য এক যুগ যেখানে এঁদের (অর্থাৎ, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির ও বিশ্বাসের) পরস্পরের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনার শুধু অবসানই হয়নি, মানুষের স্মৃতি থেকেই মুছে গিয়েছিল সেই সম্ভাব্যতা।
পৃথিবীতে একটা অনেক বেশি উন্নত, প্রকৃত সভ্যতার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, পশ্চিমের সামরিক পরাক্রমের কাছে হেরে যাওয়া তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। দ্বাদশ শতকের ভারতে,
যে কোনও মানদণ্ডেই, ম্যাঙ্গালোরের বিদেশি বণিক সম্প্রদায় ছিল বিশাল… ইয়েমেন এবং পারস্যের অধিকাংশ বণিকরাই এসে নামত ওখানে… ইবন বতুতা যখন এসেছিলেন, তখন ম্যাঙ্গালোরের মুসলমানরা, যাঁরা ছিলেন বিদেশি বণিক, সংখ্যায় ছিলেন প্রায় চারহাজারের মতো… কয়েকশো মাইল দক্ষিণে কালিকটে ছিল আরও বিশাল এবং আরও বহুরকমের বণিক সম্প্রদায়ের বাস। বতুতার জাহাজ যখন ভিড়েছিল তখন উপকূলে ছিল তেরোটি চিনা জাহাজ… নগরীতে নিয়মিত আসত লোকেরা চিন থেকে, সুমাত্রা থেকে, সিংহল, মালদ্বীপ, ইয়েমেন আর ফার্স (পারস্য) থেকেও… ষোড়শ শতকের প্রথমদিকে দুয়ার্ত বারবোসা বলে এক পর্তুগীজ নাবিক এসেছিলেন এই শহরে। তিনি দেখেছিলেন যে শহরের বণিকদের মধ্যে আছে আরব, পারসিক, গুজরাতি, খোরাসানি আর দাক্ষিণাত্যের লোকেরা।
এভাবে তৈরি হয়েছিল এক মিশ্রভাষা, যার উল্লেখ পাওয়া যায় আরব ভূগোলবিদ মাসুদির বিবরণ থেকে। কিন্তু সামরিক কৌশলে রপ্ত, যুদ্ধবাজ পাশ্চাত্যের দাক্ষিণ্যে ছারখার হয়ে গিয়েছিল সেই সুখী জনপদ, বিচ্ছিন্ন হয়েছিল বিভিন্ন শান্তিপ্রিয় জাতির মধ্যে আদানপ্রদানের সহায়ক যোগাযোগ।
গণপরিসরে ইতিহাসের যে বয়ানের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়, তা হয় পশ্চিমের লেখা ইতিহাস, নতুবা পশ্চিমে প্রশিক্ষিত ও পুরস্কৃত দেশি ইতিহাসবিদের বয়ান। পরিবেশ সংকট নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত ওঁর ‘দ্য গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট’-এ একজায়গায় লিখেছেন,
But as has always been seen, one feature of Western modernity is truly distinctive: its enormous intellectual commitment to the promotion of its supposed singularity.
