মৃণাল সেন সম্বন্ধে দু’টি বা তিনটি কথা যা আমি জানি

মৃণাল

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

 

 

 

লেখক চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ, সাংস্কৃতিক ভাষ্যকার।

 

 

জাঁ লুক গোদার যেভাবে বলে থাকেন, ‘তাঁর বিষয়ে দু’টি বা তিনটি কথা যা আমি জানি’, তেমনভাবেই মৃণাল সেন বিষয়ে আমি কয়েকটি মন্তব্য করতে পারি। মন্তব্য অর্থে এটা কোনও পর্যবেক্ষকের মন্তব্য নয়, বরং আমার মনে হয় আমরা যারা মৃণাল সেনের ঈষৎ তরুণ ও পরবর্তীকালের সহযোগী ছিলাম, তারা মৃণালকে কেন মনে রাখব, তার একটা সদুত্তর খোঁজার জন্য আমার এই কাটাকুটি এবং চিরকুট জরুরি।

প্রথমত, মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রের কথা ভাবলে যা মনে আসে তা হল মৃণাল সেন মধ্যবিত্ততার নির্বিকল্প স্থপতি। তার কারণ শুধু এই নয় যে তিনি সবসময় মধ্যবিত্তদের নিয়ে ছবি করেছেন। আপাতত এই বিষয়টি নিয়ে তুলনামূলক আলোচনার স্বার্থে, একটা রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে আমরা বাংলা চলচ্চিত্রের একটি নির্দিষ্ট বছর, ১৯৬০-কে তুলে নিই। আমরা দেখব, ১৯৬০ এই বছরটা শুরু হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ দিয়ে, তারপর এপ্রিলে অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে এল ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’, অগস্টে এল মৃণাল সেনের ‘বাইশে শ্রাবণ’, এবং বছরশেষে, সম্ভবত নভেম্বরে এল রাজেন তরফদারের ‘গঙ্গা’। চারটিই ভালো ছবি। কিন্তু এই ছবিগুলির মধ্যে তফাতটা কোথায় ছিল? তফাত এই যে, সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ দেখলে এখন আমাদের মনে হয় যে সত্যজিৎ উপেন্দ্রকিশোরের নাতি হিসেবে বা সুকুমারের ছেলে হিসেবে জীবনের প্রথম থেকেই উনিশ শতকীয় আলোকপ্রাপ্তির মধ্যেকার একধরনের দ্বন্দ্ব এবং সংশয় খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। সেই দ্বন্দ্ব ও সংশয়েরই একটা নিরসনপর্ব আমরা দেখি পরবর্তীকালের শহরত্রয়ীতে— যেখানে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘সীমাবদ্ধ’ বা ‘জন অরণ্য’-তে তিনি তীব্রভাবে মধ্যবিত্তকে আক্রমণ করলেন। কিন্তু এই আক্রমণের একটা পরিপ্রেক্ষিত, পূর্বপশ্চিম বা আদিঅন্ত ঠিক করা যায়। একদিক থেকে দেখলে সত্যজিতের ছবিসমূহ উনিশ শতকের চেতনার মধ্যেকার একধরনের অসহায়তা, জীর্ণতা ও অপূর্ণতার প্রকাশ।

এরপর ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ আমরা যদি দেখি, তাহলে তো আমরা বুঝতেই পারি যে কিংবদন্তী ও সাম্প্রতিকতার মধ্যে দাঁড়িয়ে ঋত্বিক কীভাবে নাশকতার দেবদূত হয়ে কাজ চালিয়েছেন এবং সেই কাজ করতে গিয়ে মধ্যবিত্তের বিশ্বাস ও পলকা নিরাপত্তার যে বাতাবরণ তা তিনি ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন৷

যদি আমরা একেবারে শেষে চলে যাই, রাজেন তরফদারের ‘গঙ্গা’ দেখি, তাহলে তাতে ভিসকন্তির ‘লা তেরা ত্রেমা’-র মতোই মাঝিমাল্লাদের আকাঁড়া জীবন ও বাস্তবতা আমরা খানিকটা হলেও দেখতে পাই। অন্তত আমরা বুঝতে পারি পরিচালকের উদ্দেশ্য কী ছিল, অবশ্য তার কতটা তিনি বাণিজ্যিক বিধিনিষেধের মধ্যে থেকে করে উঠতে পেরেছেন তা স্বতন্ত্র।

