আহমেদ খান হীরক
নব্বইয়ের দশকে যখন আমাদের কৈশোর এবং বহতা মফস্বল ব্যান্ড সঙ্গীতে ভেসে যাচ্ছে, আমরা উন্মাতাল শুনছি জেমস, বাচ্চু, হাসান, শাফিন, খালিদদের, যখন ভেঙে পড়ছে আমাদের গান নিয়ে নানান একঘেয়ামির ভঙ্গি, তখনও, মাঝে মাঝে, রেলবিজ্রের রাতে, বা ফসলক্ষেতের সন্ধ্যায় দুয়েকটা দলছুট গান গেয়ে উঠি। গানগুলো ব্যান্ডের নয়— গানগুলো তৎকালেরও নয়, কিন্তু গানগুলো কোনও অদ্ভুত কারণে আমাদের চিৎকারের সাথে, উচ্ছ্বাসের সাথে, এবং কৈশোরিক আবেগের সাথে একাত্ম হয়ে যেতে পারে, আমরা ’আসলে কেউ সুখী নয়’ গাইতে গাইতে, ’এসো চুল খুলে পথে নামি’ বলে চোখ বন্ধ করতে করতে নিমেষে গেয়ে উঠতে পারি ‘আমার সারা দেহ খেও গো মাটি…’ আর গাইতে গিয়ে আমরা অনুভব করি, সিনেমার গান হওয়া সত্ত্বেও, নাইটকোচে কি ভাতের হোটেলে কি আইসক্রিমওয়ালার মাইকে বাজা সত্ত্বেও, লোকের গলায় গলায় থাকা সত্ত্বেও, পুরনো হওয়া সত্ত্বেও, গানগুলোর আলাদা মাধুর্য রয়েছে; কথায় রয়েছে কাব্যগুণ, সুরে আছে সহজিয়া বাংলা মেলোডি…
আমরা তখনও পোক্তভাবে চিনি না আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে। আমরা জেমসকে চিনি, আইয়ুব বাচ্চুকে চিনি, আমরা তাদের ভক্ত। কিন্তু আমরা এই পুরনো গানগুলোকে গাই। কোথাও বাজলে থমকে শুনি।
এরই মাঝে, সিনেমার কিছু কিছু গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে পেয়ে ওঠে। আমরা ব্যান্ড কালচারের লোক। সিনেমার গানকে খুব আমলে নিতে চাই না। আমরা গিটারের ঝংকার চাই… আমরা হতাশার নিমজ্জন চাই, আমরা দুঃখবিলাস চাই, আমরা বলি কীসের এত দুঃখ তোমার… বলি পথের বাপই বাপরে মনা পথের মা-ই মা… বলতে বলতে আমরা শুনি সিনেমার রোমান্টিক গান— বাজারে যাচাই করে দেখি নি তো দাম/সোনা কিনিলাম নাকি রূপা কিনিলাম… আমরা মাথা নাড়াই… না না এসব আবার কেমন গান? বরং গান তো হল আরও বেশি কাঁদালে উড়াল দেব আকাশে…
অথচ আমরা খেয়াল করি গোসল করতে করতে কিংবা রাতের ছাদে চলন্ত উপগ্রহ দেখতে দেখতে আমরা বাজারে যাচাই করে দেখি নি তো দাম গেয়ে উঠি… আমরা অবাক হই। যে সিনেমা দেখলাম না পর্যন্ত তার গান আমরা কেন গাইছি? আমরা বড়জোর জীবনমুখী গাইতে পারি… লাল ফিতে সাদা মোজা সু স্কুলের ইউনিফরম… কিন্তু এর সাথে আমরা কেন পড়ে না চোখের পলক গাইছি?
যে গানগুলো আমাদের জেনারেশনেরও আগে, কিন্তু প্রবাহিত হচ্ছিল আমাদের কানে; আর যে গানগুলো আমাদের সময়ে সিনেমার বলে বাতিল করতে চেয়েও গ্রাহ্য করে নিতে হচ্ছিল… এখন জানি তার বেশিরভাগেরই স্রষ্টা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তার লেখা আর সুর-সঙ্গীতের গানের হিসেব করলে সংখ্যা কী দাঁড়ায় জানা নেই—কিন্তু তার গান যে বাংলার কোনও প্রান্তরে পৌঁছায়নি এমন হয়নি এ দাবি নিঃসন্দেহে করা যায়।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের গানের উপজীব্য ছিল সিনেমা। একের পর এক হিট গান তিনি সৃষ্টি করেছেন। যদি গানের হিটযন্ত্রও বলা হয় তাকে বাড়িয়ে বলা হয় না এতটুকুও। অথচ হিটের লক্ষ্যে কখনও তিনি লক্ষচ্যুত হননি। তার গানে একই রকম কাব্যকথা আর সহজ সুরের ঝংকার শেষতক পাওয়া যায়। এক দিকে যেমন সব কটা জানালা খুলে দাও না কিংবা মাঝি নাও ছাইড়া দে’র মতো কালজয়ী দেশাত্মকবোধক গান তিনি সৃষ্টি করেছেন অন্যদিকে আমার বুকের মধ্যেখানে মন যেখানে বা আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ের মতো সিনেমার প্রবল জনপ্রিয় গানের নির্মাণ হয়েছে তার কথা-সুর-সঙ্গীতে।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আমাদের মতো নাকউঁচু, বাংলা সিনেমাবিমুখ একটি প্রজন্মকেও তার গান শোনাতে এবং মনে রাখতে বাধ্য করেছেন… আমি এটিকে অনেক বড় শক্তি ও অর্জন হিসেবে দেখি। এছাড়া তার অন্যান্য যে অর্জন ও গৌরব… ১৫ বছর বয়সের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ইত্যাদি বিষয় যে কোনও ব্যক্তিই জানেন।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল-এর শেষটা ভালো হয়নি। একজন স্রষ্টার এমন শেষ কারও কাম্য নয়। কিন্তু কাম্য যা, তার কীইবা এ সময় উৎপাদন করছে?
কাব্যকথার সহজ সুরের এই সঙ্গীত স্রষ্টার জন্য ভালোবাসা।