আমরা আমাদের ইতিহাস লিখতে শিখিনি, তাই সেই সৌহার্দ্যময় সভ্যতার বিনষ্টির কথা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতে হল অনেকদিন। আমরা ইতিহাস থেকে পেয়েছি সংঘাতের কাহিনী, পরাভবের স্মৃতি, প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার গৌরবের আখ্যান, আর এভাবে বিশ্বাসে বিশ্বাসে, সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিতে, ভৌগলিক নানা অঞ্চলের মধ্যে বজায় থেকেছে অলঙ্ঘ্য ব্যবধান।
এর আগে, কাশ্মীরের হজরতবাল মসজিদে সংরক্ষিত নবীর ক’গাছা চুল চুরি যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৬৪-র দাঙ্গার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, ঢাকার রাস্তায় এক মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের পারিবারিক স্মৃতির রেশ ধরে লিখেছিলেন ‘দ্য শ্যাডো লাইনস’। দাঙ্গায় ঢাকার রাস্তায় নিহত হয়েছিল ত্রিদিব, ত্রিদিবের প্রেমিকা মে (May) জাতিতে ইংরেজ। ত্রিদিব সম্বন্ধে বলছেন,
… সে জানে যে সে ওইভাবেই দেখা পেতে চায় মে-র — একজন অপরিচিত হিসেবে এক ধ্বংসাবশেষের মধ্যে… এমন কোনও জায়গায় যার কোনও অতীত নেই, ইতিহাস নেই। মুক্ত, সত্যিকারের মুক্ত দু’জন মানুষের, সম্পূর্ণ অপরিচিতের স্বাধীনতা নিয়ে মিলিত হওয়া।
ইতিহাসের বিভিন্ন বয়ানবাহিত স্মৃতিই মানুষকে মুক্ত হতে দেয় না, স্মৃতি তার বন্ধন। বন্ধনমুক্ত হতে যে মুক্ত-চেতনা জাগিয়ে তুলতে হয়, তার উন্মেষ ঘটানোয় কাহিনীকারের খুব বড়ো ভূমিকা থাকতে পারে, সম্ভবত নিজের লেখক-জীবন যে সার্থকতার অন্বেষনে, অপ্রত্যক্ষে সেটারই আভাস দিলেন এই সূত্রে। স্মৃতিকে উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করে কাহিনীতে অনুবাদ করতে হয়। ওই উপন্যাসেই লিখলেন,
প্রত্যেকেই বেঁচে থাকে একটা গল্প হয়ে… আমার ঠাকু’মা, আমার বাবা, তাঁরও বাবা, লেনিন, আইনস্টাইন, আমি শুনিনি এমন আরও বহু নাম; এঁরা সবাই গল্পেই বেঁচে থাকে, কারণ একমাত্র গল্পের মধ্যে দিয়েই বেঁচে থাকা যায়, শুধু প্রশ্ন হল, তুমি কোন গল্পটা বাছবে…।
কিন্তু নিজেদের সভ্যতার গল্প নিজেরা লেখার যোগ্যতা আমরা অর্জন করে উঠতে পারলাম কই? উত্তর-ঔপনিবেশিকতার অলঙ্ঘ্য বাধ্যবাধকতায় আমাদের ইতিহাস বলে জানলাম যা উপনিবেশক নির্দেশ করল জানতে। নিজেদের অধিকার, সভ্যতা ও যোগ্যতা সম্বন্ধে সচেতন হলাম পশ্চিমের চোখ দিয়ে দেখে। উপনিবেশক নির্দিষ্ট করে দিয়ে গেল কোন স্মৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকব আমরা, আপাতদৃষ্টিতে যা স্বাধীনতা, তা লাভ করার পরেও।
বিংশ শতকের গোড়ায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে বিদেশির দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব সর্বজনবিদিত, সেই জাপানি শিল্পতত্ত্ববিদ ওকাকুরা কাকুজো তাঁর ‘The Book of Tea’-তে এই মানসিক পরাধীনতা নিয়ে লিখেছিলেন,
We Asiatics are often appalled by the curious web of facts and fancies which has been woven concerning us. We are pictured as living on the perfume of the lotus, if not on mice and cockroaches. It is either impotent fanaticism or else abject voluptuousness. Indian spirituality has been derided as ignorance, Chinese sobriety as stupidity, Japanese patriotism as the result of fatalism. It has been said that we are less sensible to pain and wounds on account of the callousness of our nervous organization!
Why not amuse yourselves at our expense? Asia returns the compliment. There would be further food for merriment if you were to know all that we have imagined and written about you. All the glamour of the perspective is there, all the unconscious homage of wonder, all the silent resentment of the new and undefined. You have been loaded with virtues too refined to be envied, and accused of crimes too picturesque to be condemned.