পাশাপাশি মৃণাল সেন, যিনি আজ আমাদের আলোচ্য, তাঁকে দেখলেই বোঝা যায় যে আকাল তাঁর বিষয় নয়, বরং আকালের পরোক্ষ প্রভাবে আমাদের প্রেম বিষয়ক ধারণাটি কীভাবে রূপান্তরিত হয়, আমরা কীভাবে মধ্যবিত্ত সংকট থেকে একটি তুচ্ছ দম্পতির মিলনরজনীকে দেখতে পাচ্ছি, বস্তুত এটাই মৃণালের দেখার বিষয় ছিল। এমনকি তার আগের ছবি ‘নীল আকাশের নীচে’ যা নানা কারণে বিখ্যাত হয়েছিল তা অবশ্য আমার মনে হয় আজ আর কোনও দামি প্রসঙ্গই নয়। এখানে কাবুলিওয়ালার ধাঁচে গল্প-বলা, ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’ রাজনীতি, বা জওহরলাল নেহেরুর কোটনিস মিশনের কথা ভেবে লাভ নেই। বরং এখানে দুজন মানুষ, একজন চিনা আগন্তুক ফেরিওয়ালা এবং আরেকজন ভারতীয় মহিলা যে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবীদের সমর্থন করেন, এই দুজনের মধ্যে এক সম্প্রসারিত মাত্রার যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি। বাঙালি মধ্যবিত্তরা যে ঘরের ভেতরে থেকেও একধরনের বিশ্বজনীনতা আবিষ্কার করতে চায়, তা দেখানোর চেষ্টা মৃণাল আজীবন করেছেন। ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিতে মৃণালের এই যে প্রয়াস, এবং ১৯৯১ সালে যখন তাঁর ‘মহাপৃথিবী’ ছবিতে মধ্যবিত্তের ঘরের মধ্যে বার্লিনের দেওয়াল ভেঙে পড়ল, তা সেই একই চেষ্টার অনুবর্তন। মধ্যবিত্তদের চোখ দিয়ে বিশ্বকে দেখার এই যে সাধনা তা মৃণাল সেনকে অনন্য করেছে। কারণ ‘কলকাতা ৭১’ থেকে শুরু করে ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘একদিন অচানক’ এমনকি ‘আকালের সন্ধানে’ ছবিগুলিতে ধর্ম বা পাপ, পুণ্য বা সংকট যা-ই মৃণাল সেন দেখান না কেন, তা সবই এক বিশেষ মধ্যবিত্ত দোলাচল থেকে। তিনি কোনও প্রশ্নেরই পূর্ণ সমাধান দেওয়ার বা এক দার্শনিক ইতিবৃত্ত খোঁজার চেষ্টা করেন না। পূর্ণ সমাধান এক্ষেত্রে জরুরিও নয়। কিন্তু মধ্যবিত্তদের সবসময় একটা উদ্দেশ্য থাকে সব জিনিশের একটা পূর্ণ গোলাকার বিকল্পহীন সমাধান খোঁজা, ব্যর্থ হওয়া এবং সেই ব্যর্থতাগুলোকে নথিবদ্ধ করা। মৃণাল সেন সেগুলিকে দ্বান্দ্বিকতায় তাড়িত করেছেন। তাঁর ‘ভুবন সোম’ তো আপাদমস্তক মধ্যবিত্তদের ব্যর্থতা ও সাফল্য নিয়ে তোলা ছবি। ‘ভুবন সোম’-এর মতো এমন তীব্র ও করুণ আমলাতন্ত্র আর কোথাও এইভাবে প্রকাশিত হয়নি। যেমন ‘আকাশকুসুম’-এর যে তরুণটি প্রণয়িনীকে ঠকায়, এই ঠকানোটাও যে মধ্যবিত্তের নিজস্ব অধিকার তা মৃণাল সেন জানেন। তাই মৃণাল সেন-এর সমস্ত ছবিই আসলে মধ্যবিত্তের এক ধরনের আত্মজীবনী, সফল হোক, বা ব্যর্থই হোক, তা এক আত্মরতির পরিণাম।

