ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য
‘উদ্বাস্তু’ কথাটার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ছোটবেলাতেই। যাদবপুর বা বাঁশদ্রোণীর নানান কলোনির নাম তো কানে আসতই। এছাড়াও বাড়ির খুব কাছেই ছিল বাস্তুহারা বাজার। তবে সে যাই হোক কেন, মানুষের ভিটেছাড়া হওয়ার কারণ বলতে একটা ব্যাপারকেই বুঝতাম– দেশভাগ।
অথচ এই দেশভাগের কষ্ট আমার পরিবার তেমন করে ভোগ করেনি। ১৯৩৭-এই আমার ঠাকুরদা (আর সম্ভবত তাঁর ভাই) ফরিদপুর কোটালিপাড়ার সিদ্ধান্তবাড়ির ভিটে বিক্রি করে দিয়ে কলকাতায় চলে আসে। শুনেছি সেই বাড়ি আর নেই। ভেঙে অন্য বাড়ি উঠেছে। তবে বুড়োশিবের মন্দির ছিল একটা– সেই শিবই না কি এখন শিবরাত্রের সলতে হয়ে রয়ে গেছেন। শুনেছি ওই মন্দির-সংলগ্ন মাঠে এখনও চড়কের মেলা লাগে।
তবে হ্যাঁ, ভিটেছাড়া হওয়া ছাড়াও কষ্ট অনেক রকমের ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে-পরেই দেশভাগের ধাক্কা গোটা বাংলার নাভিশ্বাস তুলেছিল। সেই কষ্ট সকলের মতন আমাদের পরিবারও পেয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে উদ্বাস্তুদের কষ্টের কোনও তুলনাই চলে না।
উদ্বাস্তুদের নিজের চোখে প্রথম দেখেছি সিনেমায়। ‘ছিন্নমূল’-এই সম্ভবত। এর আগে দুর্ভিক্ষের ছবিটবি দেখে মানুষের দুর্দশা সম্বন্ধে একটা ঝাপসা ধারণা হয়েছিল। মায়ের শিক্ষায় ‘ঠাকুরের পাপ’-এর ভয়ে খাবার ফেলার সাহস পেতাম না। ‘ফ্যান দাও মা’-র একটা ছবি, মায়ের কথা শুনেই, খুব জোরদার গেঁথে গেছিল মনে। সেই ছবি মনে পড়লে ভয়ে শিউরে উঠতাম। কিন্তু ‘ছিন্নমূল’-এর আগে উদ্বাস্তু আমি দেখিনি বা ভাবিনি। শুনেছি শুধু। ‘উদ্বাস্তু’। আর তাদের কষ্টের একটা ঝাপসা আভাস পেয়েছি শুধু।
এই শব্দটা আবার নতুন করে চিনিয়ে দিল তিন বছরের আলান কুর্দি। আধা-বালি-আধা-জলে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে থাকা অপরূপা ভূমধ্যসাগরতীরে লাল জামা নীল প্যান্ট আলান কুর্দি। দেখে প্রথমে মনে পড়েছিল-– আমার ছেলের একটা ওইরকম লাল জামা ছিল। ছোট খেলনাপকেট লাগানো। ২০১৫ সালের কথা।
আমরা সিরিয়ার কথা জেনেছি পশ্চিমী প্রেসের থেকে। মায়ানমার, কঙ্গো বা সোমালিয়ার কথা জানতে পারিনি তেমন। জানতে পারিনি সুদানের কথাও। ইউ এন রিফিউজি এজেন্সির তথ্য বলছে-–
–সারা দুনিয়ায় ভিটে থেকে উৎখাত হওয়া শরণার্থী মানুষের সংখ্যা ৬.৫৬ কোটি
–উদ্বাস্তুর সংখ্যা ২.২৫ কোটি, যার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি আঠেরো বছরের কম বয়সী
–নিজের দেশ, নাগরিকত্ব বা নাগরিক সুযোগসুবিধে বলতে কিছু নেই, এমন মানুষের সংখ্যা ১ কোটি
