গৌতম চক্রবর্তীর লেখা

গৌতম চক্রবর্তী 

 

দীর্ঘদিন পরে আবার উত্তাল পাহাড়। পাহাড়ের সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছেন তাঁদের বহুদিনের পুরনো দাবী সামনে রেখে। গোর্খাল্যান্ড। এর আগেও বহুবার এই একই দাবীতে বার বার উত্তাল হয়েছে পাহাড়। হয়েছে নানা আন্দোলন। প্রতিবার কঠোর হাতে দমন করা হয়েছে পাহাড়ের মানুষের সেই স্বপ্ন, নানা প্রলোভনে বিক্রি হয়ে গেছে আন্দোলনের নেতারা। বহু রক্ত ঝরেছে, আরও ঝরবে নিশ্চিত। মানুষের বুকের ভিতর ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা স্বপ্ন নেভাতে পারে না কোনও রাষ্ট্রশক্তি। ইতিহাস তার সাক্ষী।

প্রায় ২৩ বছর আগে চাকরি করার সময় প্রথমবার পা রেখেছিলাম দার্জিলিং-এ মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। শিলিগুড়ি ছাড়াতেই দৃশ্যপট বদলে গেছিল, বদলে গিয়েছিল আবহাওয়া। অবিশ্বাস্য লেগেছিল, সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ যা ছিল আমার কল্পনার বাইরে। ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন আবহাওয়া। একবারও মনে হয়নি এটা আমারই রাজ্য। তারপর ব্যবসাসূত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছি পাহাড়ের সাথে, বিগত ২০ বছর ভীষণ কাছ থেকে দেখেছি মানুষগুলিকে। তাঁদের ভালো মন্দ হাসি কান্না, তাঁদের জীবনযাত্রার সাথে মিশে গেছি অঙ্গাঙ্গীভাবে। সহজ সরল কিছু মানুষ, একেবারে সোজাসাপ্টা। আনন্দ দুঃখ হাসি কান্না বন্ধুত্ব শত্রুতা সব কিছুতেই বড্ড প্রকট। সমতলের জটিলতার ধার ধারেন না বিন্দুমাত্র।

দার্জিলিং লাভা রিশপে লিজে হোটেল চালাতাম প্রথমে। প্রথম প্রথম একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতেন তাঁরা। রাজনীতি নিয়ে আলোচনা শুরু হলেই ভীষণ অস্বস্তির সাথে পাশ কাটিয়ে যেতেন। একটু একটু করে সেই বাধা কেটেছে। প্রাণ খুলে মিশেছি আমরা। বদলেছে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি। নানা প্রশ্ন করেছি, ঝগড়া করেছি দিনের পর দিন। ধীরে ধীরে আবেগ ছাপিয়ে যুক্তি প্রাধান্য পেয়েছে।

৯০ লক্ষ গোর্খার বাস ভারতবর্ষে। দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে তাঁরা নেপালি হিসাবেই পরিচিত। শুধু যুদ্ধের সময় গোর্খারা সাময়িক পিঠ চাপড়ানি পান, অন্য সময় বাহাদুরের বেশী সম্মান দেওয়া হয় না তাঁদের। তাছাড়া কথায় কথায় নেপালে পাঠানোর হুমকি তো আছেই সমতলের দেশপ্রেমী মানুষদের থেকে। অথচ কার্গিল যুদ্ধের সময় এই গোর্খা যুবকেরাই ঘিরে ফেলেছিল দার্জিলিং-এর সেনানিবাস। দাবী ছিল ১৫ দিনের ট্রেনিং আর হাতিয়ার দিয়ে পাঠাতে হবে ফ্রন্টে। না, বিনিময়ে চাকরি বা অন্য কোনও সুযোগসুবিধার দাবী নেই। তাঁদের সরাতে গুলি পর্যন্ত চালাতে হয় সেনাকে। জানা নেই ভারতের আর কোনও প্রান্তে অনুরূপ কোনও ঘটনা ঘটেছিল কিনা।

একটা সামান্য চাকরীর পরীক্ষা দিতেও পাহাড়ের মানুষগুলিকে আসতে হয় কোলকাতায়। পাসপোর্ট বানানো বা হাই কোর্টের মামলার জন্যও সেই কোলকাতা। যে কোনও সরকারী গুরুত্বপূর্ণ অফিস বা কাজও সেই এক দিনের পথ। এমনকি পাহাড়ের মানুষের উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি হয় কোলকাতার ঠাণ্ডা ঘরে বসে। যাদের পাহাড়ের সংস্কৃতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ, বা চাহিদার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। যুগ যুগ ধরে এমনটাই ঘটে আসছে পাহাড়ের মানুষগুলির সাথে।