একইভাবে ‘খারিজ’ ছবিটি একদিক থেকে দেখলে মৃণাল সেনকে পড়ার এক আদর্শ উপক্রমণিকা হতে পারে। যে মধ্যবিত্তকে মৃণাল সেন সনাক্ত করেন, সে একইসঙ্গে স্বর্গ ও নরকের বাসিন্দা। এই পর্যন্ত মৃণাল সেনকে আমরা চিনতে পারি, যে তিনি এই জগতেরই শরিক। এই জগত থেকেই উনোনের ধোঁয়া উড়িয়েছিলেন ‘সর্বজয়া’ ‘ইন্টারভিউ’ ছবির শুরুতে। এই জগতের মানুষই ম্যানিকিনকে বিবস্ত্র করে, কিন্তু একইসঙ্গে নিজেও বিবস্ত্র হয়। আমরা এক্ষেত্রে বলব মৃণাল সেনের ভূমিকা যদি ‘খারিজ’ হয়, তাঁর সমাপ্তি ‘মহাপৃথিবী’।

দ্বিতীয়ত, মৃণাল সেন সম্বন্ধে আরেকটি কথা যা আমার মনে হয় এবং তাঁর এই কৃতিত্বটি ভুলবার নয় যে তিনি সত্তর দশকের পরে বাংলা ছবিকে এক আন্তর্জাতিক জগতে প্রতিস্থাপিত করেন। সেটা কী ধরনের বিশ্বজনীনতা? তার আগে আমাদের যেসব ছবিগুলি ছিল, সত্যজিৎ রায় বা ঋত্বিক ঘটকের, তা বিশেষভাবে ভারতীয় বাস্তবতাকে স্পর্শ করছিল এবং তাঁরা বাণিজ্যিকতার বদলে শিল্পমূল্যে তাঁদের চারপাশের পৃথিবীকে বিচার করার চেষ্টা করছিলেন, তা যেমন প্রকৌশলগত, তেমনি দার্শনিক। যেমন সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’ এবং ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’ আমর্মে আলাদা এবং হয়তো অনেক বৈপ্লবিক, কিন্তু সেগুলি একান্তভাবেই দু’জন ভারতীয় মহৎ পরিচালকের বিশ্বদর্শনের পরিণাম।

মৃণাল কিন্তু সত্তরের দশকে দুনিয়ার ম্যানিফেস্টো নির্মাণের মধ্যে গিয়ে পড়লেন। দর্শক হিসেবে আমরা দেখব, এই প্রথম কোনও ভারতীয় ছবি প্রায় প্রতি কদমে তৃতীয় বিশ্ব অর্থাৎ আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকার বাস্তবতার সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটছে। তৃতীয় বিশ্বের ‘ইমপারফেক্ট সিনেমা’ অর্থাৎ দোষত্রুটিযুক্ত সিনেমা ও তার ‘এসথেটিক্স অফ হাংগার’ বা ক্ষুধার নন্দনতত্ত্ব যে ধরনের বাস্তবতা তুলে ধরে, যেমন সোলানাসের ‘চুল্লির প্রহর’ বা আলেয়া-র ‘মেমোরিজ অফ আন্ডারডেভেলপমেন্ট’ বা আফ্রিকার ওসমান সেমবেনে-র ‘হালা’ ছবিতে আমরা যে ধরনের বাস্তবতা দেখতে পাই, মৃণাল তেমনভাবেই নব্যউপনিবেশবাদের সঙ্গে ভারতীয় মধ্যবিত্তের যে সংঘর্ষ তা তুলে ধরেন, এবং তাকে পরপর ‘কলকাতা ৭১’, ‘ইন্টারভিউ’, ‘পদাতিক’, এবং ‘কোরাস’-এ বর্ণনা করে যান। এই ছবিগুলিই তাঁকে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি দিয়েছে ও তাঁর স্থানাঙ্ককে আন্তর্জাতিকতায় চিহ্নিত করেছে। মৃণাল সেন যে সত্তরের দশকের কলকাতার ভাষ্যকার বলে প্রচারিত হন, তার কারণ হচ্ছে এই কলকাতার গলি-উপগলিগুলির ভাষ্য লিখতে গিয়ে তিনি লাতিন আমেরিকার বা আফ্রিকার চলচ্চিত্রকাররা সেই মুহূর্তে যে ধরনের চিন্তাভাবনা বা কাজ করছিলেন, তাঁদের সঙ্গে সমরেখ হয়েছিলেন। এমনকি তাঁর লেখা, তাঁর সাক্ষাৎকার এবং অবশ্যই তাঁর ছবিগুলো একধরনের নতুন ভাষার খোঁজ করেছিল, যে কৃতিত্ব সামান্য নয়।