UNHR আরও বলছেন-– উদ্বাস্তুদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ এসেছেন সিরিয়া, আফঘানিস্তান আর দক্ষিণ সুদান থেকে। এও বলছেন-– “We are now witnessing the highest levels of displacement on record.” UNHR-এর কথায়-– আমাদের সভ্য পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে ২০ জন করে মানুষ গৃহহীন হচ্ছেন।
এইখানে শরণার্থী বা গৃহহীন (displaced people) এবং উদ্বাস্তুদের মধ্যেকার পার্থক্যটা একটু নজর করা যাক।
জাতিসংঘের ১৯৫১-র রিফিউজি কনভেনশনে গৃহীত সংজ্ঞা অনুযায়ী উদ্বাস্তু তাঁরাই, যাঁরা নানান ভয়-আশংকার কারণে নিজেদের দেশ ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। আর শরণার্থী তাঁরা-– যাঁরা নিজের ভিটে ছেড়েছেন বটে, তবু স্বেচ্ছায় নিজের দেশ ছাড়েননি।
খবরের কাগজে নিত্য পড়ি, কিভাবে শরণার্থীরা ভীড় করছেন ইয়োরোপ বা অন্যান্য দেশে যাবার জন্য। এও দেখি– কিভাবে নানান সামাজিক অপরাধের দায় তাঁদের ওপর ন্যস্ত করা হয় প্রাপ্য সুযোগসুবিধা থেকে তাঁদের বঞ্চিত করবার জন্য। মানুষ হিসাবে যেটুকু প্রাপ্য তার পাট তো আগেই চুকেছে। এবার নাগরিক হিসাবে প্রাপ্যটুকুও কেড়ে নেবার জন্য ভদ্রজন মরিয়া হয়ে ওঠেন। কিন্তু এটা দেখি না-– বিশ্বব্যাপী শরণার্থীদের ভীড় সবথেকে বেশী সামাল দিচ্ছে যে সব দেশ, তাদের মধ্যে প্রথম ছয় দেশ হল তুরস্ক, পাকিস্তান, লেবানন, ইরান, উগান্ডা আর ইথিওপিয়া।
সব শেষে এইটুকু বলার– ২০১৬ সালের হিসেবে আমাদের দেশে হিংসা আর হানাহানির কারণে শরণার্থী হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় আট লক্ষের কাছাকাছি, যার মধ্যে এক ২০১৬ সালেই গৃহচ্যুত হয়েছেন প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মানুষ। এছাড়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণেও ঘর হারিয়েছেন অনেকে। তাঁদের কথা স্বতন্ত্র। এই আট লক্ষ মানুষের সিংহভাগ উৎখাত হয়েছেন হয় জম্মু ও কাশ্মীর থেকে, নয়তো আসাম থেকে। বাকীরা? রাজনৈতিক হানাহানিই কি এর কারণ?
২০ জুন চলে গেল আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু দিবস। এই ‘সুযোগে’ আলান কুর্দি, তার রোহিঙ্গিয়া ভাইবোন আর সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত মৃত ও জীবন্মৃত উদ্বাস্তু আর শরণার্থীদের সামনে স্বীকারোক্তি করে রাখলাম-– ভয়ে আছি। ভীষণ ভয়ে।
তথ্যঋণ –
১) http://www.unhcr.org/
২) http://www.internal-displacement.org/database/
৩) ইকোনমিক টাইমস, মে ২২, ২০১৭ এবং জুন ১৯, ২০১৭
আসলে কি জানেন, ‘সৃষ্টির মনের কথা মনে হয় দ্বেষ।’ আরো লক্ষ লক্ষ আলান কুর্দির মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা দেহের ফটোগ্রাফ অপেক্ষা করে আছে।
বাঃ! তাহলে তো আর ভেবে লাভ কী! ‘সৃষ্টির মনের কথা…!!’