ব্যবসাসূত্রে ঘনিষ্ঠতা আছে পাহাড়ের সব জনজাতির মানুষের সাথেই। লিম্বু লেপচা ভুটিয়া তামাং গোর্খা রাই ইত্যাদি। প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা থাকলেও সবাই নেপালি ভাষাকেই ব্যবহার করেন প্রধান ভাষা হিসাবে। এমনকি বর্তমান প্রজন্ম নেপালি ছাড়া অন্য ভাষায় স্বচ্ছন্দও নন। সকলেই নিজেকে গোর্খা পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এটা একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। সেখানে সমতলের মতো জাত ধর্মের ভাগাভাগির বিন্দুমাত্র আভাষ পাইনি কোনওদিন। বরং ভিন্ন জাত বা ধর্মের মানুষের বিয়ে সেখানে অতি সাধারণ ব্যাপার। আর নামটা গোর্খাল্যান্ড না হয়ে দার্জিলিং প্রদেশ হলেও রাজ্যভাগে বাঙালির বিরোধিতা বিন্দুমাত্র কমবে বলে মনে হয় না।

ইতিহাসের কচকচানিতে বেশী যাব না। (সতের’শ আশির আগে এ অঞ্চল ছিল সিকিমের চোগিয়ালদের। নেপালের গোর্খারা বারে বারে আক্রমণ চালিয়ে দার্জিলিং-এর পার্বত্য অঞ্চল অধিকার করার চেষ্টা করে গেছে। নাইন্‌টিন্থ সেঞ্চুরির প্রথমে ওরা সিকিমের পুব দিকে তিস্তার পার পর্যন্ত অধিকার করে তরাইকেও ওদের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল। এবার আসরে নামল বৃটিশরা। নর্দার্ন ফ্রন্টিয়ারে নেপালের এই এগিয়ে যাওয়া বন্ধ করার জন্য আঠার’শ চোদ্দতে শুরু হল অ্যাংলো-গোর্খা লড়াই। গোর্খারা হেরে সুগৌলি চুক্তি করল আঠার’শ পনেরোতে। চুক্তি অনুযায়ী গোর্খারা সিকিমের যে সব অঞ্চল দখল করেছিল, সব ছেড়ে দিতে হল বৃটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিতে। প্রধানত অঞ্চলটা ছিল মেচি আর তিস্তার মধ্যবর্তী অঞ্চল। এরপর আঠার’শ সতেরোর তেতুলিয়া চুক্তি অনুযায়ী অঞ্চলগুলো বৃটিশরা আবার ফেরত দিয়ে দিল সিকিমরাজকে। ওদের নিশ্চিত করল– ভয় নেই, তোমাদের দেখভালের জন্য আমরা আছি। এরপর আঠার’শ পঁয়ত্রিশে সিকিমরাজ দার্জিলিং উপহার দিল বৃটিশ কোম্পানিকে। আঠার’শ চৌষট্টির সিঞ্চুলা চুক্তিতে ভুটান-ডুয়ার্স, কালিম্পং কোম্পানিকে দিয়ে দিল ভুটান। বারো’শ চৌত্রিশ বর্গমাইল এরিয়া নিয়ে তৈরি হল দার্জিলিং জেলা। এই তো দার্জিলিং-এর ইতিহাস।– বিপুলদার, অর্থাৎ সাহিত্যিক বিপুল দাসের লেখা।) প্রশ্ন হল এখানে বাঙালিদের ইতিহাস কোথায়? পাহাড় কেটে বসতি বানিয়ে নগর গড়েছে কারা? শুধু প্রশাসনিক সুবিধার জন্য যে ভূখণ্ড একদিন জুড়ে দেয় ব্রিটিশেরা, সেটা কী যুক্তিতে বাঙালির অধিকার? দার্জিলিং আলাদা রাজ্য হলে সেটা কী ভাবে বঙ্গভঙ্গ হয়?

পরিশেষে একটাই বক্তব্য, গোর্খাল্যান্ড কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয়, একটা স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবী মাত্র। ভারতের ৯০ লক্ষ গোর্খার আত্মপরিচয়ের জন্য সংবিধান সম্মত এক ন্যায্য দাবী। জাতি হিসাবে বাঙালি কোনওদিন কারও অধীনতা মেনে নেয়নি। মহাভারতের অর্জুনও এই এলাকায় ঢোকার সাহস দেখাননি। মুঘল আমলে বারো ভূঁইয়া থেকে ইংরেজ আমলে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালির নাম সবার আগে আসে। ওপার বাংলাতেও ভাষার জন্য ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাঙালি গড়েছে বাংলাদেশ। সেই বাঙালিই যখন অন্য এক জনজাতির মানুষকে তাঁদের ন্যায্য দাবী থেকে বঞ্চিত করে নিজের অধীনস্থ করে রাখে তখন সেটার প্রতিবাদও জরুরী প্রকৃত বাঙালি হিসাবে। এক গর্বিত বাঙালি হিসাবে আমি গোর্খাল্যান্ডের দাবী সমর্থন করি।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

  1. তবে যদি সবার স্বাশাসন ও আলাদা রাজ্যগঠনের দাবী একের পর এক মেনে নিতে হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আরো অনেক অনেক টুকরোয় ভেঙে পড়বে না? লেখক কি বলেন?

  2. গোর্খাল্যান্ড একটি ন্যায্য এবং দীর্ঘকালীন দাবী। শুধু ইগো নিয়ে বসে থাকলে বাংলা ভুল করবে।

আপনার মতামত...