ক্রাইমের ফিরিস্তি দিলে কি শেষ হবে? ঔপনিবেশিক ইংরেজের লোভের শিকার হয়েছিল সমগ্র এশিয়া। তেল উৎপাদনে যখন ব্রহ্মদেশ উন্নততর প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে অনেকটা অগ্রগতি করেছে, ছলে বলে সেখানে নিজের দখলদারি চালিয়ে, তারপর একসময় সুশাসনের অজুহাতে পুরো দেশটাকেই সামরিক পরাক্রমে অধিকার করে নিয়ে ক্রমে ধ্বংস করেছে। ব্রহ্মদেশ সম্বন্ধে বলা হত, এ হচ্ছে সেই দেশ যেখানে দিনান্তে কেউ অভুক্ত থেকে ঘুমিয়ে পড়ে না। চিন আক্রমণ করে হংকংকে নিজেদের দখলে এনে, সুবিধে করে নিয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের, আর তা করতে গিয়ে যুদ্ধ জাহাজ থেকে অবিরত গোলাবর্ষণ করে হত্যা করেছে হাজারে হাজারে নিরীহ চিনাকে। সেইসঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বড়ো অংশ জুড়ে জোর করে আফিমের চাষ করিয়ে নিঃস্ব করেছে কৃষকদের, তারপর তাদের পাঠিয়েছে ফিজিতে, আন্দামানে, মরিশাসে, ত্রিনিদাদে, একপ্রকার কৃতদাস হিসেবেই। বাংলায় মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে জমির প্রকৃত মালিককে দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে সেখানে নীলের চাষ করেছে। কলকাতা বন্দরকে তৈরিই করা হয়েছিল এই দণ্ডপ্রাপ্তদের, আর আফিম (Thugs and drugs) বিদেশে চালান দেওয়ার জন্য। এসবেরই ইতিহাস বিশদে উপজীব্য হয়েছে অমিতাভ ঘোষের একেকটা উপন্যাসে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের দেশীয় প্রযুক্তির বিকাশকে ছলে বলে কৌশলে, দরকার হলে বিলেতে পার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন করে ধ্বংস করে দিয়েছে নিজেদের প্রযুক্তির বাজারকে নিরঙ্কুশ করতে।
ব্রহ্মদেশের পটভূমিকায় ইংরেজের নৃশংসতার নানা দিক ‘দ্য গ্লাস প্যালেস’ উপন্যাসে এসেছে। সঙ্গে ভারত থেকে যে সৈনিকদের যেতে বাধ্য করা হয়েছিল ইংরেজের হয়ে সেখানে যুদ্ধ করার জন্য, তাদের বয়ানে পাই কী করে পরাধীন মানুষদের মনোবল, আত্মাভিমান শোচনীয়ভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হত নিষ্ঠুর আচরণের মাধ্যমে। ওই উপন্যাসে, হরিয়ানা থেকে আসা এক সৈনিক শুনিয়েছিল এক কাহিনী।
সা’ব আমি যখন একেবারে বাচ্চা ছেলে, তখন গ্রামের এক বুড়ো এই গল্পটা বলত। মিউটিনির গল্প। বিদ্রোহের শেষে ব্রিটিশরা যখন আবার দিল্লিতে ফিরে এল, শোনা গেল একটা দারুণ জলুষ হবে শহরে। কোটানা থেকে পাঠানো হল বয়স্ক লোকেদের একটা দল। খুব ভোরে বেরিয়ে পড়ে শ’য়ে শ’য়ে লোকের সঙ্গে তারা হাঁটতে থাকল দক্ষিণের খিড়কি দিয়ে পুরনো রাজধানীতে ঢুকবে বলে। অনেকটা দূরে যখন তখনই দেখতে পেল আকাশ পাখিতে পাখিতে কালো হয়ে গেছে। বাতাসে একটা গন্ধ, যত শহরের দিকে এগোচ্ছে তত গন্ধটা জোরালো হচ্ছে। রাস্তাটা সিধে আর জমি সমতল, অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। সামনে একটা অদ্ভুত দৃশ্য। রাস্তার দু’ধারে যেন ভয়ানক লম্বা সব সেপাই সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন একদল দৈত্যাকৃতি সেপাই ভিড় পাহারা দিতে এসেছে। কাছে আসতে তারা দেখল দৈত্য নয়, মানুষ— শূলে বেঁধানো বিদ্রোহী সেপাইদের শরীর। শূলগুলো সার দিয়ে বসানো একেবারে শহর পর্যন্ত। ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ। কোটানায় ফিরে এসে ঐ লোকেরা গ্রামের লোকেদের একজায়গায় জড়ো করল, করে বলল, ‘আজ আমরা হেরে যাওয়ার চেহারা দেখে এসেছি। আমাদের কখনো ওই চেহারা হবে না।’ সেইদিন থেকে কোটানার সব পরিবার তাদের ছেলেদের পাঠাত ইংরেজ সরকারের পল্টনে কাজ করতে।
হরিয়ানার ওই ভয়ার্ত মানুষদেরই কি আজ উত্তর-ঔপনিবেশিক স্বাধীন ভারতের সফল, উন্নতিকামী, কৃতবিদ্যদের মধ্যে দেখতে পাই না? একজন অন্তত দৈত্যাকৃতি সেপাই চোখে পড়ছে, এখনও জীবিত। অবশ্য ইংরিজিতে লেখেন, এসবই বারবার মনে করিয়ে দিতে।
ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে একটা আধুনিক যুগ এসে হাজির হল নানা অবয়বে পৃথিবীর নানা কোণে। সেই গোধূলিসন্ধির নৃত্যে যুদ্ধ আর বাণিজ্যের রক্তে যখন মেতে উঠেছে পশ্চিম, পাশাপাশি ছলে বলে কৌশলে তার শিল্পায়নের মাত্রা যখন প্রতিদিন ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিজেই নিজেকে, অলক্ষ্যে সেদিন থেকেই ঘনাতে শুরু করেছিল আজকের পরিবেশ সংকটের মেঘ। ওঁর সাম্প্রতিকতম বই ‘দ্য গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট’-এ দেখিয়েছেন কত প্রশ্নাতীতভাবে আজকের পরিবেশ সংকটের দায়িত্ব গিয়ে পড়ে সম্পূর্ণতই সেই ঔপনিবেশিক যুগে শিল্পায়ন ও তজ্জনিত আগ্রাসী বাণিজ্যিক স্বার্থান্বেষী সংস্কৃতির ঘাড়ে। শুধু বাতাসে কার্বন নির্গত হওয়ার পরিমাণ নয়, লোভী মানসিকতার বিস্তারও সভ্যতার সেই পর্যায়টারই আজকের পরিণতি।
ঔপনিবেশিক আমলে ভারতীয়দের নিয়ে গঠিত সৈন্যদলের ও নিজেদের শক্তিশালী নৌবহরের সাহায্যে অসহায় চিনের ওপর নামিয়ে আনা হয়েছিল ব্যাপক হত্যালীলা ও অন্যান্য লাঞ্ছনা — পুরোটাই ভারতের কৃষকদের আফিম চাষে বাধ্য করে উৎপন্ন আফিম, ‘মুক্ত বাণিজ্যের নামে’ চিনে প্রবেশ করানোর উদ্দেশ্যে। এই নিয়ে লেখা ওঁর আইবিস ট্রিলজির একটি হল, ‘দ্য ফ্লাড অব ফায়ার’। জাহাজ থেকে গোলাবর্ষণ করে হাজার হাজার অসহায় চিনেকে মেরে ফেলা দেখে বিচলিত হিন্দুস্থানী সৈনিক যখন কৃষ্ণভক্ত নব্-কিষেণকে জিজ্ঞেস করছে, “পণ্ডিতজী, এর অর্থ কী?” সে উত্তর দিচ্ছে, “দেখো: ওই জাহাজের ভিতরে যে আগুন জ্বলছে, তাতে জেগে উঠবে লোভের দৈত্যরা, সকল মানবের মধ্যে যা লুকিয়ে থাকে। এইজন্যই ইংরেজ এসেছে চিনে এবং হিন্দুস্থানে : এত বিশাল এই দুই দেশের জনসংখ্যা যে এদের লোভ জাগ্রত হলে সারা জগতকে তা গ্রাস করে নিতে পারে। সেই বিশাল গ্রাসক্রিয়া আজ শুরু হল। শেষ হবে, যখন সমগ্র মানবসভ্যতা হাতে হাত মিলিয়ে লোভের উন্মাদনায় গিলে ফেলবে এই পৃথিবী, এই বায়ু, এই আকাশকে।”
পরিবেশের কারণে উজাড় হয়ে যাওয়ার মুখে এসে দাঁড়িয়ে এ পৃথিবী এভাবেই টের পাচ্ছে তার ঔপনিবেশিক ইতিহাসের স্বরূপকে।
