শুধু বই নয়, টই-তেই মেলা টইটম্বুর

বই

সুরজিৎ সেন 

 

আমাদের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর লেখা ৭টি বই দিয়ে এবারের কলকাতা বইমেলা উদ্বোধন করেছেন, এই নিয়ে তাঁর বইয়ের সংখ্যা হল ৮৭। এতে পুস্তকপ্রেমীদের মনে হতে পারে যে, বইমেলা মানেই মেলা বই। ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়, মেলায় গিয়ে দেখলুম, বই ছাড়াও টই-এরাও আছে। গয়নার দোকান, গুঁড়ো মশলার দোকান, ফিল্ম প্রোডিউসারের দোকান, আচারের দোকান, এডুকেশন ব্যবসার দোকান, ব্রডব্যান্ড ব্যবসার দোকান, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যানেজমেন্ট পড়ানোর ব্যবসার দোকান আর যত্রতত্র জুটেছে পরিবেশবান্ধব জুটের ব্যাগের দোকান। বাকি রইল গর্ভপাতের ক্লিনিক, নার্সিংহোম আর ফার্টালিটি ক্লিনিক, এই সব স্টলগুলো হলেই বইমেলার ১৬ কলা পূর্ণ হবে। আগে ফুড জোন বলে একটা ব্যাপার ছিল, এখন সেটা ছাড়াও বইয়ের স্টলের পাশেই বিখ্যাত ব্র্যান্ডের খাবার পাওয়া যাচ্ছে। আর আছে শব্দদূষণ। সরকারি মণ্ডপের সামনে সারাক্ষণ সরকারি তালিকাভুক্ত লোকশিল্পীরা গান গেয়ে যাচ্ছেন উচ্চস্বরে। এছাড়াও গিল্ডের মাইকেও সারাক্ষণ গান বেজে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে একটা ক্যাকোফোনি চলছে আর চলছে মেলায় আসা মানুষের সেলফি তোলার উন্মাদনা। এই হল বইমেলা ২০১৯, যার এবছরের থিম গুয়াতেমালা, কেন কে জানে!

আমার ধারণা বইয়ের সঙ্গে পাঠকের একটা নিভৃত মানসিক ও শারীরিক সম্পর্ক আছে। সেটা একধরনের যৌনসম্পর্ক বলেই আমি মনে করি। এটা বইমেলায় ব্যাহত হচ্ছে।  আজ নয়, অনেকদিন ধরেই হচ্ছে।

ঘুরতে ঘুরতে সন্ধের অন্ধকারে হঠাৎ দেখি সারি সারি নীল পলিমারের টাবের ভেতর ভর্তি সাদা তরলের প্যাকেট। আমার মতো নষ্টচরিত্রের মানুষ ভেবেছে বাংলা মদের পাউচ বিক্রি হচ্ছে, যেমন ভিআইপি রোডের ধারে হয়। অত্যন্ত উল্লাসে কাছে গিয়ে জানলাম, ওগুলো পানীয় জলের প্যাকেট এবং ফ্রিতে দেওয়া হচ্ছে। এটা খুবই ভালো ব্যাপার যে, জলের মতো প্রয়োজনীয় একটি পানীয় সরকার ফ্রিতে দিচ্ছে। আমি অবশ্য মদ না পেয়ে খুবই হতাশ হয়েছি।

এবার বইপত্তরের কথা কিছু বলতেই হয়, বিষয়টা যখন বইমেলা। ভাষাবন্ধনে পাওয়া যাচ্ছে মিখাইল বুলগাকভের ‘মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা’র বাংলা অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন অরুণ সোম, যাঁর চেয়ে নির্ভরযোগ্য রুশ থেকে বাংলা অনুবাদ আর কারও থেকে আশাই করা যায় না ননী ভৌমিক, কামাক্ষীপ্রসাদ আর সমর সেনের মৃত্যুর পর। নিষাদ প্রকাশ করেছে গ্রাফিক নভেল, আমাদের পরিচিত টিনটিনের গল্পের আদলে, নাম: দ্য হাউস অফ সিলভিও; লেখক: সত্রাজিৎ চৌধুরি। বঙ্গীয় ভূগোল মঞ্চ বাংলা তথা ভারতের ভূগোল নিয়ে কিছু দরকারি বই প্রকাশ করেছেন। অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় ভূগোল বাঙালি শিক্ষিত সমাজে তেমন কল্কে পায় না। আশা করি, বাঙালির এই ভুল একদিন ভাঙবে। কৌরব প্রকাশ করেছে তাদেরই পত্রিকায় প্রকাশিত উদয়ন ঘোষের যাবতীয় গদ্যের সংকলন। উদয়ন ঘোষের মতো গদ্যকারকে বাংলা ভাষার পাঠক যাতে ভুলে না যায়, তার জন্য এই উদ্যোগ। কৌরবকে ধন্যবাদ। ঋত প্রকাশ করবে জীবনানন্দের ডায়ারি (সম্পাদনা: গৌতম মিত্র), জীবনানন্দের পাঠকেরা যার জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে আছেন। মনফকিরাতে পাওয়া যাচ্ছে মীরা মুখোপাধ্যায়ের দুটি বই, বিশ্বকর্মার সন্ধানে এবং বস্তারের দিনলিপি, মীরা মুখোপাধ্যায়কে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম, তাঁর শিল্পকর্ম ও শিল্পভাবনাকে বুঝতে এই বই দুটি অবশ্য পাঠ্য, যে মীরা মুখোপাধ্যায় বাংলার শিল্পী সমাজে খানিকটা ব্রাত্যই ছিলেন তাঁর শিল্পকর্মের কারণে। তালপাতা প্রকাশ করেছে সুভো ঠাকুরের বিস্মৃতিচারণা, যে সুভো ঠাকুর তাঁর ঠাকুর পরিবারের যাবতীয় ঐতিহ্য ঝেড়ে ফেলে জোড়াসাঁকো থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। সাহিত্য অকাদমিতে পাওয়া গেল রামপ্রসাদী বইটি, খুবই গুরুত্বপূর্ণ বই, শুধু বাংলা নয়, ভারতীয় ভক্তি সাহিত্যের সঙ্গে রামপ্রসাদের গানের গভীর যোগ রয়েছে, রামপ্রসাদের গানের টীকা ও প্রসঙ্গ নিয়ে বইটি সম্পাদনা করেছেন সর্বানন্দ চৌধুরী। রূপার দুটি বই, ১) স্টোরিজ অ্যান্ড এসেজ ইন আ ভায়োলেন্ট ল্যান্ড সমকালীন ভারতের একটি জরুরি দলিল আর ২ ) সীমা আনন্দের দ্য আর্টস অফ সিডাকশন, যাঁরা এই রসের রসিক তাঁদের ভাল লাগবে।

এই হল বইমেলার ঝাঁকিদর্শন। তবে একটা জিনিস দেখলাম, এত লোক, এত আয়োজন, এত আওয়াজের মধ্যে বই খানিকটা নিঃসঙ্গই হয়ে পড়েছে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4881 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...