তৃতীয়ত, একটা নতুন শহর যাকে চিনতে ফরিদপুর থেকে আসা জনৈক তরুণের পক্ষে একসময় বেশ কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু কোনওরকমে একটা মতাদর্শ খুঁজে পেয়ে ও তাকে সম্বল করে, তাকেই জি পি এস বা কম্পাস হিসেবে ব্যবহার করতে করতে ক্রমে একটা সম্পূর্ণ মানচিত্র নির্মাণ করতে পেরেছিলেন তিনি। এই শহরের প্রতি তাঁর ভালোবাসাও নিঃস্বার্থ ছিল। সেই একই শহরকে তিনি ১৯৯১ সাল থেকে আর চিনতে পারছিলেন না। ভারতের সামাজিক ইতিহাস পালটে গেল। ৯১ সাল থেকে বাজারের উদারীকরণ শুরু হল এবং তা শুরু হওয়ার ফলে যা একদা কলকাতার উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম অংশ ছিল, সেখানে মধ্যবিত্ত কোণঠাসা হয়ে গেল, স্থানচ্যুত হয়ে গেল। বস্তুত দেখা যাবে যে মৃণাল সেন নিজেও স্থানচ্যুত হলেন। তিনি আর সময়টাকে ধরতে পারছিলেন ন। ‘একদিন অচানক’-এর সেই যে অধ্যাপক, যিনি বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলেন, কোথায় গেলেন, কেন উধাও হলেন, কিছুই বুঝতে পারা গেল না। অধ্যাপকের মেয়ে বলেছিলেন, তিনি সম্ভবত নিজের জন্য কোনও পরিসর খুঁজে পাচ্ছেন না এবং নতুন করে আর জীবন শুরু করা যাবে না ভেবে চলে গেলেন। সেই ছবির বৃদ্ধ অধ্যাপকের মতো তাঁর স্রষ্টা এই শহরের ভাষ্যকার মৃণালের পক্ষেও আর নতুন করে কিছু শুরু করা সম্ভব ছিল না। জীবনানন্দের ভাষায়, ‘একটি পৃথিবী নষ্ট হয়ে গেছে আমাদের আগে..’। এমনকি একটু আগে মৃণাল যখন ‘মহাপৃথিবী’ করছেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, যে শহর তিনি ছেড়ে যাচ্ছেন, সেই শহরের ‘ঘোর স্বধর্মনিষ্ঠ রাত্রি’ আর তাঁর জীবনে ফিরে আসবে না। মৃণাল সেনের হাত থেকে সময় চলে গেছে। বা বলা যায়, সময় তাঁকে পরিত্যাগ করেছে। এই শহরটা খুব বড়, খুব ভয়াবহ হয়ে উঠছে তাঁর কাছে। তাই অনেক পরে মৃণাল সেন তৈরি করলেন ‘আমার ভুবন’, কিন্তু সেই ভুবনে তিনি নিজেও যে স্বস্তি পেলেন না, সেটা ছবিটা দেখলেই বোঝা যায়। এই ভুবনকে তিনি সত্যিকারের চেনেন না, এ তাঁর বানানো, তাত্ত্বিক ভুবন। তাই মৃণাল সেন ক্রমশ নির্বাক হয়ে গেলেন। আমরা তাঁর এই মৌনতাকে সম্মান জানাব। কারণ যে মধ্যবিত্ত আমাদের স্মৃতি, আমাদের অতীত, তা মৃণাল সেনের সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেল। আর এই পথরেখাটুকুই আমার পক্ষে মৃণাল সেনকে চেনবার একমাত্র উপায়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...