আইবিস ট্রিলজির প্রথম উপন্যাস ‘দ্য সি অব পপিজ’। ভারতের শাসনভার ছিনিয়ে নিয়ে ইংরেজ কী পরিমাণ লুন্ঠন ও শোষণ করেছিল, তার সামান্য একটু আভাস পাওয়া যাবে এই উপন্যাসে উল্লেখ করা একটি তথ্যে। উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তরপ্রদেশের গৌরীপুরে যে আফিম মজুতের গুদাম ছিল, যে কোনও সময়ে তাতে মজুত থাকা আফিমের মূল্য ছিল সেইসময় মার্কিনদেশের জাতীয় বাজেটের অর্ধেক। উপন্যাসের কাহিনীতে আমরা দেখতে পেয়েছি, সেই ‘আইবিস’ জাহাজে অকারণে কত নিষ্ঠুর, জঘন্য ও অমানবিক ব্যবহার করা হচ্ছিল দ্বীপান্তরে পাঠানো বাঙালি যুবক নীলের সঙ্গে। অথচ নীল ছিল নিরপরাধ। তার মতোই আরও বহু বাঙালিকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়েছিল, তাদের জমিতে নীলচাষ করার জন্য।
পরিবেশ সংকট নিয়ে ওঁর উপন্যাস, ‘দ্য হাংরি টাইড’। সুন্দরবনের ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। যদি সুন্দরবন না থাকে, সামুদ্রিক ঝড়ে কিংবা জলোচ্ছাসে অবিলম্বে শেষ হয়ে যাবে কলকাতা শহরও। অথচ মানুষ অবহিত নয়। সুন্দরবনের অধিবাসীদের জীবনের অর্থনৈতিক কাঠামো পালটে যাচ্ছে, তাতে আরও ত্বরান্বিত হবে সংকটের তীব্রতা, কিন্তু সেকথা একদা-উপনিবেশের মানুষেরা খেয়াল করছে না। আমাদের জানতে হচ্ছে মার্কিনদেশ থেকে আসা গবেষক পিয়ালি রায়ের আগমন উপলক্ষে, প্রয়োজন হচ্ছে দোভাষী কানাই দত্তকে। আজও শুধুমাত্র নিজেদের স্বাধীন, স্বাবলম্বী চেতনায় আমরা আমাদের জীবনের মান কোন পর্যায়ে তা নির্ধারণ করতে পারছি না। প্রকৃতি চমকপ্রদ সব উপায়ে প্রাণীকে আত্ম-সংরক্ষণের উপায় যোগান দেয়। সমুদ্রের শুশুকেরা নদীতে ঢুকে পড়ে কয়েক প্রজন্মে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল নদীর ঘোলাজলে দৃষ্টিশক্তি অকেজো হয়ে পড়ায়। প্রাকৃতিক অভিযোজনে তাদের ক্ষমতা জন্মায় বাদুড়ের মতো প্রতিফলিত শব্দের মাধ্যমে চারপাশের সবকিছুকে পর্যবেক্ষণ করার। কিন্তু মানুষ এত দ্রুত অবনতি ঘটাচ্ছে পরিবেশের যে, এবার বুঝি প্রকৃতি আর তাকে রক্ষা করতে পারবে না।
আধুনিকতার নামে একটা সাংস্কৃতিক ঘেরাটোপ তৈরি করে, তার ভিতরে জন্ম নেওয়া নানা চিন্তাধারায় আবিষ্ট করে আমাদের মনোজগত যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে পশ্চিমের অর্থনৈতিক স্বার্থ, তাতে ঐ ঘেরাটোপটার বাইরে বেরিয়ে প্রত্যক্ষভাবে আমাদের অভিজ্ঞতার প্রতিবিম্ব যখন দেখি কোনও লেখায়, বিশেষ করে যদি সেই লেখার নাগাল হয় সবগুলো মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত, আমাদের কেমন অবাক লাগে। সেইটেই বারবার ঘটে অমিতাভ ঘোষের লেখা পড়তে গিয়ে। ‘ড্যান্সিং ইন কাম্বোডিয়া অ্যাট লার্জ ইন বার্মা’ নামের বইতে লিখেছিলেন,
ইতিহাসেরই বিরুদ্ধে ঘোষণা করা এক যুদ্ধ…মধ্যবিত্তের ওপর পরিকল্পিত ও বিরামহীনভাবে আক্রমণ নামিয়ে আনা…যদি সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা আদৌ কিছু প্রমাণ করে থাকে, তবে শেষ পর্যন্ত তা হল যে মধ্যবিত্তকে কখনো ধ্বংস করা যায় না, কিছুতেই ধ্বংস করা যায় না তার হার না মানা অসাধারণ প্রতিরোধকে, সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে জ্ঞান ও অভিব্যক্তির নিজস্ব ধরনকে টিঁকিয়ে রাখার ক্ষমতাকে।
মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ও মুক্তির নামে বিচ্ছিন্নতাকামিতার যাথার্থ্য নিয়ে এক চরিত্রের মুখে বসিয়েছিলেন,
…আমি মনে মনে ভাবি, সমস্ত উপমহাদেশ জুড়ে ছোটছোট রেখা টেনে, কেন নতুন নতুন নাম দেওয়া হচ্ছে না? এতে কোন পরিবর্তনটা আসবে? এ এক মরীচিকা; পুরো ব্যাপারটাই একটা মরীচিকা। স্মৃতিকে কীভাবে কেউ ভাগ করবে?
কেমন থমকে যেতে হয় না, পড়লে?
পরিবেশ সংকটের মোকাবিলায় সাফল্যের সম্ভাবনা দ্রুত কমে আসছে। সেই নিয়ে ‘দ্য গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট’-এ লিখেছেন,
If a significant breakthrough is to be achieved, if the securitization and corporatization of climate change is to be prevented, then already existing communities and mass organizations will have to be in the forefront of the struggle. And of such organizations, those with religious affiliations possess the ability to mobilize people in far greater numbers than any others. Moreover, religious worldviews are not subject to the limitations that have made climate change such a challenge for our existing institutions of governance: they transcend nation states, and they all acknowledge intergenerational, long-term responsibilities; they do not partake of economistic ways of thinking and are therefore capable of imagining non-linear change—catastrophe, in other words—in ways that are perhaps closed to the forms of reason deployed by contemporary nation states. Finally, it is impossible to see any way out of this crisis without an acceptance of limits and limitations, and this in turn, is, I think, intimately related to the idea of the sacred, however one may wish to conceive of it.
অমিতাভ ঘোষের উপন্যাসগুলো এক এক করে পড়তে শুরু করুন। ভাষার সৌন্দর্যে, কাহিনী বুনন ও চরিত্র কল্পনার দক্ষতায়, বিশ্বাসযোগ্যতায়, অচিরেই পাঠককে নেশাগ্রস্ত করে তোলে। ওঁর উপন্যাস পাঠের অনুভূতিই আলাদা। আমি কেবল বিষয়বস্তু, প্রকল্প, এগুলোর সামান্য আভাস দিয়ে রাখলাম। এগুলোর অতিরিক্তও অনেক প্রাপ্তিই ঘটবে প্রত্যেকটি পাঠকের ক্ষেত্রেই। হ্যাঁ, পৃথিবী জুড়ে অন্যান্য যেসব মনীষীপ্রতিম চিন্তকদের সম্প্রতি পড়েছি, কেমন যেন তাঁদের অনেকের সঙ্গেই হয়তো ঠিক মিলবে না ওঁর কথাগুলো। অ্যাকাডেমিয়ার পবিত্র স্বাধীনতা বিরাজিত অঙ্গনেও এই কথাগুলো খুব স্বস্তিকর শোনায় কি? উনি কি একটু একা হয়ে পড়ছেন? আইবিস ট্রিলজিতেই লিখেছেন,
Thoughts, books, ideas, words – if anything, they make you more alone, because they destroy whatever instinctive loyalties you may once have possessed.